বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সমরসজ্জায় ভারতের বড় উদ্যোগ


ভারত গত অর্ধ শতাব্দীর ইতিহাসে তার ১৩ লাখ সদস্যের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে নাজেহাল হওয়ার পর প্রথম সে সামরিক সজ্জার দিকে তীক্ষ্ণ নজর দেয়। এরপর জন্মশত্রু পাকিস্তানকে লক্ষ্য করেই তার সামরিকায়ন চলছিল। এই প্রতিযোগিতায় পুরনো সব সামরিক যন্ত্রপাতি ও বিলম্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছিল। সম্প্রতি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করার প্রক্রিয়ায় তার প্রতিরক্ষা অগ্রাধিকারে পাকিস্তানের বদলে চীনকেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করছে। আর সে লক্ষ্যেই নতুন করে তার সামরিক সজ্জার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চলছে। হিমালয় এলাকায় চীনের সঙ্গে তার তিন হাজার ৫০০ কিলোমিটার সীমান্তে পাল্লা দিতে ভারতের সেনাধ্যক্ষরা তাদের সমরাস্ত্রের আধুনিকায়নের ব্যাপারে অত্যন্ত তড়িঘড়ি করেই এগুচ্ছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (সিপরি) হিসাব মতে, ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ। আগামী এক দশকে সে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি খাতে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতোমধ্যেই ফ্রান্সের ডেসাল্ট এভিয়েশন কোম্পানির ডেস্টাল্ট রাফালে নামের অত্যাধুনিক ১২৬টি যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০০ কোটি ডলার। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তার বহরের সোভিয়েত যুগের মিগ যুদ্ধবিমানগুলো বাতিল করা। উড্ডায়নকালে মিগের অত্যধিক ধ্বংস হওয়া ইতোমধ্যেই সেখানে ‘উড়ন্ত কফিন’ নামে অভিহিত  হচ্ছে ভারতে। এছাড়াও হুরমুজ প্রণালী থেকে মালাক্কা উপসাগর পর্যন্ত ভারত মহাসগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের দ্রুত শক্তি বৃদ্ধি ভারতকে এই অঞ্চলে নিজের শক্তি বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করেছে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও নৌশক্তি প্রসারের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, সম্প্রতি মার্কিন সিনেটে মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক জেমস আর ক্ল্যাপার বলেছেন, ‘ভারতীয় সামরিক বাহিনী তার সৈন্যদলকে বিতর্কিত সীমান্তে সীমিত সংঘর্ষের ব্যাপারে যেমন শক্তিশালী ও প্রস্ত্তত করছে তেমনি ভারত মহাসাগরে চীনা শক্তি সমাবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার নামে নৌ-শক্তির প্রসার ঘটানো হচ্ছে।’ এই ‘ভারসাম্য’ রক্ষার মধ্যে রয়েছে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা, যার মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়ছে চীনের সঙ্গে। চীনও বিষয়টিকে সুনজরে দেখছে না। বিশেষ করে অগ্নি-৫ নামের পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম রকেটকে পরীক্ষামূলকভাবে সফল উৎক্ষেপণের পর। এই দূরপাল্লার রকেটটি চীনের অভ্যন্তরে অনেক গভীর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম হবে। ১৯৬২ সালে চীন যুদ্ধের পর বন্ধ হওয়া লাদাখের সুউচ্চ বিমান অবতরণ কেন্দ্রটি পুনরায় ২০০৯ সালে খুলে দেওয়া হয়। এটি কাশ্মীর অঞ্চলে চীন সীমান্তে অবস্থিত। হিমালয় অঞ্চলের অন্য আরো বিমান ঘাঁটির মতো এটিকেও যুদ্ধ উপযোগী করে উন্নত করা হচ্ছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনার পিস ইন্সটিটিউটের (সিপরি) হিসাব অনুযায়ী, ভারত ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত একদশক সময়ে তার বাৎসরিক ব্যয় বৃদ্ধি করেছে প্রায় ১০ গুণ। ১৯৯৯ সালে যা ছিল ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৯-এ এসে তা দাঁড়িয়েছে ১৮৫ কোটি ১০ লাখ ডলারে। এই বিশাল অংকের প্রতিরক্ষা বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হবে বিমান ও নৌবাহিনীকে সুসজ্জিত করার কাজে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রখ্যাত বলে পরিচিত জেনস ডিফেন্স উইকলির খবর অনুযায়ী, মার্কিন কোম্পানি বোয়িং ও লকহিড মিডিয়াম মাল্টি-রোল কম্বাট এয়ারক্রাফট বা যুদ্ধবিমানের প্রতিযোগিতায় ডেসাল্ট রাফালের কাছে হেরে গেলেও খালি হাতে ফিরে যায়নি। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে লকহিড বিক্রি করছে আরো ৬টি রসদবাহী বিমান সি-১৩০ জে-৩০ এবং বোয়িং চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ১০০ কোটি ডলার মূল্যের ১০টি বোয়িং সি-১৭ গ্লোব মাস্টার-৩ বিমান বিক্রির। এ দুটি চুক্তি মিলে এটাই হচ্ছে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ প্রতিরক্ষা চালান। এছাড়াও বোয়িং কোম্পানি ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য পজেডন পি-১৮ বিমান সরবরাহের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এই বিমান ব্যবহৃত হবে সমুদ্রে পাহারা দেওয়ার কাজে। এছাড়া ভারত ইসরায়েলের কাছ থেকে দুটি ৮০ কোটি ডলার মূল্যের ফ্যালকন বিমান কেনার চুক্তি করতে সম্মত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতের পুরনো অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়াও বসে নেই। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রাশিয়া ভারতকে তাদের পারমাণবিক ডুবোজাহাজ আইএনএস চক্রকে ১০ বছরের জন্য ভাড়া দিচ্ছে যা ভারত ৮ বছর ধরে চেয়ে আসছিল। এছাড়াও রাশিয়া ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজ আইএনএস বিক্রিমাদিত্যর (সাবেক অ্যাডমিরাল গরশকভ) জন্য মিগ-২৯কে সরবরাহ করছে।
ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে তাদের বিমান বাহিনীকে ৪৫ স্কোয়াড্রনে উন্নীত করা। সেখানে কয়েক দশক ধরেই ৩৩ স্কোয়াড্রনে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ নিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোতে অসন্তুটি রয়েছে। রয়টার্সের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এমনই এক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর এয়ার পাওয়ার স্টাডিজের ডিরেক্টর এবং সাবেক কমান্ডার জাসজিৎ সিং বলেন, ‘বড় বেশি সময় নেওয়া হচ্ছে। আমরা কি ঘাটতি নিয়ে বাহিনী চালাতে থাকব এবং তা কত সময়ের জন্য?’ ভারত ইতোমধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে যা ২০১৫ সালের মধ্যে হাতে আসবে। সেই সঙ্গে ২৭২ সুখয়ের একটি বহরও যোগ হবে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে। এর অর্ধেক সংখ্যক বিমান ইতোমধ্যে তৈরিও হয়েছে।
ভারতের সমরসজ্জার মূল লক্ষ্য এখন তার বিমান ও নৌবাহিনীর প্রসার ও আধুনিকায়ন। সেনাবাহিনীর চেয়ে এই দুইখাতে অনেক বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। কারণ এক্ষেত্রে তারা তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন প্রক্রিয়াও বসে নেই। ফলে ভারত এখন মূলত দুই ফ্রন্টেই অর্থাৎ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে এক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। ১৯৮০ সালে রাজীব জমানায় সুইডিশ কোম্পানি বোফরসের কাছ থেকে আর্টিলারি অস্ত্র কেনার কেলেঙ্কারির পর যুদ্ধাস্ত্র কেনায় ভারতীয় সরকারগুলো যথেষ্ট সতর্ক হয়ে যায়। ক্রয়নীতি তৈরিতে কয়েক দফা পরিবর্তন আনা হয়। এসব কারণে ভারতের আর্টিলারি ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলেই মনে করে সে দেশের প্রতিরক্ষা থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলো। সম্প্রতি ভারত সরকার ২জি স্পেক্ট্রাম, ভূমি অধিগ্রহণ ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে যথেষ্ট নাকানি-চুবানির মধ্যে রয়েছে। এজন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী এন্টানি অস্ত্র ক্রয় চুক্তির মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা নিচ্ছেন।
চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যথেষ্ট জটিল। দুই দেশের বাণিজ্যের ব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকলেও আঞ্চলিক আধিপত্যের ব্যাপারে রয়েছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভারত সবসময়েই সতর্ক থাকে ১৯৬২ সালের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। এই প্রতিযোগিতা দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোকে যথেষ্ট শঙ্কিত ও চিন্তিত করছে।
চন্দন সরকার 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন