শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

জয়শঙ্করের স্ববিরোধিতা

বাংলাদেশের দু-একটি দৈনিকে গত ৯ সেপ্টেম্বর খবর আসে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর এক সেমিনারে ‘ঢাকাকে সমর্থন দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান’ জানিয়েছেন। ঢাকার মিডিয়া দক্ষিণ ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দুর’ বরাত দিয়ে খবরটি প্রকাশ করে। এর এক দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর কলকাতার আনন্দবাজার জয়শঙ্করের ওই বক্তব্য নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে। তবে মিডিয়াসহ সব জায়গায় একটা বিভ্রান্তি ছিল যে, জয়শঙ্কর কোথায় এবং কেন এই বক্তব্য রেখেছেন। কারণ গত ২৯ আগস্ট আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশ সফরের পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো বিদেশী প্রভাবশালী ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেনি। বাংলাদেশের কোনো সরকারি নেতা বা মন্ত্রীও ভারত অথবা কোনো প্রভাবশালী দেশ সফরে নেই। ফলে কোন পটভূমিতে জয়শঙ্করের বক্তব্যের অর্থ বুঝব, সেই পটভূমি সবাই জানতে চেয়েছিল। যেমন- মানবজমিন লিখেছে ‘জয়শঙ্কর দিল্লিতে ২০১৬ ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া কনফারেন্সে’ বক্তব্য রাখেন। এখন ‘ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া কনফারেন্সটা কী জিনিস এটা ওই রিপোর্ট থেকে কিছুই জানা যাচ্ছে না। অর্থাৎ জয়শঙ্করের বক্তব্য একটা কনটেক্সচ্যুয়াল দিক আছে। সংক্ষেপে সেই পটভূমি বা ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া কনফারেন্সটি কী তা খুঁজে দেখে জানা যাচ্ছে যে, আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপরাজ্যের এক একাডেমিক প্রতিষ্ঠান ‘ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টার।’ ওই প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত ছিল বা আছে, এমন ভারতীয় প্রফেশনালদের একটি সংগঠন আছে দিল্লিতে, যার নাম ‘ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টার অ্যাসোসিয়েশন’ (বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশে এর শাখা আছে)। এই অ্যাসোসিয়েশন তিন দিনব্যাপী এক কনফারেন্স (ইস্ট-ওয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া কনফারেন্স নামে) ডেকেছিল দিল্লিতে ৮-১১ সেপ্টেম্বর, যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন জয়শঙ্কর ও অন্য আরেক নোবেল সেলিব্রিটি। জয়শঙ্কর সেখানে যে লিখিত বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটারই সারাংশ ওই খবরের উৎস, যা মিডিয়া রিপোর্টে এসেছে। এখন আরো প্রশ্ন ‘ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারটি’ আবার কোন ধরনের প্রতিষ্টান?
‘ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টার’ আমেরিকার ৫০তম রাজ্য হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ রাজ্যে একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক জাতীয় নন-প্রফিট একাডেমিক প্রতিষ্ঠান আছে। হাওয়াই আমেরিকান মূল ভূখণ্ডের বাইরে প্রশান্ত মহাসাগরে এক দ্বীপপুঞ্জ রাজ্য। আমেরিকার সাথে এশিয়ার ভূখণ্ডগত দূরত্বের দিক থেকে এ দ্বীপ মাঝে অবস্থিত।  হাওয়াইয়ে ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠানের বিরাট ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠানটি জন্ম বা উদ্বোধনের সময় সাবেক সিনেটর  ও সেকালের আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডসে জনসন বলেছিলেন, এটা ‘পশ্চিম (আমেরিকার) আর পুবের (এশিয়ার) ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের মিলনস্থল হবে।’ 
আরো প্রশ্ন, আমেরিকা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান খুলে কেন? এর জবাবে প্রেক্ষিতের দিকটি হলো দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম। এই বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে দেখে বললে, গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের মধ্যে বসবাস ও অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো অসমভাবে বিকশিত হয় বা হচ্ছে, ফলে পরস্পরবিরোধী নানা স্বার্থবিরোধ তৈরি হতে থাকে। এই দ্বন্দ্ব-বিরোধগুলোকে নিয়ে বসে কথা বলে সমন্বয়ের মাধ্যমে তা যতটা কমানো বা লঘু করে দেয়া যায়, বুঝ দেয়া যায়, কাউকে কাউকে কিনে ফেলা বা প্রভাবিত করে রাখা যায়; এ প্রয়োজনে আমেরিকা ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারের মতো একাডেমিক ও নীতি গবেষণা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ার তাগিদ বোধ করে থাকে। থিঙ্কট্যাঙ্ক-জাতীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই ‘ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টার’ কিছুটা ভিন্ন এক অর্থে যে, এ সেন্টার নিজে চলার একটা বড় ফান্ড আমেরিকান সরকার থেকে আসে, আর বাকিটা অন্যান্য আমেরিকান দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তুলে চলে। যেখানে থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর বেলায় তারা প্রায় সবাই প্রাইভেট দাতব্য প্রতিষ্ঠানের (সরকারি ফান্ড নয়) অর্থে চলে।
জয়শঙ্করের বক্তৃতা লিখিত ও তাতে ১৭টা পয়েন্ট ছিল। যার মূলকথাগুলো বিশদভাবেই ‘দ্য হিন্দু’ নিয়ে এসেছিল তিনটা শিরোনামে : চীন প্রসঙ্গ, টেররিজম ও পাকিস্তান এবং শেষে বাংলাদেশ। সেখান থেকে বাংলাদেশের মিডিয়া কেবল বাংলাদেশ অংশটিই তুলে রিপোর্ট করেছে।
এ সম্মেলনে জয়শঙ্করের টার্গেট শ্রোতা পশ্চিম, বিশেষত আমেরিকা। অর্থাৎ ঠিক বাংলাদেশ বা এ দেশের জনগণ নয়। কারণ আমেরিকা যেন এশিয়া নিয়ে ভারতের কথা শুনতে এসেছে। ফলে ভারতের চোখে এশিয়ায় দ্বন্দ্ব বা খোঁচা-বিরোধ তৈরি হয়ে থাকা জায়গা হলো এই তিন ইস্যু। জয়শঙ্কর আমেরিকাসহ পশ্চিমকে বলতে চাচ্ছেন, শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের ঝামেলায় আছে। বিগত ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের ওপর ভর করে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার বিরুদ্ধে আমেরিকার অবস্থান আছে কথা সত্য। কিন্তু ‘এটা সমালোচনার সময় নয়। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আমাদেরও উদ্বেগ রয়েছে। আর এ জন্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সরকারকে সমর্থন দেয়া উচিত।’ এটা দ্য হিন্দু থেকে অনুবাদ করে নিয়ে লেখা হলো। ওদিকে আনন্দবাজার কথাটা লিখেছে এভাবেÑ ‘বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদকে রক্ষা করা না গেলে সেখানে জঙ্গিপনা আরো বাড়বে।’ তবে জয়শঙ্করের ১৭ পয়েন্টের বক্তব্য যেটা সরাসরি ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সাইটে পাওয়া যায়, তার ১৪ নম্বর পয়েন্ট হলোÑ ‘বাংলাদেশ সেকুলারিজম ও বহুত্ববাদ চাপের মুখে আছে, এই অবস্থায়  আমাদের দ্বিধা ঝেড়ে সমর্থন করা উচিত। ঘটনাগুলোকে আলাদা আলাদা করে প্রত্যেক দিকে অতিরিক্ত গুরুত্বের সাথে না তাকিয়ে আমাদের বরং সামগ্রিক উন্নয়নের অভিমুখের দিকে তাকানো উচিত, সুনির্দিষ্ট করে এটা গুরুত্বপূর্ণ।’ এ অনুবাদ আমার করা এবং এখানে লেখা। 
জয়শঙ্কর বলতে চাইছেন, সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন হয়েছে কি না, অভিমুখ ঠিক আছে কি না সেটা আগে চেক করলেই তো হয়। তা হয়ে থাকলে সেটা অর্জনে গুম-খুন-নিপীড়ন-দলন ধরনের কিছু হয়ে থাকলে সেগুলো আর আলাদা আলাদা করে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। কিন্তু মজার কথা এখানে, আমাদের জন্য প্রথম বাক্যটির চেয়ে দ্বিতীয় বাক্যটিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দ্বিতীয় বাক্যটি নিজেই জয়শঙ্করের প্রথম বাক্যটির বিরোধী।
জয়শঙ্করের দ্বিতীয় বাক্যের সারকথা হলো- সামগ্রিক বিচারে উন্নয়নের অভিমুখ ঠিক আছে তো, সব ঠিক আছে। তাহলে যদি তাই হয়, তবে প্রথম বাক্য আর বলার দরকার থাকে না। “সেকুলারিজম ও বহুত্ববাদ বিপদে থাকুক আর নেই থাকুক, আমাদের হাসিনা সরকারকে দ্বিধাহীন সমর্থন করার সাথে কিছু না। কারণ উন্নয়ন তো হয়েছেই। উন্নয়ন ঠিকমতো হয়ে থাকলে ‘সেকুলারিজম ও বহুত্ববাদ বিপদে আছে’ কি না তা আবার দেখতে যাবো কেন?” সেকুলারিজম ও বহুত্ববাদকে আবার রক্ষা করা কেন, উন্নয়ন ছাড়া আর কোনো কিছু নিয়ে ফোকাস না করতেই কি জয়শঙ্কর দ্বিতীয় বাক্যে আমাদের পরামর্শ দেননি? উন্নয়ন হলেই তো সব হচ্ছে!
তাহলে দাঁড়াল, বাংলাদেশ সম্পর্কে জয়শঙ্কর দু’টি বাক্য লিখেছেন, যার একটি অপরটিকে নাকচ করে দেয়। এ ধরনের স্ববিরোধী পরিস্থিতিতে আমরা বলতে পারি, ভারতের বিদেশ সচিব জয়শঙ্করের ‘কথা হয় না’! কারণ তা স্ববিরোধী। আচ্ছা, একটা সেকেন্ড থট দেয়া যাক।
‘বহুত্ববাদ’ এই শব্দটি কি ভারতের বিদেশনীতিতে আছে বা ছিল? তা আগে জানা যায়নি। নাকি আমেরিকাকে খুশি করতে কেবল এখন এই শব্দ ব্যবহার করতে চাইছে? আমাদের সন্দেহ হচ্ছে। কেন? বহুত্ববাদ বলতে আমেরিকা আমাদেরকে বোঝাতে চায় কেবল সরকারের বক্তব্য নয়, সরকারবিরোধীদেরও সমালোচনা বক্তব্য থাকবে, থাকতে দিতে হবে। বিরোধীরাও অবাধে তাদের কথা বলতে পারবে। তাদের কোনো আপত্তি, বিরোধিতা থাকলে তা আমলে নিতে হবে। ইনক্লুসিভ অর্থে সবাইকে কথা বলতে দিতে হবে ও ক্ষমতাসীনদের তা শুনতে হবে। তা বিনা বাধায় তা সরকারকে সহ্য করতে হবে। জয়শঙ্কর কি বহুত্ববাদ বলতে এটা বুঝেছেন বা বুঝাচ্ছেন? তাই যদি হয়, তবে ২০১৪ নির্বাচনে সবাইকে নিয়ে নির্বাচনের বিপক্ষে কেন ভারত অবস্থান নিয়েছিল? কেন ভারতের বিদেশ সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে জানালেন সবাই নয়, যারা যারা আসে এই অর্থে মেজরিটি নিয়ে নির্বাচনের পক্ষে ভারতের অবস্থান? অর্থাৎ বহুত্ববাদকে ভারত নিজেই বহু আগে থেকে চাপের মুখে বিপদে ফেলে রেখেছে। তাই নয় কী? তাহলে এখন কান্নাকাটি করে লাভ কী? বোঝা যাচ্ছে, জয়শঙ্কর খুব খারাপ ছাত্র! এসব দিক হোমওয়ার্ক করে ক্লাসে আসেননি!
আসলে মানতেই হবে সুজাতা বুদ্ধিমান ছিলেন। কারণ ভেবে দেখলে বোঝা যায়, এখন থেকেই বহুত্ববাদের কথা তুলে জয়শঙ্কর কি নিজের বিপদ ডাকছেন না! যেটা সুজাতা কখনোই করেননি। যেহেতু ২০১৪-এর নির্বাচন বলে রাখা হয়নি যে, ২০১৯ সালে সরকারের মেয়াদ শেষ হবে না, তার মানে সরকারকে আবার নির্বাচনের ঝামেলা পোহাতে হবে। সেই আলোকে আগে থেকেই বহুত্ববাদের কথা মাঠে এনেছেন বলে জয়শঙ্করের বিপদের আশঙ্কা প্রবল। সুজাতা বুদ্ধিমান ছিলেন বলে ‘বহুত্ববাদ’ বলে কোনো কথাই তোলেননি। এবার সুজাতার জায়গায় জয়শঙ্কর কী বলবেন?
আসলে কঠিন এক বাস্তবতা হলো, আমরা মানি আর না-ই মানি, ক্ষমতা বলে কিছু থাকলে ক্ষমতার বিরোধী বলেও কেউ কেউ থাকবে। এখন বিরোধী বলতে যদি কোনো বিরোধী দল না থাকতে দেই, মানে আমার দলের বাইরে বিরোধী থাকতে না দেই। তাহলে আমার দলের ভেতরেই এক সবল বিরোধী গ্রুপ হবে। এ ছাড়া আরো এক বিপদ আছে। লিবারেল বা আইনি বিরোধী দলের সবাইকে যদি গুম-খুন করে দমিয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলি, তো এবার এক সশস্ত্র বিরোধী দল হাজির হবে।  এর অর্থ হলো- আসলে আমিই ঠিক করি আমার বিরোধীরা কেমন হবে, কোথায় থাকবে, ভেতরে না বাইরে, সশস্ত্র না নিরস্ত্র ইত্যাদি। অর্থাৎ বেছে নেয়ার দায় এবং ক্ষমতা আসলে ক্ষমতাসীনের। দেখেন কোনটা নেবেন! অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সুযোগ নেই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন