রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৬

পাকিস্তানের আবার ভাবা উচিত

জাতিসংঘে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ভাষণ অনেকটা যুদ্ধংদেহী মনে হতে পারে। কিন্তু এতে বোঝা যায়, ভারত কাশ্মীর ও অন্যান্য স্থানে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে পড়েছে। উরিতে সেনাছাউনিতে হামলায় ১৪ জওয়ানের মৃত্যুর পর ভারতে এখন একটি দাবি ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছে: প্রতিশোধ।

এদিকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে অঙ্গীকার করেছেন, তারা চাইলে যেকোনো সময় ও স্থানে পাল্টা হামলা চালাতে পারে (সার্জিক্যাল স্ট্রাইক)। ভারতীয়দের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পছন্দ হিসেবে এটি খুবই নিকৃষ্ট পর্যায়ের। কিন্তু কোনো কিছু না করে এটা বাস্তবায়ন করতে গেলে ধৈর্যের প্রয়োজন আছে, যে জিনিসটা ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ কোনো বিকল্প নয়। তাহলে এখান থেকে বেরোনোর পথটা কী?
পাকিস্তান স্বীকার করেছে, উরির সমস্যা সমাধানে কোনো অরাষ্ট্রীয় সংস্থাকে যুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু এখন যখন সারা পৃথিবী উরির ঘটনায় আতঙ্কিত হয়েছে, তখন ইসলামাবাদ বলছে, এটি ভারতের সাজানো ঘটনা, এতে ইসলামাবাদের হাত নেই। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তার ভূমি ব্যবহার করে এই হামলা চালিয়েছে, তারা এর কী ব্যাখ্যা দেবে। পাকিস্তান কাশ্মীরের প্রসঙ্গটি তুলে অন্য সব দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তান আশা করে, তারা আলোচনার উদ্যোগ নিলে নয়াদিল্লি তাতে যোগ দেবে।
সম্ভবত, ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের ওপরই তার চোখ ছিল। ভারত এতে যোগ দেবে না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেওয়ায় এই সম্মেলন বাতিল হয়ে গেছে। কারণ, ভারতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশ ও ভুটানও এতে যোগ দেবে না বলে জানিয়েছে। দৃশ্যত, ভারত যখন না বলেছে, তখন এই সম্মেলন বাতিল করতেই হবে। 
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি। যুদ্ধ কোনো পথ নয়। কিন্তু আলোচনাও ফলপ্রসূ হয়নি। ওদিকে সুষমার বক্তৃতা পাকিস্তানের প্রতি আরও একটি হুমকি। ব্যাপারটা হলো, পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডে ভারত বিরক্ত, ফলে তারা কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। কারণ, এটা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে আলোচনা থেকে সমাধান আসবে না।
ভারত ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি সংশোধনের কথা বলছে। আর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সারতাজ আজিজ বলেছেন, পাকিস্তানের অংশগ্রহণ ছাড়া এই চুক্তি সংশোধন করা হলে তা হবে ‘যুদ্ধ’। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। উভয় পক্ষের মানুষকেই তা বলতে হবে। পাকিস্তান বারবার বলছে, উপমহাদেশে শান্তি আনতে হলে কাশ্মীর সমস্যার একটা না একটা সমাধান বের করতেই হবে।
যেভাবেই হোক, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান এককভাবে এটা করতে পারবে না। কাশ্মীরিরা নিজেদের কথা বলতে চায়। সম্প্রতি আমি ছাত্রদের আমন্ত্রণে শ্রীনগরে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাই। দেখলাম, তরুণেরা স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ চায়। তারা বুঝতে পারছে না, ভারত নিজের সীমান্তে আরও একটি মুসলিম দেশ চায় না।
কথা হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন ভারত ছেড়ে যায়, তখন তারা রাজাশাসিত রাজ্যগুলোকে সুযোগ দিয়েছিল, তারা যদি ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে না চায়, তাহলে তারা স্বাধীন থাকতে পারে। তো এরপর জম্মু ও কাশ্মীরের তৎকালীন শাসক হরি সিং ঘোষণা দেন, তাঁরা স্বাধীন থাকবেন। কিন্তু এই ভূমিবেষ্টিত অঞ্চলটির বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সমর্থন লাগবে। তিনি শুধু একজনের ওপর নির্ভর করতে চাননি।
কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর মুসলিমপ্রধান হওয়ায় পাকিস্তান আশা করেছিল, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেবে। তা না হওয়ায় পাকিস্তান অনিয়মিত সেনাদের ঢুকিয়ে দেয়, যার সমর্থনে ছিল নিয়মিত সেনারা। ফলে মহারাজা ভারতের সহায়তা চান। আর ভারত বলে, সেনা পাঠানোর আগে তাঁকে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে হবে। তাঁকে ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেশন অ্যাক্টে সই করতে হয়।
এ মুহূর্তে কাশ্মীর উপত্যকার দুটি অংশ আজাদির বিপক্ষে। হিন্দু–অধ্যুষিত জম্মু ও বৌদ্ধ–অধ্যুষিত লাদাখ ভারতীয় ইউনিয়নের সঙ্গেই থাকতে চায়। সে কারণে আজাদির দাবিটা কাশ্মীরের সেই অংশের মধ্যেই সীমিত হয়ে যাচ্ছে, যেখানকার ৯৮ শতাংশ মানুষই মুসলমান।
ভারতে এখন বিভাজনের রাজনীতি চলছে। ক্ষমতাসীন দল হিন্দুত্বের তাস নিয়ে খেলছে। ফলে এটা ধারণা করা কঠিন যে কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট পার্টি আজাদির দাবিতে সমর্থন দেবে। অন্যভাবেও, সব রাজনৈতিক দলই স্বাধীনতার দাবির বিপক্ষে, তাদের কেউ কেউ হয়তো বড়জোর বলতে পারে, রাজ্যকে ক্ষমতা দেওয়া হোক।
দেশভাগ মানুষের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, আজ ৭০ বছর পরও তা শুকায়নি। মানুষ কীভাবে আশা করে, ভারত আবারও একটি দেশভাগ মেনে নেবে; তা সে কাশ্মীরিদের ভাবাবেগ যতই খাঁটি হোক না কেন। আর সেই দেশভাগ যদি আবারও ধর্মের ভিত্তিতে হয়, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অস্তিত্বই কমজোর হবে। এটা ঠিক, ভারতের ২৫ কোটি মুসলমানও দেশের নাগরিক, তারা হিন্দুদের মতো সম–অধিকার ভোগ করে। তাদের জিম্মি করা যাবে না। কিন্তু কাশ্মীরের চলে যাওয়ার ফলাফল এত মারাত্মক হবে যে তা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামাবাদের আবার ভাবা উচিত। কারণ, তারা প্রতিনিধি আবদুল বাসিতের মারফত বলেছে, উরি হামলা ছিল ‘সাজানো নাটক’, এতে পাকিস্তানের হাত নেই।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন