শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬

ভরাট হওয়া পদ্মা অববাহিকায় ‘গঙ্গা ব্যারেজের’ কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন

বাংলাদেশে পদ্মা নদীর উপর ‘গঙ্গা ব্যারেজ’ নির্মাণে ভারতের হঠাৎ রাজি হওয়া নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া পদ্মায় বর্তমান প্রস্তাবিত স্থানে এর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ তৈরির ৪০ বছর পর যখন পদ্মার ধারণক্ষমতা ব্যাপক হ্রাস পেয়ে জীর্ণ-শীর্ণ দশা দাঁড়িয়েছে সেসময় এই ব্যারেজ কী মাত্রায় কাজে আসবে সে প্রশ্নে উত্তর মিলছে না। উল্লেখ্য, ৬০ ও ৯০-এর দশকে এই ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েও ভারতের আপত্তির মুখে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।

ফারাক্কা বাঁধ তৈরির ৪০ বছর পর গঙ্গা বাঁধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যখন বাংলাদেশ এই বাঁধ করতে চেয়েছিলো ভারত তখন বাধা দিয়েছিলো। পদ্মা নিজে মরে গেছে, এর শাখা-প্রশাখা-উপশাখাগুলো ভরাট হয়ে পানি ধারণের যোগ্য হয়ে নেই। পানি সংরক্ষণের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। বাংলাদেশের ভেতরে আরেক ফারাক্কা তৈরি হতে যাচ্ছে কি না সে প্রশ্নও উঠছে। পদ্মার পানি ধরে রেখে কৃষি কাজে লাগানোর লক্ষ্যে বড়াল নদীর মুখে বহুল আলোচিত ‘বড়াল রেগুলেটর’ নির্মাণ করা হয় রাজশাহীর চারঘাটে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো যে, এই রেগুলেটর এখন বিষফোঁড়ার মতো হয়ে গেছে, বড়াল নদীর পুরোটাই হেজেমজে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একে তো ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পদ্মা নদীকে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তার উপর বর্তমান প্রস্তাবিত স্থানে এই ব্যারেজ নির্মাণও একেবারে যুক্তিহীন। তাঁদের মতে, এতে অর্থ ও পরিবেশের অপচয়ই কেবল বাড়বে।
গঙ্গা ব্যারেজ আবার আলোচনায় : পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলায় হাবাসপুরে (নদীর ডান তীর) গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ করা হবে। গঙ্গা অববাহিকার পানি সংরক্ষণ করে তা দেশের কৃষিসহ বহুমুখী কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে এই ব্যারোজ নির্মিত হবে বলে বলা হচ্ছে। গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গঙ্গা ব্যারজ নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পটিকে গুরুত্ব দেয়া না হলেও গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ আর মাত্র ১০ বছর বাকি থাকায় সরকার এ ব্যারেজ নির্মাণে উদ্যাগী হয়ে উঠেছে। কেননা, এর নির্মাণে ৭ বছরের বেশি সময় লাগবে। এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় ১১৭ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ব্যারেজের ওপর যে ব্রিজ করা হবে, সেখান থেকে টোল আদায় করা হবে। এ দু’টি উৎস থেকেই মোট বিনিয়োগের এক-চতুর্থাংশ ফেরত আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া প্রায় ১৭টি জেলায় কৃষি ও সেচের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা থেকেই উঠে আসবে বাকি বিনিয়োগ। সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শুরু হয়। নানা জটিলতার পর ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালে সমীক্ষার কাজ শেষ হয়। লক্ষ্য অনুযায়ী পদ্মার শাখা গড়াই, হিসনা, চন্দনা ও জিকে পাম্পের জন্য ৭শ’ কিউবিক মিটার, গড়াই হাইড্রোপাওয়ারের জন্য ৩শ’ কিউবিক মিটার এবং গঙ্গা ব্যারেজের জন্য ১ হাজার কিউবিক মিটার মোট ২ হাজার কিউবিক মিটার পানি গঙ্গানির্ভর এলাকাসমূহে পৌঁছে দেয়া হবে। এই পানি পৌঁছানো হবে ব্যারেজের দুই পাশের আটটি সংযোগ খালের মাধ্যমে শুষ্ক মওসুমে। বহুমুখী এ প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হবে ২ কিলোমিটার ও প্রস্থ হবে ১৮ মিটার। এতে থাকবে বর্ষা মওসুমের পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার। আরো থাকবে নেভিগেশেন লক, স্লুইস গেট, ২৫ মিটার করে দু’টি ফিশ পাস গেট, ব্রিজ, রেলওয়ে ও গ্যাস পাইপ লাইন। মূল ব্যারেজ নির্মাণ করতে ৩ বছর লাগলেও পুরো প্রকল্প শেষ হতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৭টি জেলা- যা দেশের মোট এলাকার ৩৭ শতাংশ গঙ্গার পানির ওপর নির্ভরশীল। দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এ অঞ্চলে বসবাস করে। কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধিকল্পে ১৯৭৫ সালে গঙ্গা নদীতে প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হলে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গঙ্গার পানিপ্রবাহ হ্রাস পেতে থাকে। ফলে এই ১৭টি জেলার কৃষি, মৎস্য চাষ, বন, নৌ চলাচল এবং নদীর পানির স্বল্পতার জন্য পলি অপসারণে সমস্যা দেখা দেয়। একই সঙ্গে এ অঞ্চলে নদীতে সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে পড়ছে এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেই ক্ষতির খানিকটা পুষিয়ে নিতেই একটি ব্যারাজ নির্মাণ করার এই উদ্যোগ। বলা হচ্ছে, গঙ্গা ব্যারেজ নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পাবনা এবং রাজশাহী বিভাগের ১৭টি জেলার ১৯ লাখ হেক্টর কৃষিজমির সেচের পানি সুনিশ্চিত হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত হবে বর্ষা মওসুমে প্রবাহিত পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ ধরে রাখা, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রসার। কর্তৃপক্ষের দাবি, ব্যারেজ থেকে উজানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাকা এলাকা পর্যন্ত ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকবে বিশাল রিজার্ভার। যার পানি ধারণক্ষমতা থাকবে ২৯০০ মিলিয়ন মিটার কিউব। এই পরিমাণ পানি থেকে ব্যারেজের মাধ্যমে শুষ্ক মওসুমে ২ হাজার মিলিয়ন কিউসেক পানি সরবরাহ করা হবে। ব্যারেজের দুই পাশের আটটি সংযোগ খালের মাধ্যমে শুষ্ক মওসুমে এই পানি ছাড়া হবে। এর ফলে গঙ্গানির্ভর ১৬টি নদী শুষ্ক মৌসুমে ফিরে পাবে নাব্যতা। সেইসাথে গঙ্গা অববাহিকার ৫১ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ১৯ লাখ হেক্টর জমি সরাসরি সেচের আওতায় চলে আসবে। এই ব্যারেজ থেকে আয় হবে প্রতি বছর ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। দীর্ঘমেয়াদে এই আয় আরো বৃদ্ধি পাবে। 
অর্ধ শতাব্দীর গঙ্গা ব্যারেজ : ভারতের বাধা : একজন পানি বিশেষজ্ঞ জানান, ১৯৫৯ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তির পর ১৯৬২-৬৩ সালেই গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়ে প্রথম জরিপ হয়। পরে ১৯৬৮-৬৯ সালে আরেকটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এজন্য একটি সমীক্ষাও চালানো হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদা ‘মেজর প্রজেক্ট অন দ্য গ্যাঞ্জেস’ শীর্ষক এই সমীক্ষা চালায়। ওই সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে ৪ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করে ১৯৭০ সালে তৎকালীন সরকার গঙ্গা ব্যারেজের প্রাথমিক কাজের জন্য ৫ কোটি রূপি বরাদ্দ করে। হার্ডিজ ব্রিজের আড়াই মাইল ভাটিতে এই ব্যারেজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করার পর ১৯৭৪ সালে গঙ্গা ব্যারেজ সার্কেল গুটিয়ে ফেলা হয়। জানা যায়, ১৯৯৯ সালে ওয়ারপো এবং যৌথ নদী কমিশন ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে একাধিকবার তাগিদ দেয়। ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি এন্ড ডিটেইল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ফর গ্যাঞ্জেস ব্যারেজ প্রজেক্ট’ নামক এই প্রকল্পটি চারদলীয় জোট শাসনামলে ২০০৫ এর ১৮ এপ্রিল অনুমোদিত হয়। ডেভেলপম্যান্ট এন্ড ডিজাইন কনসালট্যান্ট নামক একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান এই ব্যারেজ নির্মাণে চূড়ান্ত সমীক্ষা পরিচালনার কাজটি করে। এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও চীনের বিশেষজ্ঞরাও জড়িত ছিলেন। সমীক্ষা বাবদ ব্যয় হয় ৪০ কোটি টাকা। এসময় এক বিকল্প প্রস্তাবে ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে যোগিঘোপা ব্যারেজ করে ২০০ মাইল লম্বা খালের মাধ্যমে ১ লাখ কিউসেক পানি নিয়ে ফারাক্কার উজানে গঙ্গায় ফেলার কথা বলেছিলো। আধা মাইল চওড়া এই সংযোগ খালটির গভীরতা ধরা হয়েছিল ৩০ ফুট। শুষ্ক মওসুমে যেখানে ব্রহ্মপুত্রে ১ লাখ ৩০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকে সেখান থেকে ১ লাখ কিউসেক পানি নেয়া হলে এই নদীর অবস্থা গঙ্গার চেয়েও ভয়াবহ হবে এটা আঁচ করতে পেরেই ওই সময় ভারতীয় প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। 
১৯৯৬ সালে ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানি চুক্তি সম্পাদিত হবার পর সরকার গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আগামী ২০২৬ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এরপর দু’দেশের সম্মতিতে চুক্তিটি নবায়ন করার কথা রয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- এই পরিমাণ পানি ভারত বাংলাদেশকে দেয় না এবং চুক্তির গ্যারান্টি ক্লজ পর্যন্ত মেনে চলে না। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শুষ্ক মওসুমে গঙ্গা নির্ভর নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। দেখা দেয় মরুময়তা। পরিবেশেও এর বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়।
এর আগে ভারত এই প্রকল্পটিতে সম্মতি না দেয়ায় তা ঝুলে থাকে। নয়াদিল্লি বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে জানায়, ভারতের কারিগরি বিশেষজ্ঞরা ঢাকার পাঠানো প্রকল্প নথিপত্র যাচাই করে এই ড্যাম ভারতে বন্যা সৃষ্টি করবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করে। গঙ্গা পশ্চিমবঙ্গের সমতল ভূমি দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতীয় চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, নদীটির পানির স্তর সামান্য বাড়লেও বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন ভারতের বিপুল এলাকা ডুবে যাবে। ঢাকাকে বৈজ্ঞানিক মডেলসহ পুুরো সমীক্ষা প্রতিবেদন পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে নয়াদিল্লি বলে, তারা নিশ্চিত হতে চায়, ড্যামের ফলে ভারতীয় ভূখ-ে পানির উচ্চতা বাড়বে না। ভারত যেসব নথিপত্রের জন্য অনুরোধ করেছিল, বাংলাদেশ সেগুলোর সবই পাঠায়। দীর্ঘদিন ভারত এবিষয়ে চুপচাপ থাকলেও হঠাৎ করেই এই প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহী উঠে তারা। এবারের বন্যায় বিহারের ব্যাপক ক্ষতির জন্য সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী নিশিত কুমার ফারাক্কা বাঁধকে দায়ী করেন এবং এই বাঁধ ভেঙে দেবার দাবি তোলেন। বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এতে বিব্রত হয় ভারত। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে সান্ত¡না দেয়ার জন্যই গঙ্গা ব্যারেজের প্রতি আগ্রহী হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। ফারাক্কার কারণে পদ্মার তলদেশ ভরাট হয়ে যাবার ফলে এতো পানির ধারণক্ষমতা নেই- এটি সর্বমহলই জ্ঞাত। এখন ব্যারেজ নির্মিত হলে কোথায় পানি রাখা হবে তারও হিসেব নেই। জানা গেছে, গত ৪০ বছরে বাংলাদেশে পদ্মার তলদেশ ১৮ মিটার ভরাট হয়ে গেছে। এক সময় যে পদ্মা ২৫ লাখ কিউসেক পানি ধারণ করতে পারতো এখন তা ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। 
ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সাইট পরিদর্শন : ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশনের ডিরেক্টর ভুপাল সিংয়ের নেতৃত্বে ভারতীয় ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৭ অক্টোবর পাংশায় পদ্মা নদীতে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের সাইট পরিদর্শন করেন। এসময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পশ্চিম অঞ্চল ফরিদপুরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলীসহ প্রকৌশলীরা উপস্থিত ছিলেন। পদ্মা নদীর হাবাসপুর ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে ভারতীয় প্রতিনিধিদল প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় ধরে নদীতে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের সাইট পরিদর্শন করেন। এ সময় পদ্মা নদীর পাংশা ও পাবনা সীমান্তের মাঝে জেগে ওঠা চরে নেমে ভারতীয় প্রতিনিধিদল পদ্মার মূল চ্যানেলসহ বিস্তৃত পদ্মা নদী ও গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের সাইট পর্যবেক্ষণ করেন।
ব্যারেজের স্থান নিয়ে বিতর্ক : এদিকে বাংলাদেশে গঙ্গা ব্যারেজের স্থান রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলায় নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, এই স্থানে এই ব্যারেজের স্থান নির্ধারিত হলে পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এই প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে, পাংশায় প্রকল্পটি হলে কেবল বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল সুবিধা পাবে। বরং পূর্ব নির্ধারিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে এই বাঁধ হলে সংরক্ষিত পানি অনেক বেশি কাজে লাগানো সম্ভব হবে। পূর্ব নির্ধারিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মিত হলে সংরক্ষিত পানি একাধারে পদ্মা, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, ইছামতি, কুমার প্রভৃতি নদীকে নাব্য রাখতে সহায়ক হবে। এই সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের আরো অনেক বেশি এলাকা প্রকল্পের আওতায় আসবে। ফারাক্কার মরুকরণজনিত প্রক্রিয়ার কবল থেকে অনেক বেশি এলাকা রক্ষা পাবে। অন্যদিকে, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে অনেক ভাটিতে পাংশায় প্রকল্প হলে স্বল্প এলাকা প্রকল্পভুক্ত হতে পারবে। আর যেহেতু পাংশা থেকে অল্প দূরত্বে পদ্মা নদী যমুনায় মিলিত হয়েছে, সেহেতু সংরক্ষিত পানির অপচয় ঘটবে। এর পাশাপাশি পদ্মার শাখা নদীগুলোও নাব্যতা ফিরে পাবার সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত : বিশিষ্ট পানি প্রকৌশলী, পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ইঞ্জিনিয়ার ম. ইনামূল হককে গতকাল শনিবার এবিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, রাজবাড়ির পাংশায় গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের কোন যৌক্তিকতা আদৌ নেই। এখানে ব্যারেজ হলে তা কেবল ফরিদপুর অঞ্চলের কাজে লাগতে পারে। যদিও সেই অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে। তিনি জানান, পরামর্শ ছিলো- হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছাকাছি স্থানে এটি নির্মাণ করা হোক। তাহলে আরো অনেক বিস্তৃত অঞ্চল এর আওতায় আসতে পারবে। তিনি বলেন, পদ্মার বুক ভরাট হয়ে আছে। পানির প্রবাহ মন্থর হবার ফলে প্রতিনিয়ত পলি জমে চলেছে। পানির গতি না থাকলে এই পলিও অপসারিত হবে না। আর ড্রেজিং কাজও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। পদ্মার শাখা-প্রশাখাগুলোকে নাব্য করার উদ্যোগ নিলে পানির রিজার্ভ বৃদ্ধি পেতে পারতো। 
নদী বিষয়ে সরেজমিন পরিদর্শন ও গবেষণা করেন গ্রন্থকার মাহবুব সিদ্দিকী। হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রখ্যাত বৃটিশ প্রকৌশলী উইল কক্স ছিলেন বিখ্যাত আসোয়ান বাঁধের ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বলেছিলেন ফারাক্কা বাঁধ ‘ফারাক্কা’ নামক স্থানে করা ভুল হয়েছে। মাথাভাঙা নদীর প্রবেশ দ্বারে এই বাঁধ করা হলে তা উভয় দেশের জন্যই সমভাবে উপকারী হতো। গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, বর্তমানে যে স্থানে গঙ্গা ব্যারেজ করার কথা বলা হচ্ছে সেটা হলে তা ফারাক্কার মতোই ভুল স্থানে করা হবে। এখন এটি বরং মাথাভাঙা নদীর ৩/৪ কিলোমিটার ভাটিতে হিসনা নদীর উৎসমুখে করা হলে বেশি উপকৃত হবার সুযোগ আছে। সারা বছর পানি থাকে এমন ২০টির মতো বিল আছে কুষ্টিয়া অঞ্চলে। এগুলোকে রিজার্ভার হিসেবে কাজে লাগানো যেতো। তিনি বর্তমান স্থানে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণকে অপরিকল্পিত ও অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করেন। এর ফলে বাংলাদেশের ভেতরে আরেকটি ফারাক্কার জন্ম দেয়া হচ্ছে কি না সে প্রশ্ন তোলেন। মাহবুব সিদ্দিকীর মতে, ফারাক্কা বাঁধের পর গত ৪০ বছরে বাংলাদেশে পদ্মার তলদেশ ১৮ মিটার ভরাট হয়েছে। এক সময় যে পদ্মা ২৫ লাখ কিউসেক পানি ধারণ করতে পারতো এখন তা ৫০ ভাগে নেমে এসেছে। পানির ধারণ ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। অন্যদিকে পদ্মার পানিতে সদা প্রবহমান থাকতো এমন শাখাগুলোও মরে হেজে-মজে গেছে। সেগুলোর ধারণ ক্ষমতা নেই বললেই চলে। বড়াল, গড়াই, মাথাভাঙা, মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাভাঙ্গা, গড়াই, আত্রাই, চিকনাই, হিনসা, কুমার, সাগরখালি, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ পদ্মার ৮৫টি শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য চর। কোনো কোনো স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রূপ নেয়ায় ফসল আবাদ করেছেন অনেকেই। বর্তমানে পদ্মা নদীর দীর্ঘ চর এলাকায় নানা রকম ফসলের আবাদ করছেন কৃষকরা। এসব শাখা-প্রশাখায় নাব্যতা ফিরিয়ে এনে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়েও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
অন্যদিকে পর্যবেক্ষকদের একটি মহল বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত গঙ্গা বাঁধকে সমর্থন করতে পারে দুই কারণে- এক. গঙ্গা বাঁধের সুফল-কুফল যাই হোক, গঙ্গার পানি বণ্টন সংক্রান্ত বাংলাদেশের দাবি এর ফলে দুর্বল হয়ে পড়বে, দুই. শুরু থেকে ভারত বলে আসছে গঙ্গার পানির অংশ দাবি না করে বাংলাদেশের উচিত তার বর্ষা মওসুমের পানি সংরক্ষণ করে কাজে লাগানো। গঙ্গা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ অবশেষে ভারতের এ দাবির প্রতিই সমর্থন করছে কিনা তা চিন্তা করা দরকার। এই সাথে তারা তুলছেন, গঙ্গা অববাহিকার বর্তমান অবস্থায় গঙ্গা বাঁধ-এর অকার্যকারিতা নিয়ে। আমাদের তিস্তা বাঁধসহ আমাদের অকেজো হয়ে পড়েছে ভারতের পানি নীতির কারণে। তাদের মতে সবদিক বিবেচনা করেই গঙ্গা বাঁধ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়া উচিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন