মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬

নীতিমালার দুর্বলতা- বিদেশী কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প

নানা জটিলতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। নীতিমালার দুর্বলতা অস্থিতিশীলতা কাটছে না এ শিল্পের। বিদেশী বিনেয়োগের ক্ষেত্রে কোন নির্দেশনা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তরা। তারা বলছেন, বহুজাতিক কোম্পানির সাথে অসম প্রতিযোগিতায় হিমশিম খাচ্ছেন তারা। নীতিমালা না থাকার কারণেই বিদেশী কোম্পানিগুলো এদেশের ৪৫ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ জন্য পোল্ট্রি নীতিমালার সংস্কার করে বাস্তবায়নের দাবি দীর্ঘ দিন ধরেই জানিয়ে আসছে তারা।
 তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী বলছেন, পোল্ট্রি শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতেই আহবান করা হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের। বিদেশী বিনিয়োগ হলেই এ শিল্প আরও এগিয়ে যাবে। এ জন্য সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে হতাশা কেটে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে যে নীতিমালা করা হয়েছে এটিতে অনেক ত্রুটি রয়েছে। এটিকে আরও যুগোপযোগী করতে হবে। লক্ষ্য পূরণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে এই নীতিমালা করলেই যে আমিষের চাহিদা পূরণ হবে তা বলা কঠিন। তবে উৎপাদন সমস্যা সহসা কেটে যাবে।
এই শিল্পের প্রয়োজনীয় খাদ্য, মুরগীর বাচ্চাও এখন যথেষ্ট পরিমাণ উৎপাদিত হচ্ছে দেশে। এরই মধ্যে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে চাহিদামত মাংস ডিম উৎপাদনের।
পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়ন এবং বিকাশে ২০০৮ সালে প্রণয়ন করা হয় পোল্ট্রি নীতিমালা। তবে নীতিমালার কোথাও উল্লেখ নেই পোল্ট্রি খাতে বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা কি হবে?
দেশীয় সক্ষমতার মধ্যেও ৭টি বিদেশী কোম্পানিকে এ খাতে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর ৫টি ভারতীয় আর থাইল্যান্ড ও চীনের একটি করে কোম্পানি। থাই কোম্পানি সিপির দখলে রয়েছে বাজারের অন্তত ২৫ শতাংশ। আরও প্রায় ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে অপর ছয়টি বিদেশী কোম্পানি। ভারতের কোম্পানিগুলো হলো, ভিএইচ গ্রুপ, গোদরেজ, সগুনা, টাটা এবং অমৃত গ্রুপ। চাইনিজ কোম্পানির নাম নিউ হোপ।
উদ্যোক্তারা বলছেন, আরো ৮টি বিদেশী কোম্পানি এখাতে বিনিয়োগের অনুমতি পেতে যাচ্ছে। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতার কারণে পোল্ট্রি খাতে বিদেশী কোম্পানিগুলো, দেশীয় অংশীদার ছাড়াই নিজেরা শতভাগ বিনিয়োগ করছে। এতে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছেন এ খাতের উদ্যোক্তার।
বিদেশী বিনিয়োগকারী আর দেশীয় উদ্যোক্তাদের অসম প্রতিযোগিতায় নষ্ট হচ্ছে বাজারের ভারসাম্য। তাই এই শিল্পকে বাঁচাতে পোল্ট্রি নীতিমালার আধুনিকায়ন এবং বাস্তবায়নের ওপর জোর দিলেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় বিদেশীদের হাতেই চলে যাবে এই শিল্পের পুরো নিয়ন্ত্রণ। হারিয়ে যাবে এদেশের উদ্যোক্তারা।
জানা গেছে, নীতিমালা প্রণয়নের আট বছর পরও কাগজে-কলমেই আটকে আছে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ কর্মসংস্থানের খাত পোলট্রি শিল্পের উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগ। তাই আস্থাহীন হয়ে পড়েছেন উদ্যোক্তারাও। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের চেষ্টায় উৎপাদন বাড়লেও দাম এবং মান নিয়ন্ত্রণহীন।
পোলট্রিকে প্রাণিজ কৃষি খাত ঘোষণা করে শস্য খাতের সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল জাতীয় পোলট্রি উন্নয়ন নীতিমালায়। বার্ড ফ্লু মড়কের পর প্রণীত এ নীতিমালায় আছে কাঁচামাল থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের কথাও।
এ খাতে বিনিয়োগ লাগবে আরো ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সরকারের হিসাব মতে,২০১৬ সালে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ। ২০২১ সালে তা বাড়িয়ে প্রতিদিন উৎপাদন করতে হবে ৪ কোটি ৫ লাখে। বর্তমানে মাংস উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন ১হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন। পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হলে তা বাড়িয়ে প্রতিদিন উৎপাদন করতে হবে ৩ হাজার ২৯৯ মেট্রিক টন। বিশ্লেষকরা বলছেন, লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ঠিক করতে হবে অগ্রাধিকার। আমাদের পোল্ট্রি শিল্প দেশীয় পুঁজি এবং দেশীয় উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে উঠা এই শিল্পটি দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। পোল্ট্রি ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানমুখী একটি সমৃদ্ধ শিল্প। বিশেষত আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই শিল্প নতুন বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে। শুধুমাত্র সরকারের অপেক্ষায় বসে না থেকে এবং শুধুমাত্র চাকরি নির্ভরশীল না হয়ে আমাদের যুব সমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে সমৃদ্ধ অর্থকরী শিল্পে পরিণত করেছে পোল্ট্রি শিল্পকে। ব্যাপারটিকে হাল্কা করে দেখার মোটেই অবকাশ নেই। পোল্ট্রি শিল্পের কল্যাণে আমাদের দেশের যুব ও যুব মহিলারা নিজেদেরকে সফল ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিজেদের সমতার সীমারেখায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে পোল্ট্রি শিল্পের মতো এমন ব্যাপকভিত্তিক সফলতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি চাহিদা পূরণের নজির আর কোনো শিল্পে লক্ষ্য করা যায়নি।
সবচেয়ে বড় কথা- পোল্ট্রি এমন একটি শিল্প যে শিল্পটি শুধুমাত্র মহানগরকেন্দ্রিক নয়, এই শিল্পটি জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এই শিল্পকে কেন্দ্র করে পরিচালনা, পরিচর্যা, বাজারজাতকরণ এবং খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রমের সুবাদে আরো ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে ব্যবসা এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এই আরো ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে পোল্ট্রি শিল্প। বেসরকারিভাবে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ রয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেশীয় চাহিদা পূরণ করেও বিদেশে রপ্তানি হয়েছে পোল্ট্রি পণ্য। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে প্রথম বার্ড ফ্লু দেখা দেয়ার ফলে দুই বছরে এই শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের তি হয় ৪১৫০ কোটি টাকা। পরবতী ২ বছর এই অবস্থার কিছুটা স্বাভাবিক গতি আসলেও ২০১১ সাল থেকে আবারো মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে পোল্ট্রি শিল্প।
তথ্য উপাত্তে জানা যায়, বিকাশমান পোল্ট্রি শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ৯০ এর দশকে। তারও আগে ১৯৬৪ সালে ৩০ একর জমির উপরে গাজীপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে পোল্ট্রি শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। তবে ১৯৯৫-৯৬ সালে দেশী ও সোনালী জাতের মুরগীর বাইরে উন্নত জাতের লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগীর চাষে খামারিরা ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। এরফলে দেশের জনগণ আয়-উপার্জনের সামঞ্জস্যতায় ডিম ও মুরগীর মাংস খেতে পারে। পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ও সফলতার পেছনে রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের উদ্যোক্তাদের নীরব বিপ্লব। পোল্ট্রি খামার জেলা, উপজেলা থেকে ছড়িয়ে ইউনিয়ন থেকে গ্রাম পর্যায়ে চলে যাবে। পোল্ট্রি শিল্পে এখন বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ৩০ হাজার ৪২ কোটি টাকা।
পোলট্রিকে প্রাণিজ কৃষি খাত ঘোষণা না করায় প্রান্তিক চাষীরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষি ঋণ পাচ্ছে না। বড় বড় খামারিরা ব্যাংক ঋণ পেলেও ক্ষুদ্র কৃষকরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে করে এ শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর শিল্প বাধাগ্রস্ত হওযার কারনেই সরকার ২০২১ সালের মধ্যে পুষ্টির ঘাটতি পূরণের লক্ষ্য ব্যর্থ হতে চলেছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন(বিপিআইএ) দেয়া তথ্য মতে,এটি একটি ঝুকিপূর্ণ ব্যবসা। কিন্তু এখানে এখনও কোন বীমা ব্যবস্থা চালু হয়নি। এতে করে বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের কারণে কোন ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ পায়না খামারিরা। এতে করে বাধ্য হয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা খামার ছেড়ে দেন।
এব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম সাত্তার মন্ডল বলেন,এখাতে সব বিনিয়োগই বেসরকারি। সরকারের কোন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। সরকারের প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোন কাজ নেই। একদিনের বাচ্চা কোম্পনিগুলো নিজেদের মত মূল্যে বিক্রি করছে। এক্ষেত্রে সরকারের কোন মনিটরিং নেই। সরকার একটি নীতিমালা করার কথা থাকলেও গত আট বছরেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এতে করে এ শিল্প পিছিয়ে পড়ছে।
 বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন (বিপিআইএ) সেক্রেটারি বলেন, সরকার বলছে চাহিদা পূরণে তারা কাজ করছে। কিন্তু আমরা এর কোন ফল পাচ্ছি না। আট বছর আগে পোল্ট্রি নীতিমালা করলেও তা এখনও আঁতুড় ঘরে পড়ে রয়েছে। এভাবে একটি শিল্প চলতে পারে না। আর নীতিমালা না হওয়ার কারণেই ক্ষুদ্র খামারিরা কৃষি ঋণ পাচ্ছে না। এতে করে এ শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন