শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৪

চীনের বাঁধ : দিল্লির মুখে ঢাকার যুক্তি!

ভাটির দেশ হওয়াটাই যেন বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের কারণ। এই বদ্বীপ দেশের মধ্যে জালের মতো বিস্তৃত নদ-নদী; কিন্তু বেশির ভাগ বড় নদীর উৎস এ দেশের ভেতরে নয়। দেশটির তিন দিকে বেষ্টিত ভারত থেকে অথবা ভারতের ওপর দিয়ে এঁকে বেঁকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে অন্তত ৫৪টি নদী। একটি ব্যতিক্রমী নদী রয়েছে যেটি বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়ে ভারত হয়ে আবার বাংলাদেশের ফেনীর ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
বাংলাদেশ যেমন অনেক নদীর ভাটি অঞ্চলের দেশ তেমনিভাবে উজানের ভারতও কয়েকটি বড় নদীর ভাটির দেশ। এসব নদী হয়তো বা চীন অথবা নেপাল-ভুটান থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি নদী ভারত হয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশেও। এই উপমহাদেশে বেশির ভাগ বড় নদী মূলত হিমালয় পর্বতমালার বিভিন্ন হিমবাহ থেকে সৃষ্ট। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা। সুরমা কুশিয়ারাও ভারত থেকে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে।
এসব নদ-নদীর মধ্যে বাধাহীন প্রবাহের স্রোতবাহী নদ ছিল ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের উত্তরাংশে কৈলাশ পর্বতের নিকটবর্তী আংসি হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়। এরপর চীনের দক্ষিণ তিব্বতের মধ্য দিয়ে ১৭৯০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে নিমসা পর্বতের কাছাকাছি বড় আকারের ইউ বাঁক নিয়ে ভারতের অরুণাচলে প্রবেশ করে। এটি আসামের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যমুনা নাম ধারণ করে। গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ হয়ে পদ্মার সাথে মিলিত হয় এটি এবং পরে মেঘনার সাথে মিলে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। আরেকটি ধারা জামালপুর-ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকার অদূরে মিশে মেঘনার সাথে। পুরনো ব্রহ্মপুত্রের এই ধারা এক সময় ছিল প্রধান প্রবাহ। কোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্পে পাল্টে যায় স্রোতধারা। মূল ধারাটি হয়ে পড়ে ম্রিয়মাণ, গৌণ। 
দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর গভীরতা ১২৪ ফুট থেকে ৩৮০ ফুট পর্যন্ত। তিব্বতের বিস্তৃত গতিপথে নদীটি খুব প্রশস্ত নয় তবে পাহাড় পর্বত গিরিখাদের পথে এ নদী বেশ স্রোতবাহী। গভীর গিরিখাদে ২০০ মিটার ওপর থেকে জলপ্রপাত ও বিশাল পানিরাশি আর স্রোতের সৃষ্টি করেছে নদীধারার কোনো কোনো স্থানে। অরুণাচল হয়ে আসামে প্রবেশের পর এর সাথে আরো দু’টি নদীর জলধারা মিশে এটি হয় বেশ বিস্তৃত। এই বিস্তৃত বিশাল আকার নিয়েই ব্রহ্মপুত্রের প্রবেশ দক্ষিণাংশ দিয়ে বাংলাদেশে। 
বাংলাদেশে প্রবেশ করে এর উন্মত্ততা কিছুটা ঠাণ্ডা হওয়ায় হয়তো বা এর নামের প্রকৃতি পাল্টে হয়েছে যমুনা। নদ থেকে রূপান্তর ঘটেছে নদীতে। এই যমুনাই বাংলাদেশের নদীবাহিত মিষ্টি পানির বড় অংশের জোগান দিয়ে আসছে এত দিন। তবে যমুনা আর কত দিন বাংলাদেশের শুষ্ক মাটিতে প্রাণের সঞ্চার করতে পারবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এর প্রবাহ আটকে দেয়ার আয়োজন করছে উজানের দুই দেশ চীন আর ভারত। প্রতিবেশী ভারত চেয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের সাথে তিস্তা গঙ্গার সংযোগ তৈরি করে এর পানি নিয়ে যাবে দক্ষিণের তামিলনাড়– পর্যন্ত। সেই ভাবনায় ছেদ ধরিয়ে দিয়েছে তার সাথে অম্লমধুর সম্পর্কের টানাপড়েনে থাকা প্রতিবেশী চীন। ভারতে প্রবেশের আগেই গিরিখাদের ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদীর স্রোত আটকে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল চারটি প্রকল্প নিয়েছে বেইজিং। ভারতে অনেকের ধারণা বাঁধের সংখ্যা আসলে চার নয়, কম করে হলেও হবে ২৬টি। সংখ্যা যাই হোক না কেন তিব্বতিরা সাংপো নামে যে নদীকে ডাকে তার বাধাহীন প্রবাহ আর পাচ্ছে না ভারত ও বাংলাদেশ।
তথ্যের অবাধ গতিপ্রবাহ নেই চীনে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ধারণা করা হচ্ছিল দেশটি সাংপো নদীতে বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা করছে; কিন্তু ২০১০ সালে তা স্বীকার করার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি দিল্লি। এর আগে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রবাহ ভিন্ন দিকে সরিয়ে সেচে লাগানো, বন্দরের নাব্যতা বাড়ানোতে ব্যবহারসহ নানা পরিকল্পনা নেয় দিল্লি; কিন্তু মাথায় বাজ পড়ার মতো চীনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কথা জানতে পারে ভারত। দেশটি ভারতকে আশ্বস্ত করেছিল বাঁধ দিলেও নদীর পানি অন্য দিকে সরিয়ে নেবে না। কিন্তু এ কথায় আস্থা আনতে পারছে না দেশটি। মেয়াদ ফুরিয়ে আসা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ সম্প্রতি তার দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রীকে বলেছেন তিনি যেন চীনা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে জেনে নেন ইয়ার্লাং সাংপো নদীতে যে বাঁধ চীন দিচ্ছে সেটি ‘রান অব রিভার’ বা শুধু বিদ্যুৎ তৈরির জন্য পানি জমিয়ে আবার ছেড়ে দেয়া ধরনের হবে নাকি পানি প্রত্যাহার করা হবে। 
নয়া দিল্লি বেইজিংয়ের কাছ থেকে নিশ্চিত হতে চায় তারা এখানে বাঁধ দিয়ে জমানো পানি সেচ বা অন্য কোনো কাজের জন্য প্রত্যাহার করে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবে না। এর আগে ২০১২ সালে মনমোহন সিং চীনা প্রধানমন্ত্রীর সাথে যখন বৈঠকে বসেছিলেন তখনো সাংপো নদীর বাঁধ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। চীনা প্রধানমন্ত্রী তখন ড. সিংকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি এ বিষয়ে ভারতের উদ্বেগ সম্পর্কে সচেতন রয়েছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ঠিক এভাবেই টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলেন; কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পরও স্বস্তিতে নেই দিল্লি। সম্প্রতি সাংপোর নদী শাসন দেখে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে তারা এই প্রকল্প শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য করছে কি না। 
চীন এখন সাংপো হিসেবে পরিচিত ব্রহ্মপুত্র নদের জাংমোতে এক বিশাল বাঁধ নির্মাণ করছে। তিব্বতের এই স্থান ছাড়াও দাগো জিয়াসা জেক্সো নামক স্থানে আরো তিনটি বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। গত এক দশকের বেশি সময় আগে বাঁধ তৈরির কাজ শুরু করলেও চীন ২০১০ সালের অগে এই নির্মাণের কথা স্বীকারই করেনি। স্বীকার করার পর থেকে অবশ্য বেইজিং বলে আসছে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এসব বাঁধ দিচ্ছে; কিন্তু চীনা ডেইলির এক প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো উল্লেখ করা হয় যে, সেচের জন্য বাঁধের পানি ব্যবহারের ব্যাপারে তাদের চিন্তাভাবনা রয়েছে। সেচের পানি প্রত্যাহার ছাড়াও দিল্লির আরো উদ্বেগ হচ্ছে, যে অঞ্চলে এই বাঁধ দেয়া হচ্ছে সেই এলাকা হলো ভূমিকম্পপ্রবণ। এখানে বিপুল জলরাশি আটকে রাখা হলে বড় রকমের বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে অনিশ্চয়তা সৃষ্টির পাশাপাশি চীনের এই উদ্যোগ ব্রহ্মপুত্র বেসিনের ওপর নির্ভরশীল অরুণাচল-আসামের বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার লোকজন নদীটিতে আসলে কয়টা বাঁধ বেইজিং দিচ্ছে সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে পারছে না। জন জাগৃতি নামের এক এনজিও জানিয়েছে, চীনারা ব্রহ্মপুত্রের ওপর ২৬টি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। বাস্তবে এত বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি সঠিক না হলেও দেশটি ২০১১-২০১৫ সময়ের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে ১২ কোটি কিলোওয়াট পানি বিদ্যুৎ তৈরির লক্ষ্যমাত্রার কথা বলেছে তার সাথে এর মিল রয়েছে। প্রকাশিত খবর অনুসারে চীনারা ব্রহ্মপুত্রের বড় বাঁকের অদূরে মেডংয়ে এক বিশালাকার বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়েছে। এটি এখনো প্রকাশ করা না হলেও তিব্বতের বোমে-মেডং সড়ককে ভারী যানবাহন চলাচল উপযোগী বৃহদাকার করার জরুরি প্রকল্প থেকে বুঝা যায় এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে তারা। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হলে এটি হবে ইয়াংজি নদীতে নির্মিত থ্রি জর্জেস ড্যামের চেয়েও বড়। এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৩৮ থেকে ৪৯ গিগাওয়াট, যা ভারতের মোট পানি বিদ্যুৎ উৎপান ক্ষমতা ৩৩ গিগাবাইটের চেয়ে অনেক বেশি।
বেইজিং সম্প্রতি সাংপোতে নির্মাণাধীন ও নির্মিতব্য চারটি বাঁধকে রান অব দ্য রিভার টাইপ ঘোষণা করে। প্রকৃতপক্ষেই যদি বাঁধগুলো এ ধরনের হয়ে থাকে তাহলেও ভাটি অঞ্চলে এর বেশ কিছু বিরূপ প্রভাব পড়বে। এর মধ্যে রয়েছে নদীর বাধাহীন প্রবাহে যে বিপুল পলি ভাটি অঞ্চলের ভূমিতে উর্বরতা সৃষ্টি করত তা আর হবে না। অবকাঠামো নির্মাণ হয়ে গেলে সহজেই সেচের জন্য পানি প্রত্যাহারের কাঠামোও তৈরি করা সম্ভব হবে। জন জাগৃতির হিসাব অনুসারে এই বাঁধগুলো নির্মাণের জন্য নদীশাসনের পর বর্ষায় ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ ৬৪ শতাংশ কমবে আর শুকনা মওসুমে কমবে ৮৫ শতাংশ। এ ছাড়া উত্তর-পূর্ব চীনে বন্যা দেখা দিলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আকস্মিকভাবে পানি ছাড়ার ফলে প্লাবনের সৃষ্টি হবে ভারত বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলে। এ ছাড়া ভারতের শঙ্কা হলো চীন সাংপো নদীতে এভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে ফেললে এই নদীতে ভারত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। এক হিসাব অনুযায়ী ভারতে ৮৪ হাজার ৪৪ মেগাওয়াট পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে ৩১ হাজার ৮৫৭ মেগাওয়াট উৎপন্ন হবে দেশটির উত্তর পূর্বাঞ্চলে। এর মধ্যে মাত্র ৮০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। 
চীনের কাছে ভারতের মূল যুক্তি হলো আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অভিন্ন নদীতে বাঁধের মতো কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে অথবা পানিপ্রবাহ প্রত্যাহারের মতো কিছু ঘটলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতা হতে হবে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান হলো ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় পানিবণ্টন চুক্তি। চীনকে এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবেশীর আহ্বানে সাড়া দিতে দেখা যায়নি। অন্য দিকে বাংলাদেশে অভিন্ন নদীতে বহু বাঁধ দেয়ার আগে ভারত দ্বিপক্ষীয় পানিবণ্টন চুক্তি করেনি। 
দেখার মতো বিষয় হলো অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহারের ব্যাপারে ভারতের সামনে বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে যে যুক্তি দিয়ে আসছিল সেই যুক্তিই এখন দিল্লি দিচ্ছে বেইজিংয়ের সামনে। টিপাইমুখ বাঁধের প্রকল্পের ব্যাপারে যে যুক্তি বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন সেটি ভারত এখন চীনের কাছে তুলে ধরছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ অথবা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এ যুক্তিই তুলে ধরেছেন।
ভারতের নীতি নির্ধারকদের জন্য এটিও একটি ভাবনার বিষয়। ভারতীয় অংশে আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি ভিন্ন দিকে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা হলে চীনের পানি প্রত্যাহার না করার জন্য কী যুক্তি দেবে ভারত? এ জন্য নয়া দিল্লি কৌশলে বাংলাদেশের সম্মতি নিতে চায়। এর অংশ হিসেবে টিপাইমুখসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীতে বাঁধ দিয়ে উৎপন্ন বিদ্যুৎ থেকে বাংলাদেশকে একটি অংশ বিক্রির ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ করতে চায় ভারত। না বুঝে হোক অথবা সচেতনভাবে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতেই হোক বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সে ফাঁদে পা দিয়েছে। বাংলাদেশের উজানের নদীতে ভারতকে বাঁধ দেয়ার বিপরীতে বাংলাদেশ এখন শুধু সে প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে বিক্রি করার নিশ্চয়তা চেয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে। এর মাধ্যমে ভারতকে অভিন্ন নদীতে ইচ্ছামতো পানি প্রত্যাহারের ছাড়পত্রই প্রকারান্তরে দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের বিদ্যুৎ করিডোর দেয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে। এই করিডোরের মাধ্যমে উত্তর পূর্ব ভারতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। এতে বাংলাদেশের জন্য সর্বগ্রাসী যে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প তা নিয়ে জোর গলায় ভারতকে কিছু বলার সুযোগ হারাবে ঢাকা। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার কথা আর জোর গলায় বলতে পারবে না ঢাকা।
বহুল আলোচিত-সমালোচিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। গত জানুয়ারিতে মতাসীন ইউপিএ সরকারের শেষ সময়ের এক মন্ত্রিসভা বৈঠকে এটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। আর মধ্য প্রদেশের বিজেপি সরকার এর অংশ হিসেবে রাজ্যটিতে কেন ও বেতওয়া নদীর মধ্যে সংযোগ খাল খননের কাজ শুরু করে দিয়েছে। গঙ্গা অববাহিকার পানি দিয়ে এখানে দু’টি বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ যখন তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি নিয়ে দেনদরবার করছে, ঠিক সেই সময়ে ভারতের বিশাল অংশজুড়ে প্রধান প্রধান নদীগুলোর মধ্যে আন্তঃসংযোগ তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে ভাটির বাংলাদেশে প্রবহমান পানি প্রত্যাহার করে ভারতের শুষ্ক রাজ্যগুলোয় সেচকাজের জন্য পানি নেয়ার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের উজানে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ প্রধান প্রধান প্রায় সব নদীর মধ্যে সংযোগসাধনের এ প্রকল্পে ১৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি খরচ হবে। সুরমা ও কুশিয়ারার সাথে এই সংযোগ তৈরির পরিকল্পনা নেই। টিপাইমুখ বাঁধের মাধ্যমে সুরমা, কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহারে রয়েছে ভিন্ন এক প্রকল্প।
এই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হবে ভারতের বৃহত্তম অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প, যার মাধ্যমে দেশটির প্রধান প্রধান সব নদীর মধ্যে সংযোগ তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে দেশটির পানি ঘাটতির রাজ্যগুলোয় পানি পৌঁছানো এবং পানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অসংখ্য বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের উত্তরের হিমালয়ের নদী এবং দেিণর উপদ্বীপ এলাকার নদীগুলোর মধ্যে সংযোগ তৈরি করা হবে। পরিকল্পনা অনুসারে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের ভারত অংশে এবং নেপাল ও ভুটানে অনেক বাঁধ (ড্যাম) নির্মাণ হবে। পানি প্রত্যাহার ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ড্যাম বা ব্যারাজ নির্মাণ করা হবে। কোনো কোনো স্থানে ফারাক্কার মতো ড্যাম বা ব্যারাজ দু’টিই করা হবে। বাংলাদেশের উজানে ব্রহ্মপুত্রের পানি সংযোগ খাল দিয়ে ফারাক্কার উজানে গঙ্গা ও মহানন্দার সাথে এর সংযোগ তৈরি করে পানি নিয়ে যাওয়া হবে দেিণ। এ অংশে দুই লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেচ এবং ৩০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এর মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে নাব্য করতে ফারাক্কার উজানে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে।
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি হলো বাংলাদেশের জন্য বাঁচা-মরার একটি ইস্যু। ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নদী হলো ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা। এই যমুনা ও গঙ্গা নদীর মাধ্যমে ৫০ শতাংশের মতো পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অন্য প্রধান নদী গঙ্গায় ফারাক্কা এবং এর উজানে আরো অনেক বাঁধ দেয়ার মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার শুরুর পর বাংলাদেশ বর্তমানে পানির জন্য প্রধানত ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। এর মধ্যে আরেকটি প্রধান নদী তিস্তার উজানে গজলডোবাসহ আরো বেশ কয়েক স্থানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। 
ব্রহ্মপুত্রের পানি চীন বা ভারত যে-ই প্রত্যাহার করুক না কেন এর জন্য বাংলাদেশের এই অববাহিকার ওপর নির্ভরশীল বিপুলসংখ্যক মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে। এই নদীর পানি প্রত্যাহার নিয়ে বাংলাদেশের মতো ভারতেরও যেহেতু উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে সেহেতু এই নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করা যায়। এই বৈঠকে ভাটির দেশের পানির যে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে সেটি বাংলাদেশ অন্য অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রেও দাবি করতে পারবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠছে। এটি যে এ দেশের মানুষের জীবন মরণের একটি ইস্যু সেটি ভুলিয়ে দেয়ার সন্তর্পণ চেষ্টা চলছে অন্য অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বড় ইস্যু বানিয়ে। এটি কোনোভাবেই বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ইতিবাচক হবে না। 
mrkmmb@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন