শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাংলাদেশের সমুদ্রসম্পদ ও মেরিটাইম সিল্ক রোড

সমুদ্রসম্পদ নিয়ে বিরোধ বিসম্বাদ বিশ্বে একটি নিত্য ঘটনা। পৃৃথিবীতে আনেক বড় বড় যুদ্ধ এই সমুদ্রসম্পদ ও সীমানাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে। আবার বিশ্বশক্তির খেলা বা প্রতিযোগিতার একটি বড় ক্ষেত্র হলো সমুদ্রে কার কর্তৃত্ব¡ প্রতিষ্ঠিত থাকবে তা নিয়ে। বিশ্ববাণিজ্য পরিবহনের একটি প্রধান উপায় হলো সমুদ্রপথ। সমুদ্রবিহীন দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরনির্ভরতার জন্য কৌশলগত পর্যায়ে প্রাথমিকভাবেই পঙ্গু হয়ে পড়ে। সেনাকুক দ্বীপপুঞ্জের জন্য এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তি জাপান ও চীনের মধ্যে উত্তাপ উত্তেজনায় যুদ্ধ বেধে যায় যায় অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল সমুদ্রসীমা বিরোধকে কেন্দ্র করে। এখনো সেই উত্তেজনার ইতি ঘটেনি। হরমুজ প্রণালীর কর্তৃত্ব নিয়ে ইরাক-ইরান দশককাল যুদ্ধ করেছে। মিসরে অনেক উত্থান পতনের কারণ ছিল সুয়েজ সংযোগ খাল। দুই প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সাথে ছিল বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের সমুদ্রসীমা বিরোধ। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা এবং এর দীর্ঘ শুনানি শেষে রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সাথে সাগর বিরোধের অবসান ঘটেছে। দু’দেশ সমুদ্রে যে সীমা দাবি করেছিল আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে তার অনেকটাই মধ্যবর্তী একটি রেখা টেনে দেয়া হয়েছে। ফলে এ রায়ের পর কোনো পক্ষের একতরফা জয় হয়নি। আবার কোনো পক্ষ সেভাবে হেরেও যায়নি। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচার প্রোপাগান্ডার ঢেউ বয়ে যায় সমুদ্র জয়ের।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে পরে দেখা যায়, বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার নিষ্পত্তিটাই আসলে হয়েছে বড় লাভ বাংলাদেশের। সমুদ্র জয়ের প্রচারণা বেশ কিছু ক্ষেত্রে না পাওয়াকে আড়াল করতেই হয়তো বা করা হয়ে থাকতে পারে। 

এর মধ্যে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিয়ে নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক আদালতে যে মামলা চলছে তার শুনানি শেষ হয়ে গেছে। যেসব যুক্তিতর্ক সেখানে উত্থাপন করা হয়েছে তার কমই বিস্তারিত প্রকাশ হয়েছে। আগামী ১৪ জুন এই মামলার রায় হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য আগে থেকেই ২০১৪ সালে আরেকটি সমুদ্র জয়ের খবর শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। এরপরও আসলেই কি সমুদ্র জয়ের মতো কোনো বিষয় আছে নাকি অন্য কিছু অপেক্ষা করছে তা নিয়ে উদ্বেগের অন্ত নেই। 

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় এই অঞ্চলে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকেছিলেন স্যার রেডকিপ। তিনি সব কিছু নিষ্পত্তি না করে অনেক স্থানে রেখে দিয়েছিলেন অস্পষ্টতা, যার জন্য ছয় দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ও ভারতের স্থল সীমানাটিই পুরোপুরি নিষ্পত্তি করা যায়নি। বরং নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে অপদখলীয় জমি নিয়ে। স্যার রেডকিপ বাংলাদেশ ভারত সমুদ্রসীমার ব্যাপারেও একটি সীমান্ত রেখা টেনে দিয়েছিলেন। আজ সেই সীমান্ত রেখাটিই বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের অন্যতম প্রধান নির্ণায়কে পরিণত হয়েছে। রেডকিপের সমুদ্র সীমান্ত রেখার যে দলিল বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে উপস্থাপন করেছে সেটির সাথে ভারতের উপস্থাপিত দলিলের মিল নেই। আদালত বাংলাদেশের দলিল গ্রহণ করলে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা পাবে বাংলাদেশ আর একই সাথে হাজার হাজার মাইল সমুদ্রের মালিকানাও চলে আসবে বাংলাদেশের ভাগে। আর যদি ভারতের দলিল আদালত গ্রহণ করে তাহলে দক্ষিণ তালপট্টির মালিকানা হারাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সুন্দরবনে আড়াআড়িভাবে নেমে এসেছে সীমান্ত রেখা। লন্ডন মিউজিয়ামে রেডকিপের আঁকা যে মূল ম্যাপটি, তাতে এই স্থলসীমান্তের সাথে মিল রেখে আড়াআড়িভাবে সমুদ্র সীমাটিও আঁকা হয়েছে। এটিকে সমুদ্রসীমা হিসেবে উপস্থাপন করা হলে দক্ষিণ তালপট্টির পশ্চিম পাশ দিয়ে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত রেখা চলে যায়। কিন্তু ভারত যে রেডকিপের সীমান্ত ম্যাপটি আদালতে উপস্থাপন করেছে সেটি আড়াআড়িভাবে না নেমে কিছুটা পূর্ব দিকে বাঁকা করে নামিয়ে আনা হয়েছে, যাতে সীমান্ত রেখাটি চলে যায় দক্ষিণ তালপট্টির পূর্ব পাশ দিয়ে আর এতে দ্বীপটির মালিকানা চলে যায় ভারতের ভাগে। ভারত রেডকিপের এই মানচিত্রটি কোথায় পেয়েছে তা এক রহস্যজনক ব্যাপার। 

রেডকিপের যে সীমান্ত ম্যাপ লন্ডন মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে সেটি প্রকৃত দলিল হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ শুরু থেকে এ দলিল সংগ্রহের প্রতি মনোযোগী না হয়ে ভারত যে ধরনের ম্যাপ আদালতে উপস্থাপন করেছে তাকে সামনে রেখে যুক্তিতর্ক সাজিয়েছিল। লন্ডন মিউজিয়ামের ম্যাপটি উপস্থাপন করে অনেক পরে। ফলে বাংলাদেশ পক্ষের যুক্তি যতটা জোরালো হওয়ার সুযোগ ছিল, ততটা হয়নি। 

এ মামলার শুনানিতে ভারতের এজেন্ট হিসেবে যেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও এসংক্রান্ত আইন উপদেষ্টা নীরা রাধাকে নিয়োগ করা হয়েছে সেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এজেন্ট করা হয়েছে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: দীপু মনিকে। দু’জনই শুনানির সময় তাদের বক্তব্য রেখেছেন। দু’দেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। মামলাটি তথ্য উপাত্ত দলিল দিয়ে কতটুকু দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করা হয়েছে তার ওপর নির্ভর করবে এর সাফল্য। আর এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা কী ছিল সেটি জানা সহজ বিষয় নয়। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণে ভারতের যে প্রভাব গত পাঁচ বছর দেখা গেছে সেটি এর ওপর সক্রিয় ছিল কি না তাও স্পষ্ট নয়। তবে ভারত দ্বিপক্ষীয়ভাবে এ বিষয়টি নিষ্পত্তি না করার কারণে নয়াদিল্লির ইচ্ছার বাইরে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে এই মামলা করেছে বলে মনে করা হয়। সেটি করা না হলে এ ব্যাপারে কোনো সালিসি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের সামনে আর ছিল না।

বাংলাদেশের এই সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির সাথে সমুদ্রাঞ্চলে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়টিও সম্পৃক্ত। এই তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশ যে ২৩টি ব্লকে সমুদ্রাঞ্চলকে ভাগ করে সে ব্যাপারে মিয়ানমার ও ভারত দুই দেশই আপত্তি তুললে শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে দরপত্র চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারের সাথে বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার পর বেশ ক’টি ব্লক পূর্ণ বা আংশিকভাবে অনুসন্ধানের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে নতুন করে বিন্যাস করতে হয়। ভারতের সাথে সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর নির্ভর করবে আসলে বাংলাদেশ কতটা সমুদ্রাঞ্চলে তার তেল গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে পারবে। তবে আদালতের রায় প্রাপ্তির আগে ভারতের তেল গ্যাস কোম্পানি ওএনসিজিকে দু’টি ব্লক ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে উৎপাদন বণ্টন চুক্তিও স্বাক্ষর করা হয়েছে। এই দু’টি অনুসন্ধান ব্লকই ভারতের সাথে সমুদ্রসীমান্ত সংলগ্ন। ভারতীয় কোম্পানিকে দু’টি গ্যাসব্লক তাড়াহুড়া করে কেন ইজারা দেয়া হলো এ ব্যাপারে অবশ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। এর আগে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার তেল গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যাপারে যে প্রথম দফা দরপত্র আহ্বান করা হয় তাতে ভারতের কোম্পানি কোনো আগ্রহ ব্যক্ত করেছে এমন কিছু জানা যায় না। প্রতিবেশী এ দেশটির গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশী কোম্পানিকে ব্লক ইজারা দিতে দেখা যায়। তবু কেন বাংলাদেশের গ্যাস ব্লক নিয়ে ভারতীয় কোম্পানির আগ্রহ সেটি স্পষ্ট করে জানানো হয়নি। তবে এর সাথে কৌশলগত স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

সমুদ্রসীমার তেল গ্যাস অনুসন্ধানের বাইরে কৌশলগত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। জাপানের একটি কোম্পানি এই বন্দরের ব্যাপারে সমীক্ষা চালানোর পর কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় এটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহ ব্যক্ত করে চীন। চীনের সাথে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনাও অগ্রসর হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সে আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ে। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে বর্তমান সরকার গঠিত হওয়ার পর বিষয়টি আবার আলোচনায় চলে আসে। বলা হয় চীনকে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ এবং গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ দেয়া হতে পারে। একতরফা নির্বাচনের ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো মেনে না নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে চীনের সমর্থন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরে সরকার এ ব্যাপারে কতটুকু অগ্রসর হবে তা নিয়ে অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয়। সরকারের সর্বোচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারণী ফোরামে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে করার কথা বলা হয়। অন্য দিকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে ভারত-চীন যৌথ অংশীদারিত্বের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। এর সমর্থনে বেশ কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।

চীন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র অঞ্চল ঘিরে নতুন একটি মেরিটাইম (সামুদ্রিক) সিল্ক রোড তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে চাইছে। ইতোমধ্যে তারা পাকিস্তানে গোয়াদর ও শ্রীলঙ্কায় হামবানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। চীন মিয়ানমারের সিটওয়েতে আরো একটি বন্দর তৈরি করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে রয়েছে তাদের গভীর আগ্রহ। তবে ভারত কোনোভাবেই চাইছে না এই বন্দর চীন এককভাবে করুক। এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এই অঞ্চলে চীনকে অধিক সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে ওয়াশিংটনেরও। মিয়ানমারের সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো ব্যাপক বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিরোধী নেত্রী অং সান সু কি ক্ষমতায় আসবেন বলে আবহ তৈরি হয়েছে। ফলে এই অঞ্চলে পশ্চিমের স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা অনেকখানি বেড়ে গেছে। সেই সাথে অনেকখানি বেড়েগেছে বাংলাদেশের গুরুত্ব। বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে আমেরিকান স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোম্পানি সান্তোস কনোকো ফিলিফস অফশোরে তেল গ্যাসব্লক অনুসন্ধান কাজ পাওয়ার ব্যাপারে অনেক আগে থেকেই আগ্রহী। কিন্তু তাদের অনুসন্ধান ব্লক দেয়ার ব্যাপারে একধরনের পিছুটান দেখা গেছে বারবার। অথচ ভারতীয় কোম্পানিকে দু’টি ব্লক ইজারা দেয়া হয়েছে দ্রুতগতিতে। চীনা প্রতিষ্ঠানকেও গ্যাস অনুসন্ধান ব্লক দেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। 

ভারত, বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমার নিয়ে নতুন উপ-আঞ্চলিক জোটকে বিআইসিএমকেও এগিয়ে নিতে চাইছে ভারত চীন দু’টি দেশই। এই উদ্যোগের মাধ্যমে এ দু’টি দেশ নানা বিরোধের মধ্যেও বঙ্গোপসাগর এলাকার ব্যাপারে এক ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে।

গত ১৪ ফেব্রুয়রি বেইজিং থেকে করা পিটিআইয়ের এক খবরে বলা হয়েছে, ভারত চীনের মেরিটাইম সিল্ক রোডে যোগ দিতে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেইজিংয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেনন ও চীনা স্টেট কাউন্সিলারের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এই কথা বলা হয়। ভারতীয় সাংবাদিক সি রাজা মোহন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় বিষয়টির ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, স্থলপথে মহা সিল্ক রোডের উন্নয়নের পাশাপাশি সামুদ্রিক সিল্ক রোড তৈরির ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী চীন। পশ্চিমে চীনের জিনজিয়াং এবং পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের সংযোগকারী ট্রান্স কারাকোরাম মহাসড়কের আধুনিকায়নের কাজ হাতে নিয়েছে বেইজিং। এখন জিনজিয়াংয়ের সাথে আরব সাগরের সংযোগ সৃষ্টিকারী কাশগড় করিডোরে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে। দক্ষিণে শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা ও পাকিস্তানের গোয়াধর বন্দরের সাথে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের এই এলাকার বন্দরগুলোর সংযোগসাধন করে নতুন সামুদ্রিক সিল্ক রোডের উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন। 

চীনা প্রেসিডেন্ট জি শিংপিংয়ের পূর্বসূরি হু জিনতাওয়ের ২১ শতকের মহাকৌশলের একটি অংশ হিসেবে মেরিটাইম সিল্ক রোডের পরিকল্পনার কথা প্রথম আসে। সমুদ্রসীমা নিয়ে এ অঞ্চলে সৃষ্ট উত্তেজনার কারণে এটি নিয়ে তৎপরতা খ্বু বেশি দূর এগোয়নি। চীনা নেতারা মনে করেন ভারত মহাসাগরে সমুদ্রবন্দরের এই কৌশলগত বাণিজ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ভারতের অংশীদারিত্ব ছাড়া সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম গভীর সমুদ্রবন্দরে চীন-ভারত যৌথ যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে তার সাথে এর একটি সম্পর্ক থাকতে পারে। এ নিয়ে কোনো সমঝোতা হলে বাংলাদেশে এশিয়ার দুই পরাশক্তির নানা কাজে সমন্বয়ের একটি দৃশ্যপট দেখা যেতে পারে। এতে পদ্মা সেতুতে চীনা অর্থায়নও হতে পারে। সেই সাথে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর যে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান অগ্রসরমান ছিল অথবা আমেরিকান মেরিনের এখানে অবস্থানস্থলের ব্যাপারে যে আলোচনা অন্তরালে হয়ে আসছিল তা খুব বেশি দূর এগোবে না। কিন্তু এখানে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে ভারতের আগামী নির্বাচনে কারা ক্ষমতায় আসছে সেটি নিয়ে। মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য সে নির্বাচনে কংগ্রেসের আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় সব পর্যবেক্ষকই নেই বলে উল্লেখ করছে। বেইজিং আলোচনায় এ বিষয়ে কথা হয়ে থাকতে পারে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও দুই দেশের এই আলোচনার মধ্যে যে বাংলাদেশ এবং বঙ্গোপসাগরের বিষয়টি থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। এ আলোচনার পথ ধরে কোনো সমঝোতা হলে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বা যৌথ নৌমহড়ায়ও এর প্রভাব দেখা যেতে পারে। এর পাল্টা কৌশল যুক্তরাষ্ট্র কী নেবে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে বিজেপি বা তৃণমূলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের বোঝাপড়ার কথা বলা হচ্ছে। এসব কারণে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বলা যাচ্ছে না। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতের নির্বাচন এবং বঙ্গোপসাগর এলাকার পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশ মিয়ানমারে পশ্চিমা কর্তৃত্ব কতটুকু থাকবে তার অনেক কিছুই নির্ভর করবে। চীনের মেরিটাইম সিল্ক রোডে ভারতের অংশগ্রহণ এবং উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার যেসব উদ্যোগকে এগিয়ে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে তার সাফল্যের সাথে এ অঞ্চলে পশ্চিমা স্বার্থের অনেকখানি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বাংলাদেশের একতরফা নির্বাচনোত্তর সরকার কত দিন ক্ষমতায় থাকবে তার অনেক কিছুও এসব মেরুকরণ আর ভারতের মে মাসের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করতে পারে। তবে এ অঞ্চলটি যে ক্রমেই এক ধরনের প্রক্সি সঙ্ঘাতের ক্ষেত্রে পরিণত হতে যাচ্ছে তারই আভাস পাওয়া যাচ্ছে এখন। বুঝে হোক না বুঝে হোক আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অনেক ক্ষেত্রে এই খেলার ঘুঁটি হিসেবে যেন নিজেদের ব্যবহার হতে দিচ্ছে। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কত দূর গিয়ে ঠেকে তা দেখার জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন