বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০১৪


র‌্যাব ‘ঘাতক বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে অনেক আগেই। এটা পুরানা খবর। এখন তাকে নিষিদ্ধ বা বিলুপ্ত করবার দাবি করছেন অনেকে। দেখছি, পড়ছি। বেশ ভদ্রলোক হয়ে উঠছে বাংলাদেশ! সুশীল!! 

র‌্যাব বিলুপ্তির দাবি নতুন কোন খবর নয়। মানবাধিকারকর্মীরা এই দাবি করছেন বহু দিন আগে থেকেই। যেমন, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। দুটোই স্বনামে খ্যাত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। নারায়ণগঞ্জের মতো ঘটনা তখনো ঘটেনি। তার আগেই কেন র‌্যাব বিলুপ্ত করা উচিত তার যুক্তি দিয়েছিলেন। মানবাধিকারের অবস্থান থেকে আমি র‌্যাব বিলুপ্তির পক্ষে। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে র‌্যাব বিলুপ্তির পক্ষে আমার আরো যুক্তি আছে। র‌্যাবে সেনাবাহিনীর সদস্যরা র‌্যাবের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা, নির্যাতন, গুম, খুনে জড়িত হয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশে সৈনিকতার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হোক কেউ চাইতে পারে না। সৈনিক যদি কোন নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা করা শেখে তাহলে তাকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেয়া সেনাবাহিনীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ফলে দেশের জন্য যেমন, দেশের প্রতিরার জন্যও তা বিপদ ডেকে আনে। 

র‌্যাবে অফিসারপর্যায়ের সৈনিকেরা দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। আজ অভিযোগ উঠছে তাদের বিরুদ্ধে। সৈনিকতার মর্যাদা রক্ষা এবং বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে রক্ষা করবার জন্য হলেও অবিলম্বে র‌্যাব বিলুপ্ত করা দরকার। নিদেন পক্ষে সকল সেনাকর্মকর্তাকে অবিলম্বে র‌্যাব থেকে প্রত্যাহার করা উচিত। এর বেশি র‌্যাবের বিলুপ্তির পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আমি আজ কিছু লিখব না। গণপ্রতিরক্ষা ও সৈনিকের কর্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটা অন্যত্র আলোচনা করা যাবে। আজ আমি অন্য বিষয়ে যাবো। 

র‌্যাবের বিলুপ্তির দাবি নতুন না হলেও বাংলাদেশের ভদ্রলোকদের কেউ কেউ এখন র‌্যাব বিলুপ্ত করতে চাইছেন, এটাই নতুন। তাদের সংখ্যা বেশি নয়, কম। এখনো বেশির ভাগই সন্ত্রাস দমনে র‌্যাবের ভূমিকায় মোহিত। তারা সন্ত্রাস দমন চান, কিন্তু আইনবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ড, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, অপহরণ, গুম ও খুন এই সব চান না। হলেও আড়ালে-আবডালে মিডিয়ার ভেতরের পাতায় ছোট এক টুকরা খবর হিসেবে থাকুক। হইচই না হোক। এর বেশি কিছু নয়। 

অপহরণ, গুম ও খুনের সংখ্যা ভীতিকর জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনেরও আগে। অথচ এখন হইচই হচ্ছে। যারা আগে এর শিকার হয়েছেন তারা বিশেষ রাজনীতি বা মতাদর্শের মানুষ। এখন ক্ষমতাসীনেরা তাদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করছে। এখনো সাতক্ষীরায় অপহরণ, গুম বা খুনের ঘটনা চলছে। কিন্তু সাতক্ষীরা নিয়ে হইচই হচ্ছে না। সরকার আড়ালে রাখতে পারছে। যারা অপহরণ, গুম ও খুন হচ্ছে তারা ‘জামায়াত-হেফাজত-বিএনপি’ ফলে রাষ্ট্রের দিক থেকে এদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে একটা জনমত গণমাধ্যম তৈরি করে রাখতে পেরেছে। র‌্যাব-১১-এর কমান্ডারের বিরুদ্ধে অভিযোগও নতুন নয়। তিনি নারায়ণগঞ্জে বদলি হয়ে আসার আগে লক্ষ্মীপুর ছিলেন। সেখানকার বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের হত্যার অভিযোগ কে না জানে। লক্ষ্মীপুর থেকে হেলিকপ্টার করে র‌্যাবকে জনরোষের কবল থেকে উদ্ধার করতে হয়েছে। সাতক্ষীরা লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, কোন জেলার ক্ষেত্রেই আমাদের আবেগ এত উথলে ওঠেনি, যতটা নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রে হচ্ছে। রাজনৈতিক বা মতাদর্শিকভাবে যারা ক্ষমতাসীনদের বিরোধী তাদের আইনবহির্ভূতভাবে অপহরণ, গুম বা খুনের নৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি আমরা দিয়েছি। যে মতাদর্শ, রাজনীতি ও তাদের সমর্থক গণমাধ্যম এই কাজ বিবেকহীনভাবে করেছে এবং এখনো করছে তারা এখন নারায়ণগঞ্জের অপহরণ, গুম বা খুনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। এখনো অন্য এলাকার কথা একইভাবে ও একই মাত্রায় বলছে না। সাধারণ মানুষকে এতো বোকা ভাবা ঠিক না। ভদ্রলোকদের অপরিণামদর্শী হিপোক্র্যাসি বোঝার মতো বুদ্ধি নাকে শিকনি ঝরা বস্তির বাচ্চাগুলোরও আছে। 

র‌্যাব না থাকলে বাংলাদেশে ইসলামি সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তাদের দমন করবার জন্য এই ধরনের বিশেষ বাহিনী দরকার। আর সন্ত্রাস দমন মানেই তো এখন ইসলামি সন্ত্রাস। একসময় নকশালীরা ছিল। কিন্তু মুফাখখার, ডাক্তার টুটুলসহ নেতৃস্থানীয়দের খতম করার পর থেকে নকশালীরা গৌণ হয়ে গিয়েছে, তারা ভদ্রলোকদের জন্য এখন আর বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। ইসলামপন্থীরাই ভদ্রলোকদের প্রধান ভীতির কারণ। মিডিয়া নিরন্তর তাদের আরো ভয়ানক করে তুলছে। তো, তাদের কথা হচ্ছে র‌্যাব যে কাজ করবার কথা সেটা তারা করুক। অর্থাৎ শিবির, জামায়াত, হেফাজত ও মাদরাসার ছেলেদের ধরুক, অপহরণ করুক, গুম করুক, পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে নুলা করে ফেলে দিক, ক্রসফায়ারে দিক, পেট ফুটা করে পানিতে ডুবিয়ে দিক। কিছুই আসে-যায় না। র‌্যাব মারলে মারবে বিএনপির নেতা ও কর্মীদের। ইলিয়াস আলী গুম হয়ে যাবে, অসুবিধা নাই। কিন্তু তারা নিজেদের মধ্যে সেই কাজ করবে কেন? তাও আবার টাকার বিনিময়ে? 

টাকার বিনিময়ে র‌্যাব নারায়ণগঞ্জে এই কাজ করল? কী খারাপ কথা। সুশীলরা মনে খুব দুঃখ পেয়েছে। মনের দুঃখে তারা মানববন্ধন করেছে। এত দিন লক্ষ্মীপুর, সাতক্ষীরা, নরসিংদীসহ বহু জায়গায় মানুষ অপহৃত হয়েছে, খবর নাই। গুম হয়ে যাওয়া মানুষের লাশ পাওয়া গিয়েছে, কোন প্রতিবাদ নাই। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় সুশীলসমাজ নড়েচড়ে বসেছে। তাদের আপত্তি, র‌্যাব আমাদের নিজেদের লোক মারবে কেন? নরসিংদী, লক্ষ্মীপুর, সাতক্ষীরা এই সব জায়গায় গুম, অপহরণ ও হত্যার খবর ভদ্রলোকদের বিচলিত করেনি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ করেছে। 

তবুও বলব খারাপ কী? এরপরও সুশীলদের আমি সমর্থন করি। কারণ ছেঁকা খেয়ে শেখার মধ্যে দোষ নাই। কিন্তু বাংলাদেশের সকল নাগরিকেরই জানমালের অধিকার আছে- এই নীতির ওপর না দাঁড়ালে যে বাঘ অন্যকে খায় সেও একদিন ঘাড় মটকে দিতে আসবে। আমরা মনে হয় সেই পর্যায়ে দ্রুতই পৌঁছে যাচ্ছি। এই শিক্ষা যারা দ্রুত নেবে তারাই নিজেদের ঘাড় রা করতে পারবে। 

দুই
বহু কিছু ভুলে যাই আমরা, তার পর নিজেরা নিজেরা খেয়োখেয়ি করি। এখন র‌্যাব নিয়ে মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের বাহিনী গঠনের বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার হবার কথা ছিল শুরু থেকেই। অপরাধ বা অপরাধী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আসলে এক ভয়াবহ সমাজ গড়ে উঠেছে যেখানে কোন নীতির বালাই নাই। এমন এক সমাজ যেখানে আইন নাই, অথচ আইনের শাসন নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা দেওয়া হয়। যেখানে সরকার নাই, অথচ আছে নিরঙ্কুশ একনায়কতান্ত্রিক মতা। আমরা যার নাম দিয়েছি গণতন্ত্র। নির্বাচন আছে, কিন্তু অংশগ্রহণ নাই, আদালত আছে, বিচার নাই। কী বলব? 

নাগরিকদের নিরাপত্তা নাই, কিন্তু পুলিশ আছে; প্রতিরা নাই, অথচ সেনাবাহিনী আছে- সীমান্তে নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে নিয়মিত, আর আমরা সীমান্ত রক্ষাকে এখন সীমান্ত ‘গার্ড’ দেওয়া বুঝি। বীর বাঙালি সীমান্ত ক্ষাকে দারোয়ানগিরিতে পরিণত করেছে। লজ্জাও পাই না আমরা। তো এখন এই পরাবাস্তব পরিস্থিতিকে আড়াল করা খুবই দরকার হয়ে পড়েছে। নিজেদের, সমাজের রাষ্ট্রের বিকৃতি নিয়ে আমরা কথা বলতে চাই না। কিন্তু সব দোষ নন্দ ঘোষ। এখন র‌্যাব বিলুপ্ত করা উচিত নাকি উচিত নয় এই নিরর্থক তর্কে নারায়ণগঞ্জকে গুমগঞ্জ আর ইট বেঁধে লাশ ডোবানোর বন্দর নগরীতে পরিণত করেছে। সেই বন্দরের ঘাটে নাকি দুটি নৌকা বাঁধা থাকে, আর তাদের কাজ রাতবিরাতে নদীতে ইট বেঁধে লাশ ডুবিয়ে দিয়ে আসা। দারুণ বাংলাদেশ। 

এখন লাশ ভেসে উঠছে নদীতে। আগে খালে বিলে পাওয়া যেত। কিম্বা পথের ধারে, আড়ালে আবডালে। এখন লাশও পাওয়া যায় না। মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে বহু দিন থেকেই। সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কোন হদিস নাই। ভাগ্য ভালো সেই সকল লাশের যারা নদীর তলদেশ থেকে ভেসে উঠছে। লাশেরা নিশ্চয়ই কিছু বলতে চায়। আমরা শোনার জন্য প্রস্তুত কি? না, আমরা শোনার জন্য তৈরি না। 

জি, আমরা ভুলে যাই। ভুলে কি যাই নি যে দুই হাজার আট সালে শেখ হাসিনা একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল তিনি ক্ষমতায় এলে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবেন? যারা এই জঘন্য অপরাধ করেছে তাদের তিনি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন? ‘জিরো টলারেন্স’! আহ্- সেই মধুর জিরো টলারেন্স! আওয়ামী লীগ আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে একদমই সহ্য করবে না। কই? করেছে কি? ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগানের আড়ালে সেই প্রতিশ্রুতি শীতলক্ষ্যার  নদীতে ডুবে গিয়েছে। এখন বাংলাদেশকে মুখে স্কচ টেপ আঁটা, ইট বাঁধা ও পেট ফুটা অবস্থায় উদ্ধার চলছে। এতে দেশোদ্ধার হবে না। দেশকে আমরা কোথায় নিয়ে গিয়েছি তার হুঁশ আমরা অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। রাষ্ট্র গড়বার ক্ষেত্রে নাগরিকদের নিজেদের মধ্যে যে ন্যূনতম নৈতিক ঐক্য ও পারস্পরিক সম্মতি দরকার আমরা কখনই তার চর্চা করি নি। প্রতিপক্ষকে কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ‘নির্মূল’ করতে চেয়েছে, আর কেউ চেয়েছে ইসলামের নামে। আমরা প্রত্যেকেই এক দিকে রাজাকার ও মৌলবাদী হয়েছি, অন্য পক্ষে কেউ হয়েছে নাস্তিক ও মুরতাদ। চমৎকার বাংলাদেশ!! কেউ নাগরিক হই নি। অন্যের অধিকার আছে বা থাকতে পারে, এটা আমরা স্বীকারই করি না, মানা তো দূরের কথা।

নারায়ণগঞ্জের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পর যে সকল বীরপুঙ্গব র‌্যাবকে বিলুপ্ত করবার দাবি করে এখন মহৎ হতে চাইছেন, তাদের প্রথমেই প্রশ্ন করা উচিত সেই প্রতিশ্রুতির কী হোল? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যা কিছুই করে থাকে তা ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে কিংবা প্রশ্রয়ে করে। আর ক্ষমতাসীনদের এই একনায়কতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচার যদি বন্ধ করতে হয় তাহলে দরকার নাগরিক ও মানবিক অধিকার সম্পর্কে নাগরিকদের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা। সেই সচেতনতা থাকলে নাগরিক ও মানবিক অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার দিকেই সকলে নজর দিতেন। যে চেতনা ও রাজনীতি আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গুম ও হত্যাকাণ্ডকে অনিবার্য করে তোলে তাকে প্রত্যাখ্যান না করে শুধু র‌্যাব বিলুপ্ত করলে কি সমাধান হবে? হবে না। 
আসলে র‌্যাব গঠন করাটাই ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তার গঠনকাঠামোর মধ্যে যেমন গলদ রয়েছে, তেমনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের র‌্যাবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন ধরা যাক র‌্যাব বিলুপ্ত হোল। কিন্তু পুলিশের অপহরণ, গুম, খুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও তাদের নিজেদের হেফাজতে থাকা অভিযুক্তদের হত্যা বন্ধ হবে কিভাবে? তার মানে কি পুলিশ বাহিনীকেও এরপর বিলুপ্ত করতে হবে? আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গুম ও হেফাজতে মৃত্যু বা নানাবিধ কায়দায় নাগরিকদের হত্যার হিসাব ধরি তাহলে চ্যাম্পিয়ন পুলিশই হবে। র‌্যাব না। এই পরিস্থিতিতে কী করা? অন্যান্য সংস্থার কথা না-ই বা বললাম। 

বিএনপি সরকারের আমলে দুই হাজার চার সালে র‌্যাব গঠিত হবার পরপরই র‌্যাবের বিরুদ্ধে লিখেছিলাম। অনেকেরই মনে আছে। আজ র‌্যাব নিয়ে লিখতে গিয়ে খুঁজে বের করলাম, ‘র‌্যাব ও আমাদের অসুখ’ (দেখুন, ১ নভেম্বর ২০০৪)। আরো লিখেছিলাম ‘র‌্যাব বিতর্ক’ (১৩ নভেম্বর ২০০৪)। সেই সময় অনেক ঝুঁকি নিয়েই লিখতে হয়েছিল। তখন সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানকে হত্যা করায় শহরের নাগরিকেরা উল্লসিত হয়েছিলেন। এই প্রশ্ন খুব কম মানুষই তুলেছিলেন, তাও অনেক দেরিতে যে, যত ঘৃণিত অপরাধী হোক, কোন ব্যক্তিকে আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তিকেই নড়বড়ে করে তোলে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? ইতোমধ্যে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ শুরু হয়ে গিয়েছে। ইসলামি জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দমন ও হত্যার জন্য নতুন ধরনের বাহিনী দরকার। র‌্যাব গঠন ও রক্ষার পক্ষে ক্ষমতাসীনরা বিস্তর যুক্তি পেয়ে গেল। আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতেও তাদের অসুবিধা হোল না। বিএনপিও দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে অপারেশানে টার্গেট পেয়ে গেল। বিভিন্ন নামের সশস্ত্র বামপন্থী দলের নেতা ও কর্মীদের নিধন উৎসবে মেতে উঠল। এদের অনেকেই আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে লড়েছে, বিএনপি তাদের দল নয়, কিন্তু জিয়াউর রহমানের আমলে তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছে। 

মনে রাখা দরকার রাষ্ট্র নিজেই বল প্রয়োগের সংস্থা। অবাধ্য বা আইন ভঙ্গকারী অবাধ্য নাগরিকদের দমন করবার জন্য তার নিয়মিত বাহিনী আছে। আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনী ইত্যাদি তো রয়েছেই। তারপরও কেন র‌্যাব দরকার? দরকার কারণ আইনের বাইরে, বিধিবিধানের বাইরে ও আইনি বাধ্যবাধকতা ও শৃঙ্খলার অধীন না থেকে মানুষ হত্যা করা ছাড়া সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণী অবাধ বাজারব্যবস্থা ও পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই যুগে নিজেদের ধনসম্পদ ওর ক্ষমতা রক্ষা করতে পারে না। যে সমাজ ও অর্থনীতি উন্নয়নের নামে গড়ে তোলা হয়েছে সেই সমাজ ও রাষ্ট্রকে র‌্যাব জাতীয় খুনি বাহিনী পোষা দরকার হয়ে পড়ে। দরকার হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনীকেও একই ভাবে গড়ে তোলার। 

পিচ্চি হান্নানকে হত্যার মধ্য দিয়ে আমরা ‘ক্রসফায়ার’ শিখেছি। অনেকের কানে তা মধু বর্ষণ করেছে। তারা দাবি করলেন, এইবার আমরা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুক্ত হবো। এরপর হত্যা শুরু হোল সেই সকল গোপন রাজনৈতিক দলগুলোর ক্যাডারদের যাদের আমরা ‘নকশাল’ বলে চিনি। বিদ্যমান আইনে অপরাধী হলে তাদের বিচার ও শাস্তি হতে পারত। কিন্তু তাদের নেতাদেরও ক্রসফায়ারে হত্যা করা হোল। মোফাখখার, টুটুল আরো অনেকে। এরপর শুরু হোল ইসলামি সন্ত্রাসীদের হত্যা। পরিকল্পিতভাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম ও হত্যা শুরু হোল। বিএনপি, জামায়াত, শিবির সাফ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হোল। বাংলাদেশ হত্যা, অপহরণ, গুম ও ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া লাশের দেশে পরিণত হোল। সবই তো আমাদের চোখের সামনেই ঘটল। 

দশ বছর আগে যা বলেছিলাম, আজো তাই বলব। র‌্যাব নয়, এটা আমাদের নিজেদেরই অসুখ। আজো তাই বলব। র‌্যাব বিলুপ্ত করা হলে এই অসুখ থেকে মুক্তি হবে না, তবে মুক্তির দিকে নজর দেবার হিম্মত তৈরি হবে। সামাজিক নিরাপত্তা আসলে কী এবং তাকে নিশ্চিত করবার জন্য কী ধরনের পুলিশবাহিনী আমাদের দরকার সেই আলোচনা ও নীতিনির্ধারণী তর্কগুলো শুরু হতে পারে। ‘অপরাধ’ নিছকই ক্রিমিনাল বা ফৌজদারি মামলার ব্যাপার না। অপরাধের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক আছে। সেই দিকগুলো বোঝা ও বিশ্লেষণের পরিবেশ গড়ে তোলা দরকার সবার আগে। কারণ সমাধান এই সব ক্ষেত্র থেকেই আসবে। 

কিন্তু সবার আগে দরকার সেই ঐক্যবোধ যে এই সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। নারায়ণগঞ্জ শুরু ছিল না, অতএব শেষও নয়। লক্ষ্মীপুর, সাতক্ষীরা নরসিংদী ও অন্যান্য জেলা ভুলে গেলে চলবে না। হত্যাযজ্ঞ চলবে। এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণই সবার আগে দরকার। 

কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন