শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫

‘নোংরা যুদ্ধের’ কৌশলে বেপরোয়া রক্তক্ষয়

স্নায়ুযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরকে মোকাবেলা করার জন্য ডার্টি ওয়ার বা নোংরা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করত। এই কৌশল দুই পরাশক্তি প্রত্যক্ষভাবে যেমন গ্রহণ করত তেমনিভাবে তাদের সমর্থনপুষ্ট ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রো-এশিয়ার বিভিন্ন সরকারকে প্রতিপক্ষ দমন বা নির্মূল করতে মদদ দিতো। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনয়নের চেয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল অনেকখানি এগিয়ে। তবে কমিউনিস্ট বলয়ের অতিনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার কারণে তাদের নোংরা যুদ্ধ কৌশলের খবর মুক্তবিশ্বে কমই আসত। আবার যা কিছু প্রকাশ পেতো তা পাওয়া যেত প্রোপাগান্ডার মোড়কে। ফলে প্রকৃত ঘটনা থেকে যেত অনেকটাই আড়ালে। এই নোংরা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ৫০, ৬০ ও ৭০-এর থেকে আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, চিলি, প্যারাগুয়ে, পেরু ও উরুগুয়েতে বেশি। আফ্রো-এশিয়াতেও কম বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে একই ধরনের। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে সাংস্কৃতিক বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব দমন ইত্যাদি নাম দেয়া হয় এই অভিযানের। অন্যান্য দেশের মধ্যে ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন প্রসেস, অপারেশন কলম্বো, অপারেশন চার্লি, অপারেশন গ্লাডিয়ো, নাইট অব দ্য পেন্সিলস, অপারেশন ইন্ডিপেন্ডেন্স, এজেইজা ম্যাসাকার, মারগারিয়া বেলেন ম্যাসাকার, ডেথ ফ্লাইটস, ডিসাপারেসিডোস (গুম, অপহরণ) ইত্যাদি নামে এ ধরনের অভিযান চলেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে এখন চলছে সেই নোংরা খেলাই। মিসর, সিরিয়া, ইসরাইল, লিবিয়া, ইয়েমেন, ইরাক-- কোনো দেশই এই খেলার রক্তক্ষরণ থেকে মুক্ত নয়। বিস্ময়করভাবে এক দেশের ঘটনার সাথে আরেক দেশের ঘটনার অদ্ভুত মিল লক্ষ করা যায়। মিসরে সিসি শাসনে যা ঘটছে, তার সাথে মিল লক্ষ করা যায় বাংলাদেশের ঘটনা পরম্পরায়।

পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সবাই একই মাত্রায় নোংরা খেলার কৌশল গ্রহণ করেনি। সোভিয়েতবলয়ের দেশগুলো এটিকে ‘সাম্রাজ্যবাদের’ কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করে এর দায় চাপানোর চেষ্টা করত আমেরিকার ওপর। কিন্তু স্টালিন বা মাও সেতুংয়ের আমলে তারা নিজ দেশে ভিন্ন মতাবলম্বী অথবা নিজ দলের প্রতিপক্ষ দমনে যে নোংরা খেলার কৌশল অবলম্বন করেছে, তা মাত্রার দিক থেকে কোনো অংশে কম নয়। সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট পূর্ব ইউরোপ কিংবা হাফিজ আল আসাদের সিরিয়া এবং সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে নির্মমভাবে নোংরা খেলার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার উত্তর কোরিয়া এ ক্ষেত্রে এখনো পুরনো ঐতিহ্যের ধারাতেই চলছে। উত্তর কোরীয় নেতা কিম তার আপন ফুপাকে কুকুর দিয়ে কামড়িয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করেছেন, যিনি ক’দিন আগ পর্যন্ত তার ও তার পিতার প্রশাসনের প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকায় ছিলেন। 

নোংরা যুদ্ধের কৌশলকে পরাশক্তি বা আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর প্রক্সি যুদ্ধ হিসেবেও অনেক সময় চিহ্নিত করা হয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের পর পাকিস্তানের সহায়তায় আফগানদের প্রশিক্ষিত করে রুশ বাহিনীর বিতাড়নে মূল ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এ জন্যই ওসামা বিন লাদেনের ‘আলকায়েদা’ গঠিত হয়। পরে তাদের সমর্থনে আফগানিস্তানে তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো। নাইন-ইলেভেনের বোমা হামলার পর সেই আলকায়েদা ও তালেবানকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে মিত্রদের সাথে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযান চালিয়ে তালেবান শাসনের অবসান ঘটায়। এ ঘটনার পথ ধরে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের এক বিরাট অঞ্চলে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যাতে এখনো নির্বিচারে মৃত্যুবরণ করছে দু’দেশের নাগরিকেরা।

আলকায়েদার কথা এখন আর শোনা যায় না। এখন নতুন শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছে আইএস বা আইসিস নামে। খোলা জিপ বা ভ্যানে চড়ে মেশিনগান উঁচিয়ে যেভাবে তারা ইরাক ও সিরিয়ার বিরাট অঞ্চল দখল করে একধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে তা অনেকটাই বিস্ময়কর। আন্তর্জাতিক শক্তি চাইলে তাদের অঙ্কুরেই যেখানে দমন করা সম্ভব ছিল, সেখানে নানাভাবে তাদের শক্তি সঞ্চয় করতে এবং প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলাসহ যত অঘটন ঘটছে, সব কিছুর দায় শিকার করছে আইএস। আর সাথে সাথেই এসব দেশের মুসলমানদের ওপর নেমে আসছে নানা ধরনের খড়গ ও নিপীড়ন। প্যারিসে হামলার পর ফ্রান্সের শত শত মসজিদ বা নামাজের ঘর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবার। একই ধরনের ঘটনা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকায় ঘটছে। এসবের সাথে সেই পুরনো নোংরা খেলার যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছেন অনেক বিশ্লেষক।

ডার্টি ওয়ার কেন, কিভাবে?
ডার্টি ওয়ারের কৌশল মূলত ক্ষমতাধর দেশগুলো তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে গ্রহণ করে থাকে। সংশ্লিষ্ট দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এই খেলা চালানো হয়। আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের বৈধ যোগাযোগ পদ্ধতি হলো কূটনৈতিক সম্পর্ক। ভিয়েনা কনভেনশন ও জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন রীতি অনুসারে এই সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকে। এর বাইরে প্রতিটি দেশই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য গোয়েন্দা সংস্থা সৃষ্টি করে থাকে। এ ধরনের গোয়েন্দা সংস্থার আকার ও কাঠামো নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সামর্থ্যরে ওপর।

অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা কার্যক্রম স্ব স্ব দেশের আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকারের ধরনের ওপর অবশ্য নির্ভর করে লক্ষ্য অর্জনের জন্য আইনবহির্ভূত পথ কতটা অনুসৃত হবে সে দেশে। একনায়কতান্ত্রিক শাসনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অপরিমেয় ক্ষমতা দেয়া হয়। এটি শুধু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে দেখা যায়নি, যেকোনো একনায়ক বা রাজতন্ত্র শাসিত দেশেও তা লক্ষ করা যায়।

রাষ্ট্রের বাইরে কূটনৈতিক নিয়মবহির্ভূত গোয়েন্দা কার্যক্রম অন্য দেশে চালানো আইনের দ্বারা বৈধ নয়। এ কারণে বিভিন্ন কূটনৈতিক বা বাণিজ্যিক পরিচয়ের মোড়কে এ কার্যক্রম চালানো হয়। কোনো কোনো দেশে মানবাধিকার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অথবা মিশনারী প্রতিষ্ঠানের আদলেও গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম চলতে থাকে। প্রতিটি রাষ্ট্রই ভিন্ন পরিচয়ে গোয়েন্দাকার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে অবহিত। অনেক সময় আবার এ ধরনের কার্যক্রমে অঘোষিতভাবে পাস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ও চালানো হয়।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের উদ্দিষ্ট দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক এমনকি কোনো কোনো সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতেও অনুপ্রবেশ করে। রাজনৈতিক দলে অনুপ্রবেশ বা দল গঠনের কাজ ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গিয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধকালে। এ সময় বিভিন্ন দেশে মার্কসবাদী ভাবাদর্শে রাজনৈতিক দল গঠন ও আন্দোলন ব্যাপক আকার নেয়। এসব উদ্যোগে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে সারা বিশ্ব থেকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা অংশ নিতেন। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন রাজনৈতিক বা আদর্শগতভাবে তার প্রভাব বিস্তার করে বিশ্বব্যাপী। সোভিয়েত আমলে কেজিবির গোয়েন্দা কার্যক্রমে এর ছিল বিরাট ভূমিকা। সীমিত পরিসরে ষাটের দশক থেকে চীনও বিদেশে তার প্রভাববলয় সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক মতবাদ ছড়িয়ে দেয়ার কৌশল নেয়। একপর্যায়ে আদর্শিক প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে সারা দুনিয়ায় চীন ও সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের বিপরীতে স্নায়ুযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রও রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল গঠন, নিয়ন্ত্রণ এবং দলকে প্রভাবিত করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে আমেরিকা। বৈশ্বিক শক্তিগুলোর বাইরে আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের নিজ নিজ প্রভাবাধীন অঞ্চলে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থনৈতিক ও অন্যভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। এসব কার্যক্রমের বড় অংশই চালানো হয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক দিয়ে।

গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ভিন্ন রাষ্ট্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক অনুপ্রবেশের একটি বড় উপকরণ বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় বৃত্তি, প্রশিক্ষণ ও সফর কর্মসূচিকে। যে রাষ্ট্রের সামাজিক সাংস্কৃতিক বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য থাকে, সেখানে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের নানা কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে তা পরবর্তী পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট দেশে লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজে লাগানো হয়।

বৃহৎ দেশগুলোর দূতাবাসেই কূটনৈতিক পরিচয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কাজ করেন। সংশ্লিষ্ট দেশ এ বিষয়ে অবহিত থাকলেও প্রতিপক্ষ দেশে একই ভূমিকার প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে অথবা শক্তি সামর্থ্যরে অপারগতা বা নির্ভরশীলতার কারণে বাদ প্রতিবাদ করা হয় না। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বা বিদ্রোহ সৃষ্টি করে পতন ঘটানোর ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে।

সাধারণভাবে ডার্টি যুদ্ধের সব উপকরণকে ডার্টি বা নোংরা মনে হয় না। ইসরাইল ও আন্তর্জাতিক ইহুদি সংগঠনগুলোর পরিচালিত একটি আন্দোলনের নাম হলো ফ্রি ম্যাসন আন্দোলন। এ আন্দোলনের সাথে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব একসময় জড়িত ছিলেন। এই আন্দোলন মূলত বিশ্বব্যাপী ইহুদি স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে। এর তত্ত্বাবধানে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, অনেক সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন এবং আন্দোলন পরিচালিত হয়।

দক্ষিণ এশিয়ায় নোংরা যুদ্ধ
স্নায়ুযুদ্ধকালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরস্পরকে মোকাবেলার জন্য যে ডার্টি ওয়ার বা নোংরা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করত, সেটি দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রভাবশালী প্রতিপক্ষ ভারত ও পাকিস্তান গ্রহণ করছে ব্যাপকভাবে। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বানানো এই যুদ্ধ গতানুগতিক যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর বলে মনে করা হয়। গতানুগতিক যুদ্ধে যেখানে স্বপক্ষের লোকক্ষয় ও সম্পদহানি এড়ানো যায় না, সেখানে নোংরা যুদ্ধে আক্রান্ত ও আক্রমণকারী, দুটোই হয় মূলত প্রতিপক্ষের। এতে যুদ্ধ খরচও তুলনামূলকভাবে স্বল্প। এ ছাড়া নোংরা যুদ্ধের কৌশল হিসেবে প্রতিপক্ষকে খুন অপহরণ গুম করার কাজ স্থানীয় ভাড়াটিয়াদের দিয়েও করা সম্ভব। ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এসব কাজ সরকার বা নিরাপত্তাবাহিনীকে ব্যবহার করে করাতে দেখা গেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুম-অপহরণ ছাড়াও বিচারিক মোড়কেও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালাতে দেখা যায়। 

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগোত্তর সময়ে ভারত নেহরু ডকট্রিনের অংশ হিসেবে প্রতিপক্ষ দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারে গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের বিস্তৃত করে। ষাটের দশকের শেষার্ধে আইবি ভেঙে বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) গঠনের পর ভারতের ‘নোংরা যুদ্ধ’ চালানোর সক্ষমতা বেশ বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৫ সালে সিকিমকে ভারতের সাথে একীভূত করে নেয়ার মধ্য দিয়ে সংস্থাটি একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে। এর আগে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল সংস্থাটির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। ভারতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো, পাকিস্তানের বেলুচ এবং খাইবার পাখতুনখোয়া ও ‘ফাটা’ এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করা। এ দুটো এলাকার সাথে ভারতের সীমান্ত সংযোগ না থাকায় ডার্টি ওয়ারে বেলুচ-পাখতুনখোয়ায় সাফল্য অতটা পাওয়া যায়নি। তবে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসানের পর সেখানে ভারতের বিশেষ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেতে থাকে নয়া দিল্লি। আফগান তালেবানের বিপরীতে পাকিস্তানি তালেবানের সাথে এক বিশেষ যোগসূত্র তৈরি করতে সক্ষম হয় ভারত। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সমঝোতা বিরাট সুযোগ এনে দেয় নয়া দিল্লির হাতে।

দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান প্রাথমিকভাবে ‘ডার্টি ওয়ার’-এর প্রতি ততটা কৌশলগত গুরুত্ব দেয়নি। ফলে ১৯৭১ সালে দেশটির পূর্বাংশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা এ ধরনের কোনো কৌশলের সার্থক প্রয়োগ ঘটাতে পারেনি। কিন্তু ’৭০-এর দশকের পর থেকে পাকিস্তানও ভারতের পাল্টা ডার্টি ওয়ারের প্রতি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যস্থল হয় কাশ্মির, উত্তরপূর্ব ভারতের সাত রাজ্য ও পাঞ্জাব। কাশ্মির ও পাঞ্জাবের সাথে পাকিস্তানের স্থলসীমান্ত থাকায় বিচ্ছিন্নতাকামীদের কৌশলগত নেটওয়ার্ক বিস্তার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতা করা সহজ হয়। সে তুলনায় দূরবর্তী সাত রাজ্যে পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য কিছু করার অবকাশ থাকে না। বরং এ ক্ষেত্রে চীন ও বাংলাদেশ এ অঞ্চলের সাথে সীমান্তসংলগ্ন হওয়ায় সেসব দেশের নিজস্ব নেটওয়ার্ক এ ক্ষেত্রে কার্যকর হয়ে দাঁড়ায়।
ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যে নীতির ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ ঘটেছে, তাতে এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কথা। আর বাংলা ও পাঞ্জাবের মতো গণভোটের মাধ্যমে প্রদেশ বিভাজনের ঘটনা ঘটলে জম্মুর অংশবিশেষ ভারতের অঙ্গ হলেও কাশ্মির উপত্যকা পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কথা। কিন্তু কাশ্মিরের রাজার ভারতে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা শেখ আব্দুল্লাহর দিল্লির প্রতি আনুকূল্য দেখানোর ফলে কাশ্মির ভারতের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। পরে এ নিয়ে পাকিস্তান সেনা অভিযান শুরু করলে বর্তমান আজাদ কাশ্মির পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আর অস্থির ও উত্তপ্ত থেকে যায় জম্মু-কাশ্মির। পাকিস্তান ডার্টি ওয়ারের পাল্টা কৌশল গ্রহণের আগ পর্যন্ত কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিকে সশস্ত্র রূপ নিতে দেখা যায়নি। 

পাঞ্জাবে নোংরা যুদ্ধের প্রভাব লক্ষ করা যায় খালিস্তান আন্দোলনের সময়। এ সময় খালিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাকিস্তানে গোপন আশ্রয় ও প্রশ্রয় লাভ করে। কিন্তু ভারত পাঞ্জাবে সর্বাত্মক বিদ্রোহ নির্মূল অভিযানে নামলে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো তাতে সাহায্য করায় এই আন্দোলনের অকালমৃত্যু ঘটেছে বলে মনে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য পাঞ্জাবে নতুন করে অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

উপমহাদেশে আঞ্চলিক যে ডার্টি ওয়ার গেম চলছে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে, প্রতিপক্ষের মানচিত্র পরিবর্তন বা কোনো অংশকে নিজ প্রভাবের অধীনে নিয়ে আসা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক সমর্থন দেয়াকে অনেক পাকিস্তানি বিশ্লেষক ভারতের ডার্টি ওয়ার কৌশলের অংশ মনে করেন। এখন পাকিস্তানের করাচি, বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়া এবং ফেডারেল টেরিটরি অঞ্চলে যে অস্থিরতা চলছে, তাকেও ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টি ওয়ার গেমের অংশ মনে করেন ইসলামাবাদের বিশ্লেষকেরা। অন্য দিকে কাশ্মিরের উত্তপ্ত অবস্থা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সাত রাজ্যে অস্থিরতার পেছনে চীন-পাকিস্তানের ডার্টি ওয়ার গেম সক্রিয় বলে মনে করা হয়।

ডার্টি ওয়ার গেম যেখানেই সংঘটিত হোক না কেন, তার অনিবার্য পরিণতি ব্যাপক রক্তক্ষয় ও ধ্বংসযজ্ঞ। অনেক সময় নিজ হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তারের জন্য মিত্র শক্তির ওপর আঘাত হানাকে কৌশলের অংশ মনে করা হয় এ যুদ্ধে। এ জন্য এ যুদ্ধে শত্রু-মিত্র সবাই থাকে ঝুঁকির মধ্যে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের বিমান দুর্ঘটনায় আমেরিকান কর্মকর্তাদের মৃত্যুকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন অনেকে।

বিশ্বের শান্তি ও স্থিতির সাথে ডার্টি ওয়ারের সম্পর্ক বিপরীতধর্মী। কূটনীতিনির্ভর পররাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর যখনই গোয়েন্দানির্ভরতা প্রাধান্য লাভ করে, তখন বিশ্বের অনেক অঞ্চল হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। এ অবস্থা এখন দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের একই অবস্থার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা অনেকের। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিরোধী পক্ষের আন্দোলন ও তা দমনে কত লোক ক্ষয় তথা খুন গুম অপহরণ ক্রসফায়ার ও অন্যান্য বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে এসব তথ্য একসময় বিদেশী সূত্র থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এখন জানা যাচ্ছে আর্জেন্টিনায় বামপন্থী আন্দোলন দমনের নামে যে ডার্টি ওয়ার চলেছিল, তাতে ৩০ হাজার বাম অ্যাকটিভিস্ট ইউনিয়নিস্ট ছাত্র সাংবাদিক মার্কসিস্ট ও পেরোনিস্ট গেরিলাকে হত্যা করা হয়েছে। চিলির অবমুক্ত দলিল থেকে এখন জানা যাচ্ছে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত সময়ে ডার্টি ওয়ারে সেখানে ২২ হাজার লোক নিহত বা গুম হয়েছেন। অন্য দেশের ডার্টি ওয়ারেও বিপুলসংখ্যক লোক এভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। দুই দশক আগে আলজেরিয়ায় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টের বিজয়ের পর ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে ১০ হাজারের বেশি নিহত হয়েছে। মিসরে ব্রাদারহুড-বিরোধী অভিযানে নিহতের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে বেসরকারি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। আফ-পাক এলাকায় নিহতের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে এ সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। সিরিয়ায় হাফিজ আল আসাদের সময় ৩০ হাজার লোক নিহত হয়েছেন। বাশার আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে পৌনে চার লাখ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক লোকক্ষয়ের পর ’৭৩-৭৪ সালে বিপুলসংখ্যায় রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। চলতি দশকে লক্ষ করা যাচ্ছে এর পুনরাবৃত্তি। আইএস ধুয়া বা হামলার যে দাবি উঠছে, সেটিও ব্যাপক লোকক্ষয়ের কারণ ঘটাতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কে কোন উদ্দেশ্যে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, তার কোনো হদিস থাকে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন