![]() |
॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ॥ |
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
জীবনের অনেকগুলো দিন পেরিয়ে এসে স্মৃতির পাতা উল্টালে কত কিছু ছায়াছবির মতো জীবনের পর্দায় ভেসে ওঠে। মনে হয়, এই সে দিন সেনাবাহিনী থেকে ফিরে করটিয়া কলেজে ভর্তি হলাম। আমতলা গোল চত্বরে বক্তৃতা করলাম, নাক-কান ঘেমে একাকার হয়ে গেল। মনে হয়, এই তো সে দিন মুক্তিযুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর হাতে সব অস্ত্র দিয়ে দিলাম। তারপর তিনি নিহত হলে প্রতিবাদ করে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর লাখ লাখ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে দেশে ফিরলাম। বিমান থেকে নেমে মাটিতে পা ফেলতে মন সায় দিলো না। জননী জন্মভূমি মাটি মাকে চুমু খেয়ে বুকে হাঁটলাম অনেকক্ষণ। মনে হয়, এ যেন এই গতকালের কথা। কিভাবে দিন যায়, মাস ঘুরে বছর যায়, ব্যস- থাকলে বোঝাই যায় না। ইদানীং ব্যস-তা কিছু কম। তাই কিছুটা বুঝতে পারি। গত ২৩ নভেম্বর রাত ১১টা ২১ মিনিটে হঠাৎই মোবাইল বেজে উঠল। সাধারণত ১১টার পর মোবাইল বন্ধ করে দিই। সে দিন কোনো কারণে ফোন বন্ধ করা হয়নি। ১১টার দিকে ঘুম এসে যায়। যদিও বাইরে থাকলে এমনটা না-ও হতে পারে। তবে বেশি রাত জাগলে আমার ঘুম আসে না
। কিন' ১১-১২টার মধ্যে
একবার ঘুমিয়ে পড়লে
ঘুম নিয়ে আর
কোনো সমস্যা নেই।
গত ১০-১২
বছর ঘুমের জন্য
তেমন হাহাকার করতে
হয়নি। ঘুমের ওষুধ
খেতে হয় না।
বই অথবা পত্রিকা পড়লেই
ঘুম এসে যায়।
বছর দশেক যাবৎ
পত্রিকা অথবা বই-ই আমার
রাতের ঘুমের ওষুধ।
ওদিনও যেন কী
পড়ছিলাম। হঠাৎই
ফোন বাজছিল। অপরিচিত নম্বর।
ইদানীং অনেকেই অপরিচিত নম্বর
ধরে না। সাথী-সঙ্গীরা থাকলে
আমিও ধরি না।
তারাই সব সময়
ধরে দেয়। কেউ
কাছে না থাকলে
দু’-একবার নিজেও
ধরি। তবে ল্যান্ডফোন সব
সময়ই ধরি এবং
ওটা ধরা একটা
দায়িত্ব-কর্তব্য মনে
করি। কে ফোন
করল সেটা বড়
কথা নয়। যে
ফোন করেছে সে
গরিব না ধনী
তা-ও বিচার
করি না। যে
যা-ই বলুক
না কেন, যতক্ষণ
সময় সুযোগ আছে
ধরার এবং শোনার
চেষ্টা করি। ছেলে,
মেয়ে, স্ত্রী সে
দিন টাঙ্গাইলে ছিল
না, তারা ছিল
ঢাকায়। ঘরে একাই
ছিলাম। তাই ফোন
বাজতেই ধরেছিলাম। অপর
প্রান- থেকে জিজ্ঞেস করেছিল
এটা কাদের সিদ্দিকীর ফোন?
বলছি বলায় বলল,
অসময়ে ফোন করে
আপনাকে হয়তো বিরক্ত
করলাম। আপনি ঠাণ্ডু
স্যারের ছেলে জুয়েলকে হয়তো
চেনেন। সে গতকাল
মারা গেছে (ইন্না
লিল্লাহি ওয়া ইন্না
ইলাহি রাজিউন)।
আজ বিকেলে বাবার
পাশে তাকে কবর
দেয়া হয়েছে। আপনি
ফিরোজের কাছে তার
খোঁজ করেছিলেন, তাই
আপনাকে জানালাম। ২৫
তারিখ বাদ মাগরিব
ধানমন্ডিতে কুলখানি। সম্ভব
হলে আসবেন। আমার
সারা মনপ্রাণ অশান-
হয়ে উঠল। এ-ও কি
সম্ভব? আমার থেকে
৭-৮ বছরের
ছোট। এই সে
দিন ওর সাথে
কথা বলেছি, বাসায়
আসতেও বলেছিলাম। কারণ
ওকে প্রায় ৩০-৩৫ বছর
দেখিনি। জুয়েলের মৃত্যুর খবর
শুনে অনেক অতীত
স্মৃতি মনের পর্দায়
ছায়াছবির মতো ভেসে
উঠল।
১৯৬৮ সাল। আইয়ুব-মোনায়েমের তখন দুর্দান- প্রতাপ। আড়াই-তিন বছর সেনাবাহিনীর ঘানি টেনে কেবলই বাড়ি ফিরেছি। বিন্দুবাসিনী স্কুল থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করে করটিয়া কলেজে ভর্তি হতে গেছি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী তখন টাঙ্গাইলে ছাত্রদের প্রধান নেতা। বক্তৃতার জাদুকর, করটিয়া কলেজের সাবেক ভিপি। সে হিসেবে সর্বত্র তার নামডাক। কিন' সরকারি প্রশাসনের কাছে তিনি চক্ষুশূল। টাঙ্গাইল তখনো জেলা হয়নি। ময়মনসিংহ জেলার অধীন এশিয়ার সর্ববৃহৎ মহকুমা টাঙ্গাইল। ময়মনসিংহের ডিসি তখন টাঙ্গাইল নিয়ন্ত্রণ করেন। মোকাম্মেল হকের মতো জাঁদরেল সিএসপি ময়মনসিংহের ডিসি। সরকারের জন্য লতিফ সিদ্দিকী তখন এক মস-বড় উপদ্রব। তার ভাই হিসেবে আমি আরো নতুন উপদ্রব হয়ে দেখা দিই এটা কোনোমতেই প্রশাসন চায় না। গুঞ্জন ছিল, আমাকে করটিয়া কলেজে ভর্তি হতে দেবে না। ’৬২ থেকে ’৬৮ বারবার বাবা ও বড় ভাইকে জেলে নিয়ে আমাদের পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য একেবারে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছিল। কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে তখন ৪৫ থেকে ৫০ টাকার প্রয়োজন। বাবার মোক্তারি সনদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তার উপার্জন বন্ধ। বিনা কারণে দেড়-দুই বছর জেল খেটে কেবল বেরিয়েছেন। বড় ভাই তখনো জেলে। ছোট বোন রহিমা দেশের একমাত্র মহিলা কলেজ কুমুদিনীতে পড়ে। শুশু সিক্স কিংবা সেভেনে, শাহানা থ্রি-ফোরে। কোথা থেকে কিভাবে অনেক কষ্ট করে মা আমার হাতে বিশ-পঁচিশ টাকা তুলে দিয়ে কলেজে ভর্তি হতে বললেন। কিভাবে যেন মোট আটত্রিশ টাকা সংগ্রহ করে করটিয়া কলেজের উদ্দেশে ছুটলাম। করটিয়া কলেজে আরো দু’-একবার গেছি। কিন' কলেজে পা দিলেই কেমন যেন সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে যেত। ভয়ে শিউরে উঠতাম। আমি একসময় মির্জাপুরের বরাটি-নরদানা পাকিস-ান হাই স্কুলে শ্রী দুখীরাম রাজবংশীর ছাত্র ছিলাম। দুর্দান- হেড মাস্টার ছিলেন তিনি। হোস্টেলে যারা থাকত তারা রাত ১১টার আগে কখনো ঘুমাতে পারত না। শ্রী দুখীরাম রাজবংশীর কারণেই শিক্ষকদের প্রতি আমার দুর্দান- ভয় ছিল। তখন করটিয়া কলেজে একদল লতিফ সিদ্দিকীকে দেবতুল্য সম্মান করত, অন্য দলের কাছে শাহজাহান সিরাজ ছিলেন মাথার মুকুট, চোখের মণি। কে কে যেন আমাকে প্রথম দিন কলেজে নিয়ে গিয়েছিল। ভর্তি ফরম পূরণ করে নিয়মমতো একজন শিক্ষকের স্বাক্ষর নিয়ে কেরানির রুমে জমা দিতে গেলে ভর্তি ফি বাবদ ৪৮ টাকা চাইলেন। আমার কাছে তখন ছিল ৩৮ টাকা। ভর্তি কেরানি ছিলেন কুমিল্লার মাখন ভাই। দেখতে আইয়ুব খানের চেয়েও লম্বা। ৬ ফুট ৪-৫ ইঞ্চি হবেন। দারুণ ভলি খেলতেন তিনি। নেটে দাঁড়িয়ে যখন ডাউন দিতেন, তার বল মাটিতে পড়লে মাটি নিচু হয়ে যেত। লতিফ ভাইকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমার শুকনো মুখ দেখে বললেন, ‘ভাইস প্রিন্সিপালকে দিয়ে লিখিয়ে আনলে কম টাকাতেও ভর্তি করা যেতে পারে।’ তখন কলেজে প্রিন্সিপাল ছিলেন না। করটিয়া কলেজের প্রখ্যাত প্রিন্সিপাল তোফায়েল আহমেদকে আন্দোলন করে কেবলই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাইস প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যার তখন দায়িত্বে। তত দিনে কলেজে লতিফ সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজের পরিষ্কার দু’টি দল হয়ে গেছে। শাহজাহান সিরাজ তখন করটিয়া কলেজের ভিপি। লতিফ সিদ্দিকী ময়মনসিংহ কারাগারে রাজবন্দী। স্বাভাবিক কারণেই শাহজাহান সিরাজের কলেজে প্রতাপ বেশি। আর ভাইস প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যার ঘোরতর মুসলিম লীগার এবং শাহজাহান সিরাজের পক্ষের লোক। তার কাছে গেলে আমার কথা রাখবেন? লতিফ সিদ্দিকীর ভাইয়ের বেতন বাকি রেখে কলেজে ভার্তির সুযোগ দেবেন? শঙ্কিত মনেই তার কাছে গিয়েছিলাম। আমার সাথে অনেকেই গিয়েছিল। সালাম দিয়ে নাম বলে সামনে দাঁড়াতেই মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি লতিফের ভাই?’ ‘জি হ্যাঁ।’ ‘কেন এসেছ? কী চাও?’ ‘ভর্তি হবো। সব টাকা দিতে পারব না।’ ‘বেশ তো অসুবিধা কী? ক’টাকা দেবে?’ ‘ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ।’ কেরানি মাখন ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সর্বনিম্ন কত টাকায় ভর্তি করা যায়?’ তিনি এটা-ওটা হিসাব করে বললেন, ‘পঁচিশ টাকা হলেও চলে। সাঁইত্রিশ টাকা হলেও চলে।’ ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পঁচিশ টাকা, নাকি সাঁইত্রিশ টাকা দিয়ে ভর্তি হবে?’ ‘আমি সাঁইত্রিশ টাকাই দিতে চাই।’ সাথে সাথে তিনি সাঁইত্রিশ টাকা নিয়ে আমাকে ভর্তি করার আদেশ দিয়ে দিলেন।
৫-৭ মিনিটের মধ্যে দুই মাসের বেতন, ভর্তি ফি, আরো আরো কী কী নিয়ে আমার নামে সাঁইত্রিশ টাকার রিসিট কেটে ভর্তি বই দিয়ে দিলেন। ভর্তির রসিদ বই হাতে পেয়ে বারবার মাকে দেখাতে ইচ্ছে হলো। তাই রাস-াঘাটে দেরি না করে ঝড়ের বেগে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে রসিদ বই দিয়ে যখন বলতে পারলাম, ‘মা, আমি করটিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছি।’ এর আগে একটা অস্বসি- আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সেই প্রথম অনুভব করেছিলাম, যেকোনো আনন্দে ভাগীদার লাগে। জীবনে অনেক আনন্দের মুহূর্ত এসেছে, কিন' করটিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার আনন্দ আজো আমাকে শিহরিত করে। কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার অল্প পরেই টাঙ্গাইল থেকে এক ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে হাজির। প্রিন্সিপালকে বললেন, লতিফ সিদ্দিকীর ভাইকে এ কলেজে ভর্তি করা যাবে না। ম্যাজিস্ট্রেটের কথা শুনে ভাইস প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যার যেন আসমান থেকে পড়লেন। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান, কিছুক্ষণ আগেই তিনি আমার ভর্তি ফরমে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। সাথে সাথে মাখন ভাইকে ডেকে আনলেন। তিনি বলেন, ১৫-২০ জনের আগে আমি ভর্তি হয়ে রিসিট বই নিয়ে চলে এসেছি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আর কোনো উচ্চবাচ্য না করে চলে এলেন। পরদিন কলেজে গেলে স্যার আমাকে ডেকে পাঠান, ‘সরকার চায় না তুমি এ কলেজে পড়ো। তোমার পড়া বন্ধ করতে সরকার হয়তো কিছু করতেও পারে। ভর্তির যে ১০-১১ টাকা বাকি আছে কোনো অসুবিধা না হলে দু’-এক দিনের মধ্যেই তা শোধ করে দিয়ো। আর যদি অসুবিধা হয় তাহলে বাকি টাকা আমিই জমা দিয়ে ভর্তিটা শুদ্ধ করে রাখব।’ ১১ টাকা জোগাড় করতে খুবই চিন-ায় পড়লাম। আমাদের পাশেই থাকতেন গোপালগঞ্জের জুট ইনসপেক্টর নির্মল সাহা। তার ছোট ভাই বিজন সাহা আমার খেলার সাথী। ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি, সাহারা খুব কৃপণ হয়। বিজনকে নিয়েও আমার তেমনি ধারণা ছিল। কিন' ম্যাট্রিক পাস করার পর ওর কাছে বিশ টাকা হাওলাত চাইলে কিছুক্ষণ পর ওর বৌদি নাগরপুরের দিপালীকা সাহার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা এনে দিয়েছিলেন। বিকেলে বৌদি আমাকে অন্যদের সাথে মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন। সেই থেকে সব সাহা যে কৃপণ হয় না এমন একটা ধারণা হয়েছিল। খুব তাড়াতাড়ি টাকার দরকার। তাই এক বা দু’দিন পর বিজনকে বলেছিলাম, কলেজের জন্য পনেরটা টাকার দরকার। আমার পনেরটা টাকা দরকার শুনে বিজন কুমার সাহা কানুর বৌদি আমার বন্ধু দীপক সাহার বোন পরীর মতো সুন্দরী দিপালীকা সাহা বিশ টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঠাকুরপো, তোমার টাকা-পয়সার দরকার হলে কোনো লজ্জা কোরো না, আমাকে বোলো।’ আর কোনো দিন লজ্জা করিনি, তাকে বলতেও হয়নি।
আল্লাহর রহমতে হাইকোর্ট থেকে বাবা সনদ পেলে আমাদের আর অভাব থাকেনি। বৌদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলেজে গিয়ে মাখন ভাইকে টাকা দিতে গেলাম, গিয়ে দেখি আমার নামে বকেয়া টাকা জমা হয়ে গেছে। কে দিয়েছে? প্রিন্সিপাল সাহেব নিজে ভর্তির পরদিনই বাকি টাকা জমা দিয়ে দিয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেট আসায় তার শঙ্কা ছিল- টাকা বাকি রেখে ভর্তি হয়েছি, এ জন্য যদি কোনোভাবে ভর্তি বাতিল করে দেয়, তাই বিশুদ্ধ ভর্তির জন্য পুরো টাকা জমা দিয়ে দিয়েছেন। সাহস করে স্যারকে টাকা দিতে গেলে কাছে ডেকে কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘ওটা এখন থাক। পরে কখনো দিস।’ কলেজে ভর্তির আগ থেকেই শুনে আসছিলাম, ঠাণ্ডু স্যার আমাদের বিরোধী, শাহজাহান সিরাজের পক্ষে। কিন' আমার ভর্তিতে কোনো বাধা দিলেন না, বাকি রেখে ভর্তির সুযোগ দিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট এসে ভর্তি না করার কথা বলায় বাকি রেখে ভর্তি অশুদ্ধ হতে পারে সেই শঙ্কায় নিজে টাকা দিয়ে শুদ্ধ করে রাখলেন। তাকে পক্ষে না বিপক্ষে বলব? আমি অন্যদের চেয়ে পাঁচ-ছয় বছর দেরিতে কলেজে গেছি। প্রাইমারিতে স্কুল পালিয়ে দুই বছর নষ্ট করেছি। হাইস্কুলে এসে ’৬৫-তে বাড়ি থেকে পালিয়ে সেনাবাহিনীতে গিয়ে তিন বছর নষ্ট করেছি। স্বাভাবিকভাবেই চার-পাঁচ বছরের ছোটরা ছিল আমার ক্লাসফ্রেন্ড। বেশ হৃষ্টপুষ্ট শক্তমর্দ হয়েই কলেজে গিয়েছিলাম। আমি যে লতিফ সিদ্দিকীর ভাই, মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকীর ছেলে, সরকারের জন্য গলার কাঁটা- এটা ছয়-সাত মাসেই প্রমাণ হয়ে গেল। এরপর যখন যে ব্যাপারে তার কাছে গেছি কখনো না করেননি। করটিয়া কলেজে সব সময়ই সবার মাসিক বেতন বাকি থাকত। ফাইনাল পরীক্ষার সময় ফরমফিলাপ করতে গিয়ে একত্রে অনেক ছাত্রের ১৮-২০-২২ মাসের বেতন দিতে হতো। সেই প্রথম বর্ষে ভর্তির সময় যা দু-এক মাসের বেতন দিয়ে ভর্তি হতো, তারপর কেউ এক পয়সাও দিতো না। ফাইনাল পরীক্ষার সময় সব বেতন একসাথে দিতে হতো। সত্যিকার অর্থে অনেক দরিদ্র ছাত্র একসাথে ২০-২২ মাসের বেতন দিতে পারত না। আবার আমার মতো অনেকে ছিল, যারা প্রতি মাসেই বেতন এনে খেয়ে ফেলত। তারা আবার বাড়িতে অত টাকা একসাথে চাইতেও পারত না। এসব সমস্যা নিয়ে ফাইনাল পরীক্ষার সময় বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীরই থাকত পেরেশান। ওই সব পেরেশানি দূর করতে অনেকবার স্যারের কাছে গেছি। একবারো তিনি বিমুখ করেননি। কোনো কোনো ছাত্রের ১০-১২ মাসের এমনকি সত্যিই যারা গরিব তাদের সম্পূর্ণ বেতন মওকুফ করে শুধু সেন্টার এবং বোর্ড ফি দিয়ে ফরমফিলাপের অনুমতি নিয়েছি। তাই ঠাণ্ডু স্যারকে নিয়ে তার ছেলের মৃত্যুর সংবাদে কত কথা যে মনে পড়ছে কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। প্রবাদ আছে, আলেমের ঘরে জালেম, শিক্ষিতের ঘরে অশিক্ষিত। ভাইস প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যারের ছেলেমেয়েরা ক’জন উপযুক্ত হয়েছে বা প্রকৃত লেখাপড়া শিখেছে বলতে পারব না; কিন' ’৬৮-’৬৯-এ জুয়েলকে লেখাপড়া করতে দেখিনি। আমি যখন সকালে কলেজে যেতাম এবং বিকেলে ফিরতাম, করটিয়া বাজারের সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস-ায় ওকে প্রায় দিনই মকবুলের সাথে ঘোরাফেরা করতে দেখতাম। মকবুল পরে করটিয়া কলেজের জিএস হয়েছিল। জুয়েল কতটা লেখাপড়া করেছিল জানি না। হালকা-পাতলা-শ্যামলার মধ্যে দেখতে বেশ সুন্দর ছিল। চোখ-নাক-মুখ ছিল টানা টানা। ’৬৮ থেকে ’৭১- এ সময়টাজুড়েই আমি জুয়েলকে একইভাবে দেখেছি। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ তারপর স্বাধীনতা। এরপর করটিয়ার সাথে আমার সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ’৭১ থেকে ’৭৫ সালের মাঝে ঠাণ্ডু স্যারের সাথে এক বা দু’বার দেখা হয়েছে। প্রকাশ্যে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করায় তিনি বিস্মিত হতেন। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমার দশাও ছিল তাই। বাপ-দাদার শেখানো তাহজিব-তমদ্দুন ভুলে কখনো বড়দের সাথে বেয়াদবি করতে পারিনি। তা না হলে স্বাধীনতার পর শানি- কমিটির সদস্য খলিল স্যার আমার সাথে দেখা করতে এলে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সদর রাস-ায় তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করায় তিনি জার জার হয়ে কেঁদেছিলেন। কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন, ‘যে জন্য এসেছিলাম, তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। মনে করে এলাম তোমার সামনে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইব অথচ তুমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছো, আমি আর কার কাছে ক্ষমা চাইব। আমার যা হওয়ার হবে।’ স্যারকে বলেছিলাম, ‘শানি- কমিটির সদস্য হিসেবে সবার যদি শাসি- হয়, নিশ্চয়ই আপনারও হবে। কিন' তার আগে কেউ আপনাকে অপমান-অপদস' করতে পারবে না।’ কাঁদতে কাঁদতেই স্যার সে দিন বাড়ি ফিরছিলেন। করটিয়া কলেজের বাংলার অধ্যাপক খলিল স্যার ছিলেন নির্বিবাদী ভীষণ ভালো শিক্ষক। কেন তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জেলা শানি- কমিটির সদস্য হয়েছিলেন বা বানানো হয়েছিল, সে রহস্য জানি না।
১৯৬৮ সাল। আইয়ুব-মোনায়েমের তখন দুর্দান- প্রতাপ। আড়াই-তিন বছর সেনাবাহিনীর ঘানি টেনে কেবলই বাড়ি ফিরেছি। বিন্দুবাসিনী স্কুল থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করে করটিয়া কলেজে ভর্তি হতে গেছি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী তখন টাঙ্গাইলে ছাত্রদের প্রধান নেতা। বক্তৃতার জাদুকর, করটিয়া কলেজের সাবেক ভিপি। সে হিসেবে সর্বত্র তার নামডাক। কিন' সরকারি প্রশাসনের কাছে তিনি চক্ষুশূল। টাঙ্গাইল তখনো জেলা হয়নি। ময়মনসিংহ জেলার অধীন এশিয়ার সর্ববৃহৎ মহকুমা টাঙ্গাইল। ময়মনসিংহের ডিসি তখন টাঙ্গাইল নিয়ন্ত্রণ করেন। মোকাম্মেল হকের মতো জাঁদরেল সিএসপি ময়মনসিংহের ডিসি। সরকারের জন্য লতিফ সিদ্দিকী তখন এক মস-বড় উপদ্রব। তার ভাই হিসেবে আমি আরো নতুন উপদ্রব হয়ে দেখা দিই এটা কোনোমতেই প্রশাসন চায় না। গুঞ্জন ছিল, আমাকে করটিয়া কলেজে ভর্তি হতে দেবে না। ’৬২ থেকে ’৬৮ বারবার বাবা ও বড় ভাইকে জেলে নিয়ে আমাদের পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য একেবারে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছিল। কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে তখন ৪৫ থেকে ৫০ টাকার প্রয়োজন। বাবার মোক্তারি সনদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তার উপার্জন বন্ধ। বিনা কারণে দেড়-দুই বছর জেল খেটে কেবল বেরিয়েছেন। বড় ভাই তখনো জেলে। ছোট বোন রহিমা দেশের একমাত্র মহিলা কলেজ কুমুদিনীতে পড়ে। শুশু সিক্স কিংবা সেভেনে, শাহানা থ্রি-ফোরে। কোথা থেকে কিভাবে অনেক কষ্ট করে মা আমার হাতে বিশ-পঁচিশ টাকা তুলে দিয়ে কলেজে ভর্তি হতে বললেন। কিভাবে যেন মোট আটত্রিশ টাকা সংগ্রহ করে করটিয়া কলেজের উদ্দেশে ছুটলাম। করটিয়া কলেজে আরো দু’-একবার গেছি। কিন' কলেজে পা দিলেই কেমন যেন সারা শরীর আড়ষ্ট হয়ে যেত। ভয়ে শিউরে উঠতাম। আমি একসময় মির্জাপুরের বরাটি-নরদানা পাকিস-ান হাই স্কুলে শ্রী দুখীরাম রাজবংশীর ছাত্র ছিলাম। দুর্দান- হেড মাস্টার ছিলেন তিনি। হোস্টেলে যারা থাকত তারা রাত ১১টার আগে কখনো ঘুমাতে পারত না। শ্রী দুখীরাম রাজবংশীর কারণেই শিক্ষকদের প্রতি আমার দুর্দান- ভয় ছিল। তখন করটিয়া কলেজে একদল লতিফ সিদ্দিকীকে দেবতুল্য সম্মান করত, অন্য দলের কাছে শাহজাহান সিরাজ ছিলেন মাথার মুকুট, চোখের মণি। কে কে যেন আমাকে প্রথম দিন কলেজে নিয়ে গিয়েছিল। ভর্তি ফরম পূরণ করে নিয়মমতো একজন শিক্ষকের স্বাক্ষর নিয়ে কেরানির রুমে জমা দিতে গেলে ভর্তি ফি বাবদ ৪৮ টাকা চাইলেন। আমার কাছে তখন ছিল ৩৮ টাকা। ভর্তি কেরানি ছিলেন কুমিল্লার মাখন ভাই। দেখতে আইয়ুব খানের চেয়েও লম্বা। ৬ ফুট ৪-৫ ইঞ্চি হবেন। দারুণ ভলি খেলতেন তিনি। নেটে দাঁড়িয়ে যখন ডাউন দিতেন, তার বল মাটিতে পড়লে মাটি নিচু হয়ে যেত। লতিফ ভাইকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমার শুকনো মুখ দেখে বললেন, ‘ভাইস প্রিন্সিপালকে দিয়ে লিখিয়ে আনলে কম টাকাতেও ভর্তি করা যেতে পারে।’ তখন কলেজে প্রিন্সিপাল ছিলেন না। করটিয়া কলেজের প্রখ্যাত প্রিন্সিপাল তোফায়েল আহমেদকে আন্দোলন করে কেবলই সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাইস প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যার তখন দায়িত্বে। তত দিনে কলেজে লতিফ সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজের পরিষ্কার দু’টি দল হয়ে গেছে। শাহজাহান সিরাজ তখন করটিয়া কলেজের ভিপি। লতিফ সিদ্দিকী ময়মনসিংহ কারাগারে রাজবন্দী। স্বাভাবিক কারণেই শাহজাহান সিরাজের কলেজে প্রতাপ বেশি। আর ভাইস প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যার ঘোরতর মুসলিম লীগার এবং শাহজাহান সিরাজের পক্ষের লোক। তার কাছে গেলে আমার কথা রাখবেন? লতিফ সিদ্দিকীর ভাইয়ের বেতন বাকি রেখে কলেজে ভার্তির সুযোগ দেবেন? শঙ্কিত মনেই তার কাছে গিয়েছিলাম। আমার সাথে অনেকেই গিয়েছিল। সালাম দিয়ে নাম বলে সামনে দাঁড়াতেই মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি লতিফের ভাই?’ ‘জি হ্যাঁ।’ ‘কেন এসেছ? কী চাও?’ ‘ভর্তি হবো। সব টাকা দিতে পারব না।’ ‘বেশ তো অসুবিধা কী? ক’টাকা দেবে?’ ‘ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ।’ কেরানি মাখন ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সর্বনিম্ন কত টাকায় ভর্তি করা যায়?’ তিনি এটা-ওটা হিসাব করে বললেন, ‘পঁচিশ টাকা হলেও চলে। সাঁইত্রিশ টাকা হলেও চলে।’ ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘পঁচিশ টাকা, নাকি সাঁইত্রিশ টাকা দিয়ে ভর্তি হবে?’ ‘আমি সাঁইত্রিশ টাকাই দিতে চাই।’ সাথে সাথে তিনি সাঁইত্রিশ টাকা নিয়ে আমাকে ভর্তি করার আদেশ দিয়ে দিলেন।
৫-৭ মিনিটের মধ্যে দুই মাসের বেতন, ভর্তি ফি, আরো আরো কী কী নিয়ে আমার নামে সাঁইত্রিশ টাকার রিসিট কেটে ভর্তি বই দিয়ে দিলেন। ভর্তির রসিদ বই হাতে পেয়ে বারবার মাকে দেখাতে ইচ্ছে হলো। তাই রাস-াঘাটে দেরি না করে ঝড়ের বেগে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে রসিদ বই দিয়ে যখন বলতে পারলাম, ‘মা, আমি করটিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছি।’ এর আগে একটা অস্বসি- আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সেই প্রথম অনুভব করেছিলাম, যেকোনো আনন্দে ভাগীদার লাগে। জীবনে অনেক আনন্দের মুহূর্ত এসেছে, কিন' করটিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার আনন্দ আজো আমাকে শিহরিত করে। কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার অল্প পরেই টাঙ্গাইল থেকে এক ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে হাজির। প্রিন্সিপালকে বললেন, লতিফ সিদ্দিকীর ভাইকে এ কলেজে ভর্তি করা যাবে না। ম্যাজিস্ট্রেটের কথা শুনে ভাইস প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যার যেন আসমান থেকে পড়লেন। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটকে জানান, কিছুক্ষণ আগেই তিনি আমার ভর্তি ফরমে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। সাথে সাথে মাখন ভাইকে ডেকে আনলেন। তিনি বলেন, ১৫-২০ জনের আগে আমি ভর্তি হয়ে রিসিট বই নিয়ে চলে এসেছি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আর কোনো উচ্চবাচ্য না করে চলে এলেন। পরদিন কলেজে গেলে স্যার আমাকে ডেকে পাঠান, ‘সরকার চায় না তুমি এ কলেজে পড়ো। তোমার পড়া বন্ধ করতে সরকার হয়তো কিছু করতেও পারে। ভর্তির যে ১০-১১ টাকা বাকি আছে কোনো অসুবিধা না হলে দু’-এক দিনের মধ্যেই তা শোধ করে দিয়ো। আর যদি অসুবিধা হয় তাহলে বাকি টাকা আমিই জমা দিয়ে ভর্তিটা শুদ্ধ করে রাখব।’ ১১ টাকা জোগাড় করতে খুবই চিন-ায় পড়লাম। আমাদের পাশেই থাকতেন গোপালগঞ্জের জুট ইনসপেক্টর নির্মল সাহা। তার ছোট ভাই বিজন সাহা আমার খেলার সাথী। ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি, সাহারা খুব কৃপণ হয়। বিজনকে নিয়েও আমার তেমনি ধারণা ছিল। কিন' ম্যাট্রিক পাস করার পর ওর কাছে বিশ টাকা হাওলাত চাইলে কিছুক্ষণ পর ওর বৌদি নাগরপুরের দিপালীকা সাহার কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা এনে দিয়েছিলেন। বিকেলে বৌদি আমাকে অন্যদের সাথে মিষ্টিমুখ করিয়েছিলেন। সেই থেকে সব সাহা যে কৃপণ হয় না এমন একটা ধারণা হয়েছিল। খুব তাড়াতাড়ি টাকার দরকার। তাই এক বা দু’দিন পর বিজনকে বলেছিলাম, কলেজের জন্য পনেরটা টাকার দরকার। আমার পনেরটা টাকা দরকার শুনে বিজন কুমার সাহা কানুর বৌদি আমার বন্ধু দীপক সাহার বোন পরীর মতো সুন্দরী দিপালীকা সাহা বিশ টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঠাকুরপো, তোমার টাকা-পয়সার দরকার হলে কোনো লজ্জা কোরো না, আমাকে বোলো।’ আর কোনো দিন লজ্জা করিনি, তাকে বলতেও হয়নি।
আল্লাহর রহমতে হাইকোর্ট থেকে বাবা সনদ পেলে আমাদের আর অভাব থাকেনি। বৌদির কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলেজে গিয়ে মাখন ভাইকে টাকা দিতে গেলাম, গিয়ে দেখি আমার নামে বকেয়া টাকা জমা হয়ে গেছে। কে দিয়েছে? প্রিন্সিপাল সাহেব নিজে ভর্তির পরদিনই বাকি টাকা জমা দিয়ে দিয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেট আসায় তার শঙ্কা ছিল- টাকা বাকি রেখে ভর্তি হয়েছি, এ জন্য যদি কোনোভাবে ভর্তি বাতিল করে দেয়, তাই বিশুদ্ধ ভর্তির জন্য পুরো টাকা জমা দিয়ে দিয়েছেন। সাহস করে স্যারকে টাকা দিতে গেলে কাছে ডেকে কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ‘ওটা এখন থাক। পরে কখনো দিস।’ কলেজে ভর্তির আগ থেকেই শুনে আসছিলাম, ঠাণ্ডু স্যার আমাদের বিরোধী, শাহজাহান সিরাজের পক্ষে। কিন' আমার ভর্তিতে কোনো বাধা দিলেন না, বাকি রেখে ভর্তির সুযোগ দিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট এসে ভর্তি না করার কথা বলায় বাকি রেখে ভর্তি অশুদ্ধ হতে পারে সেই শঙ্কায় নিজে টাকা দিয়ে শুদ্ধ করে রাখলেন। তাকে পক্ষে না বিপক্ষে বলব? আমি অন্যদের চেয়ে পাঁচ-ছয় বছর দেরিতে কলেজে গেছি। প্রাইমারিতে স্কুল পালিয়ে দুই বছর নষ্ট করেছি। হাইস্কুলে এসে ’৬৫-তে বাড়ি থেকে পালিয়ে সেনাবাহিনীতে গিয়ে তিন বছর নষ্ট করেছি। স্বাভাবিকভাবেই চার-পাঁচ বছরের ছোটরা ছিল আমার ক্লাসফ্রেন্ড। বেশ হৃষ্টপুষ্ট শক্তমর্দ হয়েই কলেজে গিয়েছিলাম। আমি যে লতিফ সিদ্দিকীর ভাই, মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকীর ছেলে, সরকারের জন্য গলার কাঁটা- এটা ছয়-সাত মাসেই প্রমাণ হয়ে গেল। এরপর যখন যে ব্যাপারে তার কাছে গেছি কখনো না করেননি। করটিয়া কলেজে সব সময়ই সবার মাসিক বেতন বাকি থাকত। ফাইনাল পরীক্ষার সময় ফরমফিলাপ করতে গিয়ে একত্রে অনেক ছাত্রের ১৮-২০-২২ মাসের বেতন দিতে হতো। সেই প্রথম বর্ষে ভর্তির সময় যা দু-এক মাসের বেতন দিয়ে ভর্তি হতো, তারপর কেউ এক পয়সাও দিতো না। ফাইনাল পরীক্ষার সময় সব বেতন একসাথে দিতে হতো। সত্যিকার অর্থে অনেক দরিদ্র ছাত্র একসাথে ২০-২২ মাসের বেতন দিতে পারত না। আবার আমার মতো অনেকে ছিল, যারা প্রতি মাসেই বেতন এনে খেয়ে ফেলত। তারা আবার বাড়িতে অত টাকা একসাথে চাইতেও পারত না। এসব সমস্যা নিয়ে ফাইনাল পরীক্ষার সময় বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীরই থাকত পেরেশান। ওই সব পেরেশানি দূর করতে অনেকবার স্যারের কাছে গেছি। একবারো তিনি বিমুখ করেননি। কোনো কোনো ছাত্রের ১০-১২ মাসের এমনকি সত্যিই যারা গরিব তাদের সম্পূর্ণ বেতন মওকুফ করে শুধু সেন্টার এবং বোর্ড ফি দিয়ে ফরমফিলাপের অনুমতি নিয়েছি। তাই ঠাণ্ডু স্যারকে নিয়ে তার ছেলের মৃত্যুর সংবাদে কত কথা যে মনে পড়ছে কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। প্রবাদ আছে, আলেমের ঘরে জালেম, শিক্ষিতের ঘরে অশিক্ষিত। ভাইস প্রিন্সিপাল ঠাণ্ডু স্যারের ছেলেমেয়েরা ক’জন উপযুক্ত হয়েছে বা প্রকৃত লেখাপড়া শিখেছে বলতে পারব না; কিন' ’৬৮-’৬৯-এ জুয়েলকে লেখাপড়া করতে দেখিনি। আমি যখন সকালে কলেজে যেতাম এবং বিকেলে ফিরতাম, করটিয়া বাজারের সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল রাস-ায় ওকে প্রায় দিনই মকবুলের সাথে ঘোরাফেরা করতে দেখতাম। মকবুল পরে করটিয়া কলেজের জিএস হয়েছিল। জুয়েল কতটা লেখাপড়া করেছিল জানি না। হালকা-পাতলা-শ্যামলার মধ্যে দেখতে বেশ সুন্দর ছিল। চোখ-নাক-মুখ ছিল টানা টানা। ’৬৮ থেকে ’৭১- এ সময়টাজুড়েই আমি জুয়েলকে একইভাবে দেখেছি। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ তারপর স্বাধীনতা। এরপর করটিয়ার সাথে আমার সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ’৭১ থেকে ’৭৫ সালের মাঝে ঠাণ্ডু স্যারের সাথে এক বা দু’বার দেখা হয়েছে। প্রকাশ্যে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করায় তিনি বিস্মিত হতেন। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমার দশাও ছিল তাই। বাপ-দাদার শেখানো তাহজিব-তমদ্দুন ভুলে কখনো বড়দের সাথে বেয়াদবি করতে পারিনি। তা না হলে স্বাধীনতার পর শানি- কমিটির সদস্য খলিল স্যার আমার সাথে দেখা করতে এলে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সদর রাস-ায় তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করায় তিনি জার জার হয়ে কেঁদেছিলেন। কেন এসেছেন জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেছিলেন, ‘যে জন্য এসেছিলাম, তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। মনে করে এলাম তোমার সামনে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইব অথচ তুমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছো, আমি আর কার কাছে ক্ষমা চাইব। আমার যা হওয়ার হবে।’ স্যারকে বলেছিলাম, ‘শানি- কমিটির সদস্য হিসেবে সবার যদি শাসি- হয়, নিশ্চয়ই আপনারও হবে। কিন' তার আগে কেউ আপনাকে অপমান-অপদস' করতে পারবে না।’ কাঁদতে কাঁদতেই স্যার সে দিন বাড়ি ফিরছিলেন। করটিয়া কলেজের বাংলার অধ্যাপক খলিল স্যার ছিলেন নির্বিবাদী ভীষণ ভালো শিক্ষক। কেন তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জেলা শানি- কমিটির সদস্য হয়েছিলেন বা বানানো হয়েছিল, সে রহস্য জানি না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন