শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৪

করিডোর ও বিদ্যুৎ আমদানি শত শত ড্যাম নির্মাণের বৈধতা পাচ্ছে ভারত

মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের আশ্বাসে করিডোর দেয়ার মাধ্যমে ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে শত শত ড্যাম নির্মাণের আন্তর্জাতিক বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে বিশাল জলরাশি আটকে প্রায় আড়াই শ’ ড্যাম, ব্যারাজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারবে। এসব ড্যাম-ব্যারাজ নির্মাণ করে দেশটি বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি আটকানো পানি কৃষি ও সেচকাজে লাগাবে। বাংলাদেশ ভারতকে বিদ্যুতের করিডোর দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে এসব ড্যাম-ব্যারাজ নির্মাণে ভারত কার্যত আন্তর্জাতিকভাবে বাধামুক্ত হয়েছে। শুধু করিডোর-বিষয়ক একটি সম্মতিপত্র দেখিয়ে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতাও নিতে পারবে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট স্টিয়ারিং কমিটির সপ্তম বৈঠক শেষে এই নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়টি সাংবাদিকদের অবহিত করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ড্যাম নির্মাণের কারণে ভাটিতে বাংলাদেশের ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। বহু নদী পানিশূন্য হয়ে পড়বে। 
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এবং ভারতের পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব ইন্ডিয়ার (পিজিসিআই) প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি বিদ্যুৎ করিডোর বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করবে। তারা আগামী ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। বিদ্যুৎসচিব ড. মনোয়ার ইসলাম জানিয়েছেন, এ জন্য যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টিয়ারিং কমিটির (জেএসসি) সপ্তম বৈঠকে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল থেকে এই করিডোরের আওতায় বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ আসামে যাবে। তবে এতে জানানো হয়, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে বাংলাদেশ এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিভাবে পাবে সেটি আলোচিত হবে পরে। বিদ্যুৎসচিব জানান, জেএসসি বৈঠকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতকে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালনের করিডোর দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সম্ভাব্য দু’টি করিডোর ঠিক হয়েছে। 
জাতিসঙ্ঘের সাবেক পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ এস আই খান বলেন, ভারত খুব সহজে এ ধরনের একটি সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে তারই স্বার্থে। কিন্তু আমরা কি পেলাম, তা খতিয়ে দেখছি না। বাংলাদেশকে বিদ্যুতের শেয়ার দেয়া হচ্ছে, তাই দেশটি (বাংলাদেশ) আমাদের সাথে আছে এমন কথা ভারত এখন জোর গলায় বিশ্বকে বলতে পারে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ ছাড়পত্রও নিয়ে নিতে পারে।  আর এটি দেখিয়ে ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে ড্যাম-ব্যারাজ বানানোর কাজটি সহজেই করতে পারবে। এভাবে অল্প কিছু বিদ্যুৎ দেয়ার কথা বলেত ভারত এক সময় টিপাইমুখ বাঁধটিও নির্মাণ করে ফেলতে পারে। 
জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম ইনামুল হক বলেন, এতে ভারত উজানে ড্যাম-ব্যারাজ বানানোর জন্য বাংলাদেশের মৌন সম্মতি লাভ করার চেষ্টা করছে। এটা তাদের পক্ষে কাজে লাগিয়ে নদীর উজানে বাঁধ ব্যারাজ নির্মাণে ভাটির দেশের (বাংলাদেশের) সম্মতি আছে বলে প্রচারণা চালাতে সহজ হবে, তবে তা নৈতিক হবে না। আন্তর্জাতিকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হবে ভাটির দেশের মৌন সম্মতি আছে। 
করিডোর নেয়ার নেপথ্য কথা : জানা গেছে, কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কি কি ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে এই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, তা ভারত এখন না বললেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হিমালয়ের নদীগুলো বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্রের উজানে শত শত বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এটি সম্ভব হবে। ভারত দীর্ঘ দিন ধরে ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করে আসছিল। এ জন্য বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ব্রহ্মপুত্র বেসিনে ২২৬টি বিশালাকারের বহুমুখী ড্যাম নির্মাণের সাইটও নির্ধারণ করে ফেলে কয়েক বছর আগে। 
নির্মিতব্য এসব ড্যাম থেকে ভারত আগামী ৫০ বছরে ৯৯ হাজার ২৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বলে সমীক্ষা রিপোর্ট সম্পন্ন হয়। ইতোমধ্যে এ বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। বেশ কয়েকটি ড্যাম নির্মাণও শুরু করেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত ইতোমধ্যে ব্রহ্মপুত্র বোর্ড নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নদী ও পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে পড়ে। কারণ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থা এসব বাঁধ নির্মাণে বিপুল অর্থায়নের আশ্বাস দিয়ে আসছিল। কিন্তু ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে বিশেষ করে অন্যতম উৎস খোদ অরুণাচলেই এসব বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়ে। বাঁধের বিরোধিতার কারণে অরুণাচলের বহু মানুষ এখন গৃহহারা। নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হচ্ছে এসব বাঁধবিরোধীদের ওপর।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা: মো: আব্দুল মতিন  বলেন, করিডোর দিতে হলে অবশ্যই নদীর ভবিষ্যতের কথা ভালোভাবে বিচার বিশ্লেষণ করেই দিতে হবে, নদীর প্রবাহ ঠিক থাকবে কি না তা বিবেচ্য বিষয়। পুরো বিষয়টি জানতে হবে কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে তার মাধ্যমে। কারণ নদী মরে গেলে বিদ্যুৎ দিয়ে তো কোনো লাভ হবে না। তবে এসব বিবেচনার আগে বিদ্যুতের বিনিময়ে করিডোর দেয়া পক্ষান্তরে নদীর উজানে বাঁধ বা অবকাঠামোর পক্ষে একটা নৈতিক সমর্থন দেয়া হয়ে যায়, যা কাজে লাগিয়ে নদীর উজানে ড্যাম-ব্যারাজ বানানোর সুযোগ পেয়ে যেতে পারে ভারত। 
পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা, এ ধরনের নদী-পরিবেশ বিধ্বংসী প্রকল্পের কারণে ভারতের একটি বিশাল ুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ভূমি ছাড়া হবে। কয়েক লাখ একর আবাদি জমি হবে বিনষ্ট। পাশাপাশি বিশাল এক গহিন অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্য পাল্টে যাবে পুরো পাহাড়ি এলাকায়। আর এ জন্য  বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন এসব বাঁধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নানাভাবে নির্যাতিত হতে থাকে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে। নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও। বাঁধবিরোধীদের দমনে দেশটি নানা পদক্ষেপ নিয়ে আপাতত দমাতে পারলেও ভাটির দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে বিপত্তি বাধে ভারতের। কারণ এসব বাঁধ নির্মাণ নির্বিঘœ করতে পুরো অববাহিকা এলাকার দেশগুলোর সম্মতি চেয়েছে দাতাগোষ্ঠী। বাংলাদেশ যদি এসব বাঁধ নির্মাণে সম্মতি দিয়ে দেয়, তাহলে ভারত ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারবে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট স্টিয়ারিং কমিটির সপ্তম বৈঠক শেষে ওই নীতিগত সিদ্ধান্তটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপন করে প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের সেই সুযোগই পেয়ে যাচ্ছে ভারত। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সামান্য পরিমাণ বিদ্যুতের আশায় বাংলাদেশ যদি এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্মতি দিয়ে দেয় তাহলে এ দেশে বেঁচে থাকা নদীগুলো শিগগির মরে যাবে, আর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন