শনিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬

ভারতীয়দের চিন্তায় সার্বভৌম বাংলাদেশ নেই


ভারতীয়রা যে কখনোই বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়নি তার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন উপলক্ষে। স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্যের পেছনেও ভারতীয়দের ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। বাংলাদেশকে ঘিরে ভারতের উদ্দেশ্য ও কৌশল সম্পর্কে নতুন করে কথা বলার কারণ সৃষ্টি করেছেন ভারতেরই বিশিষ্টজনেরা।

নয়াদিল্লিতে বসে তো বটেই, ঢাকায় দাঁড়িয়েও নিজেদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানান দিয়েছেন তারা। প্রথমে দেশটির সাবেক কূটনীতিক এমকে রাজগোত্রার বক্তব্য উল্লেখ করা যাক। কেবলই কূটনীতিক নন, দ্য সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স নামের থিংকট্যাংকেরও সভাপতি তিনি। সুতরাং তার কোনো কথাকে হেলাফেলা করা যায় না। ২০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত খুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, সীমান্ত উন্মুক্ত হলেই নাকি ঢাকা-দিল্লির মধ্যকার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সীমান্তও তিনি সবকিছুর জন্যই উন্মুক্ত করতে বলেছেন। মিস্টার রাজগোত্রার অন্য একটি কথাও যথেষ্ট তাত্পর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার ও জোরদার করার ব্যাপারে বর্তমানে দুই দেশের সরকারই খুব তত্পর রয়েছে।

বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে, একই সময়ে একই ধরনের কথা শোনা গেছে ভারতের অন্য একটি থিংকট্যাংকের পক্ষ থেকেও। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অর্থসাহায্যে পরিচালিত এই থিংকট্যাংটির নাম সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ। এর উদ্যোগে ১৪ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে আয়োজিত এক সেমিনারে ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বলেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে ভারত যা কিছু পাওয়ার আশা করেছিল সেসব পাওয়া শুরু হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরেক দফা ক্ষমতায় থাকলে ভারতের সম্পূর্ণ লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। অশোক মেহতা বলেছেন, একাত্তরের যুদ্ধের সময় আশা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ সৃষ্টি হলে ভারতের পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি শান্ত হবে। কিন্তু সেটা এত বছরেও হয়নি। শেখ মুজিব মারা গেছেন অনেক আগে। এরপর ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনে সমস্যাটা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। তবে এখন (অর্থাত্ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর) পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। আমাদের কমান্ডোরা যৌথ মহড়া চালাচ্ছে। আসামের উলফা বিদ্রোহীদের যৌথভাবে আত্মসমর্পণ করানো হচ্ছে। একেবারে শুরুতে যা কিছু আশা করা হয়েছিল সেসবই পাওয়া যাবে যদি শেখ হাসিনা আরেক মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় আসতে এবং সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।

লক্ষণীয় যে, নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার ব্যাপারে কথায় কোনো ফাঁক রাখেননি এই সাবেক জেনারেল। ভারতের অন্যতম নীতিনির্ধারক হিসেবে পরিচিত বলেই অশোক মেহতার মূলকথাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করা দরকার। লগি-বৈঠার তাণ্ডব থেকে ডিজিটাল নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে এত দিনে সাধারণ মানুষও জেনে গেছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ড এবং ওই হত্যাকাণ্ডকে উপলক্ষ করে ঢাকার তথা শেখ হাসিনা সরকারের ‘সুনির্দিষ্ট অনুরোধের’ পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাউন্টেন ডিভিশনকে নিয়ে আসাসহ আরও অনেক ঘটনা ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়েও প্রমাণিত হয়েছে, ভারত সর্বতোভাবে শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন জোগাচ্ছে। এই সমর্থনের বিনিময়ে শেখ হাসিনার সরকারও একের পর এক সব বিষয়ে ভারতের ইচ্ছা পূরণ করে চলেছে। ট্রানজিটের আড়ালে সড়ক ও নৌপথে করিডোর দেয়া থেকে অশোক মেহতা বর্ণিত যৌথ মহড়ার পাশাপাশি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভারতের হাতে তুলে দেয়া পর্যন্ত সরকারের সব পদক্ষেপের পেছনেই রয়েছে ভারতের ইচ্ছা পূরণের উদ্দেশ্য। একই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে দেশের ভেতরে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিকে নির্মূল করে দেয়ার কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বহু বছর আগে মীমাংসিত বিষয়কে নিয়ে মাতামাতি করার পেছনেও ভারতই রয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরও ভারতীয়রা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। তারা তাই শেখ হাসিনাকে আরও এক মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় আনতে চাচ্ছে। সে ইচ্ছার কথাটাই বেরিয়ে এসেছে জেনারেল অশোক মেহতার মুখ দিয়ে।

এটাও কিন্তু মোটেই নতুন কিছু নয়। কারণ অশোক মেহতার আগে আরও অনেকেই এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন, লিখেছেনও। উদাহরণ হিসেবে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরীর বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ সংখ্যা ‘এশিয়ান এজ’-এ ‘দিল্লি ক্যানট অ্যাফোর্ড টু লেট ঢাকা স্লিপ অব ইটস রাডার’ শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জেনারেল রায় চৌধুরী তার নিজের এবং একই সঙ্গে ভারতেরও প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। তার মতে সার্বভৌম রাষ্ট্র হলেও বাংলাদেশ নাকি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান ‘গ্রেট গেম’-এর অংশ এবং বাংলাদেশকে নিজের কব্জায় রাখাই নাকি সে ‘গ্রেট গেম’-এর উদ্দেশ্য! এটা চলছেও নাকি অনেক আগে থেকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দেয়ার মাধ্যমে ‘গ্রেট গেম’-এর ‘রাউন্ড ওয়ান’ বা প্রথম পর্বে বিজয়ী হলেও নিজের ‘অনুগ্রহপ্রাপ্ত’ শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রাণে বাঁচাতে না পারাটা ছিল ভারতের বড় ধরনের পরাজয়। এর ফলে ‘গ্রেট গেম’-এর ‘রাউন্ড টু’ চলে গিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে। জেনারেল রায় চৌধুরী বলেছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডও ছিল ‘গ্রেট গেম’-এরই সর্বশেষ ‘রাউন্ড’। এর উদ্দেশ্য নাকি ছিল ‘ভারত-বান্ধব’ হাসিনা সরকারের স্থলে ‘পাকিস্তান-বান্ধব’ খালেদা জিয়ার সরকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সর্বশেষ এ রাউন্ডে পাকিস্তান হেরে গেছে, টিকে গেছে শেখ হাসিনার ‘ভারত-বান্ধব’ সরকার। তা সত্ত্বেও আবারও ভারতের পরাজয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন জেনারেল রায় চৌধুরী। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ খুব সহজে এবং বারবার নয়াদিল্লির ‘রাডার’ থেকে সরে যায়। কিন্তু পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর আর ‘রাডার’ থেকে সরে যেতে দেয়া যাবে না বলে কঠোর অভিমত প্রকাশ করেছিলেন ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান। নিজের বিশ্বাস জানাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, নয়াদিল্লি তথা ভারত সরকার অবশ্যই হাসিনা সরকারকে পুরোপুরি এবং চূড়ান্তভাবে সমর্থন করে। নয়াদিল্লি নিশ্চয়ই চায়, বাংলাদেশ যেন আর কখনও নয়াদিল্লির ‘রাডার’ থেকে সরে যেতে না পারে। অর্থাত্ বাংলাদেশে যাতে ‘ভারত-বান্ধব’ তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারই টিকে থাকে এবং আবারও ক্ষমতায় আসতে পারে।

আরও অনেক উদাহরণই দেয়া যায়—যেগুলোর মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হবে জেনারেল শংকর রায় চৌধুরী থেকে জেনারেল অশোক মেহতা এবং সবশেষে এমকে রাজগোত্রা পর্যন্ত প্রত্যেকে আসলে ভারতীয়দের উদ্দেশ্য ও কৌশল সম্পর্কে জানান দিয়েছেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীও ঢাকা থেকে বিদায় নেয়ার আগে তাত্পর্যপূর্ণ কিছু কথাই শুনিয়ে গেছেন। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে পরামর্শের আড়ালে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত ‘নতুন করে’ চিহ্নিত করা দরকার। পিনাক রঞ্জনের কাছে তখন নতুন কিছু ভয়ঙ্কর তথ্যও জানা গিয়েছিল। যেমন তিনি জানিয়ে গেছেন, ‘নতুন করে’ সীমান্ত চিহ্নিত করার বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি দুই বার বৈঠক করেছেন এবং আলোচনাও নাকি ‘এগিয়ে’ রয়েছে। বাংলাদেশকে নাকি যেকোনো সময় ‘সারপ্রাইজ’ দেখতে হতে পারে। বিষয়টি আসলেও ‘চমকে’ ওঠার মতোই। কারণ ‘নতুন করে’ সীমান্ত চিহ্নিত করার ব্যাপারে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে চুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার—এমন তথ্য বাংলদেশের জনগণ এখনও জানতে পারেনি। ওদিকে ভারতের সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমান রাজ্যসভার সদস্য মণি শংকর আয়ারও জনগণকে কম বিস্মিত করে যাননি। গত বছর ২০১০ সালের জুলাই মাসে ভারতের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধি দলকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ সফরকালে মিস্টার আয়ার বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘অর্থনৈতিক সীমারেখা’ রাখার কোনো প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না। ভারতের ব্যাপারে নিজেদের ‘মাইন্ডসেট’ পরিবর্তন করার জন্যও বাংলাদেশের জনগণকে নসিহত করে গেছেন ভারতের এই রাজনীতিক।

এভাবে উদাহরণের সংখ্যা বাড়ানোর পরিবর্তে বলা দরকার, ভারতীয়রা কখনোই বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়নি। ভারতীয়দের পরিকল্পনায় রয়েছে অধিকৃত কাশ্মীরের মতো একটি অঙ্গরাজ্য, বড়জোর নয়াদিল্লির ইচ্ছাধীন একটি রাষ্ট্র। এ জন্যই ঢাকার ক্ষমতায় তারা এমন কাউকে রাখতে চায়, যার নেতৃত্বাধীন সরকার শুধু ভারতের ইচ্ছাই পূরণ করবে। সেদিক থেকে বর্তমান সরকার একশ’ ভাগ ‘ভারত-বান্ধব’ বলেই তারা শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন। সে কথাটাই নতুন পর্যায়ে আরও একবার জানান দিয়েছেন জেনারেল অশোক মেহতা। এদিকে খোদ বাংলাদেশের রাজধানীতে দাঁড়িয়ে এম কে রাজগোত্রা সীমান্ত উন্মুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী। তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার জন্য যা কিছু দরকার তা-ই করতে হবে।

এ তো গেল রাজনৈতিক পর্যায়ে ভারতীয়দের বক্তব্য। ওদিকে সামরিক পর্যায়েও কিন্তু বাংলাদেশের জন্য মধুর কিছু পাওয়া যাবে না। যেমন—এবারের বিজয় দিবসেও ভারতীয়রা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে অসম্মানিত করেছে। চরম অবজ্ঞা দেখিয়েছে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী জনগণের প্রতি। গত ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে যখন বিজয়ের চার দশক উদযাপিত হচ্ছিল, ভারতীয়রা তখন ‘পূর্ব পাকিস্তান বিজয় দিবস’ উপলক্ষে আনন্দ-উত্সবে ফেটে পড়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতীয়রা ১৬ ডিসেম্বরকে ‘পূর্ব পাকিস্তান বিজয় দিবস’ হিসেবে উদযাপন করে আসছে। বিশ্ববাসীকে তারা বোঝাতে চায় যেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ তারাই ‘জয়’ করেছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে জনগণের তো বটেই, মুক্তিবাহিনীরও কোনো ভূমিকা বা অবদান ছিল না। এই প্রচারণার মূলকথা হলো, ভারতীয়রাই ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশীদের হাতে তুলে দিয়েছিল! এ জন্যই ১৬ ডিসেম্বর ভারতের ‘বিজয় দিবস’।

নিজেদের এই তথাকথিত ‘বিজয় দিবস’ সম্পর্কিত প্রচারণায় ভারতের সেনাবাহিনীর লোকজনও প্রথম থেকে সর্বাত্মকভাবে অংশ নিচ্ছেন। সামপ্রতিক উদাহরণ হিসেবে এখানে জেনারেল জ্যাক ফ্রেডেরিক রালফ জ্যাকবের কিছু বক্তব্য উল্লেখ করা দরকার। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে তিনি ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় এসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে আত্মসমর্পণ করানোর আয়োজনে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে দৈনিক প্রথম আলো তার সেদিনের অভিজ্ঞতাভিত্তিক সাক্ষাত্কার প্রকাশ করেছে। ভারতের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানাতে গিয়ে এই জেনারেলও মুক্তিবাহিনী এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন। যেমন—সাক্ষাত্কারে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘তার নেতৃত্বে থাকা ২০ হাজার যোদ্ধা টাঙ্গাইলে পাকিস্তানি সেনাদের হটাতে একটি বুলেটও খরচ করেনি। এমনকি ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে তিনি ঢাকা অভিমুখের যাত্রায় শামিল হননি।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০১১)

অথচ ঐতিহাসিক এবং প্রমাণিত সত্য হলো, স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোয় একমাত্র কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীই দেশের ভেতরে থেকে পুরো সময় যুদ্ধ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় সেনবাহিনীর যে ডিভিশনটি প্রথমে ঢাকায় পৌঁছেছিল এবং পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করিয়েছিল, সে সেনাদের বড় অংশই জামালপুর থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকায় এসেছিল। ভারতীয় ছত্রীসেনাদের বেশির ভাগও টাঙ্গাইলেই নেমেছিল। জামালপুর দিয়ে আগতদের পাশাপাশি বিমান থেকে নামা ছত্রীসেনাদেরও কাদেরিয়া বাহিনীই আশ্রয়, নিরাপত্তা ও সহযোগিতা দিয়েছিল। তাছাড়া গাজীপুরের প্রচলিত পথের পরিবর্তে সাভার হয়ে বিকল্প পথে ঢাকায় আসার পরামর্শটাও ছিল কাদের সিদ্দিকীর। জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন থেকে আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান আয়োজন করা এবং অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াতে কাদের সিদ্দিকী অংশ না নিলে ভারতীয় সেনাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হতো না। কারণ জেনারেল জ্যাকব নিজেও স্বীকার করেছেন, ঢাকায় তখনও ৩০ হাজার পাকসেনা ছিল, অন্যদিকে ভারতের মাত্র হাজার তিনেক সেনা বিভিন্ন দিক থেকে ঢাকার দিকে সবে আসতে শুরু করেছিল। সে অবস্থায় কাদেরিয়া বাহিনীই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু এত দিন পর ভারতীয় জেনারেল কাদের সিদ্দিকীর তথা মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা ও অবদানকে অস্বীকার করেছেন। বলা বাহুল্য, এর পেছনেও রয়েছে একই উদ্দেশ্য। ইহুদি এই জেনারেলও বোঝাতে চেয়েছেন যেন স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী তথা বাংলাদেশের জনগণের কোনো ভূমিকা ছিল না। যা কিছু সবই করেছিল ভারতীয়রা—তারা প্রথমে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ দখল ও বিজয় করেছে এবং তারপর ‘দয়া করে’ বাংলাদেশীদের হাতে স্বাধীন রাষ্ট্র তুলে দিয়েছে!

এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অর্থ সাহায্যে পরিচালিত থিংকট্যাংক সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক অলোক বানশালের দেয়া তথ্য ও ব্যাখ্যাও উল্লেখ করা দরকার। তিনিও অন্য ভারতীয়দের মতোই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ভারতের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ‘ভারতের বিজয়ে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা’ শিরোনামের নিবন্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে অলোক বানশাল লিখেছেন, মুক্তিবাহিনী নিশ্চিত হয়েছিল যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিভিন্নস্থানে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছে। এ সময় পাকবাহিনী অনেকটা সাহস হারিয়ে ফেলে। যুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী স্থানীয় জনসাধারণকে সহায়তা করত। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন সময়ে মানচিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করত। মুক্তিবাহিনী দেশের বিভিন্নস্থানে যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীকে যানবাহন দিয়েও সহযোগিতা করেছে।’ লক্ষণীয় যে, ভারতের এই প্রতিরক্ষা গবেষকও মুক্তিবাহিনীর ভূমিকাকে শুধু খাটোই করেছেন। তিনিও বোঝাতে চেয়েছেন যেন দেশ স্বাধীন করে দিয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সে বাহিনীকে সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ ভূমিকা!

এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল্যায়ন থেকে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়ার নসিহত পর্যন্ত সবকিছুর মধ্য দিয়েই ভারতীয়রা বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মনোভাব ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানান দিয়ে চলেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আনুগত্যই যে ভারতীয়দের জন্য প্রশ্রয়ের কারণ হয়ে উঠেছে সে কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন