সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

দায়মুক্তি বিশেষ আইনের বাধ্যবাধকতার কারণে কেউ কিছু বলতে পারে না বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে টেন্ডার ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

সর্বশেষ চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)’ ৪ বছরের জন্য মেয়াদ বাড়নো হয়। মাঝখানে আরো ২ বছর বাড়ানো হয়েছিল। আইনটি কার্যকর শুরু ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর। বিশেষ আইনে বাধ্যবাধকতার কারণে কেউ কিছুই বলতে পারে না। এই সুযোগ নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে কাজ টেন্ডার ছাড়াই বাস্তবায়ন কাজ করছে মন্ত্রণালয়। প্রায় দুই ডজন প্রকল্পে কাজ চলছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেন্ডার ছাড়া এভাবে কাজ দেয়ায় দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র এবং সরকারের ক্রয়নীতির বাইরে বিশেষ আইনে ছোট-বড় কোনো প্রকল্পের কাজ কোনো দেশী-বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া ঠিক হচ্ছে না। 

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি বলেছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্যই বিশেষ আইন করা হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় গেলে অনেক সময় নষ্ট হয়। ফলে বিশেষ আইন ব্যবহার করে দ্রুত কাজ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প এ আইনের আওতায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে বিশেষ আইনে ব্লক ইজারার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বচ্ছতার সঙ্গে সবকিছু করা হবে বলে জানান তিনি। 

তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়ম করার জন্য বেপরোয়া না হলে এ রকম আইন করার দরকার ছিল না। এই আইন করার আগের, এমনকি এই সরকারের আগের সরকারগুলোর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির অনেক ঘটনা সবাই জানেন। কিন্তু এই আইন অনেক বেশি দুর্নীতির পথ তৈরি করেছে, যথেচ্ছাচারের সুযোগ দিয়েছে। ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি’ নয়, এটি কার্যত ‘দ্রুত লুণ্ঠন ও দুর্নীতি দায়মুক্তি আইন’। 

তিনি বলেন, ২০১০ সালে বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের অজুহাতে আইন প্রণয়নের সময়ই আমরা আশঙ্কা জানিয়েছি যে, এই আইন বিদ্যুৎ সংকটের টেকসই সমাধান তো দেবেই না, উল্টো সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্ম দেবে। পরের বছরগুলোয় এই আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই অনিয়মের ধারাবাহিকতা আরও চার বছর চালিয়ে যেতে চায় বলেই সরকার এর মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে। দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, গোপন চুক্তি ও সমঝোতার দুষ্টচক্রের গোড়া জ্বালানি মন্ত্রণালয়কে সব আইনি বাধ্যবাধকতার ওপর স্থাপন করে দুর্নীতি আর জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতাকে অবাধ করতে চায় সরকার।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে দ্রুত বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদ ২০১০ সালে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০’ প্রণীত হয়। 

সূত্র জানায়, প্রণীত এই আইনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ বিধানের ‘আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়, এ আইনের অধীন বিবেচিত কোনো কাজ, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো ধরনের আইনগত পদপে গ্রহণ করা যাবে না। অর্থাৎ এ আইনবলে দরপত্র ছাড়া সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ যে কাউকে দিতে পারবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আইনের আওতায় আনা যাবে না। এই আইনে কোনো ভুল হলেও জবাবদিহির সুযোগ নেই। 

সূত্র জানায়, ২০১০ সালে এই আইনের অধীনে থেকে ছোট-ছোট অনেক তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিনা টেন্ডারে নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে ছোট প্রকল্পের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বড়-বড় প্রকল্পের কাজও বিনা টেন্ডারে দেয়ার উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। কয়েক বছর ধরে প্রায় সব বড় প্রকল্পেরই বিশেষ আইনে টেন্ডার ছাড়া কাজ দেয়ার উদ্যোগ নেয় মন্ত্রণালয়। 

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিশেষ আইনে প্রকল্পের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে জ্বালানি বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি রয়েছে।

 মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই মুহূর্তে অন্তত দুই ডজন প্রকল্প বিশেষ আইনে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এর মধ্যে রয়েছে বাপেক্সের ১০৮টি কূপ খনন প্রকল্প, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, ইস্টার্ন রিফাইনারি ইউনিট-২ (এসপিএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন, ভারতের নুমালীগড়-পার্বতীপুর পাইপলাইন নির্মাণ, গভীর সমুদ্র ব্লকগুলো ইজারা দেয়া, জ্বালানি বিভাগের আওতায় পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর এলাকায় এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন প্রকল্পসহ একাধিক প্রকল্প।

 সূত্র জানায়, দায়মুক্তি আইনের আওতায় আনা হয় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এছাড়া এ আইনের বলে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাসপ্রমকে ১০টি কূপ খননের কাজও বিনা টেন্ডারে দেয়া হয়। গ্যাসের চাপ বৃদ্ধির জন্য একটি কম্প্রেসারও বিনা টেন্ডারে বসানো হয়। পরবর্তী সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকার বড়-বড় প্রকল্প, বিশেষ আইনের আওতায় টেন্ডার ছাড়াই দেয়া হচ্ছে। 

সম্প্রতি গভীর সাগরে ৩টি তেল-গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এগুলো হলো মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার ১২, ১৬ ও ২১ নম্বর। জ্বালানি তেল পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে ২৩৭ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন। মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে টেন্ডার ছাড়াই কাজ দিতে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিও করা হয়। অতীতে স্থলভাগ বা সাগরে তেল-গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হতো। দেশী-বিদেশী কোম্পানি সেখানে দরপ্রস্তাবে অংশ নিত। তখন প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কোম্পানি নির্বাচন করা হতো। বিনা টেন্ডারে ইজারা দেয়ার কারণে এখন আর সেটি হচ্ছে না।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশেষ আইনে করার মূল লক্ষ্য হচ্ছে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়ায় দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সুফল পাওয়া যাবে সেভাবেই কাজ করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বিশেষ আইনে টেন্ডার প্রক্রিয়া এড়িয়ে করার কারণেই আজ বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করা গেছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম মনে করেন, বিনা টেন্ডারে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। কোনো কোম্পানিকে এককভাবে কাজ দিলে সেই ক্ষেত্রে প্রকল্প খরচ প্রতিযোগিতামূলক বাজার থেকে বেশি পড়বে এটাই স্বাভাবিক। আইনের বলে বড়-বড় প্রকল্প নেয়া ঠিক হচ্ছে না, এটা নিয়ে ভবিষ্যতে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন