রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

ভারতে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকা বড় কারণ দেশের চিকিৎসাসেবায় আস্থার অভাব

বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ক্রম উন্নত হচ্ছে, তবে এর চেয়ে দ্রুতগতিতে উন্নত হচ্ছে প্রতিবেশী ভারতের চিকিৎসাব্যবস্থা। ফলে মেডিক্যাল ট্যুরিজমে এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ হয়ে ওঠা ভারতে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক রোগী যাচ্ছে।সংশ্লিষ্টরা বলছে, দেশের চিকিৎসাসেবায় আস্থার অভাব ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে প্রতিবছর ছয় লাখ থেকে সাত লাখ লোক বাংলাদেশ থেকে শুধু ভারতে যায় চিকিৎসাসেবা নিতে। এতে বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

দেশের চিকিৎসাসেবা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানী উত্তরার বাসিন্দা তাবাসুম রিমা কালের কণ্ঠকে বলেন, “আমার হাত-পায়ে পানি আসে, পা ফুলে যায় এবং কোমরে ব্যথা। এসব সমস্যা নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি, বারবার ডাক্তারদের কাছে গেছি, কিন্তু কেউ কোনো সমস্যা চিহ্নিত করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে আমি গত জুলাই মাসে ভারতে একটি হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। ওই হাসপাতালে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানতে পারি আমার শরীরে ‘ভিটামিন-ডি’ ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে আমি অনেকটা সুস্থ। ”

খুলনার বাসিন্দা রোজি হোসেনের সঙ্গে দেখা হয় কলকাতার একটি হাসপাতালে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ডাক্তারদের কাছে গেলে শুধু প্রেসক্রিপশন ভর্তি টেস্ট এবং ওষুধ লিখে দেন,  কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায় না। এমনকি তিনি চিকিৎসকের লেখাপড়া নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি দারুণ অনাস্থার কথা জানান এই রোগী। তাঁর মতো মফিজুর রহমানও সম্প্রতি কেয়ারিং ইন্ডিয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কলকাতায় যান ফিস্টুলা অপারেশন করতে। তিনি বলেন, দেশের ডাক্তারদের ওপর ভরসা করতে পারছি না, তাই এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি।

এরপর অবাক হওয়ার মতো তথ্য দিলেন কলকাতা বেলভিউ ক্লিনিকের মেডিসিনের ডাক্তার ডা. রাহুল জৈন। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশে তাঁর প্রায় ১০ হাজারের বেশি রোগী রয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত বলেও তিনি মনে করেন। তার পরও রোগীরা এখানে কেন আসে তা বুঝতে পারছেন না।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এবং ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী এবং সমসংস্কৃতির দেশ হওয়ায় প্রতিবছরই দেশটিতে রোগী যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। তিনি জানান, প্রতিবছর ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ লোক ভারতে যায়। এর মধ্যে ২০ শতাংশ চিকিৎসা ভিসা নিয়ে যায়, তবে প্রকৃত অর্থে চিকিৎসার্থে যাওয়া লোকের সংখ্যা কমপক্ষে ৬০ শতাংশ হবে। অন্যরা টুরিস্ট ভিসা নিয়ে ভারত যায় বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, ভারতে চিকিৎসাসেবা বিশ্বমানের। বিশ্বের সব অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম তাদের হাতের নাগালে থাকায় সেখানকার চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত এবং একই সঙ্গে সাশ্রয়ী।

তবে বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা এখন যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। এই সেবা এখন মফস্বল পর্যন্ত বিস্তৃত। যারা ভারতে যায় তারা মেডিক্যাল ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানগুলোর প্ররোচনায় পড়ে যায়। কারণ চিকিৎসাসেবা এখন ব্যবসানির্ভর হয়ে পড়েছে। ওই সব দেশের প্রতিষ্ঠিত হাসাপাতালগুলোর বাংলাদেশে নিজস্ব অফিস আছে। তারা কমিশনের জন্য রোগীকে প্ররোচিত করে বিদেশে নিয়ে যায়। বাংলাদেশের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, ৪০ শতাংশ রোগীই যায় প্রয়োজন ছাড়া। এটি বেশি দিন থাকবে না, সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখন উপচেপড়া ভিড়। অভিযোগ আছে, চিকিৎসকরা রোগ চিহ্নিত করতে না পারায় রোগীরা বাধ্য হয়ে ভারতে যায়। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের সঠিক তথ্যের ঘাটতি রয়েছে এবং সঠিক জায়গায় না যাওয়ার কারণে তাদের এমনটি হতে পারে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের পিএসআরআই হাসপাতালের পরিচালক ডা. দিপাক শুকলা কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বমানের প্রযুক্তি ছাড়া বিশ্বমানের সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। আর ভারতের সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি এবং দক্ষ কর্মী থাকায় দিন দিন মেডিক্যাল পর্যটক বাড়ছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতের মোট মেডিক্যাল পর্যটকের মধ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রায় ২২ শতাংশ।

দিপাক শুকলা আরো বলেন, মেডিক্যাল ট্যুরিজমের বর্তমান বিশ্ববাজার প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার। আর এতে ভারতের হিস্যা বাংলাদেশের টাকায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এ বাজারে বাংলাদেশের অবদান ২২ শতাংশ। তার মানে বাংলাদেশিরা প্রতিবছর ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিজমে খরচ করে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তিনি জানান, প্রতিবছর বিশ্বে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে মেডিক্যাল টুরিজমের বাজার বাড়ছে।

তবে ভারতের মেডিক্যাল ট্যুরিজমের বাজার নিয়ে প্রফেশনাল সেবা নেটওয়ার্ক গ্র্যান্ট থর্টনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ভারতের মেডিক্যাল ট্যুরিজমের বাজার ৩০০ কোটি ডলারের। ২০২০ সালে নাগাদ এই বাজার হবে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের মেডিক্যাল ট্যুরিজম খাতে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান। এ দুই দেশের যৌথ অবদান ৩৪ শতাংশ। এর পাশাপাশি আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অবদান এই খাতে ৩০ শতাংশ। বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেডিক্যাল গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে চেন্নাই, মুম্বাই, এপি ও এনসিআর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন