শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৫

ফারাক্কা থেকে টিপাইমুখ : বাংলাদেশের ভুমিকা ( ৫ বছর আগের আলোচনা এখন্ও প্রযোজ্য)

মুক্তিআন্দোলন আয়োজিত
গোলটেবিল আলোচনা সভায় পঠিত প্রবন্ধ:
স্থান: প্রেসক্লাব যশোর
১০ ডিসেম্বর ২০১১
-----------------------------------------------------------------------
ফারাক্কা থেকে টিপাইমুখ : বাংলাদেশের ভুমিকা


অবতারনা:
অবশেষে সকল জলপনা-কল্পনার এক ধরনের অবসান হয়েছে; ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মান হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বিকার করেছে গত ২২ অক্টোবর ২০১১ মনিপুর সরকার, ন্যাশনাল হাইড্রোপাওয়ার করপোরেশন (এন এইচ পিসি) লিঃ ও সুতলেজ জলবিদ্যুৎ নিগম (এসজেভিএন) লিঃ মধ্যে সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেদেশের প্রধান মন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এক ভাষণে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন টিপাইমুখে বাঁধ নির্মান হবেই বরং বাংলাদেশ বিনিয়োগ করলে উৎপাদিত বিদ্যুতের শেয়ার পাবে।
এর আগপযর্ন্ত ভাটির দেশের আতংকিত মানুষ হিসেবে আমাদের ধারনা ছিল হয়তোবা টিপাইমুখে বাঁধ নির্মান হবেনা, হয়তো বা হবে এমনি নানামুখি সংশয় ছিল। এখন সে দোলাচালের অবসান ঘটেছে। টিপাইমুখে বাঁধ নির্মান হচ্ছেই।
আমাদের জানা দরকার ভারতের অভ্যন্তরে সে দেশের সরকার তার নদীর উপর বাঁধ নির্মান করলে বাংলাদেশের কি আসে যায় অথবা বাংলাদেশের কি করার আছে। কিন্তু তার আগে খোজ নেয়া দরকার, টিপাইমুখ আসলে কি? সেখানে কি হচ্ছে? এবং আমরা কেন উদ্বিগ্ন?
টুইভাই নদীর মুখ হলো টিপাইমুখ। টিপাইমুখে বরাক নদীর সঙ্গে মিলিত হয় টুইভাই নদী। টিপাই শব্দটি টিইভাইয়ের অপভ্রংশ। টিপাইমুখ ভারতের মনিপুর রাজ্যের মিজোরাম সীমান্তের কাছে একটি অখ্যাত জনপদ। এটি চুড়াচন্দর জেলার একটি উপজাতীয় ব্লক। প্রায় ২৪ হাজার সংখ্যালঘু জাতিসত্তার লোক এখানে বাস করে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকদিক থেকে খুবই অবহেলিত ও গুরুত্বহীন এই জনপদ। কিন্তু বরাক নদীর পানি প্রবাহের ক্ষেত্রে টিপাইমুখের গুরুত্ব অপরিসীম।
বরাক নদীর উৎপত্তি হলো মনিপুরের জাপভো পর্বতশৃঙ্গে। এর উৎসে রয়েছে অনেক পাহাড়ি ছড়া (যাদের মধে গোমতী, হাওড়া, কাগনি, সেনাই বুড়ি, হরিমঙ্গল, কাকরাই, কুরুলিয়া, বালিঝুড়ি, সোনাইছড়ি এবং দরদরিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য)। উৎপত্তিস্থল থেকে টিপাইমুখ পযর্ন্ত বরাক নদী প্রবাহিত হেয়েছে পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে। টিপাইমুখের পর বরাক নেমে আসে সমতল ভুমিতে।
উৎস থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পযর্ন্ত বরাক নদীর দৈর্ঘ্য ৫৬৪ কিলোমিটার। বাংলাদেশে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ দিয়ে প্রবেশের পর বরাক নদী সুরমা ও কুশিয়ারা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পরে আরো দক্ষিনে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী পুরানো ব্রক্ষ্মপুত্রের সাথে মিলে সৃষ্টি হয় মেঘনা নদী। মেঘনা পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। মেঘনা শব্দের উৎপত্তি ‘মেঘ’ ও ‘নাদ’ শব্দদ্বয় থেকে। নাদ শব্দের অর্থ গর্জন। অর্থাৎ মেঘের গর্জনে যে নদী ফুলে ওঠে, ফেঁপে ওঠে, সে নদীই হলো মেঘনা। এই মেঘনার আকার তাই উত্তর-পূর্ব ভারতে মেঘ বর্ষনের সঙ্গে অবিচ্ছদ্যভাবে জড়িত। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে বরাক নদী মেঘনার আদি পর্যায়। আর এ থেকে বুঝা যায়, বরাক বরফপুষ্ট নদী নয় বরং বৃষ্টি পুষ্ট নদী। শুষ্ক মৌসুমে এ নদী শান্তভাবে প্রবাহিত হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে তিন-চার দিন বৃষ্টি হলেই ধারনকরে ভয়ংকর রুপ।

টিপাইমুখে বাঁধ নির্মানের ইতিহাস:
১৯২৯ সালে কাছাড় উপত্যকায় প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখাদিলে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মানের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রথম আলোচনা শুরু হয়। প্রস্তাব করা হয় টিপাইমুখে জলাধর নির্মান করে বন্যার সময় পানির প্রবাহ কমানো হবে।
১৯৫৪ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় পানি কমিশন টিপাইমুখে একটি বহুমুখী প্রকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা শুরু করে।
১৯৫৫ সালে বরাক নদীতে বাঁধ নির্মানের জন্য মনিপুরের ময়নাধর অঞ্চলকে নির্ধারন করা হয়।
১৯৬৪ সালে পরিকল্পনা বদলে নারায়নধর, তারপর ভুবনধরে এ বাঁধ নির্মানের পরিকল্পনা করা হয়। পরে এ সিদ্ধান্ত বদলে যায়।
১৯৭৪ সালে টিপাইমুখে একটি বাঁধের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রক্ষপুত্র বোর্ড এ সম্পর্কে বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে।
১৯৮২ সালে ভারত গঙ্গা-ব্রক্ষপুত্র সংযোগ খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি বৃদ্ধির যে প্রস্তাব দেয়, তাতে টিপাইমুখ বাধেঁর প্রস্তাব অর্ন্তভুক্ত ছিলো।
১৯৯৩ সালে বাঁধ নির্মান শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়, তবে ভারতের কিছুু অঞ্চলে বিরুপ প্রভাবের কথা চিন্তা করে তখন থেমে যায় উদ্যোগটি।
১৯৯৫ সালে আবার তা গৃহীত হয়। কিন্তু
১৯৯৮ সালে তা নাচক হয়ে যাই মনিপুর রাজ্য বিধান সভায়।
১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে টিপাইমুখে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় ঘড়ৎঃয ঊধংঃবৎহ ঊষবপঃৎরপ চড়বিৎ ঈড়সঢ়ধহু (ঘঊঊচঈঙ) বা নিপকোকে।
১৯৯৯ সালের ৯ জানুয়ারী মনিপুর রাজ্য সরকার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে।
২০০৩ সালে বিশাল অঙ্কের প্রকল্প বাজেট পুননির্ধারনের মাধ্যমে নতুন উদ্যমে কার্যক্রম শুরু হয়।
২০০৬ সালেই পরিবেশ সম্পর্কে অনাপত্তি সার্টিফিকেট-এর (ঊহারৎড়হসবহঃধষ ঈষবধৎধহপব ঈবৎঃরভরপধঃব) জন্য ভারতের পরিবেশ দপ্তরের কাছে আবেদন করে।
২০০৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়।
২০০৮ সালে বাঁধের ডিজাইন চুড়ান্ত হয়।
২০০৮ সালের ২৮ জুলাই মনিপুর রাজ্য সরকার বাঁধের নিরাপত্তা ও নির্মান সামগ্রী আনার জন্য আইন পাশ করে। পাশাপাশি বাঁধ নির্মান কাজে ব্যবহৃত মনবাহাদুর রোডের প্রতি সাত কিলোমিটার পরপর সামরিক পাহারা বসায়।
২০০৮ সালের ২৪ অক্টোবর প্রকল্পটির পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়া হয়। এবং এ কাজের জন্য ভারতীয় সেনাবহিনী পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মাঝে কাজ থেমে ছিলো। এখন এই বাঁধ নির্মানের নতুন উদ্যেগ নিয়েছে ভারত।

এক নজরে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পে :
বাঁধের প্রকার : মাটির ড্যাম, ভেতরের অংশ পাথরের।
উচ্চতা : ভূমি থেকে ১৬১ মিটার, সমুদ্র সমতল থেকে ১৮০ মিটার।
দৈর্ঘ্য : ৩৯০ মিটার।
পানি ধারন ক্ষমতা : ১৬ বিলিয়ন ঘন মিটার।
সর্বোচ্চ রির্জাভ লেভেল : ১৭৮ মিটার।
নির্মান ব্যয় : ১০৭৮ কোটি ভারতীয় রুপি।
পুরো প্রকল্পের মোট ব্যয় : ৫১৬৩.৮৬ কোটি ভারতীয় রুপি।
উদ্দেশ্য : প্রাথমিকভাবে উদ্দেশ্য ছিল বরাক উপত্যকায় পানি ধারনের মাধ্যমে ২০৩৯ বর্গমিটার এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রন করা। পরে এর মাধ্যমে ১৫০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে।
কাজের সময়সীমা : ২০১২ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।

টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের পেছনে ভারতের যুক্তি:
২০০৬ সালে পরিবেশ সম্পর্কে অনাপত্তি সার্টিফিকেটের জন্য পরিবেশ দপ্তরের কাছে দেয়া আবেদন থেকে জানা যায়- ‘প্রকল্পটির লক্ষ হলো ১৬২.৮ মিটার উচু পাথর দিয়ে ভর্তি বাঁধ, যা ১২৭৫৬ বর্গমিটার আয়তনের অববাহিকার বৃষ্টির পানি আটকাবে। এর সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৫০০ মেগাওয়াট। এ বাঁধের ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রনের খাতে ভারতীয় মুদ্রায় ৪৫.৭০ কোটি রুপির সাশ্রয় হবে। পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের ফলে ২৩১ কোটি রুপির ফসল উৎপাদন বাড়বে ও বাঁধ এলাকায় মাছ চাষ করে বছরে ১৪ কোটি রুপির মুনাফা হবে। নৌ চলাচলের সুবিধা হবে এবং বাঁধ এলাকায় পর্যটনের সুবিধা সম্প্রসারিত হবে।

টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে ভারতীয় নাগরিক:
এ প্রকল্পের বিপক্ষে উপদ্রুত উত্তর-পূর্ব ভারতের বিশেষ করে মনিপুর রাজ্যের মানুষের মধ্যে প্রচন্ড আপত্তি রয়েছে। এই আপত্তির কারন প্রধানত চারটি।
প্রথমত: প্রস্তাবিত বাঁধটি নিরাপদ নয়। টিপাইমুখ ভুতাত্ত্বিক দিক থেকে অতি স্পর্শকাতর এলাকা। এখানে নিয়ত চলছে মহাদেশীয় ভূতাত্ত্বিক প্লেটের সংঘাত এবং ভূমির অধোগমন অর্থাৎ নিচের দিকে বসে যাওয়া। এ প্রকল্পের উদ্যোক্তরাও এ সমস্যা স্বীকার বরেন। ফলে এই ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা বেশী। উদ্যোক্তাদের হিসাবে এখানে রিকটার স্কেলে ৭ এর বড় ভূমিকম্প ১৬টি হয়েছে। এরমধ্যে দুটি অত্যান্ত বড়, রিকটার স্কেলে এদের পরিমাপ ৮.৫ এর বেশী এবং এদুটি ভূমিকম্প দুনিয়ার সর্ববৃহৎ ভূমিকম্পের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত। একটি গবেষনায় দেখাযায়, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলটি ক্যালিফোার্নয়া, জাপান, মেক্সিকো,তাইওয়ান ও তুরস্ক সহ বিশ্বের ছয়টি প্রধান ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার অন্যতম। 
দ্বিতীয়ত: প্রকল্প অঞ্চলে আদিবাসিদের চিরকালীন জীবনযাত্রার জন্য এটি একটি বড় হুমকি। কেননা এই বাঁধের ফলে ৬৭টি গ্রামের প্রায় ৪০,০০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং এর মধ্যে ১৫ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ৬৭ ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামের মধ্যে ১৬টি গ্রাম সম্পূর্ন তলিয়ে যাবে।
তৃতীয়ত: ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে এ ধরনের প্রকল্প ইতোমধ্যে ব্যর্থ প্রমানিত হয়েছে। যার একটি হলো ত্রিপুরায় গোমতী নদীতে ডুম্বুর বাঁধ। অপরটি হলো মনিপুরে অবস্থিত ইথাই বাঁধ বা লোকটাক প্রকল্প। ডম্বুর বাঁধের কারনে ৪৬.৩৪ বর্গ কিঃমিটার ভূমি পানির নীচে তলিয়ে যায়। ৮ থেকে ১০ হাজার পরিবারের প্রায় ৬০-৭০ হাজার লোক উদ্বাস্তু হয়েছে। এই সব ক্ষতিগ্রস্থ আদিবাসিরা এখন স্বাধীনতা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে।
চতুর্থত: প্রস্তাবিত বাঁধ পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এই বাধ ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। মনিপুরে নাগা মহিলা ইউনিয়নের সম্পাদিকা আরমান পামে এক খোলা চিঠিতে লিখেছেন, ‘মনিপুর রাজ্য জীব বৈচিত্রের দিক থেকে পৃথিবীর সর্বাদিক সম্ভাবনাময় অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে দুর্লভ জীব বৈচিত্রের সম্পদ রয়েছে। এই প্রকল্পে তলিয়ে যাবে বিচিত্র, আচেনা ও দূর্লভ উদ্ভিদকুল, প্রানীকুল ও সমৃদ্ধ জিনের সম্পদ ভান্ডার।’
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় জনগনের বিরোধীতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক কারনে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করতে চায়। স্থানীয় জনগনকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারত সরকার ইতোমধ্যে অনেকগুলি ব্যবস্থা নিয়েছে। এরমধ্যে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মুনাফার একটি বড় হিসসা মনিপুর পাবে। ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার প্রতিটি পরিবারকে ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ বছরে বিনামূল্যে দেওয়া হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠান উৎপাদিত বিদ্যুতের আয়ের এক শতাংশ ও রাজ্য সরকার সমপরিমান ক্ষতিগ্রস্থদের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করবে।
ভারত সরকারের এতসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে সরকার ও স্থানীয় জনগনের মধ্যে মতানৈক্য নিরুষনে সম্ভব হয়নি। ক্ষুদ্র জনগোষ্টি হওয়ার কারনে তাদের আন্দোলন সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কোন দাগ কাটতে পারেনি। তবুও তারা হরতাল, মিছিল, সভা ও আবেদন নিবেদন করে তাদের বক্তব্য পেশ করে চলেছে।
বাংলাদেশে টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিক্রিয়া :
বরাক নদীর উপর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান হলে বাংলাদেশে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে নানাদিক থেকে-
প্রথমত: রাজনৈতিক দিক থেকে। এই বাঁধ দুদেশের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী বিরুপ রাজনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি করবে যা শান্তিকামী মানুষের জন্য মোটেও কাম্য নয়।
দ্বিতীয়ত: এই বাঁধ বাংলাদেশের পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। বিরুপ প্রভাব ফেলবে নদীতে, পানিতে, মাছে, বৃষ্টিতে, সবুজ বনায়নে, সমাজ সাংস্কৃতিতে। এই বাঁধের ফলে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা নদীতে বর্তমানে যে পরিমান পানি প্রবাহিত হয় বর্ষার মৌসুমে তা শতকরা ২৫ ভাগ কম পানি প্রবাহিত হতে থাকবে আর শীতকালে সুরমা, কুশিয়ারা নদীতে পানি প্রবাহের পরিমান কমে যেতে পারে বর্তমানের তুলনায় শতকরা ৮০ ভাগ। এর ফলে বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অঞ্চলে শীতকালে বা রবি মৌসুমে চাষের জন্য হবে বিরাট ক্ষতি। বিশেজ্ঞদের আশংকা এই বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ মরুভুমিতে পরিনত হবে। অপর দিকে এই সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনায় পানি প্রবাহ কমে গেলে সিলেট ও ঢাকা অঞ্চলের ব্যাপক এলাকায় সমুদ্রের লোনাপানি ঢুকে যাবে।
এই অবস্থায় ভারত আমাদেরকে বুঝাচ্ছেÑ এ প্রকল্পের ফলে বর্ষাকালে সিলেট অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ কমবে আর শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়বে। আমাদের দূর্ভাগ্য এ রকম সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরামর্শকরা সমর্থন করে ছিলেন। অথচ সাধারন জ্ঞানের ভিত্তিতেই একথা প্রমান করা সম্ভব যে এ ধরনের প্রকল্পে বাংলাদেশ কোনোভাবেই উপকৃত হবে না।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে জলাধার নির্মান করে বাংলাদেশে বন্যার তীব্রতা হ্রাস-সম্পর্কিত প্রস্তাব পরিক্ষা করে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চবঃবৎ জড়মবৎং এর নেতৃত্বে টঝঅওউ এর একটি কারিগরি দল। ঊংঃবৎহ ডধঃবৎং ঝঃঁফু শিরোনামে ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দুটি কারনে উত্তর-পূর্ব ভারতে জলাধার নির্মান করে বাংলাদেশে বর্ষাকালে বন্যার প্রকোপ হ্রাস করা যাবে না।
প্রথমত: বাংলাদেশে বন্যা হ্রাস করার জন্য এ ধরনের জলাধারে বিপুল পরিমান পানি সংরক্ষন করতে হবে। বাংলাদেশে এক মিটার বন্যা হ্রাসের জন্য ৬৬ বিলিয়ন কিউসেক পানি জমাতে হবে। এ ধরনের প্রকল্প অবাস্তব।
দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দুরে জলাধারে পানি রাখলে তার প্রভাব বাংলাদেশের বন্যার উপর পড়বে না। বাঁধের নিচে প্রবাহিত নদীর পানি গড়িয়ে এসে বর্ষাকালে বাংলাদেশের বন্যায় পানি সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে।

উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ভারতের আরো পরিকল্পনা: 
ভারতের এক গবেষনা থেকে জানা যায়, ভারত সরকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বাঁধ নির্মানের আরো পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- ডিহিং বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প (ব্রক্ষপুত্রের শাখা নদীর উপর), সুবানসিড়ি বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প (ব্রক্ষপুত্রের শাখা নদীর উপর), লোহিত বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প (ব্রক্ষপুত্রের শাখা নদীর উপর), যদুকাটা বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প (মেঘনা শাখা নদীর উপর), সোমেশ্বরী বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প (বরাক নদীর শাখার উপর), নোয়া ডিহিনং বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প (ব্রক্ষপুত্রের শাখা নদীর উপর), কুলশী বহুমুখী বাঁধ প্রকল্প (ব্রক্ষপুত্রের শাখা নদীর উপর) ইত্যাদি প্রত্যেকটি প্রকল্পেই কমবেশী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের উপর। আমরা টিপাইমুখ নিয়ে চিন্তা করতে করতে বাকি প্রকল্পগুলো নীরবে এগিয়ে যাবে। বিশেষ করে যদুকাটা ও সোমেশ্বরী বাঁধ প্রকল্প দুটি নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের হাওড় এলাকায় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

ভারতের আরও বাঁধ পরিকল্পনা:
একটি গবেষনায় দেখাগেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিমালয় অঞ্চলে ভারত ৭৪টি বাঁধ নির্মান করেছে। এছাড়া ভারত ৩৭টি বাঁধ আরো নির্মান করছে। ঐ গবেষনায় বলা হয়, আরো ১লাখ ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আগামী ২০ বছরে ভারত ৩১৮টি বাঁধ নির্মান করবে। এপর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০টি বৃহৎ ড্যাম বা বাঁধ নির্মান সম্পন্ন এবং অনেকগুলি নির্মানাধীন থাকায় ভারত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ বাঁধ নির্মানকারী দেশে পরিনত হয়েছে।

ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প :
ভারত ইতোমধ্যে এক বিশাল প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। যে প্রোগ্রামের নাম জরাবৎ ওহঃবৎষরহশরহম চৎড়লবপঃ (ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প)। যা ভারতের সব নদী নিয়ে একটি জল সরবরাহ ব্যবস্থায় রুপান্তর প্রচেষ্টা।
ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের বিরোধী। ৩০টি সংযোগ খাল দিয়ে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্তত ৩৭টি নদী সংযোগের মাধ্যমে (যার সংযুক্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০০কিলোমিটার) ভারত ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি আন্ত:সংযোগ প্রকল্প গ্রহন করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর অর্ধেক পানি প্রত্যাহার করে ভারতের দক্ষিনাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে। এই প্রকল্প পরিবেশ বিপর্যয়সহ আমাদের অর্থনীতি ও সমাজ জীবনকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।
এই নদী সংযোগ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের ফসলের উৎপাদন কমে যাবে। আর্সেনিক দূষন বাড়বে। মরুকরণ বাড়বে। বনাঞ্চল ধ্বংস হবে। পানি সংকট বাড়বে। স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়বে। সামুদ্রিক লবনাক্ততা বাড়বে। বিদ্যুৎ খাত ক্ষতিগ্রস্থ হবে। নদী ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হবে। প্রাণ-বৈচিত্র হারিয়ে যাবে। এছাড়া আরো নানা রকমের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এই ধরণের আগ্রাসী প্রকল্পের বিরুদ্ধে এখনি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরী।

চাইলেই ভারত বাঁধ নির্মান করতে পারে না !
প্রথম কারণ: এর ফলে আর্ন্তজাতিক নদী আইনের লঙ্ঘন হবে। বরাক যেহেতু আর্ন্তজাতিক নদী সেহেতু ভারত এক তরফা এই নদীর উপর বাঁধ নির্মান করতে পারে না। ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ি অববাহিকাভুক্ত প্রতিটি দেশ অভিন্ন নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। অন্য দেশের কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
দ্বিতীয় কারণ: ভারত-বাংলাদেশের ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিতে শুধু গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির কথা হয়নি। অভিন্ন অন্যান্য নদীর কথাও বলা হয়েছে। চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে দুটি দেশ অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে একমত হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ এই চুক্তিবিরোধী।
তৃতীয় কারণ: ১৯৭১ সালের ওয়েটল্যান্ড কনভেনশন, ১৯৭২ সালের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশন, ১৯৯২ সালের বায়োডাইভারসিটি কনভেনশন অনুযায়ী এক তরফাভাবে টিপাইমুখের মতো প্রকল্প গ্রহনের অধিকার ভারতের নেই।
চতুর্থ কারণ: ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ‘টিপাইমুখে ভারত এমন কিছু করবে না, যার ক্ষতিকর প্রভাব বাংলাদেশের উপর পড়বে।’ যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য বাজে কথা না হয়ে থাকে, তাহলে ভারত আজ একতরফা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান করতে পারেনা।

মরনফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ:
মরনফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের পরিকল্পনা, বিরোধীতা, বাঁধ নির্মান, চালু এবং এনিয়ে দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কে তিক্ততার সম্যক আমাদের স্মরনে আছে। ১৯৯৫ সালের ২৪ মার্চ বিশ্বের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো বাংলাদেশের ঈশ্বরদীতে। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে তাপমাত্রার সুচক লক্ষ করলে দেখা যায় দেশের দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলেই তাপমাত্রা দিনকেদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে আন্তার্জাতিক নদী গঙ্গার পানি একতরফা প্রত্যাহার।
১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য ভারত ফারাক্কা বাধঁ চালু করার সময় বাংলাদেশকে অনুরোধ করে তার ফিডার ক্যানেলের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য মাত্র ১১ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহারের অনুমতি দিতে। সেই শুরু। তারপর ধিরে ধিরে উধাও হয়ে গেল বাংলাদেশের লাবন্য, সুখ। ৭৫ ফুট উঁচু ১০৯টি গেট সম্বলিত ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মানুষের জন্য প্রতিভাত হলো মরন ফাঁদ হিসাবে। সেই থেকে ভারত আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতি লংঘন করে একের পর এক একতরফা পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। ফলে শুকিয়ে গেছে আমাদের পদ্মার ধারা। এর প্রভাবে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশে ৮০টির বেশী নদী শুকিয়ে গেছে। ফারাক্কা ব্যারাজ আমাদের সময়ে মানুষ্যসৃষ্ট সবচেয়ে বেশী পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান। এই বিপর্যয় বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলে ধ্বংসাত্মক আঘাত হেনেছে। ৪০ মিলিয়ন মানুষ হয়েছে বিপর্যস্ত। প্রকৃতির উপর পড়েছে বিরুপ প্রভাব। বিপন্ন হয়ে পড়েছে পরিবেশ। বিধ্বস্ত হয়েছে কৃষি, অর্থনীতি। মারা যাচ্ছে গাছ। বেড়েছে লবনাক্ততা। শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। আর এভাবেই তাপমাত্রা বেড়ে বেড়ে এই অবস্থায় পৌছেছে। সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে কৃষির। গঙ্গার পানি কমে যাওয়ায় ষাটের দশকে চালু হওয়া দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট) বন্ধ হয়ে গেছে ১৯৯৩ তে। এ প্রকল্পের অধীনে ৩ লাখ একর জমি সেচ সুবিধা পেত। এতে ক্ষতি হয় ১০০ কোটী টাকার ফসল। রবি ও খরিপ ফসল হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। গাঙ্গেয় প্রবাহের ২০০ প্রজাতির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ী চাষ হয়েছে ব্যাহত। হাজার হাজার ধীবর পরিবার দিন গুনছে মৃত্যুর। প্রায় ২০০ মাইল নৌপথ শুস্ক মৌসুমে বন্ধ হয়ে গেছে। শত শত মাঝি মাল্লারা ছেড়ে দিয়েছে পেশা। ভূগর্ভস্থ পানি নিঃশেষ হবার পথে। পানির গুন কমছে। জমি হারিয়ে ফেলেছে উর্বরতা। মোট কথা কৃষি, মৎস্য, বনায়ন, শিল্প, নৌপথ সব ক্ষেত্রে ১৯৯৫ সালের এক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের এপর্যন্ত মোট লোকসানের পরিমাণ দাড়িয়েছে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার । বাংলাদেশের একাংশের জনগন পৌঁছে গেছে দারিদ্র ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যা মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারেরও চরম পরিপন্থী।

বাংলাদেশের সাথে ভারত কেন দাদাগিরি করে?
আমাদের জানা আছে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৭টি নদীর মধ্যে কেবল একটি বাদে সবকটি নদীর উৎস ভারতে। এসব অভিন্ন নদীর মধ্যে ৫৪টির উজানে বাঁধ ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত একতরফা পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এতেও ভারত সন্তুষ্ট না কেননা, বর্ষা মৌসুমে তাদের অনেক বাঁধই খুলেদিতে হয়, না হলে নিজেরায় পানিতে ডুবে মরে। কিন্তু বর্ষা মৌসুমেও যেনো এই পানি ছাড়তে না হয় সে জন্য এখন তারা গ্রহন করেছে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ৫৪টি নদীর পানি ২০১৬ সালের মধ্যে ভারত সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেনেবে। প্রশ্ন হলো কেন? ভারত আমাদের সাথে এহন আচারণ করে কেন? আমরাতো খোদ আমেরিকাকেও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র মেক্সিকোর সাথে এমন আচারণ করতে দেখিনা। কিন্তু ভারত করে কেন ? ভারততো আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র! এর উত্তরে এই মুহুর্তে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মরহুম মেজর এম.এ জলিলের নিবন্ধ থেকে কিছু উদ্ধৃতি বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। যেমন- তিনি লিখছেন, “‘ভারতপ্রীতি’ দেশ ও জাতির মানসপটে ‘ভারতভীতি’ হয়ে জেগে উঠেছে। অহেতুক তো আর হয়নি। পেছনে রয়েছে নিশ্চিত কারন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা ভারতপ্রীতির সূত্রে গেঁথে গেছেন, তাদের ভারতের বিরাটত্ব এতই মুগ্ধ করে ফেলেছে যে, ‘ভারত মাতা কী জয়’ বলতে পারলে যেন ধন্য হন তারা।” আমার ধারণা আমাদের এহনো আদিক্ষেতাই আমাদের উপর ভারতকে দাদাগিরি করতে প্ররোচিত করে। অমরা জোরকরে বলি ভারত আমাদের বন্ধু অথচ ভারত বাংলাদেশের চার পাশে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে, সিমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যা করে প্রতিদিন বলে ভারত তোমাদের বন্ধুনা। তার পরও অমরা বলবো ভারত আমাদের বন্ধু! আর এতে করে স্বাধীনতাকামী বাংলাদশের মানুষের মনে জাগে প্রচন্ড শঙ্কা। জাতির এই নতুজানুপনা চেহারা দেখে মেজর জলিল আক্ষেপ করে আরো বলেছিলেন, ‘যারা ভারতকেলীতে মত্ত, তারা দ্রপৈাদীর জীবন সুখ ভোগে ধন্য হোক, স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের সাধারন মানুষ নরকের কীট হয়েও স্বাধীন বাংলাদেশেই স্বকীয়তা সহকারে বাঁচতে চাই। স্বাধীনতাই আমাদের কাছে প্রিয়।’

উপসংহার
আমাদের মনেরাখা দরকার দুনিয়ায় তেলের যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে, আসচ্ছে যুদ্ধ পানির জন্য, বীজ, জীব-অনুজীব, প্রাণ বৈচিত্রের জন্য। ইতোমধ্যেই সে যুদ্ধ শুরু হয়েগেছে। রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে এই যুদ্ধের প্রথম বলি লিবিয়ার প্রয়াত নেতা গাদ্দাফি। ইরাক ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলেছে দজলা ও ফোরাত নদীর পানিনিয়ে। আমার ধারনা বাংলাদেশের সাথে ভারতের আখেরি যুদ্ধ হবে পানিনিয়ে। পানিরই অপর নাম জীবন তাই পানির জন্য যুদ্ধ মানে জীবনের জন্য যুদ্ধ। ভারত সে যুদ্ধে নেমেগেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা দূর দেখতে পারিনা। অথচ কি ভয়ংকার কালো মেঘ ধেয়ে অসচ্ছে আমাদের অনাগত শিশু বাচ্চদের দিকে, আমাদের ভবিষ্যৎ সভ্যতার দিকে। কিন্তু আমরা এখনো নীরব। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান প্রসঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান, হিসেবে সরকারের করনীয় নিয়ে এখনো জনগনকে অবহিত করেননি। মন্ত্রী বাহাদুরদের দুয়েকজনের মিডিয়ার সাথে বাতচিত দেখলে মনে হয় মেজর জলিলের উক্তির যথার্থতা রয়েছে। সরকার আর রাষ্ট্র সমর্থক নয়। টিপাইমুখ বাঁধ রাষ্ট্র এবং জনগনকে ভোগান্তিতে ফেলবে অনাগতকাল ধরে। দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা জলবায়ুকে প্রভাবিত করবে। অর্থনীতির ওপর আঘাত হানবে।
ফারাক্কার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মান বন্ধের দায়িত্ব সরকারের। জনগন বন্ধুত্ব চায়, দাসত্ব নয়। সুতরাং টিপাইমুখ বাঁধ নির্মানের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক জনগনকে ইস্পাত কঠোর ঐক্য নিয়ে প্রতিবাদমুখর হওয়ার এখনই সময়। আমাদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে, সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে ভারতের ভুক্তভোগী আন্দোলনকামি মানুষের সাথে। পৃথিবীর দেশে দেশে আমাদের সমূহবিপদে পাশে দাঁড়াবার মত লবি বাড়াতে হবে। যোগাযোগ গড়েতুলতে হবে পরিবেশবাদিদের সাথে। সরকারেরও রুখে দাঁড়াতে হবে এর বিরুদ্ধে। তবেই মুক্তি।

সূত্র: প্রথম আলো আকবর আলী খান, কালের কন্ঠ মামুন রশীদ, নয়াদিগন্ত এবনে গোলাম সামাদ, ড.সয়বাম ইবোটোবি, হাসান শরীফ, কাজী সাইদ, সিরাজুর রহমান, ডা.ওয়াজেদ এ খান, আমার দেশ, ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ-বাংলাদেশের বিপর্যয়-বেনজীন খান, ফারাক্কা ব্যারাজ ও বাংলাদেশ-বি.এম. আব্বাস এ.টি, মেজর জলিল রচনাবলী।
বেনজীন খান
মুখপাত্র
মুক্তিআন্দোলন, বাংলাদেশ 
১০ ডিসেম্বর ২০১১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন