বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৭

ব্যাংক পরিচালকদের মিলেমিশে ৯০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট

‘দশে মিলে করি কাজ হার-জিতে নাহি লাজ’ এমন একটি গ্রামবাংলা প্রচলিত ছিল। আর এটি ছিল মূল ভালো কাজের জন্যে। কিন্তু বর্তমানে মন্দ কাজে প্রবাদটি ব্যবহার হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির কলকাঠি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে।

জনগণের সেসব টাকা নিয়ে শুরু হয়েছে লুকোচুরি। ব্যাংক পরিচালকরা নামে-বেনামে টাকা তুলে নিচ্ছেন। তাও আবার মিলেমিশে লুটপাট।

বিশেষ করে পরিচালকরা ভাগাভাগি করে যে ঋণ নিচ্ছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা আর ফেরত আসছে না। ফলে বাড়ছে মন্দ ঋণের পরিমাণ। বর্তমানে অবলোপনসহ খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

এছাড়া মোট ৬ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকাই নিয়েছেন ব্যাংক পরিচালকরা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৪ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। কেউ বলছেন, ঋণ যেভাবে এককেন্দ্রিক হচ্ছে, তাতে আলামত খারাপ।

অপরদিকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর পরিচালকদের বেআইনি ও অনৈতিক চাপে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা। পরিচালকদের বেপরোয়া চাপে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি, অনিয়মের পরিমাণ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি এ কথা স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দেশে এখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ছড়াছড়ি। এজন্য অনেকটা বেপরোয়াভাবেই বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সুবিধা নেয়ার হিড়িক পড়েছে। নিয়োগেও চলছে নজিরবিহীন দুর্নীতি।

সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি ব্যাংকেই এখন বেনামি ঋণের ছড়াছড়ি। ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি বড় প্রভাবশালী গ্রুপের কাছে ব্যাংকিং খাত জিম্মি। তাদের কাছেই মোট খেলাপির বড় অংশ আটকা পড়ে আছে। তারাই নামে-বেনামে এসব ব্যাংকের মালিক। এমনও কথা প্রচলন আছে যে, এসব বড় ঋণ গ্রহীতার সর্দি-কাশি হলে ব্যাংকিং খাত প্রচণ্ড জ্বরে ভোগে। তাদের মতে, কোনো কারণে এসব গ্রুপে ধাক্কা লাগলে, পুরো ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন-পুরনো মিলিয়ে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৫৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৬টিই ব্যাংক পরিচালকদের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এছাড়া সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৯টি ব্যাংকের পরিচালক নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন প্রায় ৪শ’ কোটি টাকার বেশি। একইভাবে ৯টি ব্যাংকের পরিচালক গ্যারান্টার বা জিম্মাদার হয়ে ঋণ দিয়েছেন আরও ২৩১ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকে তাদের মোট শেয়ারের ৫০ শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারছেন না। তবে তাদের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে কোনো বাধা নেই। ফলে পরিচালকরা এখন পরস্পরের যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে যেমন ঋণ নিচ্ছেন, তেমনি প্রভাব খাটিয়ে নানা সুবিধাও নিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, ব্যাংক পরিচালকদের যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ নেয়া অনৈতিক। এখানে অশুভ ইঙ্গিত রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে আইন পরিবর্তন করে এ ধরনের ‘কানেক্টিং লেনদেন’ বন্ধ করা উচিত। তা না হলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে, যা ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দেবে।

বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতের প্রায় সব ক’টি ব্যাংকের পরিচালকরা একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ঋণ দেয়া-নেয়া করেন। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক ৫ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ৩ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, এবি ব্যাংক ৩ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, যমুনা ৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক ২ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক ২ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, পূবালী ব্যাংক ২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ব্যাংক ২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংক ২ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক ১ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংক ১ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক ১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা এবং আইএফআইসি ব্যাংকের ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া নতুন কার্যক্রমে আসা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে ঋণ দিয়েছে ৫১৪ কোটি টাকা, মধুমতি ব্যাংক ৩৫২ কোটি টাকা, মিডল্যান্ড ব্যাংক ৩৪৯ কোটি টাকা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ৩২৫ কোটি টাকা, মেঘনা ব্যাংক ৩০১ কোটি টাকা ও ফারমার্স ব্যাংক ১৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়ম করে ঋণ দেয়ার দায়ে ৫ জন পরিচালককে পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন