শনিবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০১৬

বিশ্ব নিরঙ্কুশ গণতন্ত্র প্রসববেদনায় কাতর

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্ব গণতন্ত্র প্রসব করেছে। চলমান তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে তা নিরঙ্কুশ করার প্রক্রিয়াধীন। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অর্জিত সুফল। এ যুদ্ধের ন্যাক্কারজনক প্রেক্ষাপট এবং সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি বর্ণনাতীত। তারপরও তা কলোনী যুগের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে।

গণতন্ত্র বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে চর্চা করছে। নিঃসন্দেহে এর অনেক ত্রুটিবিচ্যুতিও রয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের বিকল্প কেউ ভাবে না। এমনকি; কমিউনিস্টরাও গণতন্ত্রকেই তাদের চূড়ান্ত লক্ষে পৌঁছার প্রাথমিক ধাপ মানেন। ব্যতিক্রম কেবল ইহুদী ও মুসলমান সম্প্রদায়। অবশ্য ইহুদীরা সংখ্যার দিক থেকে এতই নগণ্য যে; তারা এখন আর কোন ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত নয়। তবে মুসলমান সম্প্রদায়; বিশেষ করে রাজনৈতিক মুসলমানরাই গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে শক্ত বাধা। একারণে; গণতন্ত্রের কুশি-লবরা মুসলমান নিধন করাই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ার জন্য অপরিহার্য মনে করছেন। গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্ব অত্যন্ত সুনিপুণ পরিকল্পনায় সেই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ইতোমধ্যেই শুরু করেছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ার পর; সিরিয়া-সহ; সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এখন বিরাণ-ভূমি।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান সঠিক ও যথার্থ অনুধাবন করেছেন। তিনি সুফী-সাধক মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির ৭৪২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘সেব আই আরোস ইস্তাম্বুল-২০১৫’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে বলেন; “সিরিয়ায় আই এস বিরোধী যুদ্ধ মঞ্চ নাটকে পরিণত হয়েছে। সিরিয়ায় যে আই এস বিরোধী যুদ্ধের অযুহাতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে সে যুদ্ধ এখন এক বিয়োগান্ত নাটকে রূপ নিয়েছে। সেখানে; কেউই ভালো-মন্দের মধ্যে কোন পার্থক্য করতে পারছে না। সেখানে; প্রত্যেকেই অভিনয় করছেন, নিজেদের ভূমিকা লুকিয়ে রাখছেন। বাস্তবতা হলো; সেখানে; প্রতিনিয়ত নারী, শিশু ও বয়স্করা হত্যার শিকার হচ্ছে, একই সাথে বাড়ি-ঘর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস হচ্ছে। নানা উদ্দেশ্য নিয়ে সিরিয়ায় বোমা ফেলা হচ্ছে। যেখানেই বোমাটি বিস্ফোরণ হোক না কেন; তাতে বিপুল রক্তপাত ও প্রাণহানী ঘটছে। এর পিছনে নিশ্চয়ই এক মহা-পরিকল্পনাকারীর মহা-পরিকল্পনা রয়েছে।”
অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞের পরও জীবি
তরা ইউরোপসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর মিছিলে নিজেদের আশ্রয় খুঁজছে। জার্মানসহ বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানরাও তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে মানবতার সেবক হওয়ার সুযোগ করায়ত্ত করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো শরণার্থীরা তাদের বাপের নামও ভুলে যাবে। তাদের ফেলে আসা পিতৃভূমি মধ্যপ্রাচ্যের খালি জায়গার কিছু অংশ ইসরাইলের রাজ্য বিস্তারে এবং বাকি অংশ মার্কিন নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে ইসরাইলের মিত্র হিসাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে। সে লক্ষণই দৃশ্যমান হওয়ার অপেক্ষায়। পশ্চিমাদেশে বসবাসরত মুসলমান নাগরিকরা তাদের পরিচয়ে বলে; I am Muslim, not practicing Muslim and not involved in any terrorist activities.মার্কিন মুল্লুকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ ঘোষণা করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছেন। তিনি ‘বন্ধু নয়তো শত্রু’ তত্ত্বে এ যুদ্ধ সারাবিশ্বে ছড়িয়েছেন। এখন আর; বিশ্বের কোন দেশই যুদ্ধের আওতামুক্ত নয়। বলা হচ্ছে এ যুদ্ধ নির্দিষ্ট কোন দেশের বিরুদ্ধে নয়; কিন্তু বাস্তবে বিশ্বের সব দেশই যুদ্ধরত।

ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং লিবীয় নেতা কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফী এ যুদ্ধেরই করুণ শিকার ও নির্মম বলি হয়েছেন। আমেরিকা call the dog bad name and kill it পলিসিতে তাদেরকে সন্ত্রাসী আখ্যায় হত্যা করে। সন্ত্রাসের সর্বসম্মত সংজ্ঞা না থাকার সুযোগটাই মার্কিনীরা তাদের ইচ্ছেমতো গ্রহণ করে। একদিকে; তারা তাদের পক্ষীয়দের দেশপ্রেমিক, বিল্পবী আখ্যায় মহীয়ান করে; অন্যদিকে; বিপক্ষীয়দের সন্ত্রাসী তালিকায় রেখে শয়তানের শিখণ্ডী বানায়। এক্ষেত্রে ব্রিটেন ও সৌদি আরব সব সময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সহচর রূপে পরস্পরের পাশে পাশেই থাকে। অর্থাৎ আমেরিকা, ব্রিটেন ও সৌদি আরব পরস্পর হরিহর আত্মা! যার নেপথ্যে ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে সৌদি আরবের গোড়াপত্তন (beginning), সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ওহাবী মতবাদ নির্মাণ মুজেযাই সক্রিয় কার্যকর।

ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম তাদের ঔপনিবেশিক (colonial) শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে divide and rule পলিসি চালু করে। সমগ্র বিশ্বই তখন রাজতান্ত্রিক শাসনের অধীন। তখনই; বলা হতো; ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না।’ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম চার্চিলের মধ্যকার চুক্তি ব্রিটিশ সম্রাজ্যের যবনিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান ঘটায়। এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্রিটিশ কলোনী যুগের অবসান হয়ে বহু স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। তখনই; ভারতবর্ষও স্বাধীন হয়।

কিন্তু ব্রিটিশরা গ্রিক মিথ-কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক দল-মত ও প্রতিষ্ঠান গড়ে বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ বপন করেছিল ততদিনে তা পরিণত হয় মহীরূহে। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা, জামায়াতে ইসলামী, তাবলিগ জামায়াত ও আহমদিয়া মুসলিম জামায়াত গঠন করে একদিকে মুসলমানদের বিভিন্ন দল-উপদলের কোন্দল তৈরীর ইন্ধন যুগিয়েছে; অন্যদিকে; হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব-সংঘাত জোরালো করারও রসদ সরবরাহ করেছে। ফলে; ভারতবর্ষ মুসলমান কেন্দ্রিক পাকিস্তান ও হিন্দু কেন্দ্রিক হিন্দুস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিপুঞ্জ, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ গঠিত হয়। অন্যকথায়; এসব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরই ফসল। আমেরিকা এগুলোকে সদ্য স্বাধীন দেশসমূহে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব, প্রভাব, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য গণতন্ত্রের শক্ত হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের ছাতায় বিশ্ব-প্রভুর আসনে সমাসীন। আমেরিকার প্রভুত্ব অস্বীকারকারী কোন রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি টিকে থাকতে সক্ষম হয়নি। মার্কিন প্রশাসন ছলে-বলে ও কলে-কৌশলে তাদেরকে নিঃশেষ করেছে। ইতিহাসে এর অসংখ্য নজির বিদ্যমান। একসময় তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং গুপ্তহত্যা অনুমোদন দিতেন। পরে অবশ্য কৌশল বদল হয়েছে। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে জড়ানো, ভিয়েতনামসহ কোন কোন দেশে হেরে যাওয়া সবই তাদের লক্ষে পৌঁছানোর কৌশল। এগুলো কামার, কুমার ও স্বর্ণকারের পেশা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে সহজ। কুমার কাদামাটি দিয়ে তৈজষপত্র, স্বর্ণকার নিপুণ-হাতে গহনা এবং কামার পুড়া লোহায় সর্ব শক্তিতে ঘা মেরে দা-কুড়াল বানায়। এভাবে; মার্কিনীরা যেখানে যা প্রয়োজন; তা করেই সবাইকে নিজেদের অধীনস্থ করে (subsidiary) রাখে। মার্কিন নৃশংসতায় চেগুয়েভার ল্যাটিন আমেরিকার কিউবায় নিহত হয়েছিল, কিউবা এখন আমেরিকার সাথে। এতো যুদ্ধের পরও ভিয়েতনামও আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে। এভাবে সবশেষে মায়ানমারও মার্কিনী ব্যবস্থাপত্রে ফিরতে বাধ্য হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম অধ্যুষিত আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় সরাসরি আগ্রাসন চালিয়ে; মুসলমানদের মধ্যে মার্কিন বিরোধী যে তীব্র ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়েছে; তাতে ঘি ঢেলে তা লেলিহান শিখায় পরিণত করার নির্বুদ্ধিতায় নেই এখন আমেরিকা। তাইতো এবার মার্কিন নীতি নির্ধারকরা কাবার তত্ত্বাবধায়ক সৌদি আরবকে মুসলমান নিধনের নেতৃত্বে নিয়ে এসেছে। সৌদি রাজ পরিবারকে ৩৪টি মুসলিম দেশ নিয়ে গঠিত সামরিক জোটের প্রধান করা হয়েছে। এটা মূলতঃ মুসলমানদের শিয়া বিরোধী সুন্নী জোট। দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম প্রধান বাংলাদেশও এ জোটের সদস্য হয়ে তাৎক্ষণিক লাভবান হয়েছে। তার মধ্যে; ওমরা ও কাজের ভিসা অন্যতম। তবে; এ জোট ভুক্তি বাংলাদেশকে নীতিগতভাবে রাশিয়া ও চীনের প্রভাবমুক্ত এবং তা ইঙ্গ-মার্কিন-সৌদি আরবের সিরিয়ার আসাদ বিরোধী এবং চূড়ান্তভাবে ইরান বিরোধী সামরিক জোটকেই শক্তিশালী করবে কিনা দেখার বিষয়।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আসাদের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশিদার হয়েছেন কিনা তাও পরিষ্কার হতে সময় লাগবে বৈকি! আফগান যুদ্ধের পরিণতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়েছে। সে থেকে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার অর্থনীতিও নাজুক। এমতাবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধব্যয় রাশিয়াকে কোথায় নেয় তা অবশ্যই ভাবনার বিষয়। অমেরিকা কিন্তু সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে সব পক্ষের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করে বেশ লাভবান। তারা অস্ত্র বিক্রির টাকায় সর্বনিম্ন দরে তেল কিনে বাড়তি লাভ হাতিয়ে নিচ্ছে।

আইএস বিরোধী অভিযানে রাশিয়ার অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে পুতিন সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগীতার প্রয়োজনীয়তা তুলে বলেছেন; “বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে মিলে যুক্তভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায় রাশিয়া।” জার্মানির পত্রিকা বিল্ডকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দেওয়ার জন্য; পশ্চিমাদের আন্তর্জাতিক সঙ্কট সৃষ্টি করার প্রবণতাকেও দায়ী করেছেন।

পুতিন পশ্চিমাদের আন্তর্জাতিক সঙ্কট সৃষ্টি করার মূল পরিকল্পনা ও টার্গেট কতটা অনুধাবন করেছেন তা নিয়ে বিশ্লেষকদের সন্দেহ রয়েছে। কেননা; ব্রিটিশ ধারাবাহিকতায় আমেরিকা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে বদ্ধপরিকর। আর সে লক্ষ্য হলো; ধর্ম ও রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থানে রাখা। যেমন; খ্রিস্টানদের জন্য ‘ভ্যাটিকান সিটি’। তারা যিশুর জন্মদিন উৎসব আয়োজন করে আশীর্বাদ বিলায়। অনুরূপভাবে; মুসলমানদের জন্য সৌদি আরবে ‘কাবা-সিটি’ নির্মাণ করে তাদেরকে হজ, ওমরা ও নামাজে আবদ্ধ করা; যাতে রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি ইসলাম মুক্ত থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন