মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৬

উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে !!!!!!

বাম হাতে চালিত গাড়ির কথা মাথায় রেখে নকশা প্রণয়ন করা হয় মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের। আর সে ভুল নকশা মেনেই নির্মাণ করা হচ্ছে ফ্লাইওভারটি। এতে নানা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও এখন আর ত্রুটি সংশোধন সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। কারণ ত্রুটি সারাতে গেলে ভাঙতে হবে ৬০টি পিলার।

সূত্র জানায়, ফ্লাইওভারের কাঠামোয় ত্রুটির বিষয়টি বেশকিছু দিন আগেই চিহ্নিত করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞরা। মূলত ভুল নকশার কারণেই এটি হয়েছে। বিষয়টি এলজিইডিকে অবহিতও করে বুয়েট। এক্ষেত্রে ৬০টি পিলারে ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়। তবে পিলার নির্মাণ হয়ে যাওয়ায় তা আর সংশোধন করা সম্ভব নয় বলেই জানায় এলজিইডি। কারণ হিসেবে বলা হয়, নির্মাণ হয়ে যাওয়ায় ছয় প্রান্তের প্রায় ৬০টি পিলার ভাঙা সম্ভব নয়। এতে ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। নতুন করে নকশা প্রণয়নে প্রকল্প বাস্তবায়নও বিলম্বিত হবে। পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নও অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক নাজমুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়নে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া হয়। আর নকশা সংশোধনে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। তাই নকশায় কোনো ত্রুটি থাকার কথা নয়। এর পরও ভিন্নমত থাকতেই পারে। এ বিষয়ে এলজিইডির কিছুই করার নেই।

তবে প্রকল্প পরিচালকের এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, ফ্লাইওভারটির মূল পরিকল্পনা ও নকশা আগেই করা হয়েছিল। তবে নির্মাণ শুরুর পর ভূগর্ভস্থ পরিষেবা সংযোগ লাইনের কারণে বিভিন্ন স্থানে পাইলিং করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ফাউন্ডেশনের নকশা সংশোধনে বুয়েটের সহায়তা নেয়া হয়। পুরো নকশার বিষয়ে বুয়েটের কোনো পরামর্শ নেয়া হয়নি। এমনকি ওঠানামার র্যাম্পের মধ্যে অসামঞ্জস্য সৃষ্টির বিষয়টি জানালেও তারা তা বিবেচনা করেনি।

বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, ফ্লাইওভারের নকশা বিশ্লেষণেই অসামঞ্জস্যের বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যায়। কারণ ফ্লাইওভারে ওঠার র্যাম্পগুলোয় পিলার রয়েছে আটটি। আর নামার র্যাম্পগুলোয় পিলার রয়েছে ১১টি করে। এতে ওঠার র্যাম্পের দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ মিটার আর নামার ক্ষেত্রে ৩২০ মিটার।

ফ্লাইওভারে ওঠার রাস্তা বেশি ঢালু হয়, যাতে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়েই ওঠা যায়। আর নামার রাস্তাটি হয় তুলনামূলক খাড়া। ফলে গতি কমিয়ে দ্রুত ফ্লাইওভার থেকে নামা যায়। এতে ফ্লাইওভারে ওঠার র্যাম্পটির দৈর্ঘ্য বেশি ও নামার র্যাম্পের দৈর্ঘ্য থাকে কম।

তবে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাতরাস্তা, মগবাজার, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, শান্তিনগরসহ প্রতিটি এলাকায় ওঠার র্যাম্প অনেক বেশি খাড়া। এজন্য এগুলোর দৈর্ঘ্যও রয়েছে কম। আর নামার র্যাম্পগুলো তুলনামূলক বেশি ঢালু। ফলে এগুলোর দৈর্ঘ্যও বড় রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বাম হাতে চালিত যানের জন্য নির্মিতব্য এ ফ্লাইওভার ডান হাতে চালিত যানের জন্য ব্যবহার করতে হবে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের মতে, ভুল নকশায় নির্মাণের ফলে ফ্লাইওভারটিতে উঠতে কিছু সমস্যা হবে। ৬০ কিলোমিটারের কম গতিতে ফ্লাইওভারে ওঠায় ঝুঁকি থাকবে। বিশেষত মালবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকবে বেশি। কারণ বেশির ভাগ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ফিটনেসে সমস্যা আছে। এগুলোর গতিও অনেক কম। ফলে ফ্লাইওভারে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ওঠা নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে।

এদিকে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে শান্তিনগর ছাড়া অন্য কোনো স্থানে ডানে মোড় নেয়ার সুযোগ নেই। তিন তলাবিশিষ্ট ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও মগবাজার, বিশ্বরোড ইন্টারসেকশন ও টঙ্গী ডাইভারশন রোডে ওঠার কোনো র্যাম্প রাখা হয়নি। এতে ফ্লাইওভারের যানবাহনের সংখ্যা কমে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব জানান, জবাবদিহিতার বাইরে গিয়ে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ সামগ্রিকভাবে মঙ্গল বয়ে আনবে না। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশার ত্রুটি মহাখালী ফ্লাইওভারের ক্ষেত্রেও ছিল। মহাখালী ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সচল ডাইভারশন তৈরি করা যায়নি। মহাখালী ফ্লাইওভারের কার্যকারিতা বাড়াতে তেজগাঁও শিল্প এলাকার দিকে একটা উইং দরকার ছিল, এটাও করা যায়নি। মহাখালীর মতো মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারও এক প্রকার অকার্যকর করে নির্মাণ করা হচ্ছে। আমাদের গাড়িচালকরা কোন দিকে বসেন, অথবা আমরা জাপান-যুক্তরাষ্ট্র নাকি ব্রিটিশ— কোন সিস্টেমে চলব, তা বিবেচনা করা ছাড়াই এটি নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বিবেচনা না করার ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ গণশুনানি ছাড়াই এ ধরনের বড় অবকাঠামো নির্মাণ। আর গণশুনানি হয় না বলেই এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের সময়ও জনদুর্ভোগের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয় না।

জানা গেছে, ২০০৩ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা প্রণয়ন করে। সে নকশার ভিত্তিতেই ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ফ্লাইওভারের নকশা ত্রুটির এটিই মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে মোটরযানের সম্পূর্ণটাই বাম হাতে চালিত। তাই সে দেশের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয়ায় মূলত নকশায় ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এছাড়া এলজিইডি গ্রামে-গঞ্জে সড়ক নির্মাণ করে। শহরে ফ্লাইওভার নির্মাণের কোনো অভিজ্ঞতাই তাদের নেই। ফলে নকশা প্রণয়নের সময় সংশ্লিষ্টরা ত্রুটি চিহ্নিত করতে পারেননি।

তারা আরো জানান, বাম হাতে চালিত যানের কারণে নকশা করায় এফডিসির সামনে র্যাম্পটি ফ্লাইওভারে ওঠার জন্য ব্যবহারের কথা ছিল। এখন এটি নামার র্যাম্প হিসেবে ব্যবহার হবে। আর এ ত্রুটির কারণে র্যাম্পটিকে সম্প্রসারণ করে এফডিসির সামনের রেলপথ অতিক্রমের পর সোনারগাঁও হোটেলের সামনে এসে শেষ করা হবে।

মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক নাজমুল আলম বলেন, ঢাকা শহরের মগবাজার-মৌচাক-শান্তিনগর একটি ব্যস্ততম এলাকা। ওই এলাকায় সবার সামনেই ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হচ্ছে। তাই পুরো প্রক্রিয়াই দৃশ্যমান। নকশা ঠিক হলেও সবার সামনেই হয়েছে, ভুল হলেও সবার সামনেই। তবে এ ফ্লাইওভারে নিচের সড়ক অনেক কম ব্যবহার হয়েছে। তাই এটি যানজটের কোনো সমাধান দিতে পারুক বা না পারুক, অন্তত নতুন কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন