বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬

ট্রাম্প নন, পুতিনই খেলবেন

যা ধারণা করা হচ্ছিল, তা-ই হচ্ছে। ট্রাম্প ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে খামোখা কিছু কথা বলা হচ্ছে। মুসলিম বিশ্ব ট্রাম্পের মতো মানুষের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে, যিনি মুসলমানদের ব্যাপারে ভীত। হ্যাঁ, তা ঠিক, ট্রাম্প এ রকমই একজন মানুষ। তিনি নিজের দেশ ও জনগণের জন্য অসম্মানজনক, কিন্তু তাঁরা এ ব্যক্তিকেই নির্বাচিত করেছেন।

তবে এ কথা বললে আমাদের ভয় একটু কমতে পারে। ব্যাপারটা হচ্ছে এই—মার্কিনদের বোকামি ও অযোগ্যতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান এত কমে গেছে যে, তাদের ক্ষমতার ওপর আরব বিশ্বের বিশ্বাস খুব কম। আমি বরং সন্দেহ করি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি খুব কম গুরুত্ব দেওয়া হবে।

সন্দেহ নেই, ট্রাম্প খুব শিগগির মধ্যপ্রাচ্যে হাজির হবেন। তিনি নির্ঘাত ইসরায়েলকে তোষামোদ করবেন আর বলবেন, যুক্তরাষ্ট্র সর্বোতভাবেই ইসরায়েলকে সমর্থন করে। উপসাগরীয় অঞ্চলের ধনী অভিজাত ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করবেন, তাঁদের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা হয়েছে
মার্কিনদের শাসনব্যবস্থা কখন ধসে পড়তে শুরু করল, আমি ঠিক নিশ্চিত নই। ১৯৫৬ সালে আইজেনহাওয়ার যখন ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইসরায়েলিদের সুয়েজ খাল থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন, তখন তাদের ক্ষমতা একদম তুঙ্গেই ছিল। একজন নরওয়েজীয় কূটনীতিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সম্পর্কে কথা বলতে গেলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মার্কিন অর্থনীতিবিষয়ক একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিতে শুরু করেন। আবার বিল ক্লিনটনের মিডল ইস্ট ‘পিস’ও হালে তেমন একটা পানি পায়নি।
আমি ধারণা করি, জর্জ ডব্লিউ বুশই আফগানিস্তানে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদিও কোনো আফগান যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করেননি। তিনি সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরাকে শিয়াদের ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এতে সৌদি আরব অনেকটাই বিরক্ত হয়েছিল। আবার সৌদি আরব (৯/১১-এর ১৯ জন হামলাকারীর মধ্যে ১৫ জনই সৌদি নাগরিক) ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিন্দুমাত্র উদ্বেগও নেই বললে চলে।
আর ওবামা তো প্রতি ক্ষেত্রেই মধ্যপ্রাচ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। কায়রোতে তিনি ইসলামের সঙ্গে সদ্ভাব পাতাতে গেলেন; তাঁর নোবেল পুরস্কার, সিরিয়ায় ‘সীমা’—এসবই বালুতে হারিয়ে গেল, যখন রুশরা তাঁকে উদ্ধার করতে এলেন। এখন তো ভ্লাদিমির পুতিনের মিগসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র ভয়ংকর সিরীয় যুদ্ধের মধ্যে শান্তি স্থাপন করছে। আর যেসব দেশে মানবাধিকারের বালাই নেই, সেখানে পুতিনের সম্পর্কে তেমন কোনো গুঞ্জনও নেই। ফিল্ড মার্শাল আল-সিসি তো পুতিনকে কায়রোর অপেরায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
এটাই কথা। পুতিন কথা বলেন, আবার কাজও করেন। তিনি খুব ভালো বক্তা নন। আর তাঁর আচরণ যতটা ব্যবসায়ীর মতো, ততটা রাজনীতিকের মতো নয়। ট্রাম্প কথা বলেন, তা ঠিক। কিন্তু তিনি কি কাজ করতে পারেন? ট্রাম্পের সঙ্গে পুতিনের অদ্ভুত সম্পর্কের ব্যাপারটা দূরে রাখতে চাইলে রাখতে পারেন। কিন্তু ট্রাম্প মনে করেন পুতিনের সঙ্গে তাঁর সে রকম সম্পর্ক আছে।
কথা হচ্ছে, ট্রাম্পকে পুতিনের কথা বুঝতে হবে, এর উল্টোটা নয়। বস্তুত, আমি মনে করি, ট্রাম্পের জমানায় আরব ও ইসরায়েলিরা পুতিনের কথা বেশি করে শুনবেন। বিষয়টা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য এখন আর যুক্তরাষ্ট্রকে নির্ভরশীল মনে করে না, যার অবস্থান প্রায়ই পরিবর্তিত হয়। ঠিক যেমন ১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল।
এমনকি পুতিন সিরিয়ায় বোমারু বিমান পাঠানোর আগ পর্যন্ত আইএসের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের হামলাও ততটা কার্যকর হয়নি। যে সময় অনেক আরবই ভাবছিলেন, ওয়াশিংটন কেন এদের ধ্বংস করতে পারছে না। এবার আরব বসন্তের প্রসঙ্গে আসি। তখনো আমরা দেখেছি, বারাক ওবামা ও তাঁর অসহায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সব তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। তাঁরা এটা বুঝতেই পারেননি যে এই বিশাল গণজাগরণ বাস্তব ব্যাপার, আর স্বৈরশাসকদের যেতে হবে (অন্তত অধিকাংশকেই যেতে হয়েছে)। ২০১১ সালে কায়রোর প্রসঙ্গে ওবামা যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন তা হলো, মিসরের রাজধানী থেকে মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া।
এ কথা বলা সহজ, একজন ইসলামভীত মানুষের মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ায় আরবরা মর্মাহত। কিন্তু তাঁরা কি ভেবেছেন, ওবামা ও তাঁর পূর্বসূরিদের কারও মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ অনুরক্ততা ছিল কি না? তা সে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যা-ই হোক না কেন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ রকম: একের পর এক যুদ্ধ, বিমান হামলা ও পলায়নের এক দৃষ্টি আকর্ষক পুনরাবৃত্তি। রাশিয়ার নীতিও ধ্বংসাত্মক ছিল। কিন্তু সোভিয়েত-উত্তর যুগে দেশটি হাত-পা গুটিয়ে নেয়, সিরিয়ায় পুতিনের সেনা পাঠানোর আগে পর্যন্ত।
সন্দেহ নেই, ট্রাম্প খুব শিগগির মধ্যপ্রাচ্যে হাজির হবেন। তিনি নির্ঘাত ইসরায়েলকে তোষামোদ করবেন আর বলবেন, যুক্তরাষ্ট্র সর্বোতভাবেই ইসরায়েলকে সমর্থন করে। উপসাগরীয় অঞ্চলের ধনী অভিজাত ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করবেন, তাঁদের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুতিন–সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সিরিয়া সম্পর্কে তিনি আকর্ষণীয় কথা বলবেন। কিন্তু সম্ভবত তিনি এ অঞ্চলকে ভৃত্য, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভাইস প্রেসিডেন্টদের হাতে ছেড়ে দেবেন, যাঁদের ভাবতে হবে—এই ব্যক্তি আসলে কী ভাবেন। অবশ্যই, আমাদের বর্তমান অবস্থাও এ রকম। ট্রাম্প কী মনে করেন? অথবা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, তিনি কি আসলেই কিছু মনে করেন (চিন্তা করেন)?

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন