শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৬

বিশেষ আইনে সাগরে তেল গ্যাস ব্লক ইজারা

বিনা প্রতিযোগিতায় গভীর সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ৫টি ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২০১০ সালে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের জন্য প্রণীত বিশেষ আইনের ক্ষমতাবলে এই কাজ দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপে সম্মতি দিয়েছেন। 

সাগরে যে ৫টি ব্লক ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার ১২, ১৬ ও ২১ নম্বর ব্লক এবং ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক। জ্বালানি বিভাগের সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার বিষয়টি সমকালকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেয়েছি। সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ দ্রুত শুরু করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি নিশ্চিত করেন, দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখেই চূড়ান্তভাবে কোম্পানি নির্বাচন করা হবে। 

সূত্র জানায়, আগামী ১৮ জানুয়ারি এ বিষয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে। ২০১০ সালে প্রণীত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ বিধানের 'আদালত, ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ' অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এ আইনের অধীন বিবেচিত কোনো কাজ গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। এ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো ধরনের আইনগত কার্যধারা গ্রহণ করা যাবে না। কর্মকর্তারা বলছেন, এই আইনের ক্ষমতাবলেই এরই মধ্যে দেশে ছোট ও মাঝারি মানের অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সরকারের ক্রয়নীতির আলোকে এ কাজ করতে গেলে দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান করা যেত না। 

গ্যাসের মজুদ বাড়ানোর জন্যও সরকার একই পন্থা অবলম্বন করতে যাচ্ছে। দেশে আবিষ্কৃত গ্যাস ফুরিয়ে আসছে। দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানির নিশ্চয়তা না থাকায় বিনিয়োগ আশানুরূপ হচ্ছে না। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত এ কারণেই সাগরে তেল গ্যাস দ্রুত অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যেভাবেই হোক তেল গ্যাসের মজুদ বাড়াতে হবে। কর্মকর্তারা আরও জানান, সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ। সেখানে অনুসন্ধান চালানোর মতো অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, সক্ষমতা আমাদের দেশীয় কোনো কোম্পানির নেই। ফলে এখানে বিদেশি কোম্পানির দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রসঙ্গত, দেশীয় সরকারি কোম্পানি বাপেক্স স্থলভাগে তেল গ্যাস অনুসন্ধান করে থাকে। সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের অভিজ্ঞতা তাদের নেই। 

বর্তমানে যে ৫টি ব্লক ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেগুলো আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে আগে বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। ইজারা পেয়েছিল মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস ও স্টেট অয়েল। গ্যাসের দাম না বাড়ানোর ফলে তারা কাজ করতে অস্বীকার করে। এরপর বারবার দরপত্র আহ্বান করেও কোনো সাড়া না পেয়ে বিশেষ আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কর্মকর্তারা জানান, এখন আগের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা হবে না। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। যেসব কোম্পানি আগ্রহ ব্যক্ত করবে তাদের প্রস্তাব নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে কোম্পানি নির্বাচন করা হবে। ওই কোম্পানির সঙ্গেই উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) করা হবে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি কোম্পানির জন্য গ্যাসের দামও বাড়ানো হতে পারে। এ জন্য সংশোধন করা হবে মডেল পিএসসি। মডেল পিএসসি অনুযায়ী সাগরে গ্যাস পাওয়া গেলে বিদেশি ওই কোম্পানির প্রতিইউনিট গ্যাস ৬ ডলারে কেনার কথা। এখন এই দাম আরও বাড়বে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন দাম নির্ধারণ করা হবে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ভারত ও মিয়ানমারে বিদেশি কোম্পানিকে গ্যাসের দাম ৮ ডলার দেওয়া হয়। এর আগে ১২, ১৬ ও ২১ নম্বর ব্লক কনোকোফিলিপস ও স্টেট অয়েলকে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তারা যৌথভাবে জরিপ কাজ করে। জরিপের তথ্যে দেখা যায়, এই ব্লকে তেল গ্যাস থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন ছিল। সেই বিনিয়োগ করার জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি জানায় মার্কিন কোম্পানি। 

মডেল পিএসসির বাইরে এসে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সুযোগ না থাকায় সরকার গ্যাসের দাম বাড়ায়নি। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি বলে কনোকো ও স্টেট অয়েল বাংলাদেশ থেকে কাজ শেষ না করেই চলে যায়। তারা প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ৯ ডলার চেয়েছিল। অথবা সাগরের তেল গ্যাস রফতানির সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই দাবি নাকচ করে দেওয়া হয়। গভীর সমুদ্রের অন্য দুটি ব্লক ১০ ও ১১ নম্বর আগে দেওয়া হয়েছিল শুধু কনোকোফিলিপসকে। কনোকোর জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছিল। তবু তারা পিএসসি করেনি। সংশোধিত মডেল পিএসসিতে বাণিজ্যিকভাবে গ্যাস উৎপাদনের পর বছরে দুই শতাংশ হারে দাম সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তাদের নিজের অংশের গ্যাসের অর্ধেক পেট্রোবাংলার অনুমতি ছাড়াই দেশের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে বিক্রির সুযোগ দেওয়া হয়। 

এ ছাড়া করপোরেট ট্যাক্স থেকে অব্যাহতি, বছরে সর্বোচ্চ ৭০ ভাগ খরচ তুলে নেওয়া এবং পাইপলাইন ব্যবহারের ওপর দেওয়া ট্যারিফ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তারপরও কনোকো পিএসসি করতে রাজি হয়নি। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ম তামিম সমকালকে বলেন, বিশেষ আইনে বড় প্রকল্পের কাজ না দেওয়াই ভালো। তিনি বলেন, সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান করতে ৫ থেকে ৭ বছর সময় লাগবে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে দরপত্র প্রক্রিয়ায় আরও ৫ থেকে ৬ মাস সময় বেশি লাগলে ক্ষতি নেই। দীর্ঘমেয়াদি বা বড় প্রকল্প করার জন্য এই আইন করা হয়নি। সাধারণ সব কাজ এ আইনে করলে ভালো-মন্দ পছন্দ করার সুযোগ থাকবে না। পাশাপাশি তিনি এ কথাও বলেন যে, যদি আলোচনায় বিশেষ কোনো শর্ত না দেওয়া হয়, বিশেষ কোনো সুবিধা না দেওয়া হয়, তবে এই আইনে কাজ দিলেও কোনো সমস্যা নেই। আইনের আওতায় ফেলে বিশেষ সুবিধা দিলেই সমস্যা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন