মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর, ২০১৬

শহীদুল্লাহ কায়সারের নির্বাচিত কলাম: ঊনসত্তর থেকে একাত্তর।


এক. ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ যেমন ইসলাম, মুসলমান ও পাকিস্তানের নামে একটা উন্মাদনা সৃষ্টি করে কানা-ল্যাংড়া-খোঁড়াদের পাশ করিয়ে নিয়েছিল, ঠিক সেই কৌশল অনুসরণ করে আওয়ামী লীগও বাংলা, বাঙ্গালী তথা জয়বাংলার ধ্বনিকে তেমনি উন্মাদনার স্তরে নিয়ে যাচ্ছেন, যেখানে তারা শতকরা শতভাগ ভোট দাবী করছেন। তাদের প্রত্যেকটি ইশতেহারে, বক্তৃতায় তারা একটা কথার উপরই জোর দিচ্ছেন। সেটা হল, আগামী নির্বাচন হবে স্বায়ত্ত্বশাসনের উপর রেফারেন্ডাম। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার অর্থ স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে ভোট দেওয়া তথা বাংলার পক্ষে ভোট দেওয়া। এই দাবীর ভিত্তিতেই তারা দেশবাসীর কাছ থেকে প্রত্যেকটি ভোট চাইছেন এবং বলছেন প্রত্যেক সিটে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকেই জয়যুক্ত করতে হবে।
জয় বাংলা ধ্বনিকে ঠিক পাকিস্তান ধ্বনির মত চরম উন্মাদনায় তুলে নিয়ে শতকরা শতভাগ সিট পাবার আশা তারা রাখছেন এবং ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের কৌশল অনুসরণে সমালোচকদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। অনেকেই সেদিন মুসলিম লীগের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল কি তার অর্থনৈতিক কর্মসূচী? পাকিস্তান হলে সেখানে কোন ধরণের সামাজিক অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা হবে, কী হবে সেই দেশের গঠণতন্ত্র?

মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এ সব প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেন। একমাত্র বাংলা লীগের জনাব আবুল হাশিম এবং তার কয়েকজন ভক্ত মুসলিম লীগের গায়ে একটা প্রগতিশীল কর্মসূচীর জামা পরাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এটা জানা কথা ছিল যে, তারা যা বলছেন সেটা নেহাৎ প্রশ্নমুখর মধ্যবিত্ত তরুণদের পক্ষে আনার জন্যই বলা হয়েছিল, আসলে মুসলিম লীগের নীতি নির্ধারণে তাদের কোন ক্ষমতাই ছিল না। বাস্তবে তা প্রমাণিত হয়েছে। শ্রমিক কি ন্যায্য মজুরি পাবে? কৃষক কি জমি পাবে? পুঁজিপতিদের মুনাফা কি সংযত করা হবে? এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হয়ে মুসলিম লীগ কোন কর্মসূচীর পরিবর্তে বলেছিল – যারা এসব প্রশ্ন করে তারা ‘কওমী গাদ্দার’, ইসলাম ও মুসলমানের দুশমন। ঠিক অনুরুপভাবে জয় বাংলার নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনসাধারণের অন্যান্য জরুরী প্রশ্নগুলোকে চাপা দিয়ে কিংবা এড়িয়ে গিয়ে বিরাট জয়কে সুনিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। স্বভাবত:ই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) তা পারবে না এবং করবে না। মুসলিম লীগের উন্মাদনার ফলে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে যে “হিন্দু বিদ্বেষ” সৃষ্টি হয়েছিল সেটা নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের পক্ষে কাজ করেছিল। আজও জয় বাংলার উন্মাদনা যে “অবাঙ্গালী বিরোধী মনোভাব” সৃষ্টি করছে সেটা আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করবে, অন্য কারও পক্ষে নয়। – শহীদুল্লাহ কায়সার / দৈনিক সংবাদ – ২৪ জুলাই, ১৯৭০। [তথ্যসূত্র: শহীদুল্লাহ কায়সারের নির্বাচিত কলাম : ঊনসত্তর থেকে একাত্তর। পৃষ্ঠা: ৮৭-৮৮]
দুই. এতদসত্ত্বেও আগামী ৭ই ডিসেম্বর (১৯৭০) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৭ই ডিসেম্বরের আর মাত্র তিন দিন বাকী রয়েছে। এই প্রসঙ্গে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা বলা একান্ত জরুরী ও প্রয়োজনীয় মনে করছি। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে তাতে প্রধান প্রতিদ্বন্ধিতা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক শক্তি ও দলের একতার প্রয়োজন ছিল, সেখানে আওয়ামী লীগ প্রগতিশীল সংগ্রামী দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্ধিতা করছে। যেখানে যেখানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রতিদ্বন্ধিতা করছে সেখানেই আওয়ামী লীগ সর্বাপেক্ষা বেশী শক্তি ও অর্থ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জামাত নয়, মুসলিম লীগ নয় – ন্যাপকে পরাজিত করতে হবে, এটাই আওয়ামী নেতাদের রণধ্বণি।

এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। কেননা আওয়ামী নেতৃত্ব প্রগতিশীল কোন কর্মসূচীতে ওয়াদাবদ্ধ হতে গররাজি। অথচ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে কোন নির্বাচনী সমঝোতা করতে হলে একটি প্রগতিশীল কর্মসূচীতে তাকে ওয়াদাবদ্ধ হতে হবে এবং সেই প্রগতিশীল কর্মসূচী নিয়েই নির্বাচকমন্ডলীর কাছে যেতে হবে। কাজেই ছয় দফার জযবা তুলে সমস্ত গণদাবীকে তার আড়ালে চাপা দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার পরিকল্পনা তারা নিয়েছে। এই জযবা দ্বারা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকেও কোণঠাসা করা হবে এবং জনগণকেও ধোঁকা দেওযা যাবে, এটাই তারা ভাবছেন। কিন্তু ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাথে কোন রকম নির্বাচনী মৈত্রী করলে এই ধরণের ভাসা কথায় চলবে না, শ্রমিক-কৃষকের দাবীগুলোর কথা বলতে হবে, বৈদেশিক নীতির কথা বলতে হবে, অতএব তাদের সঙ্গে তো যাওয়া চলবেই না বরং তাদের মুখও বন্ধ করে দিতে হবে।

যে দল আইয়ুবী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করেছে এবং সংগ্রাম করতে গিয়ে অশেষ নির্যাতন সহ্য করেছে, জেল-জুলুম ভোগ করেছে সেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে আওয়ামী লীগ এটাই প্রমাণ করেছে যে, সততা ও আন্তরিকতার বালাই তাদের নেই, তারা যা যা বলেন তা শুধু লোক ভোলানোর জন্য, ভোট আদায়ের জন্যই বলে থাকেন।

ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি মোজাফফর আহমদের বিরুদ্ধে তারা একজন বি-ডি চেয়ারম্যান ও কনভেনশন দলীয় পাটের দালালকে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন – পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন এবং গণতন্ত্র আদায় করার জন্য – কোন পাগলও এটা বিশ্বাস করবে না। তরুণ ত্যাগী ও নির্ভীক কর্মী কাজি আবদুল বারীর (পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাজনৈতিক কর্মী যিনি ১৯৬০ সালে সামরিক আইনে বেত্রাঘাত পেয়েছিলেন) বিরুদ্ধে লাফাঙ্গার মার্কা প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছে – পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন ও গণতন্ত্র আনার জন্য – এটা কেউ বিশ্বাস করবে? বিশ বছরের জেল খাটা, পুলিশের লাঠি খাওয়া প্রবীণ ত্যাগী কর্মী আলতাফ আলীর বিরুদ্ধে কোন দিন জেলের নাম শোনেনি এমন এক নাবালককে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে – স্বায়ত্ত্বশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য?

এভাবে আওয়ামী লীগ আইয়ুব-মোনেম আমলের কন্ট্রাক্টর, বি-ডি ও চেয়ারম্যানদের দিয়ে দল বোঝাই করে তাদের পিঠে আওয়ামী লীগ ছাপ মেরে ন্যাপ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। অতএব, আজ জনগণের কর্তব্য হবে এসব ছদ্মবেশী মুসলিম লীগারদের পরাস্ত করা এবং দেশবাসীর বহু সংগ্রামের পরীক্ষিত সৈনিক ন্যাপ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করা।

আওয়ামী লীগের ছাপ থাকলেও এ সব বর্ণচোরা ও সুবিধাবাদীরা নির্বাচনে সুবিধা করতে পারবে না এই আশঙ্কায় আওয়ামী লীগ সেই অতি ধিকৃত অতি নিন্দিত “কলাগাছ” শ্লোগান তুলেছে। অর্থাৎ প্রার্থী চোর, জুয়াচোর, কি পকেটমার এ সব প্রশ্ন তুলো না – প্রার্থী “শেখ মুজিবের কলাগাছ”, অতএব কলাগাছকেই ভোট দাও। কলাগাছকে ভোট দিয়ে ছয়দফা কায়েম কর। এসব সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল মালগুলো গছাবার জন্য তারা এমন কথাও বলছে যে, ভোট তো ঐ কলাগাছগুলো পাবে না, ভোট পাবে শেখ মুজিব। কাজেই তোমরা তো শেখ মুজিবকেই ভোট দিচ্ছ – অমুক কন্ট্রাক্টর, অমুক বি-ডি যে এককালের কনভেনশনী চাঁই তো নিমিত্ত মাত্র। অর্থাৎ শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ আসনেই প্রতিদ্বন্ধীতা করছে, তাকে ভোট দিতেই হবে। কোন নেতার জনপ্রিয়তা বিক্রির এ এক অভিনব পন্থা এবং সহজ ভাষায় ধোঁকাবাজি। হায়, আমার দেশ। বার বার কত ধোঁকাবাজি এই দেশ দেখল, এখন দেখছে আওয়ামী লীগের ধোঁকাবাজি।

অবশ্য এতেও বিস্মিত হবার কিছু নেই। আওয়ামী নেতারা মুসলিম লীগই করতেন সেদিন পর্যন্ত এবং মুসলিম লীগের রাজনীতিকে তারা বর্জন করতে পেরেছেন, এটা দাবী করলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে বৈকি। মুসলিম লীগ যা যা করত, করেছে আওয়ামী নেতারা ঠিক ঠিক তাই করছেন। মুসলিম লীগ বলেছিল কলাগাছকে ভোট দাও। আওয়ামী লীগও বলছে কলাগাছকে ভোট দাও। যারাই ভিন্ন মত পোষণ করত মুসলিম লীগ তাদের বলত হিন্দুর দালাল, কংগ্রেসের দালাল ইত্যাদি। আওয়ামী লীগও ছয় দফার সমালোচনা করলেই অমনি মুসলিম লীগের কায়দায় চেঁচিয়ে ওঠেন, অমুকে পাঞ্জাবীর দালাল, পশ্চিম পাকিস্তানীর দালাল। মুসলিম লীগেরও জযবা ছিল ‘কায়েদে আযম’। আওযামী লীগও তেমনি জযবা সৃষ্টি করে নিয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’।

কাজেই প্রার্থী নির্বাচনের বেলায় রাজনৈতিক নীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই মুসলিম লীগ স্টাইলই অনুসরণ করা হচ্ছে। মুসলিম লীগের আগে আওয়ামী শব্দটা যোগ দিয়ে কিছুটা উন্নতি হবে বলে যারা আশা করেছিলেন তারা হতাশ হলেও সত্যিকার সংগ্রামী কর্মীরা এতে বিস্মিত হবেন না। এই নীতি অনুসরণ করে মুসলিম লীগ সারা পাকিস্তানে যা হাসিল করতে চেয়েছে আওয়ামী লীগও একই মুসলিম লীগ পন্থা অনুসরণ করে পাকিস্তানে তা হাসিল করতে চাইছে – অর্থাৎ, মুসলিম লীগ মার্কা স্বৈরাচারের স্থলে আওয়ামী লীগ মার্কা স্বৈরাচার। এ উদ্দেশ্যেই তারা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ত্যাগী কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। কাজেই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, জনতার স্বার্থে, স্বায়ত্ত্বশাসন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে এসব আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাস্ত করে নয়, প্রার্থীদের জয়যুক্ত করতে হবে। – শহীদুল্লাহ কায়সার / দৈনিক সংবাদ – ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭০। [তথ্যসূত্র: শহীদুল্লাহ কায়সারের নির্বাচিত কলাম : ঊনসত্তর থেকে একাত্তর। পৃষ্ঠা: ১২২-১২৪]

তিন. আওয়ামী লীগ কেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রগতিশীল ও সংগ্রামী কর্মী এবং নেতাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে, গত দুদিন ধরে তার রাজনৈতিক কারণ ও পটভূমিটা বিশ্লেষণ করছিলাম। এই বিশ্লেষণ আজ একান্ত প্রয়োজনীয়। কেননা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিরুদ্ধে পার্টি দাঁড় করিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের যে সুবিধাবাদী নীতির পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে তা থেকে একটি সিদ্ধান্তই টানা যায়। সে সিদ্ধান্তটি হল, আওযামী লীগ প্রগতির পক্ষে থাকছেন না, থাকবেন না। আওয়ামী লীগ থাকবেন প্রতিক্রিয়ার পক্ষে।

সেই প্রতিক্রিয়ার পক্ষে থাকতে গেলে জনপ্রিয়তা হারাতে হবে, কাজেই এমন শ্লোগান নাও যাতে সেই প্রতিক্রিয়াশীল চেহারাটা ঢাকা দেওয়া যায়। স্বায়ত্ত্বশাসন, জয় বাংলা হল এ জাতীয় শ্লোগান। এসব শ্লোগান গালভরা শ্লোগান, লোক মাতানো শ্লোগান। অথচ এর দ্বারা জনগণের কাছে কোন নির্দিষ্ট ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতিও দিতে হচ্ছে না। কাজেই বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে তারপর বাঙ্গালী পুলিশ দিয়ে যখন বাঙ্গালী শ্রমিক বা কৃষকদের ঠ্যাঙ্গানো হবে তখন তা জয় বাংলার নামেই করা যাবে, যখন বাঙ্গালী মুনাফাখোর-কালোবাজারীকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে তখন তা জয় বাংলার নামেই করা হবে। কেননা জয় বাংলা কিম্বা ছয় দফার কোথাও এসব করতে মানা নেই। জয় বাংলা কিম্বা ছয় দফার কোথাও জনগণের কথা নেই, রুটি- রুজি কিম্বা জমির কথা নেই। কাজেই জয় বাংলার নামে যা খুশি করা যাবে, ঠিক পাকিস্তান ও ইসলামের নামে মুসলিম লীগ যা করেছিল।

পাকিস্তান হাতী হবে না ব্যাঙ হবে, গণতন্ত্র হবে না রাজতন্ত্র হবে, এর আদৌ কোন শাসনতন্ত্র থাকবে নাকি আমলার হুকুমে চলবে, দেশটা জনগণের ইচ্ছায় চলবে না কর্তার ইচ্ছায় চলবে, এখানে রুটি-রুজি ও জমির ব্যবস্থা করা হবে নাকি তেলে মাথায় তেল দেয়া হবে – লীগের মধ্যে বা বাইরে কাউকে এসব প্রশ্ন করতে দেয়া হত না। যারা এ ধরণের প্রশ্ন করত তাদেরকে ইসলামের দুশমন এবং গাদ্দার বলে লাঠিপেটা করা হত। এর পরিণতিতে কী হযেছে সেটা আমরা গত ২৩ বছর ধরে প্রত্যক্ষ করেছি – এখনও দেখছি।

পাকিস্তান ও ইসলামের নামে যেকোন সমালোচনার কন্ঠ রোধ করা হয়, চিন্তা ও বাকস্বাধীনতার উপর পাথর চাপা দেওয়া হয়। শাসনতন্ত্র আজও হয়নি। স্বজনপ্রীতি ও দূর্নীতিতে বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করা হয়, জমিদার পুঁজিদারের বল্গাহীন শোষণের জন্য সর্বপ্রকার সুযোগ করে দেয়া হয়। অন্যদিকে ভূমি সংস্কার, শ্রমিক-কৃষকের রুটি-রুজির প্রশ্ন যে শুধু চাপাই দেয়া হল তাই নয়, এসব বেয়াড়া কথা যারা বলে তাদের জন্য জেলের ভাত পাকাপাকি করে রাখা হল। ইসলাম ও পাকিস্তানের নামে এই হল মুসলিম লীগের কীর্তি। জয় বাংলা ও ছয় দফার নামে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে এই কীর্তিগুলোরই পুনরাবৃত্তি করা হবে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাদের নির্বাচনী নীতির মাধ্যমে সেটাই প্রকাশ করে দিলেন।

আরও একটা ব্যাপারে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মারাত্মক মিল রয়েছে। সেটা হল সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে। মুসলিম লীগের মধ্যে কিছু সংখ্যক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কর্মীর অস্তিত্ব ছিল ঠিকই। এরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসর্গিত ছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ভুলেও কোনদিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। তাদের কথা ছিল যদি স্বাধীনতা দাও-ই, তবে আমাদের হিস্যাটা দিয়ে যাও। সাম্রাজ্যবাদের কাছে দেন-দরবারটাই ছিল মুসলিম লীগ নেতৃত্বের প্রধান কাজ।

আজ স্বাধীনতার ২৩ বছর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সেই পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলেছে। তারা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে নারাজ। অথচ এদেশ এবং এদেশের মানুষ দুশো বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদের শাসনে লাঞ্ছিত হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী শোষণে নির্যাতিত হয়েছে। আমাদের সভ্যতা কৃষ্টি অর্থনীতি ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী অধীনতার অভিশাপে। পাকিস্তান হবার পরও এই অভিশাপ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। পাকিস্তানকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত চলছে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই। সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সদা সর্বদা গুটি চালিয়ে আসছে এবং নানাবিধ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উস্কানি দিযেছে।

আজ যে এ দেশে গণ-অধিকার লুন্ঠিত ও পদদলিত তার মূলে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ। অথচ সাম্রাজ্যবাদকে বিরোধীতা করা এমনকি একটু সমালোচনা করতেও আওয়ামী নেতৃত্ব গররাজি। নির্বাচন উপলক্ষে তাদের বড় এবং ছোট নেতারা কত শত বক্তৃতা দিলেন, কিন্তু একটা বক্তৃতায়ও দেখলাম না তারা পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত সম্পর্কে একটা কথা বলেছেন। একটা দল বা ব্যক্তি কতটা খাঁটি এবং দেশপ্রেমিক তার অন্যতম মাপকাঠি হল সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সেই ব্যক্তি বা দলের দৃষ্টিভঙ্গি কি? এই মাপকাঠিতে আওয়ামী লীগ বরবরই সাম্রাজ্যবাদ প্রীতির দোষে দুষ্ট।
এই পরিস্থিতিতে তাই আজ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি ভোটারের কাজ হল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামী প্রার্থীদের নির্বাচিত করা। যদি আমরা তা করতে ব্যর্থ হই তা হলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, আমরা এক মারাত্মক ভুল করব এবং সে ভুলের খেসারত হিসাবে আর একবার আর এক ধরণের স্বেচ্ছাচারের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হব এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের শিকার হব, জেনেশুনে দেশবাসী এত বড় ভুল করবেন না এ বিশ্বাস আমরা পোষণ করি। – শহীদুল্লাহ কায়সার / দৈনিক সংবাদ – ০৫ ডিসেম্বর, ১৯৭০। [তথ্যসূত্র: শহীদুল্লাহ কায়সারের নির্বাচিত কলাম : ঊনসত্তর থেকে একাত্তর। পৃষ্ঠা: ১২৪-১২৫]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন