রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

যে দেশে প্রাইভেট হসপিটলের দরকার হয় না

ফিদেলের মৃত্যুর সংবাদের পর ফেইসবুকে অনেকের মন্তব্যে মনে হয়েছে বিপ্লব-উত্তর কিউবার অর্জন সম্পর্কে জানাশোনার ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশে। এটা অস্বাভাবিক নয়। জানাবোঝার অনেক উৎসই আমাদের পশ্চিম নির্ভর; আর তারা কিউবা সম্পর্কে পজিটিভ তথ্য দেবে কেন?
কিউবা অনেক ক্ষেত্রেই দুর্দান্ত সফলতা পেয়েছে। আমি এখানে কেবল স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য দিচ্ছি।
প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, কিউবাতে নাগরিকদের সুস্বাস্থ্যের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ফলে সেখানে কিউবানদের জন্য প্রাইভেট হসপিটালের কোন দরকার নেই।
১৯৫৮ সালে বিপ্লবের আগের বছর দেশটিতে ডাক্তার ছিলেন প্রতি দশ হাজার মানুষের জন্য ৯ জন। এখন তা প্রায় ৭০ জন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অন্তত তিনগুন বেশি।কিউবার মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৮ বছর। তৃতীয় দুনিয়ায় এমন অর্জন বিরল। পার্শ্ববর্তী হাইতির চেয়ে তা ৩০ বছর বেশি।নবজাতক মৃত্যুর হারে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও নীচে।জনসংখ্যায় বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ গুন ছোট হবে কিউবা। কিন্তু এখনই ৭০ হাজার মেডিক্যাল গ্রাজুয়েট আছে দেশটিতে। নাগরিক প্রতি ডক্টরের হিসাবে বিশ্বে কিউবার অবস্থান এখন দ্বিতীয়। এসব ডাক্তারদের আবার ২০ শতাংশই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ত্রাণ তৎপরতায় থাকে সবসময়।
ভ্যাকসিন গবেষণার ক্ষেত্রেও কিউবা বিশ্বে সেরা। লাং ক্যানসার থেকে হেপাটাইটিস পর্যন্ত বহু রোগের সর্বাধুনিক ভ্যাকসিন ডেভেলপ করেছে দেশটি।
কিউবার এসব সুবিধা যে কেবল নিজের দেশের মানুষদের জন্য করছে তা কিন্তু নয়।
এ পর্যন্ত ১০৩টি দেশে কাজ করেছে কিউবার অন্তত ১৯ হাজার ডক্টর। যা বিশ্বজুড়ে জি-৮ ভুক্ত সকল তথাকথিত ধনী দেশের সম্মিলিত অনুরূপ সহায়তার চেয়েও বেশি। বিশ্বজুড়ে কিউবার এই চিকিৎসকদের তাই রসিকতার ছলে বলা হয়...‌ #আর্মি #অব #ডক্টর
পশ্চিম আফ্রিকায় কিছুদিন আগে যখন ইবোলা ছড়িয়ে পড়েছিল তখন সবার আগে এবং মূলত ছুটে গিয়েছিল ফিদেলের ‌আর্মি অব ডক্টর। কেবল সিয়েরা লিয়নেই ইবোলা প্রতিরোধে কিউবার ১৬৫ জন ডক্টর পাঠানো হয়েছিল।
এখনো আফ্রিকাতে বিভিন্ন দেশে তাদের দুই হাজার ডক্টর কাজ করছে।পাকিস্তানে ২০০৫-এর ভূমিকম্পের পর কিউবাই প্রথম দু হাজার ডক্টরের একটা দল পাঠায়। এমনকি ত্রাণ কাজ শেষে তারা পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের এক হাজার মেডিক্যাল স্কলারশিপ অফার করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে কিউবাই হলো প্রথম দেশ যারা গর্ভকালীন এইচআইভি সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করতে পেরেছে। স্থাস্থ্য গবেষণায় কিউবার রয়েয়ে ২৪টি ওয়ার্ল্ডক্লাস ইনস্টিটিউট।

চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর সোভিয়ত দেশগুলোর ২০ হাজার শিশুকে কিউবা চিকিৎসা দিয়েছিল। মার্কিন অবরোধের মাঝেও বছরে প্রায় ২০ হাজার বিদেশী কিউবায় যান চিকিৎসার লক্ষ্যে। এরকম মেডিক্যাল ট্যুরিজম এখন দেশটির আয়ের এক বড় খাত হযে উঠছে। এই লক্ষ্য দেশটি তার স্বাস্থ্যখাতকে আরও বিকশিত করছে।কিন্তু তাতে কিউবা বৈশ্বিক দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছে না। গত এক দশকে লাতিন আমেরিকার ১৪টি দেশে কিউবার ৮২টি স্যার্জিকাল টীম অন্তত ৩৫ লাখ মানুষের চোখের চিকিতসা করেছে।এত সফলতাও ছাড়িয়ে গেছে তার Escuela Latinoamericana de Medicina — ELAM প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

১৯৯৯ সালে কিউবা এই মেডিক্যাল স্কুলটি গড়ে তোলে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেডিক্যাল স্কুল। ১১০টি দেশের স্টুডেন্ট পড়ছে এখানে। প্রায় ২০ হাজার স্টুডেন্ট।যুক্তরাষ্ট্রেরও প্রায় শ’খানেক স্টুডেন্ট রয়েছে! হ্যা, দরিদ্র কিউবা এই হবু ডক্টরদের সবাইকে #বিনা #টিউশন #ফিতে পড়ায়। উপরন্তু শিক্ষার্থীদের সামান্য পকেট মানিও দেয়া হয়।

পুনশ্চ:
কিউবার বিপ্লবের বয়স ৫৭ বছরের মতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়সও কাছাকাছি—প্রায় ৪৬ বছর। কিউবা ৫৪ বছর পূর্ণ অর্থনৈতিক অবরোধে থেকেও স্বাস্থ্যখাতে যা করেছে—বাংলাদেশ তার সামান্যও কেন পারলো না?

আসুন, সেটা নিয়ে একটু ভাবা যাক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন