মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫

কোন পথে ভারত?

অতি সম্প্রতি ভারতে বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে গেল। বাড়িতে গরুর মাংস রাখার অভিযোগ তুলে মোহাম্মদ আখলাক নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে আর পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। উত্তর প্রদেশের দাদরি গ্রামের এ ঘটনায় আহত হন আখলাকের ২২ বছর বয়সী ছেলেও। পরে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের ফ্রিজে খাসির গোশত ছিল, গরুর নয়। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে লিখতে গিয়ে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন লেখকরা। 

এ ধরনের অসহিষ্ণু অবস্থার প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার জোয়ার নেমেছে। পুরস্কার ফেরত দেয়ার প্রথম ইচ্ছা প্রকাশ করেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ভাইঝি নয়নতারা সেহগাল। তারপর একে একে এখন পর্যন্ত ২৬ জন বিশিষ্ট সাহিত্যিক অ্যাকাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কন্নড় সাহিত্য পরিষদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেন ছয়জন কন্নড় সাহিত্যিক, বীরান্না মাদিওয়ালার, টি সতীশ জাভারে গৌড়া, সঙ্গমেশ মীনাসিনাকাই, হনুমন্ত হালিগেরি, শ্রীদেবী ভি আলুর এবং চিদানন্দ। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে অধ্যাপক চন্দ্রশেখর পাতিল ফিরিয়ে দেন কর্নাটক সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান পদ্ম পুরস্কার। এখন প্রতিদিন বাড়ছে পুরস্কার ও অর্থ ফিরিয়ে দেয়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংখ্যা। প্রতিদিন ভারতের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় শিরোনাম হচ্ছেন তারা। টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে পাচ্ছেন আমন্ত্রণ। প্রতিবাদ এখন একসুরে। হিন্দি, ইংরেজি, পাঞ্জাবি, কন্নড়, কোঙ্কানি, বাংলা, মৈথিলি, মারাঠি, উর্দুÑ সব ভাষা থেকেই হচ্ছে প্রতিবাদ। ভারতের সেরা প্রতিভারা তাদের পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন অথবা অ্যাকাডেমি থেকে পদত্যাগ করছেন। এখন পর্যন্ত অ্যাকাডেমির সাধারণ পরিষদের ২০ জন সদস্যের মধ্যে পদত্যাগ করেছেন চার জন। দাদরি ও মৈনপুরির ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে তাদের। 

সর্বপ্রথম সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়া নয়নতারা সেহগাল বলেছেন, কোনো ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের সন্ত্রাস নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও আশ্চর্যজনকভাবে চুপ রয়েছেন। এই সরকার ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাদের এই মনোভাবে আমি উদ্বিগ্ন। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে কবি এবং লেখিকা মন্দাক্রান্তা সেন বললেন, সমাজের সর্বস্তরে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে, তা মোটেই কাম্য নয়। মানুষের পক্ষে কথা বলাটা কবি, লেখক, শিল্পীদের একটা সামাজিক দায়িত্ব। অথচ এ দেশে সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তারা খুন হচ্ছেন। অত্যাচারিত হচ্ছেন। এর জোরালো প্রতিবাদ জানানোটা খুব দরকার বলে অনেক দিন ধরেই মনে করছিলাম। পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে। লেখক এবং গবেষক অরবিন্দ মালাগাত্তি বিশিষ্ট কন্নড় যুক্তিবাদী এম এম কালবার্গির হত্যার ঘটনায় সাহিত্য অ্যাকাডেমির চুপ করে থাকার নিন্দা করে সাধারণ পরিষদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানান। পাঞ্জাবি লেখক ভুল্লার বলেন, যেভাবে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, তা নিয়ে আমি প্রচণ্ড বিরক্ত। অন্য দিকে, দেশের সম্প্রীতি রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় সরকার কিছুই করছে না বলে মনে করেন প্রখ্যাত পাঞ্জাবি নাট্যকার ঔলাখ। আরেকজন লেখক অমর মিত্র বলেন, দাদরি কাণ্ডের জন্য প্রতিবাদ হওয়া দরকার। কিন্তু পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। দাদরির ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কেবল বলেছেন, ‘দুঃখজনক এবং অবাঞ্ছিত, তবে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছুই করার নেই।’

১০ অক্টোবর সাহিত্য অ্যাকাডেমিকে দেয়া এক চিঠিতে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও কবি সারা জোসেফ বলেন, এই সরকারের সময় মানুষের ভেতর ভয় জাগ্রত হচ্ছে, সঙ্কুচিত হচ্ছে স্বাধীনতা। এর প্রতিবাদে আমি আমার পদক ফিরিয়ে দিলাম। মালায়লাম ভাষায় লেখা তার ‘আলাহায়ুরে পেনকামাল’ উপন্যাসের জন্য ২০০৩ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান তিনি। ৭ অক্টোবর পুরস্কার ফিরিয়ে দেয়া প্রথিতযশা লেখক অশোক বাজপেয়ী দাদরি হত্যাকাণ্ড ও একাধিক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের চুপ থাকার সমালোচনা করেছেন। 

সরকারের ভূমিকা রহস্যজনক হলেও রাইসিনা হিলসে ভিন্নমত দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, বহুত্ববাদের সাথে সহাবস্থান আমাদের সভ্যতার মৌলিক মূল্যবোধ। তা নষ্ট করে দেয়াকে আমরা প্রশ্রয় দিতে পারি না। ইতিহাস পড়লেই দেখা যাবে, সময়ের সাথে সাথে বহু সভ্যতার পতন ঘটেছে। কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণ সত্ত্বেও ভারতীয় সভ্যতার মৌলিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়নি। সেটা মাথায় রেখে চললে ভারতীয় গণতন্ত্রের অগ্রগতি কেউই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। 

দাদরি হত্যা এবং গরুর গোশত নিয়ে একের পর এক ঘটনায় অস্বস্তি বাড়িয়েছে শাসক দল বিজেপির। কোনো রকম বিতর্কিত মন্তব্য না করতে দলটি তাদের নেতা ও মন্ত্রীদের সতর্ক করেছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার লিখেছেন, মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) বুঝতে পেরেছে, তারা যদি গরুর মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান বজায় রাখে, তাহলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার অজানা বিপদের মুখে পড়তে পারে। এর ফলে মুসলমানেরা আরো নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়বে। আরএসএস সেটা বুঝতে পেরে মুখ বন্ধ করেছে। বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা এল কে আদভানি বলেছিলেন, বিজেপি হিন্দুদের সমর্থন নিয়ে লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারে, কিন্তু মুসলমানদের সহযোগিতা ছাড়া দেশ পরিচালনা করা কঠিন। তার পরও ব্যাপারটা শুধু কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। সংঘ পরিবার মুসলমানদের সমর্থন লাভের ব্যাপারটা যদি সত্যিই তীব্রভাবে অনুভব করত, তাহলে তারা তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতো। তারা মনে করে, প্রকৃত অর্থে দেশ পরিচালনায় মুসলমানদের ভূমিকা নেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দিকেই লক্ষ করুন, সেখানে শুধু একজন মুসলমান মন্ত্রী রয়েছেন, তা-ও আবার অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে।

আনন্দবাজার পত্রিকার নয়া দিল্লি ব্যুরো চিফ প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল লিখেছেন, বিজেপি চাইছে বিতর্কটা হোক। নেহরুর সময় থেকে তৈরি হওয়া এই যে বহুত্ববাদী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে সংখ্যালঘু তোষণের বদলে এক বিকল্প হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ এসেছে, তাকে এক দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে বিজেপি এগোতে চাইছে। এই মতাদর্শগত সঙ্ঘাত এবার ভারতকে কোন পথে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে আমাদের শঙ্কা আছে। শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর কি না, তা আমরা জানি না। 

সম্প্রতি ‘ভারতীয় গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়ছে’ বলে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য অ্যাকাডেমিপ্রাপ্ত লেখক-সাহিত্যিকেরা রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। এ চিঠিতে লেখা হয়েছে, ভারতে হত্যা ও অসহিষ্ণুতার আবহ তৈরি হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত পড়ছে ক্রমাগত। নিরপরাধ সাধারণ নাগরিক অহেতুক হত্যালীলার শিকার হচ্ছেন। নরেন্দ্র ধাবলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবার্গির মতো স্বাধীন চিন্তা ও শুভবুদ্ধির উৎস ব্যক্তিত্বরা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। অথচ প্রশাসনিক অকর্মণ্যতা ও সরকারি ঔদাসীন্য পদে পদে আমাদের মানবিক অধিকার খণ্ডিত করছে। 

এত কিছুর পরও থেমে নেই উগ্রপন্থীরা। গরু জবাইয়ের অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা ও ভাঙচুর এবং মুম্বাইতে পাকিস্তানি গায়ক গুলাম আলীর কনসার্ট বাতিলের মতো বিষয়গুলো শেষে শিবসেনারা গত ১২ অক্টোবর কালি মাখিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপির সাবেক উপদেষ্টা সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে। তার দোষ ছিল পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরির একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন তিনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি ছিটিয়ে শিবসেনার কর্মী সমর্থকরা আসলে কাকে কালিমালিপ্ত করেছে? এই ন্যক্কারজনক ঘটনার দ্বারা শিবসেনা সুধীন্দ্রকে নয়, খোদ ভারতকেই কালিমালিপ্ত করে দিয়েছে! 

শুধু আকার-আয়তনে ও জনসংখ্যার বিচারেই বড় হওয়া যায় না। মন-মানসিকতার ক্ষেত্রেও বড় হওয়া দরকার। এজন্য মানবিকতা ও বিশ্বজনীনতার চর্চা বাড়াতে হবে। এ নির্মম সত্যটা ভারতীয় নেতাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। মোদির ভারতে বর্তমানে উগ্রবাদী হিন্দুরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এর বিপরীতে প্রতিবাদের মাত্রাটাও বাড়ছে সেভাবে। একটি জাতির বড় একটি অংশ যদি হতাশায় থাকে আর একটি অংশ যদি ধর্মীয় উগ্রবাদকে আদর্শ মেনে নেয় তাহলে সেই জাতির কি পরিণতি হয় তার জ্বলন্ত প্রমাণ আফগানিস্তান ও সিরিয়া। শেষ পর্যন্ত ভারত কি সে পথেই হাঁটবে? নাকি বদলে যাবে? মোদিরা কি ভারতকে বদলে দিতে পারবেন? সেটা কি সম্ভব? এমন সব প্রশ্ন আজ অসংখ্য ভারতীয়ের!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন