শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

হঠাৎ কেন বেলুচিস্তান?

হঠাৎ করে পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ বেলুচিস্তান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে উপনীত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটির স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে লাল কেল্লা থেকে দেয়া ভাষণে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত গিলগিট, বাল্টিস্তান, আজাদ কাশ্মির আর বেলুচিস্তানের অধিবাসীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মোদি বলেছেন, তাদের (বিচ্ছিন্নতাবাদী) পক্ষে কথা বলার জন্য তারা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ এটাকে বেলুচিস্তানে অন্তর্ঘাতী কাজের পেছনে যে র’ জড়িত, তার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। 
ভারত বিষয়টিকে এখানেই শেষ করেনি, বরং দেশটির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর মোদির চেয়ে অরো এক ধাপ এগিয়ে বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে সেখানকার পরিস্থিতিকে ১৯৭১ সালের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির সাথে তুলনা করেছেন। এর মাধ্যমে কার্যত তিনি বেলুচিস্তানের কথিত স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টার প্রতি পরোক্ষ সমর্থন জানিয়েছেন। এর পরপরই নয়াদিল্লি সফররত বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু নরেন্দ্র মোদির অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বেলুচিস্তানের ব্যাপারে বাংলাদেশ তার অবস্থান ব্যক্ত করে একটি নীতিগত বিবৃতি প্রকাশ করবে বলে দিল্লিতে বসেই ঘোষণা দিয়ে এসেছেন। আর এ সময়টাতে আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই মোদির দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি কতটা গভীর। এ ব্যাপারে মার্কিন প্রতিক্রিয়াটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না। তবে সেখানে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ রয়েছে। 
এ ব্যাপারে ইসলামাবাদের বক্তব্য হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী কাশ্মিরের উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে আড়াল করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতে এই নতুন ইস্যু নিয়ে এসেছেন। কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। এ ব্যাপারে রয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদিত প্রস্তাব। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ও আফগানিস্তানের কারজাইয়ের সমর্থনে ভারত যে বেলুচিস্তানকে আন্তর্জাতিক ইস্যু বানাতে চাইছে, সেটি পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। বেলুচিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরফরাজ বুগতিও এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি সরাসরি সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করছেন। সংলি ও খালিদ সামরিক ঘাঁটিতে সাম্প্রতিক হামলা এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর উদ্যোগকে ব্যাহত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে চালানো অন্তর্ঘাতী তৎপরতার জন্য তিনি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’কে দায়ী করেছেন। 
গত বছর অক্টোবরে পাকিস্তান বেলুচিস্তানে ভারতের অন্তর্ঘাতী তৎপরতার বিভিন্ন প্রমাণ জাতিসঙ্ঘে উপস্থাপন করেছে। গত মার্চে র-এ কর্মরত একজন নৌবাহিনী কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদবকে আটক করে পাকিস্তানি নিরাপত্তাবাহিনী। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও বেলুচিস্তানে ভারতের অন্তর্ঘাতী তৎপরতায় সম্পৃক্ততার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে ইসলামাবাদ। এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর রেকর্ডে করাচি, বেলুচিস্তান, গোয়াদর সমুদ্রবন্দর এলাকা এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর-কেন্দ্রিক বিভিন্ন অন্তর্ঘাতী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়। ভারত অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, কুলভূষণ এখন আর ভারতের নৌবাহিনীতে কর্মরত নেই। 
বেলুচিস্তান ইস্যুতে মানবাধিকার ও নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ্যে বলা হলেও সেখানে নির্মিত বৃহৎ সমুদ্রবন্দর গোয়াদর এবং ৪৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগপুষ্ট চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের বিষয়টি মূল ফোকাস হিসেবে উঠে এসেছে। ভারত শুরুতেই এ ব্যাপারে বিরোধিতা করে এসেছে এই বলে যে, এই করিডোর ‘বিতর্কিত’, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের ওপর দিয়ে গেছে। এটিই বেলুচিস্তান ইস্যুতে নতুন ঘটনাপরম্পরায় চীনকে সরাসরি সম্পৃক্ত করেছে। বেইজিং বেলুচিস্তানের ব্যাপারে মোদির মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে। বেলুচিস্তানকে অস্থিতিশীল করে তোলা কাশ্মিরের উত্তপ্ত হওয়ার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয়ার প্রয়াস বলেও চীনের প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। বেইজিং সরকারিভাবে বলেছে, চীন ও পাকিস্তান দুই দেশের জনগণেরই এই প্রকল্পের ব্যাপারে ব্যাপকভিত্তিক সমর্থন রয়েছে। এর বাস্তবায়নের ব্যাপারে চীন সর্বতোভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুই দেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যের সংযোগ এবং বাস্তবমুখী সহযোগিতা জোরদার করতে এ ব্যাপারে ঐকমত্যের অনেক বড় তাৎপর্য রয়েছে। এখন চীন ও পাকিস্তান করিডোরের পূর্ণ বাস্তবায়নের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। দুই দেশ অর্থনৈতিক করিডোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে এর সুবিধা ছড়িয়ে দিতে চায়। এর নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে পাকিস্তানি নিরাপত্তাবাহিনীর পূর্ণ সামর্থ্য রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে চীন। 
চীনের এ প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে মনে হচ্ছে, বেলুচ ইস্যুটিকে ভারত সামনে নিয়ে আসতে চাইলে তা বহুমাত্রিক রূপ নিতে পারে। বেলুচিস্তানে অস্থিরতা সৃষ্টির অর্থ শুধু পাকিস্তানকে অস্থির করে তোলাই নয়, একই সাথে তা চীনের ওপর আঘাত হানারই শামিল হবে বলে মনে করছে বেইজিং। এটি চীন-ভারত সম্পর্ককেও প্রভাবিত করতে পারে বলে বেইজিংয়ের প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক সুপ্ত বার্তা রয়েছে। এর অর্থ হলো ভারতে যে বিপুল চীনা বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে যৌথ অর্থনৈতিক উদ্যোগ রয়েছে, তা এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদ-প্রবণ অঞ্চলগুলো হয়ে উঠতে পারে আবার অস্থির। এ কারণে চীনের এ প্রতিক্রিয়াকে দিল্লির বিশ্লেষকেরা অনেক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। অনেকে মোদির নতুন অবস্থান দীর্ঘমেয়াদে ভারতের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে বলেও মন্তব্য করছেন।
মোদি এবার স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে যে কথা বলেছেন, সেটি আকস্মিক কোনো বক্তব্য ছিল বলে মনে হয়নি। তিনি নয়াদিল্লিতে এর আগে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সংসদীয় সভায়ও বলেছেন, এখন সময় এসেছে যখন বেলুচিস্তান গিলগিট-বাল্টিস্তান ও আজাদ কাশ্মিরের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের চালানো দমন-নিষ্পেষণের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। মোদির সামনে কাশ্মিরের ব্যাপারে এমন দু’টি তাৎক্ষণিক সঙ্কট রয়েছে, যেগুলো মোকাবেলা করা তার জন্য এখন বেশ জটিল। এর একটি হলো কাশ্মিরি তরুণ যোদ্ধা ওয়ানির হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে যে প্রচণ্ড উত্তপ্ত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তার তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না। ভারতের নিরাপত্তাবাহিনী এ ব্যাপারে যে দমনমূলক পন্থা নিয়েছে, তাতে পরিস্থিতি অধিকতর অবনতির দিকেই যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, কাশ্মিরের এই পরিস্থিতি এই ইস্যুটির সমাধানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেয়ার দাবি জোরালো করার সুযোগ এনে দিয়েছে পাকিস্তানের সামনে। 
বেলুচিস্তান নিয়ে মোদির বক্তব্যের পর পাকিস্তানে ভারতবিরোধী জনমত অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বেলুচ পরিস্থিতিকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে তুলনা করার ফলে পাকিস্তানিদের মনে পুরনো ‘বিচ্ছিন্নতা’বাদের দৃশ্যপটই ভেসে উঠেছে। ফলে যারা বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কিছু জাতীয়তাবাদী দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তারাও এখন ভিন্ন অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক আইনসভা সর্বসম্মতিক্রমে মোদির মন্তব্যের নিন্দা করে প্রস্তাব পাস করেছে। 
বেলুচিস্তানকে কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বাছাই করা হচ্ছে, সেটি একটি প্রশ্ন। বেলুচিস্তানের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে স্বাধীনতা লাভের পরপরই চিফ কমিশনারের অধীনে যে বেলুচিস্তান প্রদেশ ছিল, তা পাকিস্তানে যোগ দেয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে কালাত অঞ্চল শর্তসাপেক্ষে পাকিস্তানে যোগ দেয়। ১৯৫২ সালে চারটি অঞ্চল মিলে বেলুচিস্তান স্টেট ইউনিয়ন গঠন করা হয়। গোয়াদর ছিটমহল তখনো ওমানের একটি অংশ ছিল। পাকিস্তান সেটি ১৯৫৮ সালে ওমানের সুলতানের কাছ থেকে কিনে নিয়ে বেলুচিস্তানের অংশ করে নেয়। 
পাকিস্তানের ৪৪ শতাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত এই প্রদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে আফগানিস্তান, দক্ষিণ-পশ্চিমে ইরান, উত্তর-পূর্বে পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং দক্ষিণ-পূর্বে খায়বার পাখতুন খোয়া ও ফেডারেল নিয়ন্ত্রিত এলাকা সিন্ধুর অবস্থান। এর দক্ষিণে রয়েছে আরব সাগর। বেলুচিস্তানের সাথে নৌসীমান্ত রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার। বেলুচিস্তানের অবস্থান কৌশলগত পানিপথ, ইরানে হরমুজ প্রণালীর মুখে। এটি হলো মধ্য এশিয়ায় যাওয়ার সংক্ষিপ্ততম পথ। তদুপরি, বেলুচিস্তান হলো উত্তোলনযোগ্য ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসম্পদের সমৃদ্ধ মজুদ ক্ষেত্র। এখান থেকে পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি জ্বালানি সরবরাহ করা হয়। পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের বড় মজুদ এবং পরীক্ষাগার এখানে রয়েছে বলে মনে করা হয়। 
এক কোটি ৩১ লাখ জনসংখ্যা-অধ্যুষিত প্রদেশ বেলুচিস্তানে যখনই বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা চাঙ্গা হয়েছে, তখনই অর্থনৈতিক দুর্দশা নেমে এসেছে। ১৯৭০-এর দশকে অন্য এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হলেও পিছিয়ে পড়ে বেলুচিস্তান। এ সময়ে বেলুচিস্তানের আয় জিডিপির ৪.৯ শতাংশ থেকে ৩.৭ শতাংশে নেমে আসে। দারিদ্র্যের হারেরও এ সময় অবনতি লক্ষ করা যায়। ২০০১-০২ সালের ৪৮ শতাংশ দারিদ্র্য ২০০৫-০৬ সালে ৫০.৯ শতাংশে পৌঁছে যায়। এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য যখনই বাজেট বরাদ্দ ও সম্পদপ্রবাহ বাড়ানো হয়েছে তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী বা উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারণার মাধ্যমে এর গতি রোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। গোয়াদর বন্দর নির্মাণ, অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠা এবং বিপুল বিনিয়োগে দু’টি হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি প্রজেক্ট নির্মাণের উদ্যোগের ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা বেলুচিস্তানে। কিন্তু এসবের ব্যাপারে নানাভাবে বিরূপ প্রচারণা চালানো হয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষ থেকে। 
একটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে আপাত শান্ত বেলুচিস্তানকে পরিকল্পিতভাবে আন্তর্জাতিক আলোচনার পাদপ্রদীপে নিয়ে আসা হয়ে থাকতে পারে। পাকিস্তানের খনিজসম্পদে সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ, বেলুচিস্তানের প্রতি ভারতের দৃষ্টি অনেক আগে থেকেই। তাদের সামনে পাকিস্তানকে বিভাজিত করার যে মহাপরিকল্পনা, তাতে দেশটির পূর্বাংশের পর ছিল এই বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশÑ যার এখন খায়বার পাখতুন খোয়া হিসেবে নতুন নামকরণ করা হয়েছে। 
ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা র-এর একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বি. রমণ তার লেখা ‘কাউ বয়েজেস অব র’ শীর্ষক বইয়ে এটি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে যে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, তার মূল কারণ বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়াকে ঠেকানো ছিল না। এটি ছিল আসলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যাতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের পর বেলুচিস্তান বা সীমান্ত প্রদেশের নতুন প্রকল্পের দিকে না আগান, তার জন্য হুঁশিয়ারি সঙ্কেত। ইন্দিরা গান্ধী এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনকে আশ্বস্ত করার পর সপ্তম নৌবহর কোনো ধরনের অপারেশন ছাড়াই বঙ্গোপসাগর ত্যাগ করে চলে যায়। 
র-এর এই শীর্ষ কর্মকর্তার ইঙ্গিত অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছে। কিন্তু সে সময় আমেরিকার বলয়ে থাকা পাকিস্তানের অধিকতর বিখণ্ড হওয়া কামনা করেনি। পাকিস্তান-সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধের আড়াই দশক পর আজ বিশ্বে সে অবস্থা আর নেই। নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারত অধিকতরভাবে আমেরিকান বলয়ের সাথে একাত্ম হয়েছে। অন্য দিকে, পাকিস্তান চীনের সাথে বন্ধন জোরালো করার সাথে সাথে রাশিয়ার সাথে সামরিক ও অন্যান্য সম্পর্ক গড়ার দিকে মনোযোগী হয়েছে। 
বেলুচ অঞ্চলের বড় অংশটি এখন পাকিস্তানে। এর কিছু অংশ রয়েছে ইরান ও আফগানিস্তানে। বেলুচিস্তানকে যারা স্বাধীন করতে চায়, তারা এই পুরো বেলুচ অঞ্চলকে একটি আলাদা রাষ্ট্র করতে চাচ্ছে। ২০০৬ সালে আমেরিকান ডিফেন্স জার্নালে এবং এর পরে আটলান্টিক সাময়িকীতে মধ্যপ্রাচ্যের যে পরিবর্তিত মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে পুরো বেলুচ অঞ্চলকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখানো হয়। 
পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সাথে স্থলসীমান্ত রয়েছে ইরান ও আফগানিস্তানের। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় সমর্থন দিতে হলে ভারত বা আমেরিকাকে অবশ্যই এই দুই দেশের কোনোটিকে ব্যবহার করতে হবে। ইরান কোনো সময়ই পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দেয়নি। ইরানের বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু পাকিস্তানের ব্যাপারে এই অভিযোগ নেই। ইরানের সাথে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অতীতকাল থেকেই ভালো। ইরান তার চাবাহার বন্দর উন্নয়নের কাজ ভারতকেই দিয়েছে। কিন্তু এই বন্দরকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের সুযোগ তেহরান দেবে বলে মনে হয় না। এর প্রতিক্রিয়া ইরানের ওপর কতটা কিভাবে পড়বে, সে হিসাব ইরান করবে। 
অন্য দিকে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসানের পর থেকে আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট হয়ে নানা ক্ষেত্রে দিল্লি আফগানিস্তানে নিজের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করে এসেছে। এই প্রচেষ্টায় যতটুকু ফল এসেছে, তাতে আফগানিস্তানের ভূখণ্ড পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা সহজ হবে বলে মনে হয় না। 
তবে এ কথা ঠিক যে, বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি শক্তিশালী গ্রুপ রয়েছে। ওদের গোত্রভিত্তিক কিছু সমর্থনও রয়েছে। কিন্তু এর সাথে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আলাদা হওয়ার ব্যাপারে জনগণের ব্যাপকভিত্তিক যে সমর্থন ছিল, তার কোনো তুলনা করা যায় না। আর ভারত বাংলাদেশকে এই ইস্যুতে সম্পৃক্ত করে এর একটি আঞ্চলিক রূপ দিতে চাইছে। তথ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মূল শাসক দলের অংশ না হওয়ায় তার বক্তব্য কতটা সরকারের বক্তব্য, সেটি স্পষ্ট হচ্ছে না। এই ইস্যুতে ভারতের সাথে একাত্ম হলে বর্তমান সরকার রাজনৈতিকভাবে ভারতের অধিক পৃষ্ঠপোষকতা হয়তো পেতে পারে, যা সরকারের ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে কিছুটা সহায়কও হতে পারে। কিন্তু এর সাথে যেভাবে চীন যুক্ত হয়ে পড়েছে, তাতে বাংলাদেশ এর সাথে বেশি জড়াতে চাইলে নিজের ঘরে সঙ্কট অবস্থা ডেকে আনবে কি না সে সংশয়ও রয়ে গেছে। বর্তমান জটিল বিশ্বপরিস্থিতিতে চীন-রাশিয়া যে অক্ষ তৈরি হয়েছে, তাদের প্রতিপক্ষে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হতে পারবে, তা নিয়ে নানামুখী সন্ত্রাস রাজনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে সরকারেরও সংশয় থাকাই স্বাভাবিক। 
ফলে শেষ পর্যন্ত বেলুচিস্তানের ইস্যুটি ইরান ইরাক তুরস্ক ও সিরিয়ার কুর্দ এলাকা নিয়ে আলাদা কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠার মতো একটি জটিল ইস্যু হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটি শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে প্যান্ডোরার বাক্স খোলার মতো বিষয়, যার জের ধরে একের পর এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে থাকবে এশিয়াজুড়ে। এই ইস্যুর বড় ঝুঁকি এখানেই। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন