শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬

৯৯.৭৭ ভাগ ও ৬৮ ভাগ খালাসের গল্প

দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে যে কেউ দুদকে দরখাস্ত করতে পারেন। ভুক্তভোগী জনগণের একটা ভরসার জায়গা হলো দুদক। তবে কথা হলো, দুদক এখন পর্যন্ত মোট অভিযোগকারীদের আধা শতাংশের অভিযোগও তদন্তযোগ্য মনে করে না। যাচাই-বাছাই করেই তারা অধিকাংশ নালিশি দরখাস্ত ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। 

দুদক জনগণের কাছ থেকে আসা দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে গত তিন বছরে গড়ে দশমিক ২৩ শতাংশ দরখাস্ত আমলে নিয়েছে। ২০১৬ সালে দশমিক শূন্য ৭২ শতাংশ, ২০১৫ সালে দশমিক ১২ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে দশমিক ১৪ শতাংশ অনুসন্ধানের জন্য বাছাই করেছিল। অভিযোগ খতিয়ে দেখার বাস্তবতা যখন এতটাই শোচনীয়, তখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ পড়ল। কারণ, দুদকের বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, তাদের মাত্র ৩২ শতাংশ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি পেয়েছে। ৬৮ শতাংশ খালাস পেয়েছে। তার মানে দাঁড়ালো, ক্ষুব্ধ জনগণের দ্বারা দুর্নীতির দায়ে ‘অভিযুক্ত’ ব্যক্তিদের ৯৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ যাচাই-বাছাইস্তরে এবং দুদক দ্বারা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৬৮ শতাংশ আদালতে খালাস পেলেন। 

অনুমান করা কষ্টসাধ্য নয় যে এই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জামিনে বাইরে থাকতে পারেন। আর আপিলের বিভিন্ন স্তরে তাঁদের অন্তত আরও কিছুসংখ্যক খালাস পেতে যথেষ্ট আশাবাদী হতে পারেন। সুতরাং আমাদের দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় অভিযান বড় রকমের প্রশ্নবিদ্ধ হলো। শুরুতেই খালাস পেয়ে যাচ্ছেন ৯৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ (যাচাই পর্যায়ে) সন্দেহভাজন। বাকি যাঁরা রইলেন তাঁদের মধ্যেও বিচারিক আদালতে খালাস পেয়ে যাচ্ছেন ৬৮ শতাংশ। 

২০১৫ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ৬৮ শতাংশ আসামি খালাস পাওয়ার হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা নির্দেশ করছে যে দেশে দুর্নীতিবিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ঘাটতি আরও প্রকট হচ্ছে। এটা অনেকে হয়তো প্রশাসনিক ত্রুটিবিচ্যুতি বা প্রসিকিউশনের দুর্বলতাকে বড় করে দেখবেন, কিন্তু তা মনে করার কারণ আছে বলে মনে হয় না। আমরা দেখলাম, সদ্য সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে নেতা-কর্মীদের প্রতি তেমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে চোখে পড়ল না। আমরা জানতেই পারলাম না যে তারা কীভাবে আওয়ামী লীগার বাদে অবশিষ্ট জনগণের কাছে জবাবদিহি করল। সংগঠনটি কত টাকার চাঁদায় চলেছে আর কত টাকায় আগামী তিন বছর চলবে, সেসব বিষয়ে কিছুই বলা হলো না, কিছুই জানা গেল না। ইদানীং দুর্নীতি যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যথারীতি চলমান রয়েছে, তার তেমন কোনো স্বীকৃতি নেই। এরই পরোক্ষ প্রভাব চলছে জনপ্রশাসনে। কোথাও কোথাও দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব ও পদক্ষেপ অবশ্যই চোখে পড়ে। কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর। 

প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘দুদকের মামলাগুলো মূলত নথিনির্ভর। তাই সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নথিপত্র উপস্থাপন করতে পারলে ওই সব অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব। কিন্তু আইনগত দুর্বলতা, নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট না থাকা, ফি-নির্ভর আইনজীবীদের প্রতি নির্ভরতা, দুর্বল অনুসন্ধান ও তদন্ত এবং আপসকামিতার কারণে দুদক দুর্নীতি মামলার চূড়ান্ত বিচারে হেরে যাচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।’ এই মূল্যায়ন নিশ্চয় নাকচ করা যাবে না। এ বিষয়ে দুদকের মুখ্য জ্যেষ্ঠ প্যানেল আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে কথা হলো। ‘কী করে ৬৮ শতাংশ অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পেলেন, সেটা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা এবং দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার’ তাঁর এই অবস্থানের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই।

এটা লক্ষণীয় যে এই ৬৮ শতাংশ মামলার আসামিরা বিচারিক আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। কিন্তু দুদক কতটি ক্ষেত্রে আপিল করেছে এবং তার কী ফলাফল, সেই তথ্য অবশ্য ওই প্রতিবেদনে নেই। আপিল করার বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের সমাজে একজন ব্যক্তি দণ্ডিত হলেই তাঁরা তা মানতে চান না। তাঁরা দণ্ডিত হওয়ার পরেই আপিল করেন, আর যুক্তি দেন যে সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ‘আইনের চোখে দোষী নন’। সুতরাং বিচারিক আদালতে ৬৮ শতাংশ খালাস মানেই বলা যাবে না, তাঁরা নির্দোষ এবং দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দুর্বলতার কারণেই এই বিপর্যয় ঘটেছে। অবশ্য দুদক সচিব ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্রের মতো বিষয়কেই স্মরণ করেছেন।

তবে এসব মামলা উচ্চ আদালতে গেলে আমরা আশা করতে পারি যে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ জানা যাবে। বর্তমানে হাইকোর্টে দুর্নীতির মামলার দ্রুত শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ থাকছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি যে বিগত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদকের গতিশীলতা কোথায় হারিয়ে গেল। ওই পর্বটির কথা স্মরণেই আনতাম না, যদি না এই তথ্য আমরা জানতাম যে উচ্চ আদালত বিগত বছরগুলোতে ওই বিতর্কিত আমলে দায়ের করা মামলাগুলোর বিচারকার্য চালু রাখাকেই আইনসম্মত বলে রায় দিয়েছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর দুর্নীতি মামলা, যাতে তিনি দণ্ডিত হয়েছিলেন, সেটি সম্প্রতি আপিল বিভাগে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার মাইলফলক ঘটনাটি বর্তমান দুদকের জন্য অসামান্য গুরুত্ব বয়ে এনেছে। দুদকের আইনজীবীরা রীতিমতো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। অবশ্য ওই বিতর্কিত আমলে বহু ক্ষেত্রে যে বাড়াবাড়ি ও চরিত্রহননের পরিকল্পিত চেষ্টা হয়েছিল এবং তা যে নিন্দনীয়, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।

এই নিবন্ধের জন্য যেটা প্রাসঙ্গিক সেটা হলো দুর্নীতিবিরোধী একটি অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশে এই ত্রুটিবিচ্যুতিপূর্ণ দুদকের শিথিল প্রসিকিউশন টিমই কিন্তু বিপুলসংখ্যক মামলা দায়ের করতে পেরেছিল। আর এখন বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, অভিযোগ আমলে নেওয়াই হচ্ছে কম। ১ হাজার অভিযোগ জমা পড়লে গড়ে তা থেকে একটি বা দুটি অনুসন্ধানের জন্য নেওয়া হচ্ছে। লোকবলের অভাব? নাকি এতটাই যোগ্য লোকবল আছে, যাঁদের কারণে সুচিন্তিতভাবে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ সরাসরি নাকচ করা সম্ভব হচ্ছে। নাকি সমাজে মিথ্যা ও বিদ্বেষপ্রসূত অভিযোগকারীর সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বেড়ে যাচ্ছে? কোনটি সত্যি? চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত জমা পড়া প্রায় ৮ হাজার অভিযোগ থেকে মাত্র ৫৭১টি অনুসন্ধানের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে? ৬৮ শতাংশ মামলা খালাস হওয়ার ঘটনাকে আমরা যদি কোনো না-কোনো মাত্রায় অদক্ষতাজনিত বা ত্রুটিপূর্ণ মনে করি, তাহলে কী করে ভরসা করব যে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পাইকারি নাকচের ঘটনাগুলোতে দক্ষতার ছাপ আছে?

এটা পরিষ্কার যে সংক্ষুব্ধ নাগরিকেরা, যাঁরা প্রতিকার চেয়ে দুদকের শরণাপন্ন হন, তাঁদের কোনো প্রতিকার দিতে দুদক শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এটা রোধ করতে হলে দরখাস্ত নাকচ করার কারণ লিখিত হতে হবে। সেটা চাইলে যোগ্য লোকবল এবং শুনানিনির্ভর কোনো একটা স্বচ্ছ ব্যবস্থা বের করতে হবে। 

ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে দুর্নীতির কারণে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সংখ্যা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের চেয়ে যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে (পিটিআই, ৯ মার্চ, ২০১৬)। ভারতেও আমি মনে করি দুর্নীতি দমনে জোরালো রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সংকট চলছে। গত মার্চে লোকসভাকে বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৩ হাজার ৭৮ ব্যক্তি দণ্ডিত হয়েছেন। এর অর্থ বছরে ১ হাজার ২৬ জন দণ্ডিত হচ্ছেন। আমাদের যেমন দুদক, তেমনি ভারতের আছে কেন্দ্রীয় ভিজিলেন্স কমিশন সিভিসি। সেখানে বেশ স্বাধীনভাবে দুর্নীতির তদন্ত করে থাকে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইন্টিলেজেন্স (সিবিআই)। দুর্নীতি দমন আইনের তদন্তের ক্ষেত্রে সিবিআইর কার্যক্রমের তদারকি করে সিভিসি। সিবিআই তদন্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে, এমন ৬৭৩টি মামলার আসামিরা আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। পিটিআই এই খবর দিতে গিয়ে স্মরণ করেছে যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন দিতে তাগিদ দিয়ে চলছেন। 

আমরাও দুদকের অধিকতর স্বাধীনতা ও কার্যকর স্বায়ত্তশাসন চাইব। কিন্তু তার আগে চাইব দুর্নীতি দমনে দ্ব্যর্থহীন রাজনৈতিক সংকল্প। এটা শক্তিশালী থাকলে দুদক তার বর্তমান কাঠামো ও ক্ষমতার মধ্যেই অনেক শক্তিশালী হতে পারবে। দুদক গ্রহণযোগ্য মামলা করতে পেরেছিল বলেই বর্তমান সরকারের আমলেই ২০০৯ সালে সাজার হার ছিল সবচেয়ে বেশি, ৬১ শতাংশ। এরপর ২০১০ সালে কমলেও সাজার হার ছিল ৫৬ শতাংশ।

কিন্তু তারপর আর তেমন মামলাই আর হয়নি। সে কারণে ২০১১ সাল থেকে লাগাতার সূচক নিচে নামছে। ২০১১ সালে সাজার হার ২০ শতাংশ, ২০১২ সালে ৩২ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৩৭ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৪২ শতাংশ ও ২০১৫ সালে দেখা গেল ৩২ শতাংশ। রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সূচকের ওঠানামার সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক আছে। আওয়ামী লীগ তার কাউন্সিল উপলক্ষে ইংরেজিতে ২৪ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু সেখানে উন্নয়নগাথা আছে, যার সাফল্য আমাদের উৎসাহিত করে, কিন্তু সেখানে দুর্নীতি দমনে প্রতিষ্ঠায় কোনো অঙ্গীকার নেই। এখন এই ঘাটতিটাই পূরণ করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন