রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

জহির রায়হানের মৃত্যুরহস্য

জহির রায়হানের সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তার সাথে হঠাৎ করেই আমার পরিচয় ঘটে কলকাতায় ১৯৭১ সালে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি খুই উদ্বিগ্ন ও ক্লান্ত। তিনি আমাকে বললেন, ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে তিনি পড়েছেন এক ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার মধ্যে। তার কোনো থাকার জায়গা নেই। আমি কি তাকে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি? আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও তার নাম জানতাম। তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছায়াছবিটি আমি দেখেছিলাম। তার করা অন্য ছবি আমি দেখিনি। সিনেমা কম দেখি। কিন্তু বন্ধুদের মুখে শুনে তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি দেখেছিলাম। গতানুগতিক ছায়াছবির দলে সেটা পড়ে না। এর আছে একটা বিশেষ বক্তব্য। আছে সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয়। সিনেমাতে গল্প থাকতে হয়। গল্পে ভালোমন্দের ওপর সিনেমা অনেক পরিমাণে নির্ভর করে। কিন্তু সিনেমাতে গল্প বলতে হয় ছবির মাধ্যমে। একটা ৫০০ পাতার উপন্যাসকে দাঁড় করাতে হয় হয়তো ৫০০ ছবির মাধ্যমে। ছবির নির্বাচন ও গ্রন্থনা একটি ছায়াছবিকে বিশিষ্ট করে তোলে। 

জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিকে আমার কাছে এ কারণে মনে হয়েছিল উল্লেখ্য। আমি তাই আপন উদ্যোগে তাকে একটা অস্থায়ী থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। তবে পরে তার সাথে দেখা হয়েছিল মাত্র একদিন। তিনি তার নিজের গুণে কলকাতায় তার গুণগ্রাহী পেয়েছিলেন। তাকে ভাবতে হয়নি অন্ন, বস্ত্র, আবাসনের কথা। যেটা অনেক শরণার্র্থীর ক্ষেত্রেই হয়ে উঠেছিল যথেষ্ট বড় রকমের সমস্যা। কলকাতা জহির রায়হানের কাছে মোটেও অপরিচিত শহর ছিল না। পাকিস্তান হওয়ার আগে তার বাবা ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক। জহির রায়হান ছেলেবেলায় বাস করেছেন ব্রিটিশ আমলের কলকাতায়। লেখাপড়া করেছেন এই শহরেই। কেন যে তিনি কলকাতায় এসে এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন, আমরা তা জানি না। হয়তো এর পেছনে ছিল আরো অন্য কারণ। আর সেটা হতে পারে রাজনৈতিক। 

জহির রায়হান ছিলেন সাংবাদিক, গল্প ও উপন্যাস লেখক, চিত্রনির্মাতা এবং সেই সাথে যুক্ত ছিলেন বাম রাজনীতির সাথে। তিনি ভাষা আন্দোলন করে খেটেছিলেন জেল। তিনি কেবলই কল্পনা জগতের মানুষই ছিলেন না; ভাবতেন দেশ-দশ নিয়ে। আসলে তার এই ভাবনাই তাকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তুলেছিল, যার সাথে আবার যুক্ত হয়েছিল তার শিল্পীমন। অর্থাৎ কল্পনাশক্তি। ব্রিটিশ শাসনামলে কেবল কলকাতাতেই (টালিগঞ্জে) গড়ে উঠেছিল ছবি করার স্টুডিও। কলকাতাতে ১৯১৭ সালে প্রথম নির্মিত হয় বাংলা ছবি। যার নাম ছিল ‘নলদময়ন্তী’। এটা ছিল একটি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী। কলকাতা ছাড়া বাংলা প্রদেশে আর কোথায়ও সিনেমা তৈরির স্টুডিও ছিল না। ঢাকায় ছবি নির্মাণ আরম্ভ হয় পাকিস্তান হওয়ার পর। ছবি করতে হলে খুবই কষ্ট করতে হতো। পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম যে ছায়াছবিটি করা হয়, তার নাম ছিল ‘মুখ ও মুখোশ’। এটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। জাহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭০ সালের ১০ এপ্রিল। কিন্তু এ সময়ও ঢাকায় ছবি করার জন্য প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জামের অভাব ছিল প্রচুর। অনেক বাস্তব অসুবিধার মধ্যেই রায়হানকে অগ্রসর হতে হয়েছিল চিত্র নির্মাণের কাজে। 
কথাগুলো আমি বলছি এই কারণে যে, কলকাতায় তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবি দেখে আমাকে কলকাতার একজন চিত্র সমালোচক বলেছিলেন, রায়হানকে বলা যায় ঢাকার সত্যজিৎ রায়। আমি তার কথা শুনে বলেছিলাম, প্রযুক্তিগতভাবে সত্যজিৎ রায় কলকাতায় যত সহজে ছবি করতে পারেন, ঢাকায় তা এখনো নেই। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায় ছবি করেন যে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, রায়হান তা থেকে অনেক ভিন্ন। রায়হানের মধ্যে কাজ করে চলেছে একটা বিশেষ ধরনের সমাজ দর্শন। তাকে বরং তুলনা করা চলে মৃণাল সেনের সাথে, সত্যজিৎ রায়ের সাথে নয়। সত্যজিৎ রায়ের হাতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ হয়ে উঠেছে অনেকটা শহুরে। তাতে থাকেনি গ্রাম বাংলার ছোঁয়া। মনে হয় যেন দেখছি ইতালির নব্য বাস্তবতার প্রভাবে তৈরী কোনো ছায়াছবি। কিন্তু রায়হানের ছবিতে আছে দেশী মেজাজের পরিচয়। 

সত্যজিৎ রায় যে পরিবারে জন্মেছিলেন তার ছিল শিল্প সাহিত্যচর্চার একটা বিশেষ ঐতিহ্য। সত্যজিৎ রায় জীবন আরম্ভ করেছিলেন ছবি আঁকা দিয়ে। তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন শান্তি নিকেতনে। কিন্তু রায়হান জন্মেছিলেন এমন একটি মুসলিম পরিবারে, যেখানে চিত্রকলা এবং ছায়াছবি সম্পর্কে ছিল বিরূপ মনোভাব। এই মনোভাবকে কাটিয়ে রায়হান হয়েছিলেন চিত্রনির্মাতা।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তানের সাথে খোলাখুলিভাবে যুদ্ধ আরম্ভ করে। এর আগে সে মাঝে মাঝে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছে কমান্ডো বাহিনী। কিন্তু বলেনি কোনো যুদ্ধের কথা। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর সে যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধ আরম্ভ হয় দুই রণাঙ্গনে, পুবে ও পশ্চিমে। যুদ্ধ আরম্ভের যুক্তি হিসেবে ভারতের পার্লামেন্টে সে দেশের প্রেসিডেন্ট বলেন যে, ভারত যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। কেননা সে আক্রান্ত হয়েছে পাকিস্তান দ্বারা। পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে অমৃতসর, অবন্তিপুর, পাঠানকোট, আমবালা ও শ্রীনগরে বিমান হামলা করেছে। স্থলপথে আক্রমণ শুরু করেছে সুলেমানকি, খেমকারন, ছম্ব ও পুঞ্চে। ভারত যুদ্ধ শুরু করেছে তার আত্মরক্ষার প্রয়োজনে।

ভারত বলেনি পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের কোন অংশকে আক্রমণ করেছে। ভারতের তাই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য পাঠানোর কোনো যুক্তি ছিল না। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ সীমিত ছিল কেবল ভারতের পশ্চিম সীমান্তে। তা সম্প্রসারিত হয়নি পূর্ব সীমান্তে। এবারেও ভারত আক্রান্ত হয়েছিল পশ্চিম সীমান্তে, পূর্ব সীমান্তে নয়। কিন্তু তথাপি ভারত পূর্ব পাকিস্তানকে আক্রমণ করেছিল পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে, যা প্রয়োজনীয় ছিল না ভারতের নিরাপত্তার প্রয়োজনে। ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের পত্রপত্রিকা ও রেডিও থেকে বলা হয়, ভারতের সৈন্যরা যুদ্ধ করছে পাকিস্তানের সৈন্যদের সাথে। যুদ্ধ হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। কিন্তু ডিসেম্বরের ৪ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধের জন্য একটি প্রস্তাব ওঠায়। ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো প্রদান করে। ফলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।

ভারত বুঝতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করতে যাচ্ছে পাকিস্তানের পক্ষ। সে হয়তো পাঠাতে পারে তার সেনাবাহিনী। ভারত ৬ ডিসেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করে। এর পর থেকে বলা শুরু হয়, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কেবল ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধ করছে না, যুদ্ধ করছে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী ভারতের পূর্ব কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কমান্ড মেনে। ভারত আসলে সাহায্য করছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে। যুদ্ধ হচ্ছে ভারত বাংলাদেশ মিত্রবাহিনীর সাথে পাক-বাহিনীর। যে কথা ইতঃপূর্বে ভারত সরকার বলেনি। কিন্তু দুনিয়া এই যুক্তি মানতে চায়নি। কেননা, এই যুক্তি জাতিসঙ্ঘের সনদবিরোধী। সাবেক পাকিস্তান ছিল একটি রাষ্ট্র, দুইটি রাষ্ট্র নয়। বিশ্বের কাছে প্রতিভাত হয়েছিল ভারত চাচ্ছে পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে (Dismemberment)। যেটা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত হতে পারে না।

১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতার পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনের প্রধান হোসেন আলী তার ৬৫ জন কর্মচারীসহ পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এবং কলকাতায় বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে এই মিশন পেতে পারে ভারতের সরকারি স্বীকৃতি (De Jure Recognition)। এই উপলক্ষে সেখানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জহির রায়হান এখানে ছিলেন একজন আমন্ত্রিত অতিথি। আমি এই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম রবাহূতভাবে। হঠাৎ আমার কানে আসে, জহির রায়হান কাউকে বলছেন, দেশকে দু’বার স্বাধীন হতে দেখছি, জানি না আরো একবার স্বাধীন হতে দেখতে হবে কি না। কথাটা শুনে আমার মনে হয়, জহির রায়হান মনে করছেন, বাংলাদেশ আসলে স্বাধীন হচ্ছে না, চলে যেতে চাচ্ছে ভারতের নিয়ন্ত্রণে। যার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে আবার করতে হবে যুদ্ধ। এ রকম কথা তখন বলছিলেন ভারতের চীনপন্থী কম্যুনিস্টরা। বিশেষ করে সিপিআই এম, মার্কসবাদীরা। এ সময় আমি কলকাতার অনেক দেয়ালে লেখা থাকতে দেখেছিলাম, ‘দোস্ত দোস্ত জিগরি দোস্ত, ইয়াহিয়া জ্যোতি বোস’। অর্থাৎ ইয়াহিয়া ও জ্যোতি বসু হলেন অভিন্ন হৃদয় (জিগরি) বন্ধু। ভারতে মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে কংগ্রেস সমর্থকেরা তুলেছিল এই আওয়াজ। জহির রায়হানের মতামত দেখলাম চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের সাথে মিলতে। আমার মনে হলো, তিনি হয়ে উঠেছেন তাদেরই সহযাত্রী। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই বলেন, ‘বহিরাক্রমণ থেকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য গণচীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। জহির রায়হান ১৬ ডিসেম্বরের পর কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় আসেন। ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুর থেকে জহির রায়হান নিখোঁজ হন। এখন বলা হচ্ছে, রায়হানকে মিরপুরে বিহারিরা মেরে ফেলে। রায়হান সেখানে গিয়েছিলেন তার বড় ভাইকে খোঁজ করতে। কেউ তাকে বলেছিলেন, তার বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে মিরপুরে পাকিস্তানপন্থী বিহারিরা আটকে রেখেছে। কিন্তু রায়হান একা সেখানে কেন গেলেন, সেটা বোঝা যায় না। তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। তাই তার পক্ষে সেখানে একা যাওয়ার কাহিনী অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। 

এ ছাড়া তখন ঢাকা শহর ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মিরপুরেও ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী চলে যেতে শুরু করে ১৯৭২ সালের মার্চ মাস থেকে। তাই জহির রায়হানের অন্তর্ধান এখনো হয়ে আছে রহস্যময়। মনে হয় তিনি আর প্রাণে বেঁচে নেই। গুজব রটেছিল, তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে ভারতে নিয়ে যায়।

ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের ওপর খড়গহস্ত। চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের মধ্যে নকশালপন্থীরা ছিলেন আবার সবচেয়ে উগ্র। এদের নেতা চারু মজুমদার চলে এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের যশোর জেলার মনিরামপুরে তিনি নাকি ছিলেন আত্মগোপন করে। পশ্চিমবঙ্গের নকশালদের তিনি নির্দেশ দিতেন সেখান থেকে। শোনা যায় ১৬ ডিসেম্বরের পর চারু মজুমদার ভারতীয় সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। চারু মজুমদারকে ভারতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়, কোনো রকম বিচার না করেই। রায়হান নকশালপন্থী ছিলেন না। কিন্তু সম্ভবত চীনপন্থী হওয়ার কারণে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। তবে আমরা এখনো এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানি না। 

প্রতি বছরের মতো এ বছরও জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস পালিত হলো। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় (৩০.০১.২০১৬) লেখা হয়েছে ১৯৭২ সালে এই দিনে তিনি তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে মিরপুরে গেলে নিজেও নিখোঁজ হন। আজ তার অন্তর্ধান দিবস। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের হাতে মিরপুরে তিনি শহীদ হন বলে পরে জানা যায়। তার মৃতদেহটি পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমার মনে হয় তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে পত্রিকার মন্তব্যটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, রায়হান ছিলেন চীনপন্থী। তাকে মেরে ফেলার কোনো কারণ ছিল না পাকিস্তানপন্থীদের। কারণ চীনপন্থীদের সাথে পাকিস্তানপন্থীদের বিরোধ থাকলেও এ সময় কোনো শত্রুতা ছিল না। 

অনেক মৃত্যুরই সহজ হিসাব দেয়া যাচ্ছে না। মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১) ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিখ্যাত অধ্যাপক। তিনি পড়াতেন ভাষাতত্ত্ব। লিখেছিলেন কবর নামে একটি নাটক (আসলে ভিয়েতনামের একটি নাটকের অনুবাদ)। নাটকটি খুব খ্যাতি পেয়েছিল। তাকে কিছু ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। বলা হয়, এসব ব্যক্তি ছিলেন আল-বদর বাহিনীর লোক। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বলা চলে, চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের সাথে আল-বদর বাহিনীর বিরোধ থাকলেও শত্রুতা ছিল না। কেননা চীনপন্থী কম্যুনিস্টরা ছিলেন সাবেক পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখারই পক্ষে। এ ছাড়া তখন ভারতের সৈন্য ঢাকা শহরকে ঘিরে ফেলেছে। মুনীর চৌধুরীকে মেরে ফেলে সাবেক পাকিস্তানকে রক্ষা সামরিক দিক থেকে সম্ভব ছিল না। এটুকু বোঝার মতো ক্ষমতা আল-বদরদের ছিল।
অতীত নিয়ে আমরা অযথা অনেক ভাবছি। আমরা এসে দাঁড়িয়েছি একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই। যদিও রাশিয়া এখনো হয়ে আছে একটা বিরাট সামরিক শক্তি। কিন্তু রাশিয়া এখন আর মার্কসবাদ লেনিনবাদ অনুসরণ করছে না। হয়ে উঠেছে প্রবল জাতীয়তাবাদী। অন্য দিকে চীন আর বলছে না, আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকায় মাওবাদ অনুসরণ করে বিপ্লব ঘটানোর কথা। চীনে কম্যুনিস্টরা ক্ষমতায় থাকলেও তারা আর বিশ্ববিপ্লবী নন। তারা চাচ্ছেন বাজার অর্থনীতির পথ ধরে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ভারতে আর এখন ইন্দিরা-কংগ্রেস ক্ষমতায় নেই। এসেছে বিজেপি সরকার। এই পরিস্থিতিতে আমাদের নতুন করে ভাবা দরকার আমাদের জাতীয় নীতি নিয়ে। আমাদের ভাবা দরকার এখন আমরা কী করব এবং কোন পথে গড়ে তুলব আমাদের ভবিষ্যৎ ইতিহাস। আমরা আমাদের অতীতকে বদলাতে পারি না। কেবলই চেষ্টা করতে পারি মনমতো ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে। আমরা ইতিহাসের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে নেই।

লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন