বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১১

মেমোগেট কেলেঙ্কারি ও পাক-মার্কিন সম্পর্ক

ড্রোন হামলায় ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হওয়ার ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কি তাৎক্ষণিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন? এতে হয়তো ইসলামাবাদের দুঃখকষ্ট প্রশমিত হতে পারত এবং সম্ভবত পাকিস্তান বনে অনুষ্ঠিত আফগানিস্তানবিষয়ক সভায় উপসি'ত থাকত। গতস্য শোচনা নাস্তি। যা হোক, ভারতে অনেকেই ইসলামাবাদ কেন ‘দুঃখ প্রকাশ’ গ্রহণ করেনি বা মেনে নেয়নি তার জন্য বিস্মিত হয়েছে। দুঃখ প্রকাশ করা মানে যথাযথভাবে ক্ষমা চাওয়া নয়। তবে এর কাছাকাছি। এর অর্থ হচ্ছে ভুল করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করার অনুভূতি। মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্যদের ইচ্ছাকৃত মর্যাদাহানির কোনো ইতিহাস না থাকলে সম্ভবত ইসলামাবাদ দুঃখ প্রকাশের বিষয়টি মেনে নিত। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, আমেরিকা ও তার মিত্ররা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব এবং দেশটির জনগণের অনুভূতি বা দৃষ্টিভঙ্গির কোনো তোয়াক্কা করে না।
নিউ ইয়র্কে ৯/১১-এর হামলার পর থেকে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ তথা তাঁবেদার রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওই সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব আবদুস সাত্তারকে ফোন করে তার সরকারকে জানাতে বলেন, ইসলামাবাদ তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) পক্ষে না থাকলে তারা আফগানিস্তানের পরিবর্তে পাকিস্তানে কার্পেট বোমা হামলা শুরু করবে।
পাকিস্তান তখন সাহসিকতার সাথে ‘না’ বলতে পারেনি। এখন তারা কিভাবে মার্কিন চাপ প্রতিরোধ করছে?
সত্যিই, পাকিস্তান শক্তিশালী খেলা খেলেছে এবং এমনকি, আমেরিকানদের একটি ড্রোন ঘাঁটি ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছে। কিন' এটা হচ্ছে ক্রুদ্ধ জনমতের কাছে মাথা নোয়ানো বা নতি স্বীকার করা। আমি এখনো নিশ্চিত নই, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কিয়ানি কত দিন দুর্দান্তভাবে সেখানে অবস'ান করবেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বহু বছর ধরে মার্কিন অস্ত্র এবং সাথে সাথে তাদের সহায়তা নিতে এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের পক্ষে মুখ ঘুরিয়ে নেয়াটা যুক্তিযুক্ত দেখায় না। ইতোমধ্যে কিছু যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা বা বিবেচনা শুরু হয়ে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে সীমিত সহযোগিতা দেখা যাচ্ছে। ন্যাটোর একজন কমান্ডার বলেছেন, মর্মান্তিক ঘটনাটি পাকিস্তানের সাথে তাদের অপারেশন অথবা সহযোগিতাকে ব্যাহত করতে পারবে না। আমেরিকার অসন্তোষ ইসলামাবাদকে খুশি করতে পারবে না। কারণ আমেরিকার অনুপসি'তির ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, চীন পারবে না তা পূরণ করতে। পাকিস্তানের সাথে তার প্রতিবেশী নয়াদিল্লির সম্পর্ক এখন যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে ভারতও পাকিস্তানের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে না। পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে দুঃখ ও অনুশোচনা সত্ত্বেও ওয়াশিংটনকে আমি ভিন্নভাবে আচরণ করতে দেখছি না। ওয়াশিংটন তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, আর পাকিস্তানে তালেবানদের উপসি'তি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেনাবাহিনী সম্ভব হলে ইসলামাবাদের সহযোগিতা নিয়ে অথবা প্রয়োজনে তাদের ছাড়াই তালেবানদের বিরুদ্ধে হামলা চালাবে। ড্রোন হামলা অথবা আমেরিকান ও ন্যাটো সৈন্যদের সরবরাহ লাইন বন্ধ হওয়ার মতো কিছু আমি দেখছি না, কারণ তারা ড্রোন হামলার জন্য আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারে এবং সরবরাহ লাইনের জন্য সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোকে কাজে লাগাতে পারে।
টার্গেট বা লক্ষ্য হচ্ছে তালেবান। উভয় পক্ষ উপলব্ধি করতে পেরেছে, তারা একটি পরিসি'তির মোকাবেলা করছে- যেটা তারা একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তারা আগের অবস'ায়ও ফিরে যেতে পারবে না। সৈন্যদের হত্যাকাণ্ডের আগে যে অবস'া বিরাজ করছিল, তার কথাই এখানে বলা হয়েছে। এখনো আমেরিকা ও পাকিস্তান উভয়ে যুদ্ধ বা ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছে যেতে পারে। আগেও তারা বহুবার এ ধরনের কাজ করেছিল। কিন' তারা তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি ইতোমধ্যে বলেছেন, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র শর্তসাপেক্ষে এ বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে। ২০১৪ সালে ১ লাখ ৩০ হাজার আমেরিকান ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার পর বিশ্ব সমস্যার মুখোমুখি হবে। বন সম্মেলনে আফগানিস্তানের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদি আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অবশ্যই আরো সুস্পষ্ট হতে হবে। সম্মেলনে পাকিস্তানের অনুপসি'তি ডেনমার্কের প্রিন্সবিহীন থ্রোমলেটের মতোই। ইসলামাবাদ স্বাক্ষরকারী দেশ না হলে আর বেশি প্রতিশ্রুতি পাবে না।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক না থাকার কারণে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি অনুভব করা যায়। উভয় দেশ বিদেশী সৈন্যদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাতে পারত, কারণ তারা (বিদেশী সৈন্য) কেবল পরিসি'তির অবনতি ঘটাচ্ছে। কিন' এর পরও সমস্যা হচ্ছে, পাকিস্তান আফগানিস্তানে ভারতকে চায় না।
অপর দিকে নয়াদিল্লি কাবুলের সাথে একটি ‘কৌশলগত অংশীদার’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মার্কিন সৈন্যদের প্রত্যাহারের পর তালেবানরা যখন দেশে তৎপরতা শুরু করবে, তখন নয়াদিল্লি একা এবং কোনো সহায়তা না করে আফগানিস্তানকে ছেড়ে আসতে পারবে না। পাকিস্তান কৌশলগত গভীরতা ছাড়াই আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা মেনে নিলে দিল্লি ও ইসলামাবাদ একই পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হতে পারে। তাই ২০১৪ সালের পরও মার্কিন হস্তক্ষেপের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ইতোমধ্যে সমপ্রসারিত করা হয়েছে। কমপক্ষে তালেবানদের ধ্বংস করার জন্য ভারতের সাথে তাদের অভিন্ন ভিত্তি খুঁজে বের করতে হবে। তালেবানরা ওই অঞ্চলে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত কঠিন সময় যাচ্ছে। ‘মেমোগেট নামে’ পরিচিত কেলেঙ্কারির বিষয়টি এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি, কিয়ানি ও আইএসআই প্রধান লে. জেনারেল আহমদ শুজা পাশার নামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা এক মামলায় তাদের বিবাদি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানের তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হোসেইন হাক্কানি মার্কিন সামরিক কমান্ডের কাছে জারদারি সরকারকে সেনাবাহিনী এবং আইএসআইর হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য যে স্বাক্ষরবিহীন মেমো দিয়েছিলেন তার ওপর ভিত্তি করেই নওয়াজ শরিফ এ মামলা করেন। পরে সেনাবাহিনী হাক্কানিকে পদত্যাগ করতে দেখল। যা হোক না কেন, সমস্যাটি হাক্কানির পদত্যাগ করার চেয়ে বেশি বড়। আমেরিকা কিভাবে বারবার জারদারি সরকারের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারবে? আমেরিকা দেখছে, এ সরকার পুরোপুরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, হাক্কানির উত্তরসূরি শেরি রেহমানের ওয়াশিংটনের সাথে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সামর্থ্য এবং চাতুর্থ রয়েছে। তিনি সুকৌশলে পরিসি'তি মোকাবেলায় সক্ষম। তিনি আরো বুঝেছেন যে, একটি নির্বাচিত সরকারকে সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে না। ভারতের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ইসলামাবাদের ট্রাম্পকার্ড। ভারতে তাকে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।
লেখক : যুক্তরাজ্যে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার, রাজ্যসভা সদস্য ও ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন