বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

যে সত্য ভুলে থাকা যায় না


আজকাল বাংলাদেশ নিয়ে একটি বিশেষ মহল বেশ উৎসাহী। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে নিজেদেরকে বাংলাদেশীদের চেয়েও বেশি দরদি হিসেবে উপস'াপন করতে চায়। তারা আমাদেরকে ‘বন্ধু’ ভাবে। আবার বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটাও তারা নিরূপণ করতে চায়।

আসলে এ জনপদে কে কার বন্ধু কে কার শত্রু তার একটা ইতিহাস আছে। এ সময়ের রাজনৈতিক ভাবনাকে সামনে রেখে আমরা সেই ইতিহাস একটু চর্চা করতে চাই। এ প্রসঙ্গে একটি কার্টুনের বরাত দেয়া যেতে পারে।
১৯৪৭ সালের মে মাসে অমৃতবাজার পত্রিকায় এ কার্টুনটি ছাপা হয়। এর মাধ্যমে জনমনের প্রশ্নটি তুলে ধরা হয়- ‘কে সঠিক?’ কার্টুনটিতে চারজন রাজনীতিবিদের প্রত্যাশা তুলে ধরা হয়। তাদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে তাদের নিজ নিজ অবস'ান প্রকাশ করা হয়েছে এ কার্টুনে। সোহরাওয়ার্দীর অবস'ান : ‘বিভক্ত ভারতে ঐক্যবদ্ধ বাংলা’। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অবস'ান : ‘অবিভক্ত ভারতে বিভক্ত বাংলা’। জিন্নাহর অবস'ান : ‘বিভক্ত ভারতে বিভক্ত বাংলা’ এবং গান্ধীর অবস'ান : ‘অবিভক্ত ভারতে অবিভক্ত বাংলা’। প্রশ্ন হচ্ছে- কে সঠিক? সূত্র : হিন্দুস'ান স্ট্যান্ডার্ডের কার্টুন, ১৭ মে, ১৯৪৭।
এ কার্টুন শত্রু বন্ধু চিহ্নিত করে না, তবে পূর্ববাংলা নিয়ে তাদের মানসটা উপলব্ধি করা যায়। এ প্রসঙ্গে আমরা বঙ্গভঙ্গের গোড়ায় যেতে চাই।

১৯০৫ থেকে ২০১২ এক শ’ ছয় বছর। ইতিহাস গবেষকদের কাছে এক শ’ বছর অনেক বড় কিছু নয়। ইতিহাসচর্চার বিরাট ক্যানভাসে প্রতিটি শতাব্দীকে জাতি, রাষ্ট্র ও সমাজসভ্যতার জন্য একটি একক হিসেবে মূল্যায়নের রীতি আছে। আমাদের জাতিসত্তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিনির্মাণে বিগত এক শতাব্দী শুধু ঘটনাবহুল ও বর্ণাঢ্যই নয়; গৌরবদীপ্ত ইতিহাস সৃষ্টির অসাধারণ ব্যাপকতায় সমৃদ্ধ।

এ সময়ে আমাদের স্বাধীনতার দাবি উচ্চকিত হয়েছে বারবার। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সঙ্ঘাতের ইতিহাসও নিরবচ্ছিন্ন। এ সময় এতটা বাঙ্ময় আমরা বারবার ঐতিহ্যের কাছে হাত পেতেছি। অতীতের সাথে বর্তমানকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছি। প্রতিটি ত্যাগকে মেপেছি অর্জনের পাল্লায় তুলে। ইতিহাসের বাঁক খুঁজতে গিয়ে আমরা প্রতিটি লাল তারিখকে স্পর্শ করেছি একটি স্বাধীন জাতিসত্তার স্বপ্নমাখা আবেগ ও উপলব্ধিকে আত্মস' করে।
’৭১ যেমন আমাদের রক্তক্ষরণ ও অর্জনের সোনালি দিন, তেমনি ’৪৭ ছিল এ পথে অসাধারণ প্রাপ্তি। এর পেছনে ছিল ঘটনাবহুল জীবনের নানা অধ্যায়। এর কোনোটি ছিল ট্র্যাজেডি, কোনোটি ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর, সাধারণ বিবেচনায় বিয়োগান্তক ঘটনা কিন' সময়ের ব্যবধানে সেটিই ধরা দিয়েছে স্বাধীনতার মাইলফলক ও হিরণ্ময় দিন হিসেবে। এ লেখায় আমরা ইতিহাসের গোড়ায় যাবো না, বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত একটি নাতিদীর্ঘ সময়কে আলোচনায় টানব, যা কিনা আমাদের নিজস্ব ইতিহাস। সময় ভাবনায় একেবারে টাটকা এবং বাস্তবতার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ।

বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ। আরো পেছনে তাকালে পলাশী থেকে ’৪৭-এর ব্রিটিশমুক্ত ভারতবিভক্তি। ইতিহাসের বাঁক ঘোরানো অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী। এই ইতিহাসকে আরো পেছনে ঠেলে নিলে বখতিয়ারের গৌড়বঙ্গ বিজয়, টানা ঘটনা একই সুতোয় গাঁথা। ঘটনাপরম্পরায় একটি অপরটিকে অনুসরণ করছে। অথবা একটি আরেকটির অনিবার্য পরিণতি কিংবা কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতির সোপান।

যে পলাশী মুসলমানদের ভাগ্যবিপর্যয়; সেই পলাশীই ভারতীয় হিন্দু জাতিসত্তার কাছে আশীর্বাদ। মুসলমান ভেবেছে সব কুল গেল; আর সাধারণ হিন্দুরা ভেবেছে ‘রাজা যায় রাজা আসে’। কিন' যারা জমিদার, ব্রাহ্মণ, বাবু, রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী- তারা মুসলিম শাসনের ‘ক্ষয়িষ্ণু ধারার নিপাত’ চেয়েছে। আর ইংরেজদের ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার প্রতিক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থানে তারা উদ্বেলিত হয়েছে।

বঙ্গ বিভাগ কোনো মহলবিশেষের দাবির ফসল ছিল না। ১৮৬৮ সাল থেকে বঙ্গ বিভাগ নিয়ে ইংরেজ শাসকেরা ভাবছিলেন। ১৮৫৪ সালের আগে ইংরেজেরা ভারতের প্রশাসনিক বিভাজন-বিভক্তি নিয়ে তেমন একটা ভাবেনি। ১৭৭২ সাল থেকে টানা ৭৯ বছর বাংলার প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব ছিল ইংরেজ অধিকৃত ভারতের গভর্নর জেনারেলের ওপর। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিং বাংলার গভর্নর হন। বঙ্গের সীমারেখা তখন পর্যন্ত মোগল আমলে যা ছিল তা-ই সি'র ছিল। ১৮৫৪ সালে প্রথম বাংলাদেশের জন্য একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হয়। এই সময় এবং এর আগেও আসাম ছিল বঙ্গদেশের অংশ। এর ২০ বছর পর প্রশাসনিক সুবিধার কারণে আসামকে বঙ্গদেশ থেকে আলাদা করে সেখানে একজন চিফ কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। এরপর আট বছরের মাথায় ১৮৮২ সালে লুসাই পার্বত্য অঞ্চলকে আসামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। তবুও বঙ্গদেশের আয়তন বিশালই থেকে যায়। তখন এর লোকসংখ্যা ছিল আট কোটি। আয়তন ছিল দেড় লাখ বর্গমাইল। ১৮৬৮ সালে লর্ড অ্যালগিন পৃথক বঙ্গ বিভাগের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেন। লর্ড কার্জন সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। অবশ্য এর আগে ১৮৯৬ সালে চট্টগ্রাম বিভাগকে আলাদা করার কথা উঠেছিল, কিন' প্রস্তাবাকারে সেটি কোনো মহলে বিবেচিত হয়নি।

১৯০৩ সালে ঢাকা-ময়মনসিংহ জেলাদ্বয় ও চট্টগ্রাম বিভাগকে নিয়ে আসামকে যুক্ত করে একটি নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব ইংরেজ সরকারের বিবেচনাধীন ছিল। কোনো সমপ্রদায়ই এই বিভাজনে উৎসাহ প্রদর্শন করেনি। ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকায় উল্লিখিত প্রস্তাবটি নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে একটি বিকল্প প্রস্তাব আসে এভাবে- সমগ্র আসাম, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার ব্যতীত রাজশাহী বিভাগ এবং প্রেসিডেন্সি বিভাগের যশোর ও খুলনা জেলাদ্বয় নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে ব্যবস'াপক সভাবিশিষ্ট একটি গভর্নর-শাসিত প্রদেশ গঠন করা যেতে পারে। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লর্ড কার্জন তার পরিকল্পিত বঙ্গ বিভাগ সম্পর্কে জনমত যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করেন। পূর্ববঙ্গ সফরে তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম, ১৮ ও ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও ময়মনসিংহে জনসভা করেন।

এই প্রস্তাব ১৯০৫ সালের ১০ জুলাই ভারতসচিব ব্রডারিক অনুমোদন করেন। ঢাকাকেন্দ্রিক রাজধানী এবং বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ কর্তৃক ইতিবাচক ভূমিকায় হিন্দু সমপ্রদায় এর ভেতর মুসলিম স্বার্থের গন্ধ খুঁজে পায় এবং কার্জনের প্রশাসনিক বিভাজনের চেয়ে রাজনৈতিক ইচ্ছাকে অধিকতর দুরভিসন্ধিমূলক আখ্যায়িত করে বিরোধিতা শুরু করে। কংগ্রেস দেশব্যাপী ‘শোক দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। হিন্দু নেতারা প্রবল আপত্তি তুলে এর সাথে ধর্মীয় আবেগ যুক্ত করতে গিয়ে বড় ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনার ভেতর ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববাংলার মুসলমানদের উত্থানের স্বপ্ন জাগে। মুসলমানেরা একে স্বাগত জানান। মুসলমানদের উৎসাহ আর হিন্দুদের প্রবল আপত্তির মুখে ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনা কার্যকর হয়। নতুন প্রদেশের নাম হলো ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’। রাজধানী ঢাকা। প্রধান বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। আয়তন এক লাখ ছয় হাজার ৫৪০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ মুসলমান ও এক কোটি ২০ লাখ হিন্দু। আর স্যার ব্যামা ফিল্ডফুলার নবগঠিত প্রদেশের প্রথম ছোট লাট নিযুক্ত হন।

১৮৬৬ সালে উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেল, বিরাট প্রদেশ শাসনের অসুবিধাই দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ। তখন বাংলার ছোট লাট ছিলেন স্যার উইলিয়াম গ্রে। ১৮৭২ সালে স্যার জন ক্যাম্পবেল অভিযোগ করেন- এত বড় প্রদেশে একজনের পক্ষে শাসনকাজ পরিচালনা করা অসম্ভব। ভারতসচিব লর্ড হ্যামিলটনের সাথে লর্ড কার্জনের পত্র বিনিময়ের সূত্র ধরেও বলা চলে, বঙ্গভঙ্গের প্রধান কারণ প্রশাসনিক। একটি রাজনৈতিক কারণ যে ছিল সেই সত্যও ধরা পড়ে এনড্রো ফ্রেজারের একটি সুপারিশে। সেই সুপারিশে তিনি মন্তব্য করেছিলেন- বঙ্গ বিভাগে ঢাকা ও ময়মনসিংহের সাথে আসাম যুক্ত হলে অশান্তি কমবে এবং যে গুরুতর শাসন সমস্যার উদ্ভব হয়, সেটাও দূর হবে। ১৯০৪ সালে রিজলি অন্যভাবে রাজনৈতিক সুবিধা তুলে ধরেন। তার মতে, ‘কংগ্রেস মনে করে, বাংলাদেশ যুক্ত থাকলে খুব শক্তিশালী হয়, বিভক্ত হলে শক্তি বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্নমুখী হয়ে পড়বে। এ কথা সত্য, এটাই হবে আমাদের পরিকল্পনার অন্যতম সুফল।’

এ ছাড়া যেকোনো কারণেই হোক, লর্ড কার্জনের সাথে কংগ্রেসের তৎকালীন কোনো কোনো নেতার হয়তো ভালো সম্পর্ক ছিল না। তিনি ভারতে থাকাকালীন কংগ্রেসের শান্তিপূর্ণ মৃত্যুতে সাহায্য করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। ফ্রেজার সাহেব মন্তব্য করেছিলেন : ‘ঢাকা নতুন প্রদেশের রাজধানী হলে নেতৃস'ানীয় মুসলমানদের ওপর হিন্দু নেতাদের প্রভাব লোপ পাবে।’

ভারতের রাজনীতি তখন কার্যত নিয়ন্ত্রিত হতো রাজধানী কলকাতা থেকে। শিক্ষিত হিন্দু, নব্য বাবু এবং উঠতি ধনতান্ত্রিক নব্য হিন্দু পরিবারগুলো সেই রাজনীতি যেমন নিয়ন্ত্রণ করত, তেমনি পূর্ব বাংলার কৃষিজীবী মুসলমান ও দলিতজনদের ওপর খবরদারিও করত। বঙ্গ বিভাগ কলকাতাকেন্দ্রিক বাবুদের এই সুবিধাভোগী পরিকল্পনার ওপর একটি বড় ধরনের আঘাত হিসেবেই এসেছিল।

বঙ্গ বিভাগ তাৎক্ষণিক কয়েকটি ফলাফল নির্ণয় করে দিয়েছিল : ১. নতুন প্রদেশ উন্নতির সুযোগ পেল, ২. গরিষ্ঠ মুসলমানদের ভেতর নতুন চেতনা যেমন জাগল, তেমনি সংখ্যাধিক্যের সুবাদে লেখাপড়া ও চাকরির সুযোগ বাড়ল, ৩. বাবুদের দৌরাত্ম্য কমে যাওয়ার কারণে তারা নিজেদের একটু স্বাধীন ভাবার সুখ অনুভব করল, ৪. দুই সহোদর প্রদেশের ভেতর সমানুপাতিক প্রতিযোগিতার ভেতর উন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হলো, ৫. ঢাকা ও চট্টগ্রামের পুনর্জন্ম হলো, ৬. নদী-খাল উন্নত হলো, রেল যোগাযোগ সম্প্রসারিত হলো চট্টগ্রাম নাগাদ, ৭. নতুন প্রাদেশিক পরিষদের পূর্ব বাংলায় সম্প্রসারিত প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি হলো, ৮. সুষ্ঠু শাসনব্যবস'ায় জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বাড়ল, ৯. অনুন্নত আসাম পূর্ব বাংলায় সম্পৃক্ত হয়ে উন্নয়ন ও শিক্ষার ছোঁয়া পেল, ১০. পূর্ব বাংলায় পৃথক পুলিশ বাহিনীর ব্যবস'া হলো, ১১. প্রদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক উন্নতির পরিকল্পনা তৈরি হলো, ১২. এক বছরের মাথায় প্রমাণিত হলো, পূর্ববাংলার নেতৃত্ব জনগণ শিগগিরই প্রদেশের কর্মকর্তার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাচ্ছিল, আগে যেটা প্রায় অসম্ভব ছিল।

কার্যত পূর্ববাংলা ছিল সম্পদশালী। জনশক্তি ছিল অফুরন্ত। কৃষিনির্ভর বুনিয়াদ ছিল শক্ত। আগে কলকাতা এই সুযোগ ও সুফল গ্রহণ করত। উপকৃত হতো বাবুরা। রাতারাতি এই স্রোত ঢাকাকেন্দ্রিক হতে লাগল। ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিকতা মানেই ছিল গরিষ্ঠ মুসলমানদের সমৃদ্ধি। অবশ্য পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এই সুবিধার সমান অংশীদার ছিল।

বঙ্গভঙ্গের প্রধান বিরোধী শক্তি ছিল হিন্দু জমিদার, সাংবাদিক, উকিল ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব। জাতীয় সংহতির প্রতি আঘাত বলে চিৎকার করলেও তারা মুসলমান প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় ক্ষুব্ধ হলো। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতায় টাউন হলে কাশিমবাজারের জমিদার মহারাজা মহেন্দ্রচন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সভায় তিনি বললেন, ‘নতুন প্রদেশে মুসলমানদের প্রাধান্য স'াপিত হবে। বাঙালি হিন্দুরা সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হবে। আমাদের নিজেদের দেশে আগন'কের মতো থাকতে হবে। আমাদের জাতির ভাগ্যে ভবিষ্যতে যে কী হবে তা চিন্তা করে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি।’

আইনজীবীরা বৈধতার প্রশ্ন তোলেন মক্কেলের কথা বিবেচনা করে। বুদ্ধিজীবীরা বাংলা ভাষার ক্ষতির প্রশ্ন তুললেন। হিন্দু রাজনৈতিক নেতারা প্রচার করলেন, ব্রিটিশ সরকার বিভেদ নীতির বাস্তবায়ন করছে এবং ব্রিটিশ-মুসলমান মিত্রতার ফল বাংলা বিভক্তি।

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি তীব্র ভাষায় বঙ্গভঙ্গের নিন্দা করেন। কলকাতার হিন্দুরা ১৬ অক্টোবর জাতীয় শোক দিবস পালন করে এবং বঙ্গভঙ্গ রদের শপথ গ্রহণ করে। ১৯০৬ সালের ৭ আগস্ট ‘স্বদেশী আন্দোলন’ আরম্ভ হয়। বিলাতি দ্রব্য বয়কট করা হয়। সরকারি শিক্ষা বর্জন ও হিন্দু জাতীয় শিক্ষাকার্যক্রমের ঘোষণা দেয়া হয়। কংগ্রেসের মারাঠি নেতা বালগঙ্গাধর তিলক হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানে বঙ্গ বিভাগ কাজে লাগাতে শিবাজী উৎসব আয়োজনের ডাক দেন। এই প্রথম সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়া হয়। হিন্দুত্ববাদের মোড়কে আন্দোলন পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জমিদার শ্রেণী শুরুতে কৃষক প্রজাদের জোর করে আন্দোলনে, বিদেশী পণ্য বর্জনে বাধ্য করতে চেয়েছে। এতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লেও গণভিত্তি পায়নি।

বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে হিন্দু মানস পরিমাপ করতে গিয়ে কলকাতার হিন্দুস'ান বুক সার্ভিস থেকে প্রকাশিত বিমলানন্দ শাসমল ‘স্বাধীনতার ফাঁকি’ গ্রনে'র ৫৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন :
‘এই হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রবলভাবে এবং সুপরিকল্পিত আকারে প্রকাশ পেল বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে ১৯০৫ সালে, বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতারা ইংরেজ রাজত্বের উচ্ছেদের পরিকল্পনা করেননি। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সীমাবদ্ধ এবং বঙ্গ বিভাগ বন্ধ হওয়ায় তখনকার মতো ইংরেজ সরকারের অহমিকাতে আঘাত লাগা ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন' ক্ষতি হয়েছিল মুসলমানদের এবং সেই হেতু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন নিঃসন্দেহে মুসলমানবিরোধী ছিল।

...ভারতের নবজাগ্রত হিন্দু জাতীয়তাবাদের তাগিদে আমরা মুসলমানদের সুখ-সুবিধা লাভালাভের প্রশ্নে অন্ধ হয়ে উঠলাম। মুখে যতই হিন্দু-মুসলমান মিলনের কথা ঘোষণা করি না কেন, রাজনৈতিক দিক দিয়ে মুসলমানদের জন্য কিছু করা হচ্ছে দেখলেই আমরা হিন্দুরা তাতে বাধা দিয়েছি। পূর্ব বাংলা মুসলমান প্রদেশে রূপান্তরিত হলে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ইত্যাদিতে হিন্দুদের কোনো হাত থাকবে না। বঙ্গ ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে এইটাই ছিল আমাদের আন্দোলনের প্রধান কারণ।’

‘পাকিস্তান অর পার্টিশন অব ইন্ডিয়া’ গ্রনে'র ১১০ পৃষ্ঠায় ড. আম্বেদকর মন্তব্য করেন : ‘বাঙালি হিন্দুদের বাংলা বিভাগের বিরোধিতার কারণ ছিল এই- তারা চাইতেন না মুসলমানরা পূর্ব বাংলায় তাদের যথাযোগ্য স'ান অধিকার করুক। বাঙালি হিন্দুরা কিন' স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, বাংলা বিভাগের বিরোধিতা করে এবং সেই সাথে স্বরাজের দাবি করে তারা মুসলমানদের পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় বাংলার শাসক শ্রেণীতে পরিণত করে দিয়েছিলেন।’

বিমলানন্দ বাবু একই বইয়ের ৫৫ পৃষ্ঠায় মন্তব্য করেছেন : ‘সিন্ধু প্রদেশেও ঠিক এমনটিই হয়েছিল। ১৯১৫ সালে হিন্দুরা সিন্ধুকে বোম্বাই থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন, কারণ তখন সিন্ধু দেশে মুসলমান সংখ্যাধিক্যের সম্ভাবনা ছিল না, কিন' ১৯২৯ সালে যখন মুসলমান সংখ্যাধিক্য অবধারিত, তখন হিন্দুরা সিন্ধুকে বোম্বাই থেকে বিচ্ছিন্ন করার বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল।’

১৯০৭ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন, ‘মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই কথাটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। কে লাগাইলো সেটা তত গুরুত্বের বিষয় নহে।’
‘হিন্দু মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশে একটা পাপ আছে, এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিয়াছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনো মতেই নিষ্কৃতি নাই।’
‘আর মিথ্যা কথা বলিবার প্রয়োজন নাই। এইবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নহে। আমরা বিরুদ্ধ।’ রবীন্দ্র রচনাবলী, ১০ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬২৩-৮।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে সন্ত্রাস আশ্রয়ী হিন্দুত্ববাদের বিপজ্জনক পরিণতি এতটা প্রকট হয়ে উঠেছিল যে, সেটা সাধারণভাবে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অবিমিশ্র মুসলমান বিরোধিতার ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছিল।
‘কমিউনিস্ট পার্টি ও আমার জীবন’ গ্রনে' কমরেড মুজাফফর আহমেদ উল্লেখ করেছেন- সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের আদি প্রতিষ্ঠান, অনুশীলন সমিতির মূল প্রচারপত্রে লেখা ছিল : ‘মুসলমানদের দাবিয়ে রাখতে হবে’। এরপর বাংলার মুসলমান চাষিরা বুঝেছিল কোনো দিন কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দলের ওপর ভরসা করা যাবে না। পূর্বে উল্লিখিত বইয়ের ৭৮ পৃষ্ঠায় বিমলানন্দ আরো পেছনে গিয়ে হিন্দু মানস খুঁজতে চেষ্টা করেছেন এভাবে : ‘এ কথা ভুললে চলবে না, ভারতবর্ষে হিন্দুরা বহু দিন থেকেই মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন' নিজেদের পারস্পরিক অনৈক্য ও সামাজিক দুর্বলতার জন্য মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে তারা কার্যকর কিছু করে উঠতে পারেননি। কিন' ইংরেজ আগমনে ভারতের হিন্দুদের বহু দিনের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ হবার অবকাশ পেল। ভারত বর্ষের সিংহাসন থেকে মুসলমানদের সরিয়ে হিন্দুরাই বসিয়েছিল ইংরেজদের। পলাশী যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে বিখ্যাত মারাঠা নায়ক বালাজি বাজিরাও ক্লাইভকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, তিনি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইংরেজদের নিজের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে প্রস'ত আছেন। পলাশী যুদ্ধে মীরজাফর শিখণ্ডি ছিলেন মাত্র। সিরাজের প্রায় সমস্ত হিন্দু সেনাপতি মীরজাফরকে সামনে খাড়া করে গোপনে ইংরেজ পক্ষের সুবিধা করে দিয়েছিলেন।... ইংরেজদের হাতে শাসনভার অর্পিত হলে হিন্দুরা যে রকম প্রীত হয়েছিলেন, মুসলমানরা তা হতে পারেননি।’

জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য গ্রনে' ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘অষ্টাদশ শতকের মধ্য ভাগে দুর্বল সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকালে বাংলাদেশে ইংরেজরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করিয়া লইল, অজ্ঞান, স্বার্থান্ধ, কুচক্রী, মনুষ্যত্বহীন জনকয়েক বাঙালি ও বঙ্গ প্রবাসী জমিদার, সমাজনেতা ও ধনী ব্যক্তি মিলিয়া স্বদেশকে ইংরেজদের হাতে তুলিয়া দিলো।’

বঙ্গভঙ্গ রদ ও এর প্রতিক্রিয়া পর্বে যাওয়ার আগে আমরা অল্প ক’টি তথ্য তুলে ধরেছি এই জন্য যে, বঙ্গ বিভাগ নিয়ে কংগ্রেস হিন্দু নেতৃত্ব বাংলা মায়ের অঙ্গ রক্ষার দাবিদার বর্ণ হিন্দুদের মানসটা কী ছিল তা খানিকটা অনুভব করা। এ বিষয়ে ইতিহাস এত বেশি প্রামাণ্য দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণ করে রেখেছে যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের পরিধি ডিঙিয়ে ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত ছাড়াও যেকোনো মানুষ স্বাধীন বিবেকের ওপর নির্ভর করে বলতে পারবেন- পূর্ব বাংলার মানুষ আজ যে জাতিসত্তার পরিচয়বাহী অবয়বটি প্রত্যক্ষ করছে সেটা কত বেশি অর্জন এবং এই অর্জনে আমাদের পূর্বপুরুষদের ভূমিকা কত বেশি এবং কত দূরদর্শী ছিল। এ প্রসঙ্গে আমরা আরো ক’টি তথ্যের দিকে ফিরে যেতে পারি।

আজ এ কথা জোর দিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ করে বলা সহজ- বঙ্গভঙ্গ ছিল বাংলাদেশের সূচনালগ্ন। ঢাকার উত্থান। বর্ণ হিন্দুরা এবং এর নেতৃত্ব কখনোই মুসলিম অস্তিত্ব মানতে চায়নি। যে বাংলাদেশ মানলে মুসলমান প্রাধান্য মানতে হয়, সেই বাংলা তারা অভিধানে রাখতেও নারাজ ছিল। বাংলা যদি ষোলো ভাগও হতো এবং তাতে যদি বর্ণ আর্য ও কুলিন হিন্দুদের প্রাধান্য থাকত সেটাকে কোনোভাবেই বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ বলা হতো না। মুঘল আমলের আগেও গুপ্ত ও সেনশাসনকালে প্রশাসনিক বিভাজন হয়েছে, মুসলমান প্রাধান্যের প্রশ্ন ওঠেনি বলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামে ভারতীয় আত্মার কোনো সমস্যা হয়নি।

যে বাংলা বিভক্তি নিয়ে, আসলে বিভক্তিও নয়, প্রশাসনিক বিন্যাস নিয়ে ১৯০৫ সালে হিন্দু বাবুরা তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিলো, তারাই ’৪৭ সালে জোর করে বাংলার বুকে আড়াআড়ি কুড়াল বসালো। সিন্ধু, পাঞ্জাব, কাশ্মীর ছাড়াও ভারতজুড়ে প্রশাসনিক ভাগবিন্যাসে বিভিন্ন অঞ্চল নানাভাবে ব্যবচ্ছেদ হয়েছে। আবার জোড়া লেগেছে, কিন' বিপত্তির প্রসঙ্গ ওঠেনি। বাংলার ব্যাপারে সত্যিই কি দেবতারা ভীষণ রুষ্ট ও নাখোশ হয়েছিল! নাকি এর ভেতর হীন, নীচ ও ঘৃণ্য সামপ্রদায়িক বিষয়টাই প্রধান ছিল, সেটাই এক শ’ ছয় বছর পর আমরা খুঁজতে বসেছি। কারণ কোনো জাতি সামনে এগোতে চাইলে পেছনটাও খতিয়ে দেখে। শিকড়টা খোঁজার এই তাগিদই জাতিকে ইতিহাসমুখী করে। যে জাতি ইতিহাসের উৎস সন্ধানে ব্যাপৃত হয়, তার মানবিক শক্তি বাড়ে, চিন্তার প্রসারতা আরো বিস-ৃত হয়, সামনের পথচলাটা হয় দৃঢ়, মজবুত ও পরিচ্ছন্ন। পূর্ব বাংলাকে শোষণ করে কলকাতা সমৃদ্ধ হয়েছিল, এই স্মৃতি আমরা জেনে রাখতে চাই, লালন করতে চাই না। আমাদের ওপর আধিপত্যবাদ চেপে বসতে চায়। অক্টোপাসের মতো অষ্ট হাতে বেঁধে আড়ষ্ট করে দিতে চায়- এটা জেনে রাখার গরজ বোধ করি। কিন' আমরা ভীতির দুঃস্বপ্ন পুষে রাখতে চাই না। (অসমাপ্ত)
মাসুদ মজুমদার
digantaeditorial@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন