বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বর্ণচোরা বন্ধু ভারত সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার মূল রূপকার


যে কোনো খুন-খারাবির মতো লোমহর্ষক ঘটনায় জড়িত আধিপত্যাবাদী মূল হোতার পরিচিত প্রায়ই গোপন থেকে যায়। এটা কেবল যুগ যুগ ধরেই নয়, বরং শতাব্দীর পর শতাব্দীর পরেও জানা যায় না। বহু ঐতিহাসিক গুপ্ত, এমনকি প্রকাশ্য হত্যা সামরিক অভ্যুত্থান, অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রভৃতির মূল উদ্যোক্তা বা চক্রান্তকারী সাধারণত অজানা বা অচিহ্নিত রয়ে গেছে। কেননা এসব ঘটনা এমন দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে ঘটানো হয়েছে যে, তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণের কোনো সূত্রই পাওয়া যায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মাধ্যমে এসব ঘটানো হয়। ফলে মূল হোতাকেই শনাক্ত করা দুরূহ হয়ে পড়ে। ঘটনার জন্য এমন সব হেতু ব্যবহার করা হয় যে, ঘটনার মূল উদ্দেশ্য ও নায়ক আড়ালে চলে যায়। মানুষ কেবল তাত্ক্ষণিক কারণ ও সরাসরি জড়িতদের নিয়ে টানাটানি করে। পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়করা তেমন পদ্ধতি ব্যবহার করলেও তাদের তাত্ক্ষণিক তত্পরতা, প্রকাশ্য মন্তব্য, অতীত অপকর্ম প্রভৃতি তাদের সংশ্লিষ্টতাকে জনসমক্ষে উন্মোচিত করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশ এবং এর সেনাবাহিনীর প্রতিপক্ষ কে, কারা ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ববিরোধী, এই হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত সুবিধাপ্রাপ্ত (বেনিফিশিয়ারি) কে, কে এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই অতিমাত্রায় তত্পরতা দেখিয়েছে ইত্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে ওই অপশক্তিকে শনাক্তকরণ অতি সাধারণ মানুষের পক্ষেও দুরূহ নয়। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষও পিলখানার নির্মম হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাকে চিহ্নিত করতে এক মিনিট সময়ও ব্যয় করেনি। কেননা তারা জানে, ঐতিহাসিকভাবে কারা তাদের শত্রু, কারা ১৯৭২ সাল থেকে তাদের জ্বালাচ্ছে, তাদের সুখ-সমৃদ্ধিকে বার বার বাধাগ্রস্ত ও ব্যাহত করছে।

নানাবিধ চক্রান্তের মাধ্যমে আমাদের দরিদ্র করে রাখার কারণে আমাদের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে আমাদের অস্তিস্ববিরোধী অপশক্তির সেবাদাসদের উপস্থিতির ফলে, সর্বোপরি কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারিভাবে ওই অপশক্তির নাম ঘোষিত হচ্ছে না। পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ব্যাপারে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মূল অপশক্তিকে আড়াল করে পরস্পরকে দোষারোপ করছে। ক্ষমতাসীন সরকারের বক্তব্য হলো, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বিরোধী দলের অভিযোগ, প্রতিবেশী ভারত সরকারের ভেতরে অবস্থানকারী তার মিত্রদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করতে, দেশে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করতে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারতীয় সৈন্য পাঠিয়ে এদেশকে ছায়ারাষ্ট্রে পরিণত করতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। অন্যদিকে ভারত তার অপরাধ ঢাকার উদ্দেশ্যে এই ঘটনার পরপরই এর জন্য পরিকস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে দায়ী করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কতিপয় মন্ত্রী এবং ভারতীয় সাহায্যপুষ্ট সংবাদ মাধ্যম ভারতীয় অভিযোগের অনুকূলে তত্ত্ব প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে জনৈক বিদগ্ধ প্রাবন্ধিক লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার এই নারকীয় ঘটনার তদন্ত করলেও সরকারকে তাদের মূল শত্রু ভারতের চক্রান্ত খতিয়ে দেখতে হবে যে, নবনির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ভারত ট্রানজিট ও বন্দর সুবিধা, জয়েন্ট টাস্কফোর্স প্রভৃতি দাবি করছে। মূল সত্য হলো, ভারত যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের সম্পদ লুটে নিতে চায়। যেহেতু শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ভারতপন্থী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা, তাই ভারতীয় গোয়েন্দা চক্রের হোতারা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত সেনা কর্মকর্তাদের মনস্তত্ত্বে ভীতির সঞ্চার করে ভারতীয় বার্তা অনুধাবনার্থে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ওপর অপূরণীয় ক্ষতি চাপিয়ে দেয়। বিডিআর বিদে্রাহ ও কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ড ভারতের উদ্দেশ্যমূলক চক্রান্তবিশেষ, যা আড়াল করার পন্থা হিসেবে সন্দেহের তীর পাকিস্তানের ‘আইএসআই’র দিকে ছুড়ে দেয়।

সম্ভবত বহু অব্যক্ত জটিল কারণে শেখ হাসিনা সরকার বিডিআর গণহত্যার মূল চক্রের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তদন্তানুষ্ঠান থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তুু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সরকারের উচিত জাতীয় স্বার্থে কমপক্ষে সরকারি রেকর্ডে সংরক্ষণের জন্য পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চালিয়ে আমাদের সেই শত্রু চিহ্নিত করা উচিত যে এই বিপর্যয় ঘটিয়েছে, যাতে বর্তমান সরকার এবং তার উত্তরসূরিরা, সার্বিকভাবে দেশের সমুদয় জনগণ, এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ব্যর্থ করতে ওই শত্রু সম্পর্কে সজাগ থাকে। বিডিআর সদর দফতরের এই বিপর্যয় এত স্পষ্ট ও খোলামেলা যে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্য যে কোনো স্থানের পথচারীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য চক্র কে, সে অতি সহজেই বলবে—‘এটা হলো ভারত’। ভারত এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যূহকে দুর্বল করে তা ভেঙে দিতে, গৃহযুদ্ধ শুরু করতে যাতে যুদ্ধরত যে কোনো পক্ষের আমন্ত্রণে ভারত বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারে।

এটা স্বাভাবিকভাবে বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ রয়েছে যে, যে দেশটি আাামাদর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, আমাদের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি প্রত্যাশা করে না এবং আমাদের পঙ্গু ও অচল করার জন্য অবিরাম চক্রান্তে লিপ্ত, সে-ই বিডিআর সদর দফতরে এ অমানবিক কাণ্ড ঘটিয়েছে।
বিডিআর সদর দফতরে গণহত্যার মূল হোতাদের পরিচয় উন্মোচন করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বলেছিলেন, তারাই এই ঘটনার চক্রান্ত পাকিয়েছে যারা বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে এবং প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীতে নামিয়ে আনতে চায়। তারা আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে নির্মূল করতে চায়।

ভারতের সংশ্লিষ্টতা
রাজনৈতিক-সামরিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের অভিযোগ, বহুবিধ কূট-চক্রান্ত ও উদ্দেশ্যকে সামনে লেখে পিলখানায় এ হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। বিদ্রোহের নারকীয় রূপ এই সত্যকে উদ্ঘাটিত করে যে, এটা কেবল বিডিআর জওয়ানদের সমস্যা-সংশ্লিষ্ট দাবি কিংবা সেনা কর্মকর্তাবিরোধী মানসিকতা বা অনুভূতির জন্যই ঘটেনি, ওই অজুহাতগুলোকে বরং সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিডিআর সদর দফতরে যা ঘটেছে, তা স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ ছিল না। এটা ছিল আমাদের সেনাবাহিনী নিশ্চিহ্ন করার আমাদের শত্রুদের পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্তের অংশবিশেষ। কারা এ শত্রু?
পর্যবেক্ষক মহল, এমনকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে যে পিলখানায় সেনা কর্মকর্তা নিধনের মূল হোতা হলো ভারত। ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মন্তব্য ও বক্তব্য এবং সমরপ্রস্তুতি, বিশেষত ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর বাংলাদেশে তথাকথিত ভারতীয় শান্তি-মিশন পাঠানোর প্রস্তাব এবং ইসলামী জঙ্গিদের এ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমের প্রচারণা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে।

অপরাধ বিজ্ঞানে অতি প্রচলিত একটি প্রবাদ রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধী কৃত অপরাধের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার কিছু প্রমাণ রেখে যায়। বিডিআর বিদ্রোহ তথা হত্যাকাণ্ডের হোতারাও তাদের সংশ্লিষ্টতা গোপন রাখতে পারেনি। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরই ভারতের অযাচিত স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রস্তাব এ ঘটনার সঙ্গে ভারতের জড়িত থাকার সাক্ষ্য বহন করে। এসব প্রস্তাব যদি গ্রহণ কিংবা বাস্তবায়িত হয়, তা কেবল বাংলাদেশকে ভারতের গোলামে পরিণত করার প্রক্রিয়াকেই জোরদার করবে। এই প্রস্তাবগুলো হলো : (১) বিডিআরের জন্য অর্থ প্রদান, (২) বাংলাদেশে যে কোনো ধরনের সাহায্য প্রদান, (৩) পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভারতীয় সেনা প্রেরণ, (৪) বিডিআর পুনর্গঠনে সহযোগিতা প্রদান।

পিলখানা গণহত্যায় ভারতীয় সংশ্লিষ্টতার প্রতি ইঙ্গিত করে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করা জনৈক সেনা কর্মকর্তা একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাত্কারকালে এই বিপর্যয়ের সঙ্গে বিদেশি শক্তি জড়িত ছিল অভিযোগ করেছেন। তার মতে, এটা ছিল বেশ সুচিন্তিত সুসংবদ্ধ পরিকল্পনা। এটা কোনোভাবেই বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া বা বিডিআর সদস্যদের বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ নয়। পশুবত্ নির্মমতার ব্যাপকতা কিংবা মৃত সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি অপমানজনক অশোভনীয় নির্দয় আচরণ এই ইঙ্গিত দেয় যে, কোনো বিডিআর সদস্যই তাদের নিহত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই এমন কুিসত ব্যবহার করতে পারে না। এমন বর্বর নির্দয়তা কেবল বিদেশি হত্যাকারীরাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে করতে পারে। নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিলেই এই গণহত্যার সঙ্গে ভারতের সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগটি পরিষ্কার হয়।

ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন : কলকাতার প্রধান দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার (ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০০৯) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী টেলিফোনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপকালে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বিস্ময়কর প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ভারত বিডিআরের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বাংলাদেশকে প্রদান করতে প্রস্তুত রয়েছে। একই দৈনিক একই সংখ্যায় জানিয়েছে, ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে প্রণব মুখার্জী জানিয়েছেন,পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় যে কোনো সাহায্য প্রদানে ভারত প্রস্তুত রয়েছে। ‘যে কোনো ধরনের সহযোগিতা’ বলতে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর ভারতীয় ইচ্ছার প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন। এই দুটো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রস্তাবই এ অভিযোগ প্রমাণে স্বব্যাখ্যীয়, ভারত এই বিপর্যয় থেকে ফায়দা লোটার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। কারণ ভারতই এ বিপর্যয় ঘটিয়েছে, যা বাংলাদেশকে সুনামির মতো ঝাঁকুনি দিয়েছে। বাংলাদেশ এ সমস্যা সমাধানে কোনো দেশ থেকে আর্থিক কিংবা অন্য কোনো ধরনের সহযোগিতা চায়নি। তাহলে প্রণব মুখার্জী কেন ‘বিডিআর’-এর জন্য অর্থ প্রদানের আকস্মিক এবং এককভাবে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বিশ্বে এমন বহু দেশ রয়েছে যারা ভারতকে কয়েক শতবার কিনতে পারে। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাদের কেউই এমন অবাক করা প্রস্তাব প্রদান করেনি। ভারত বাস্তবে বাংলাদেশের মতোই দরিদ্র। প্রায় ৩৩ শতাংশ ভারতীয় এখনও অনেক বাংলাদেশীর তুলনায় দরিদ্রতর। এমন একটি ফকির-রাষ্ট্র কেন বিডিআরের জন্য অর্থ প্রদানে প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে? এটা কি স্বার্থবিহীন? এমন সহযোগিতা প্রদানের আগ্রহের পেছনে কি কোনো গোপন মতলব নেই?

পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ‘যে কোনো ধরনের সহযোগিতা’ দরকার তা প্রদানে তার দেশ প্রস্তুত, এ কথা বলে প্রণব মুখার্জী কিসের ই্ঙ্গিত দিয়েছেন? এ ধরনের প্রস্তুতি কি বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য প্রেরণের ইঙ্গিত বহন করে না? সৈন্য ছাড়া একটি সশস্ত্র বিদে্রাহ দমনের জন্য অন্য আর কোন ধরনের সাহায্য প্রয়োজন? পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও গণহত্যার সুযোগ ব্যবহার করে সাহায্যের নামে প্রণব মুখার্জী স্পষ্টভাবে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য মোতায়েনের গোপন কুমতলব ও চক্রান্ত প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন। প্রণব মুখার্জী প্রকাশ্যে ভারতীয় ইচ্ছে খোলাসা করতে দ্বিধাবোধ করেননি যে, শেখ হাসিনা বিব্রতকর অবস্থায় পড়লে ভারত তাকে উদ্ধার না করে অলস বসে থাকবে না। আসল কথা হলো, ভারত ১৯৭২ সালে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। চাপের মুখে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জৈল সিং কলকাতা থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত ‘সানডে’ (২৭ জুলাই ১৯৮৭) সাময়িকীর সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে দ্রুত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সুবিবেচনাপ্রসূূত ছিল না। এ ধরনের প্রত্যাহার ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “We could not protect the interest of country withdrawing troops hurriedly.” (দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহার করে আমরা দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারিনি।)
 
ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা মনে করে, বাংলাদেশকে ভারতের হাতের মুঠোয় রাখতে হলে এদেশে ভারতীয় সৈন্য স্থায়ীভাবে মোতায়েন রাখতে হবে। এই লক্ষ্যার্জনের জন্য ভারত বিভিন্ন ধরনের চক্রান্ত এঁটে যাচ্ছে। আন্তঃসীমান্ত অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে দক্ষিণ এশীয় ‘যৌথ টাস্কফোর্স’, ‘যৌথ সীমান্ত পাহারা’ প্রভৃতির আড়ালে ভারত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ভারতীয় সৈন্য মোতায়েনের চেষ্টা করছে। কলকাতার দৈনিক ‘টেলিগ্রাফ’ (২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯) এক প্রতিবেদনে ভারতের আসল মতলব আরও স্পষ্ট করেছে। নতুন দিল্লিকেন্দ্রিক ভারতীয় কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি জানিয়েছে, ভারত বাংলাদেশে ‘শান্তি মিশন’ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশ সম্মত হলে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চলাচলকারী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ট্রেন পাহারা দেয়ার জন্য ভারত তার সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ (সিআরপি), রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্স বা বিএসএফ পাঠানোর প্রস্তাব বিবেচনা করবে। বাংলাদেশে তথাকথিত শান্তি মিশন পাঠানোর কারণ ব্যাখ্য করে পত্রিকাটি লিখেছে, আগে বিডিআর মৈত্রী ট্রেনের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। এখন বিডিআর সদস্যদের ওপর সেনাবাহিনীর কোনো আস্থা নেই। আবার বিডিআরও সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করে না। পত্রিকাটি জানায়, এই কারণেই মৈত্রী ট্রেনের যাত্রী, ইঞ্জিন, মালামাল প্রভৃতি রক্ষার জন্য ভারত কমপক্ষে মৈত্রী ট্রেনের নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে ভারতীয় সৈন্য পাঠাতে চায়।

সর্বপ্রথম খবর প্রচার : রয়টার, এপি, এএফপি, বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকা, সিএনএন, আল-জাজিরা, এমনকি বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোকে পেছনে ফেলে ভারতীয় ব্যক্তি মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল সিএনএন-আইবিএন বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ১৩ মিনিটে (২৫ ফেব্রুয়ারি) সর্বপ্রথম বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমদের নিহত হওয়ার খবর প্রচার করে। বাংলাদেশী কোনো টিভি বা রেডিও চ্যানেল তাদের ঘরের ভেতরে ঘটা এমন লোমহর্ষক নারকীয় ঘটনার খবর পায়নি। এমনকি পরবর্তী দিন অর্থাত্ ২৬ ফেব্রুয়ারি (২০০৯) বাংলাদেশের কোনো দৈনিক এমন খবর প্রকাশ করেনি। অর্থাত্ তারা এমন খবর পায়নি। তাহলে এই স্বাভাবিক কিন্তু জটিল প্রশ্ন জাগে, কার মাধ্যমে ভারতীয় টিভি চ্যানেলটি এমন স্পর্শকাতর অথচ যথার্থ খবরটি তাত্ক্ষণিক সংগ্রহে ও প্রচারে সক্ষম হয়েছিল। এর সহজ উত্তর হলো, জেনারেল শাকিল ও তার সহকর্মীদের হত্যার সময় বিডিআর সদর দফতরে ভারতীয় কিলার কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত ছিল, যারা বিডিআর মহাপরিচালকের নিহত হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় সংশ্লিষ্টতা গোপন করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় টিভি চ্যানেল সিএনএন-আইবিএন, এনটিভি এবং টেলিগ্রাফ, হিন্দুস্তান টাইমস, আনন্দবাজার পত্রিকা প্রভৃতি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রধান দুটি বিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত চক্রকে দায়ী করে। কীভাবে ভারতীয় টিভি চ্যানেল বা পত্রিকার সাংবাদিকরা ভারতে বসে তাত্ক্ষণিক জানতে পারে যে, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জড়িত ছিল? ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের এমন আচরণ থেকে বোঝা যায়, তারা কী বলবে তা আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল।

একমাত্র সুবিধাভোগী : সাধারণত মনে করা হয়, কোনো দেশে সংঘটিত কোনো দুর্ঘটনা-দুষ্কর্ম থেকে যে দেশটি সুবিধা কুড়ায়, সে দেশটিই ওই ঘটনার মূল অনুঘটক। পিলখানা হত্যাকাণ্ডসহ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যে কোনো দুর্যোগের তাত্ক্ষণিক ও একমাত্র সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ হলো ভারত। বাস্তব পরিস্থিতি এবং অন্যান্য তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে তথ্যাভিজ্ঞমহল দাবি করেন যে, পিলখানা বিপর্যয় ভারতই ঘটিয়েছে। তাদের মতে, ভারতীয় নীতিনির্ধারক ও সংবাদ মাধ্যমের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, তাদের উদ্দেশ্যেমূলক অবাঞ্ছিত ও কুিসত প্রস্তাব এই গণহত্যার সঙ্গে ভারতের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করছে। ঢাকার অভিজাত ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য বাংলাদেশ অবজারভার’ তার সম্পাদকীয় মন্তব্যে লিখেছে :
“Now here is a conspiracyif ever there was one, the mutiny was staged by the Indian intelligence agencies in order to create an abnormal situation for sending Indian troops. But this theory is based on facts that in November 1971 the Bangladesh government in exile had to sign a precondition that said Bangladesh would not raise any regular professional Armed forces. On his return, Sheikh Mujibur Rahman defied the precondition and went ahead and raised the Armed forces. So was the BDR mutiny a part of this longstanding Scheme.”
[এখন এখানে একটিই চক্রান্ত, যদি তেমনটি কখনও থেকে থাকে, তা হলো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (বাংলাদেশে) ভারতীয় সৈন্য প্রেরণের উদ্দেশ্যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বিডিআর বিদ্রোহ ঘটিয়েছে। এই তত্ত্ব এই বাস্তব সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, ১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকারকে এমন পূর্বশর্ত (যুক্ত চুক্তি) স্বাক্ষর করতে হয়, যাতে বলা হয়, বাংলাদেশ কোনো পেশাদার নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলবে না। (পাকিস্তান থেকে) ফিরে এসে শেখ মুজিবুর রহমান ওই পূর্বশর্ত অগ্রাহ্য করে সশস্ত্র বাহিনী গঠনে এগিয়ে যান। সুতরাং বিডিআর বিদ্রোহ ওই দীর্ঘ সময় ধরে লালিত চক্রান্তের অংশবিশেষ]। দৈনিক অবজারভার তার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বাংলাদেশের সর্বশ্রেণী-পেশার মানুষের অনুভূতি, আবেগ ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এবং সুন্দরবন থেকে সিলেট পর্যন্ত যে কোনো বাংলাদেশীকে যদি এমন প্রশ্ন করা হয় যে, কারা বাংলাদেশের ওপর এমন বজ্রাঘাতসম আঘাত হেনেছে। উত্তরে অভিন্ন ধ্বনিই বেরিয়ে আসবে— ভারত এবং তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং তাদের স্থানীয় সেবাদাসরা এই মর্মান্তিক ঘটনার নেপথ্য নায়ক।

‘দৈনিক অবজারভার’ যার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত মিত্র, প্রশ্ন রেখেছে, বিডিআর বিদ্রোহ কি বিডিআর এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নেতৃত্বশূন্য করার অংশবিশেষ, যাকে ভারত তার জন্য মাথাব্যথা ও বিপদ বলে বিবেচনা করে। 
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে বিবেচনা করার পেছনে ভারতের পক্ষে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ‘অবজারভার’-এর মতে, পাকিস্তান আমলে ভারত পূর্ব পাকিস্তান সংলগ্ন সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্য বার্ষিক ৩৫ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করত। এটা ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হলে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় বন্ধ হবে। এই উদ্দেশ্যেই ভারত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো পেশাদার নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা হবে না, এমন প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে। এই প্রচেষ্টার বহুবিধ উদ্দেশ্য ছিল : এর পূর্ব সীমান্তে ভীতির অবসান ঘটানো, বাংলাদেশকে ভারতীয় থাবার নিচে রাখা, যখনই ভারত চাইবে সে সময় বাংলাদেশ দখল করা। ঢাকা থেকেই প্রকাশিত সাময়িকী ‘সাপ্তাহিক’ (৫, মার্চ ২০০৯) বাহ্যত-অজ্ঞাত এই হোতার প্রতি ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুর্বলতা আরও ব্যাপকতর করে কে উপকৃত হবে? সেনাবাহিনীকে অপেশাদারি বিপজ্জনক কাজের দিকে ঠেলে কে সুবিধা লুটে নিতে চায়? সেনা কর্মকর্তা ও বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে শত্রুতা ও দ্বন্দ্বের সুবিধা কে পাবে? পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্ত-সৃষ্ট লোমহর্ষক গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমর্যদা ক্ষুণ্ন করে কারা সুবিধাপ্রাপ্ত হবে? জনগণ, রাজনীতিবিদ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে এবং দেশকে অরক্ষিত ও পাহারাহীন রেখে কাদের স্বার্থসিদ্ধি হবে? আমাদের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। সশস্ত্র বাহিনীকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করে কার স্বার্থ অর্জিত হচ্ছে? 

পিলখানা গণহত্যার প্রকৃত সুবিধাভোগী হলো ভারত। দেখা যাক এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ভারত কীভাবে লাভবান হচ্ছে? পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ভারতের কমপক্ষে দুটো সমান্তরাল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়েছে : সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন ও অবমূল্যায়নের পরিবেশ এবং তাদের ওপর মানসিক মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা। তাছাড়া এই হত্যাকাণ্ড আমাদের সামগ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিশেষত ভারতের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্তে নজরদারিতে ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সাবেক বিডিআর মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আনোয়ার হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের প্রায় সবটাই ভারতের সঙ্গে। এই সীমান্ত অরক্ষিত ও নজরদারিহীন থাকলে কে উপকৃত হবে?

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর ভারতীয় দুষ্কৃতকারীদের বাংলাদেশী গরু, ছাগল, মহিষ, শস্য ইত্যাদি লুটের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা এর আগে ভারতীয় দুষ্কৃতকারীদের অপকর্মের প্রতিবাদ করেছিল তাদের হত্যা করা হয়। যেসব বাংলাদেশী একদা বিডিআর জওয়ানদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিএসএফের হামলা এবং চোরাচালানিদের প্রতিহত করেছে, এখন আত্মরক্ষায় শঙ্কিত হয়ে তারা একেবারে নীরব হয়ে গেছে। নির্যাতন ও হয়রানির ভয়ে এখন সীমান্তবাসী বাংলাদেশীরা ভারতীয় সন্ত্রাসী বা বিএসএফের গুলিতে নিহত স্বজনদের লাশ দাবি করে না।

বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে কোনো প্রতিরোধ না থাকায় ভারত এখন স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তিবোধ করছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে যে ভারতীয় স্বার্থের অনুকূলে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিডিআরের সিংহসম অবস্থান এখন মেষ শাবকের পর্যায়ে নেমে এসেছে। ভারত পিলখানা বিপর্যয়ের একমাত্র সুবিধাভোগী। কেউ জানে না বিডিআর এবং সেনাবাহিনী তাদের পূর্বেকার মনোবল, সাহস, কর্মপ্রেরণা, ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতা কবে ফিরে পাবে? কবে তারা আমাদের সীমান্ত ও দেশ রক্ষার শক্তি, দৃঢ়তা অর্জন করবে? কোনো কোনো বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন, বিডিআর বিদ্রোহের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মূল কারণ পদুয়া-বড়াইবাড়ীতে ভারতীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ হলেও এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যে কোনো অজুহাতে, এমনকি ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চলাচলকারী মৈত্রী ট্রেন পাহারার আবরণে হলেও শান্তি মিশনের নামে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য গ্রহণে বাংলাদেশকে রাজি করানো। কথিত শান্তি মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই বাহিনী দখলদার বাহিনী হিসেবে কাজ করবে এবং বিডিআর জওয়ান ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্বের আরও অবনতি ঘটিয়ে ভারতীয় বাহিনীর অবস্থানকে চিরস্থায়ী করবে। এর মাধ্যমে ভারত দ্বিবিধ সুবিধাপ্রাপ্তির অপেক্ষায় ছিল। এগুলো হলো : ভারতের করিডোরপ্রাপ্তি সুনিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পঙ্গু করে ধ্বংস করা। এটা ছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া জবরদস্তিমূলক চুক্তির বাস্তবায়ন মাত্র, যাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের কোনো নিয়মিত পেশাদার সেনাবাহিনী থাকবে না, বরং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ভারতীয় বাহিনীই নিশ্চিত করবে। ভারতে গঠিত প্রবাসী সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ৭ দফা চুক্তির সামান্য অংশই স্বাধীনতার পর বাস্তবায়িত হয়েছিল।

সমর প্রস্ততি : বাংলাদেশে বিডিআর বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে ভারতের সমর প্রস্তুতি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে, বিদ্রোহ থেকে ফায়দা লোটার চক্রান্ত থেকেই ভারত এ বিদ্রোহ ঘটিয়েছিল। বিডিআর বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে ভারতের সমর প্রস্তুতির বিবরণ ‘হিন্দুস্তান টাইমস’, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’সহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। ২ মার্চ, ২০০৯ ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশে মানবিক কারণে হস্তক্ষেপ করার জন্য ভারতীয় সৈন্যদের প্রস্তুত রাখা হয়। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন আসামের জোড়াহাট বিমান ঘাঁটিতে বেশ কিছু যুদ্ধ বিমান প্রস্তুত ছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট (সর্বোচ্চ সর্তকতা) জারি করা হয়। আগ্রা থেকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এক ব্রিগেড প্যারাস্যুট বাহিনী কলকাতার নিকটবর্তী কালাইকুণ্ডায় আনা হয়। বাংলাদেশে একটি অভ্যন্তরীণ গোলযোগ চলাকালীন ভারতের এই সমর প্রস্তুতির রহস্য কি পিলখানার খুনিদের, বিশেষত মুখোশ পরিহিতদের উদ্বার করা, যারা রহস্যজনকভাবে বিডিআর সদর দফতরে প্রবেশ করে এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। উল্লেখ্য, সাত বছর ধরে নেপালে মাওবাদী বিদ্রোহ কিংবা ২৬ বছর ধরে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময় ভারত কখনোই এমন সমর প্রস্তুতি নেয়নি। এ সমর প্রস্তুতি এই সত্যতা উদঘাটন করেছে যে, বিডিআর বিদ্রোহকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশে সৈন্য প্রেরণের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। এই কারণে ভারত তার সেনাবাহিনীকে সতর্কাবস্থায় প্রসু্তত রেখেছিল। ভারত সুনিশ্চিত ছিল যে কোনো মুহূর্তে ভারতীয় সৈন্য প্রেরণের জন্য বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রণ বা অনুরোধ আসবে। তথ্যাভিজ্ঞমহল জানিয়েছেন, ৫০তম ইনডিপেন্ডেন্ট প্যারাস্যুট বিগ্রেডের এক ব্যাটালিয়ন (এক হাজারের বেশি সদস্যবিশিষ্ট) রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯) আগ্রা থেকে বিরাটাকারের বিমানঘাঁটি কালাইকুণ্ডায় রাতারাতি বিমানযোগে আনা হয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আরও সৈন্য আনার প্রস্তুতি ছিল। বিডিআর জওয়ানদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের চৌকিগুলো ক্রমাগতভাবে দখল করে নেয়ার প্রেক্ষাপটে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই উদ্যোগ নেয়া হয়। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ জানায়, ভারত শেখ হাসিনাকে উদ্বার করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে সৈন্য প্রেরণে প্রস্তুত ছিল। ভারত অতি দ্রুততার সঙ্গে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্যারাস্যুট রেজিমেন্টকে রাতারাতি আগ্রা থেকে পশ্চিম বাংলায় আনা হয়। বিমান বাহিনীকে কলকাতা এবং আসামের গৌহাটিতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়।



বিদ্রোহীদের যোগাযোগ : সময়ের বিবর্তনে প্রামাণ্য তথ্য বেরিয়ে আসছে যে, বিদ্রোহীরা তাদের সীমান্তবর্তী মিত্রদের সঙ্গে গণহত্যা চলাকালীন এবং তার আগে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ বিদ্রোহ আসলে সুসংবদ্ধ চক্রান্তের ফসল। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন যোগাযোগের তথ্য এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। এগুলো একত্রে সন্নিবেশিত করলে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বাস্তব হিসেবে প্রমাণিত হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকে এমন খবর এসেছে যে, বিএসএফ তাদের সহযোগিতা চাওয়ার জন্য বিডিআর জওয়ানদের কাছে এসএমএসের মাধ্যমে পরামর্শ দিয়েছিল। গণহত্যা চলাকালীন বিএসএফের এসএমএসে বলা হয়, ‘সেনাবাহিনীর সদস্যরা তোমাদের সীমান্ত চৌকিগুলো দখল করে নেবে। তোমাদের সাহায্য করার জন্য দয়া করে আাামদের আহ্বান কর।’ তৌহিদের সেলফোন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সে বেশ কিছু সংখ্যক উচ্চপদস্থ ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করত। বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, তৌহিদ ওই নারকীয় দিনে তার ভারতীয় মুরুব্বি ও সহযোগীদের সঙ্গে ৩০০ বারের বেশি সেলফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিল। ভারত যে এই চক্রান্তের মূল হোতা তা প্রমাণের জন্য আর কী ধরনের প্রামাণ্য তথ্যের প্রয়োজন?

বিডিআর বিদ্রোহীদের গ্রেফতারে অনীহা : ২৮ ফেব্রুয়ারি (২০০৯) ভারতীয় দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা নয়াদিল্লিকে বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানদের নিরস্ত্র করে বাংলাদেশে প্রেরণের অনুরোধ জানিয়েছে। বিভিন্ন সীমান্তপথে বহু বিডিআর বিদ্রোহী ভারতে পালিয়ে যায়। এই উদ্দেশ্যে তারা সীমান্তে মোতায়েনকৃত বিএসএফ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ভারতকে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিদে্রাহীদের ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত তাড়া করেছিল। গ্রেফতার এড়িয়ে অনেকেই ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। দৈনিকটির মতে, প্রায় সাতশ; বিডিআর বিদ্রোহী পলাতক রয়েছে। কিন্তু ভারত পলায়নরত বিদ্রোহীদের আটকে সামান্যতম উত্সাহ কিংবা ইচ্ছা প্রদর্শন করেনি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রও এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার স্বার্থে ভূমিকা রাখার জন্য ভারতকে পরামর্শ দিয়েছিল। বাংলাদেশ বিষয়ে জনৈক ভারতীয় বিশেষজ্ঞকে উদ্ধৃত করে দৈনিকটি জানিয়েছে যে, বিদ্রোহজনিত অবস্থার জন্য বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও ভারত অন্যরা (মানে আমেরিকা) কী বলেছে সে ভিত্তিতে নয়, বরং ভারত নিজস্ব ইচ্ছা ও স্বার্থানুযায়ী কাজ করবে।
‘টেলিগ্রাফ’ জানিয়েছে, সীমান্তের ৩০টি পয়েন্টে বিডিআর বিদ্রোহীরা বিএসএফের সঙ্গে আশ্রয়ের জন্য যোগাযোগ করেছিল। এসব পয়েন্ট পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা সীমান্তে অবস্থিত। কোনো কোনো পয়েন্টে বিডিআর বিদ্রোহীরা ভারতে আশ্রয় চেয়ে বিএসএফের কাছে চিঠি লিখেছে।
উপসংহারে দৈনিকটি জানায়, ভারত আন্তর্জাতিক চাপে কোনো কিছু করবে না। ভারত তার সার্বিক স্বার্থ বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে। 
উপরোক্ত প্রতিবেদন এই সত্যতা নিশ্চিত করেছে যে, খুনিদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় পেয়েছে এবং ভারত কোনোভাবেই তাদের বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত নয়। ভারতের এই অবস্থান নিশ্চিত করে যে ভারত এই গণহত্যার একমাত্র রূপকার। 
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২০৮ কি.মি. স্থল এবং ৬৩ কি.মি. নৌ-সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্তে বেশ কিছু সংখ্যক চৌকি রয়েছে। কোনো বিডিআর সদস্যই মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী নাসাকার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি কিংবা মিয়ানমারে ঢুকে পড়েনি। অথবা মিয়ানামারে আশ্রয় চায়নি। তাছাড়া মিয়ানমার তার সৈন্যদেরও সর্তক অবস্থায় থাকতে বলেনি, কিংবা বাংলাদেশে সাহায্যের নামে সৈন্য পাঠাতে চায়নি, বা ভারতের মতো বিডিআর পুনর্গঠনে ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম পিলখানা বিপর্যয় প্রসঙ্গে কোনো কুিসত কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যও করেনি। প্রশ্ন উঠেছে, বিডিআর বিদ্রোহীরা কেন ভারতে প্রবেশ করেছে এবং নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহীরা ভারতে এজন্যই আশ্রয় নিয়েছে যে, তারা নিশ্চিত জানত এতে তারা কোনো ধরনের বিপদে পড়বে না। কিন্তু যদি তারা মিয়ানমারে পলায়ন করে, তবে তাদের চরম বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। ভারতের অতি উত্সাহী স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রস্তাব, বিডিআর বিদ্রোহীদের ভারতে পলায়ন, তাদের পাকড়াও করতে ভারতের অনুত্সাহ প্রভৃতি বিডিআর বিদ্রোহ এবং সেনা কর্মকর্তা হত্যায় ভারতের জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। 

বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিডিআর বিদ্রোহীদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ পূর্বপরিকল্পিত না হয়ে তাত্ক্ষণিক হলে তারা মিয়ানমারেও প্রবেশ করত। কিন্তু তারা মিয়ানমারে যায়নি। তাদের ভারতে পলায়ন এবং তাদের স্বাগত জানাতে ভারতের সদিচ্ছা প্রমাণ করে যে, সবকিছুই ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও প্রস্তুতিমূলক। পিলখানা বিপর্যয়কে ব্যবহার করে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সুবিদা-চাহিদা আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করে। ভারতের ভূমিকা থেকে বাংলাদেশ সরকারকে তার আসল শত্রুর চক্রান্ত অনুধাবন করতে হবে। ভারত সদ্য নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে ট্রানজিট ও বন্দর সুবিধা এবং জয়েন্ট টাস্কফোর্সসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণের প্রত্যাশা করে। মূল বাস্তবতা হলো, ভারত যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের সম্পদ লুটে নিতে চায়। শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আওয়ামী লীগ ভারত-ঘেঁষা হওয়ার প্রেক্ষিতে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে সর্বাধিক মাত্রার ভীতি সৃষ্টি করে ভারতীয় বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে চায় যে, ভারত উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই বিদ্রোহ ও গণহত্যা ঘটিয়ে ধূর্ততার সঙ্গে এর দায়দায়িত্ব পাকিস্তানের আইএসআই’র ওপর বর্তিয়ে নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছে।

বিডিআর জওয়ানদের কতিপয় ন্যায্য দাবিকে অজুহাত হিসেবে অতি গোপনে ব্যবহার করে ভারত বিডিআর বিদ্রোহ সংঘটনে সফল হয়। শেখ হাসিনা মাত্রাতিরিক্ত সময় নিয়ে খুনিদের হত্যাকাণ্ড চালিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেতে সুযোগ করে দিয়েছেন— খালেদা জিয়ার এমন অভিযোগ যথার্থ। পিলখানায় সেনাবাহিনীবিরোধী এই হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখা। ভারত বাংলাদেশে তার সৈন্য মোতায়েন করতে চায়, শ্রীলঙ্কায় যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে ভুটানে সফল হয়েছে। আর একই কায়দায় সিকিম তো দখলই করেছে। ভারত এরই মধ্যে বাংলাদেশে শান্তি মিশন প্রেরণের প্রস্তাব দিয়েছে।

কতিপয় ভারতীয় নীতিনির্ধারক, গণমাধ্যম ও তাদের বাংলাদেশী সহযোগীরা পিলখানার হত্যাযজ্ঞকে জেএমবি ধরনের সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তদন্তে এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে। বরং গ্রেফতারকৃত এবং সন্দেহভাজনদের অনেকেই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত। এসব চক্রের অনেকেই চাঁদাবাজি, টোল আদায়, চোরাচালান, সন্ত্রাস, হত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য অপরাধ কর্মের সঙ্গে আগে থেকেই জড়িত ছিল এবং বাংলাদেশে অবস্থা বেগতিক দেখলে এরা ভারতে পালিয়ে যায়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এরা গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ভারতে আশ্রয় নেয়। কলকাতা এবং পশ্চিম বঙ্গের আরও কয়েকটি জেলা এবং ত্রিপুরা বাংলাদেশী অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শামিম ওসমান, জয়নাল হাজারী, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ প্রমুখ ভারতে নিরাপদে অবস্থান করে। এদের অনেকেই বাংলাদেশে ‘র’-এর ‘চর’ হিসেবে কাজ করছে। এ ধরনের অভিযোগের অনুকূলে প্রামাণ্য তথ্য উপস্থাপন কঠিন হলেও এটা সর্বজনজ্ঞাত যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী মহল, আইন ব্যবসায়ী, সংবাদ মাধ্যম, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, এনজিও, ব্যবসায়ী শ্রেণী, এমনকি ধর্মীয় দল ও প্রতিষ্ঠানে ‘র’-এর নেটওয়ার্ক রয়েছে। বেসামরিক প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, বিডিআর এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে ‘র’-এর ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
কারণ

যুক্তিবিদ্যায় সর্বজনজ্ঞাত একটি কথা রয়েছে, কোনো কিছুই কিছু ছাড়া ঘটে না। প্রতিটি ঘটনার পেছনে যথাযথ কারণ বিদ্যমান থাকে। পিলখানায় হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে এই প্রবাদসম বাক্যটি বেশ প্রযোজ্য। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী অনেকগুলো কারণ বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্নভাবে এসেছে। তিনটি তদন্ত কমিটির মধ্যে দুটো এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছে। এই গ্রন্থ মুদ্রণের সর্বশেষ পর্যায়েও তৃতীয় কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও তার কোনো অংশই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটির ৩০৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের মধ্যে মাত্র সাত পৃষ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে। জমাকৃত দুটি প্রতিবেদনই সঙ্গত কারণে পিলখানা বিপর্যয়ের অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে আরও তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে। তদন্ত কমিটি এবং সংবাদ মাধ্যম এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেসব সাধারণ কারণ উল্লেখ করেছে, সেগুলো সম্ভবত এমন রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য যথেষ্ট নয় বলে বিবেচিত হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি স্বীকার করেছে যে, আধা-সামরিক বাহিনীর এমন নারকীয় তাণ্ডবের যথার্থ কারণ ও মতলব উদ্ঘাটন ও নির্ধারণে কমিটি ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং সত্যিকারের কারণ উদঘাটনার্থে তদন্ত কমিটি আরও তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটি অবশ্য উল্লেখ করেছে যে, সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিডিআর জওয়ানদের চলমান নেতিবাচক মানসিকতা এবং দাবি অপূর্ণ থাকায় তাদের অসন্তোষ ও বিরক্তি এবং ক্ষোভ এই দুর্যোগের প্রাথমিক কারণ হতে পারে। 
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, বিডিআরের দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, কতিপয় তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন দাবি এমন ব্যাপক নির্মম ঘটনা ঘটানোর মূল কারণ হতে পারে না। বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যই ওই সব দাবি ব্যবহার করা হলেও সেগুলো বাহানা মাত্র। 

তদন্ত কমিটি মনে করে, এসব দাবি ব্যবহার করে হত্যাকাণ্ডের রূপকাররা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাকে বিপদগ্রস্ত করার জন্য পেছন থেকে সুতো নেড়েছে। দেখা যাক বিডিআর জওয়ানদের দাবিগুলো কেমন।
নগণ্য সুবিধা : পিলখানা বিপর্যয়ের কারণ উদ্ঘাটন করে ঢাকার একটি বাংলা দৈনিক লিখেছে যে, সারা বছর রেশন না দেয়া, বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে প্রাপ্ত অর্থ বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে বিতরণ না করা, সীমান্ত ভাতা বৃদ্ধি না করা, সম্প্রতি পুলিশের জন্য ভিন্ন বেতন কাঠামো চালু করা হলেও বিডিআরের জন্য তেমন পদক্ষেপ না নেয়া ইত্যাদি কারণে বিডিআর জওয়ানদের মনে ক্ষোভ ও বেদনার উদ্রেক করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র উদ্ধৃত করে দৈনিকটি জানিয়েছে, সব বিডিআর জওয়ান নিয়মিত রেশন সুবিধা পায় না। যদি এই বছর ৬০ শতাংশ বিডিআর জওয়ান রেশন সুবিধা পায়, বাকি ৪০ শতাংশ আগামী বছর এই সুবিধা পাবে। তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবার মাসে ছয় কেজি আটা, ৩৬ কেজি চাল, তিন লিটার ভোজ্য তেল এবং তিন কেজি চিনি রেশন হিসেবে পেয়ে থাকে। 

চারদলীয় জোটের শাসনকালে শতকরা একশ’ ভাগ জওয়ানকে ডালসহ সারা বছর ধরে রেশন সুবিধা প্রদানের দাবি উত্থাপিত হয়। কিন্তু দাবি অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পিলখানা বিপর্যয়ের পর শেখ হাসিনা সরকার বিডিআর জওয়ানদের প্রদত্ত রেশনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং সারা বছর ধরে সবার জন্য রেশন প্রদানের ঘোষণা দেয়। 
‘সমকাল’ জানিয়েছে, ‘ডাল-ভাত’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী বিডিআর জওয়ানদের দেয় ভাতা তাদের মধ্যে বাটোয়ারা করা হয়নি। এই বিপর্যয় ঘটার আগে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রাপ্ত ভাতার এক-তৃতীয়াংশ বণ্টন করা হয়েছে। সীমান্তে মোতায়েনকৃত প্রত্যেক বিডিআর জওয়ান সীমান্ত ভাতা হিসেবে মাসিক ২০০ টাকা পায়। এই ভাতা বৃদ্ধির দাবি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। 
বিডিআর জওয়ানরা মনে করে, সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে আসা সেনা কর্মকর্তারা তাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি ততখানি আন্তরিক নন। ‘সমকাল’ জানিয়েছে, তিনশ’র বেশি কর্মকর্তার মধ্যে ২৫০ জনের বেশি কর্মকর্তা প্রেষণে সেনাবাহিনী থেকে আসা। দৈনিকটির মতে, এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিডিআর জওয়ানরা হিংসাত্মক পন্থা বেছে নিয়েছে। 

বিডিআর জওয়ানরা সেনা কর্মকর্তাদের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মকর্তা নিয়োগের, শতভাগ জওয়ানকে রেশন প্রদানের, তাদের বেতন কাঠামো সেনাবাহিনীর আদলে পুনর্নির্ধারণ এবং জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিডিআর জওয়ানদের প্রেরণের দাবি জানিয়ে আসছিল। তাছাড়া ‘ডাল ভাত’ কর্মসূচি পরিচালনা প্রক্রিয়া, বিডিআরের মালিকানাধীন দোকান পরিচালনায় অস্বচ্ছতা, সেনা কর্মকর্তাদের বিলাসী জীবন যাপন প্রভৃতি বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 
শুরু থেকে বলা হয়েছিল যে, বঞ্চনা, বৈষম্য, শোষণ এবং কর্মকর্তাদের অত্যাচার ও কর্তৃত্ব বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহ ঘটানোতে প্ররোচিত করেছে। কিন্তু নির্মমতা, বর্বরতা, গণহত্যার ব্যাপকতা, নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশের প্রতি চরম অবমাননার মাত্রা একটি সত্যকেই উন্মোচিত করেছে যে, সমুদয় হৃদয়বিদারক বিয়োগান্তক ঘটনাটি অতীব সুচিন্তিত ও সাজানো চক্রান্তের অংশবিশেষ। 
সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগ 

বিডিআর জওয়ানদের অন্যতম দাবি ছিল বিডিআর থেকে সেনা কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে পুলিশের মতো বিসিএস ক্যাডারদের তাদের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হোক। নিন্দুকদের মতে, এ দাবির নেপথ্য কারণ ছিল সীমান্তে বিডিআর জওয়ানদের অসদুপায়ে অর্থ আয়ের পথ উন্মুক্ত করা, যা সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতির কারণে কঠিন হয়ে পড়ে।

২০০২ সালের আগে সামান্য সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা বিডিআরে নিয়োগ পেতেন। এসব সেনা কর্মকর্তা সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে অবসরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন। ২০০২ সালের শেষ প্রান্তে মেধাসম্পন্ন তেজস্বী সেনা কর্মকর্তাদের বিডিআরে প্রেষণে নিয়োগ করার পর থেকে সীমান্ত পাহারা এবং আন্তঃসীমান্ত অপরাধ ও চোরাচালান পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৮০ সালের দিকে চোরাচালানিদের মাধ্যমে ভারত প্রতি বোতল ফেনসিডিল মাত্র দুই টাকায় বাংলাদেশে বিক্রি করতে শুরু করে। আমাদের যুব সমাজ এ মরণঘাতী নেশার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকলে ভারত এর মূল্য কেবল বৃদ্ধি করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, বরং বাংলাদেশ ভূখণ্ড বরাবর অসংখ্য প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ফেনসিডিল কারখানা গড়ে তোলে, যাতে অতিদ্রুত ব্যাপকভাবে এ নেশা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেয়া যায় । এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে এক ধরনের সীমান্ত অপরাধ। 
এ কারণেই বিডিআরে সেনাবাহিনীর দক্ষ কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ দেয়া শুরু হয়। অভিযোগ রয়েছে যে, ২০০২ সালের আগেকার বিডিআর জওয়ানরা চোরাচালান থেকে অর্জিত অবৈধ অর্থের কারণে বেশ সম্পদশালী ছিল। বিডিআর সিপাহি, নায়েক ও হাবিলদারদের এমন সুরম্য দালান-কোঠা ছিল, যা বাইরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কেবল স্বপ্নেই ভাবতে পারত। তাদের এ ধরনের সম্পদ অর্জন দেশের স্বার্থ বিসর্জনের মাধ্যমেই সম্ভব হতো। ২০০২ সালের পর চোরাচালান থেকে বিডিআর জওয়ানদের প্রাপ্ত অবৈধ অর্থ আগমন ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে। আটককৃত চোরাচালানের অবৈধ মালামাল থেকে অবৈধ প্রাপ্তির সুযোগ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০২ সালের আগের ও পরের আটক চোরাচালানকৃত দ্রব্যাদির পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই এর বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়। সেনা কর্মকর্তা নিধনে মুখোশ পরিহিত বিডিআর জওয়ানদের চাকরির বয়স ৫/১০ বছর হবে, যারা চোরাচালান থেকে অবৈধ পয়সা পায়নি। তাদের বয়োজ্যেষ্ঠ বিডিআর জওয়ানরা তাদের প্রায়ই বলত, দেখ আমরা সিপাহি থাকাকালীন ঘরবাড়ি করেছি। কিন্তু তোমরা এখন তা করতে পারছ না। কেননা এখন সেনা কর্মকর্তারা পয়সা বানাচ্ছে এবং তোমাদের তার অংশ দিচ্ছে না। তরুণ জওয়ানদের ক্ষেপানোর জন্য বিদ্রোহের হোতারা এ ধরনের গল্প ফেঁদেছে। অথচ বিডিআরে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগের পর থেকে বিএসএফের সঙ্গে প্রতিটি সংঘর্ষে বিডিআর বিজয়ী হয়েছিল। কূটনৈতিক দুর্বলতার কারণে সংবাদ মাধ্যমে কেবল বিডিআরের পক্ষে হতাহতের খবর প্রচার করা হয়েছে। যতদিন সেনা কর্মকর্তারা বিডিআরের নেতৃত্বে থাকবে ততদিন বিএসএফ কোনোভাবেই এঁটে উঠবে না, ততদিন ভারত উন্মুক্ত সীমান্ত পাবে না, যা ভারত ১৯৪৭ থেকেই কামনা করছিল। চোরাচালান, জাল কাগুজে মুদ্রা এবং মাদক ও অস্ত্র প্রেরণ, ভারতীয় সন্ত্রাসী ও ‘চর’দের নিরাপদ যাতায়াত, সর্বোপরি, বাংলাদেশকে অরক্ষিত রাখার জন্য উন্মুক্ত সীমান্ত ভারতের ভূ-আর্থিক স্বার্থের জন্য অত্যাবশ্যক। অন্যদিকে বিডিআর নেতৃত্বে সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আর্থিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হলো বিডিআরের ডিএডিরা, যাদের সবাই বিডিআর থেকে আসা। তারাও ছিল সুশিক্ষিত, কিন্তু সেনা কর্মকর্তাদের কারণে তারা সুবিধা অর্জনে সক্ষম হয়নি। এর মানে দাঁড়াল ভারত এবং বিডিআরের অধস্তন কর্মকর্তা ও বিডিআর জওয়ানদের সেনা কর্মকর্তা-বিরোধী অভিন্ন স্বার্থ এক বিন্দুতে এসে ঠেকেছে।

বিডিআরের সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃস্থানীয় অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণ, তাদের বেতন কাঠামো ও সুবিধাদি সেনাবাহিনীর জন্য প্রযোজ্য নিয়মানুযায়ী প্রদান করা হয়। অপরদিকে সরাসরি বিডিআরে নিযুক্তিপ্রাপ্ত বেসামরিক অবস্থান থেকে আসা বিডিআর জওয়ান এবং ডিএডিসহ অধস্তন কর্মকর্তারা সাধারণ বেতন কাঠামো অনুযায়ী আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা পায়। এই বৈষম্য বিডিআর জওয়ান ও অধস্তন বেসারকি অফিসারদের সেনা কর্মকর্তাবিরোধী প্রবণতা গঠনে মারাত্মকভাবে প্ররোচিত করে।

দুর্নীতি : বিডিআরে সাময়িক সময়ের জন্য আসা সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিডিআর জওয়ানরা দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। সংবাদ মাধ্যমে বিডিআর বিদ্রোহে যেসব কারণ তুলে ধরা হয়েছে, তা বাস্তবতার পরিপন্থী এবং অতিরঞ্জিত। সমাজের কুচক্রীমহল বিডিআরের মতো একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে এমন পাইকারি গণহত্যার প্রকৃত কারণ নির্ণয়ে দ্বিধান্বিত ও উদাসীন। এই নারকীয় বিয়োগান্তক নাটকের মূল হোতাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং ভবিষ্যতে এমন মর্মভেদী ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক তদন্ত হওয়া অত্যাবশ্যক।

এক শ্রেণীর বিডিআর জওয়ান, বিশেষত ডিএডি তৌহিদের মতো বিডিআরের অসামরিক অধস্তন কর্মকর্তাদের ক্ষোভ ও শত্রুতার মূল সূত্র হলো বেসামরিক অফিসার ও জওয়ানরা সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগপ্রাপ্তির কারণে চোরাচালান এবং অন্যান্য অপরাধের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এই কারণেই বিডিআর জওয়ান এবং তাদের অসামরিক কর্মকর্তাদের মনে সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কতিপয় তুচ্ছ কারণকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সামনে এনে মূল কারণকে আড়াল করে এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। 

ভিনদেশি চক্রান্ত : এরই মধ্যে এই সত্যতা স্পষ্ট হয়েছে যে বিডিআর বিদ্রোহ তথা গণহত্যা তথাকথিত দুর্নীতিবাজ ও অত্যাচারী অধিনায়কদের বিরুদ্ধে কতিপয় বিডিআর জওয়ানের প্রতিশোধ নেয়ার তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয় বরং এটা ছিল অত্যন্ত নিপুণভাবে অতি শক্তিধর চক্রান্তকারীদের প্রস্তুতকৃত নীলনকশার উচ্চমার্গীয় কমান্ডো অভিযান, যার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল এবং এর প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এলোমেলো করা। বাংলাদেশবিরোধী এই অভিযানের তাত্ক্ষণিক লক্ষ্য ছিল এর রাষ্ট্র কাঠামোর বিভিন্ন শাখা বিশেষত সশস্ত্র বাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে দ্বিধা, অবিশ্বাস, ভীতি ও ঘৃণা সৃষ্টির বীজ বপন। আর এর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া, এর প্রতিরক্ষা শক্তিকে পঙ্গু করা, অথবা আরেক সোমালিয়া কিংবা কঙ্গো তৈরি করা যাতে স্বঘোষিত আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক আধিপত্যবাদীর সামরিক ও অর্থনৈতিক উপস্থিতি ছাড়া এদেশ শাসনের অযোগ্য হয়ে যায়।

ঢাকার প্রাচীনতম ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য বাংলাদেশ অবজারভার’-এর সম্পাদকীয় ২০ মার্চ (২০০৯) মন্তব্যে বলা হয়েছে, অধিকাংশ জনগণের কাছে স্ফটিকের মতো স্পষ্ট যে এটা (বিডিআর বিদ্রোহজনিত সেনা কর্মকর্তা হত্যা ) ছিল সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। তবে এটা কি সরকারের বিরুদ্ধে নাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তা নির্ণয় করা দুরূহ। কিন্তু বিদ্রোহের ব্যাপকতা ইঙ্গিত দেয় যে, এটা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা, বিরক্তি বা বঞ্চনা, কিংবা বিডিআর জওয়ানদের সেনাবাহিনীবিরোধী অনুভূতি বা মানসিকতা থেকে সৃষ্টি হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে দাবি করেছেন, সরকারকে হঠানো এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার জন্যই বিডিআর বিদ্রোহের ফাঁদ পাতা হয়েছে। যদিও শেখ হাসিনা সরকারকে হঠানোর কোনো প্রচেষ্টা বাস্তবে পরিলক্ষিত হয়নি। সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন এবং তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী সেনাকুঞ্জে বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়েও নিরাপদে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সুতরাং বিডিআর বিদ্রোহ শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্তবিশেষ এমন প্রচারণা বা দাবি নিছক অনুমাননির্ভর ও সন্দেহপ্রবণ মানসিকতা থেকে সৃষ্ট কিংবা আসল কারণ ঢাকা দেয়ার অজুহাত বিশেষ।

বামপন্থী রাজনৈতিক ও কলামিষ্ট হায়দার আকবর খান রণো লিখেছেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজে সেনা কর্মকর্তা নিধন, লুণ্ঠন এবং নির্মমতার বর্বরতম নজির স্থাপন কোনোভাবেই সামরিক অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্য বহন করে না। অতি তুচ্ছ দাবীকে সামনে এনে ক্ষুদ্র একটি চক্র তাদের উদ্দেশ্যে হাসিল করেছে এবং নিঃসন্দেহে ইহা ছিল লোমহর্ষক ভয়ঙ্কর চক্রান্তের অংশ বিশেষ। নিঃসন্দেহে ইহা ছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে।

পিলখানা হত্যার জন্য দায়ী খোঁড়া যুক্তিকে প্রত্যাখান করে বর্ষিয়ান সাংবাদিক ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুর লিখেছেন, এই বিয়োগান্তক ঘটনা অভিযোগ-সংক্রান্ত বিরক্তি কিংবা ক্ষোভের বহি:প্রকাশ নয়। ইহা এমনকি বিদ্রোহও নয়। বসত্তত: এটা ছিল বরং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনাকে ধ্বংস করার সুপরিকল্পিত চক্রান্ত বিশেষ। বঞ্চণার কারণে যদি কোন অভিযোগ থাকতই, তবে সেগুলো দূরীকরণে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিল। সে ধরনের উদ্যোগ না নিয়ে তারা কেন আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর এতো প্রতিভাবান অফিসারদের হত্যা করল? স্বাধীন সার্বভৌম দেশের প্রতিরক্ষা শক্তিকে ধ্বংস করাই ছিল এর লক্ষ্য। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও কল্যাণে বিশ্বাস করে এমন কারো পক্ষে এমন ধ্বংসাত্মক অপকর্ম সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।

অধ্যাপক আবদুল গফুর বিভিন্ন নেতৃবৃন্দকে উদ্ধৃত করে অভিযোগ করেন, এই ঘটনার পেছনে বিদেশী শক্তি সক্রিয় ছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বলেছেন, পিলখানা হত্যাকান্ডের পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত জড়িত ছিল। সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই হত্যাকান্ডের পেছনে বাংলাদেশ বিরোধী চক্রের উস্কানী সক্রিয় ছিল কিনা তা তদন্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন সংগৃহীত প্রাথমিক তথ্য প্রমাণাদিতে প্রতীয়মান হয় যে, এর পেছনে বিদেশী শক্তি সক্রিয় ছিল। 

বিদ্রোহের ব্যাপকতা : বিডিআর বিদ্রোহ কেবলমাত্র পিলখানাস্থ বিডিআর সদর দফতরে সীমিত ছিল না। বরং এটা বিডিআর’এর কমপক্ষে ৩২টি ইউনিট, ব্যাটালিয়ন ও সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ছড়িয়ে পড়ে। খুলনা সেক্টরের বিডিআর জোয়ানরা খুলনা-যশোর মহাসড়ক অবরোধ করে এবং যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাজশাহীস্থ বিডিআর সদর দফতরে সারাদিন গোলাগুলি চলে। খাগড়াছড়ি বিডিআর সেক্টর সদর দফতরে গুলিবর্ষণ করা হয়। ফেনীতে অবস্থিত বিডিআর ব্যাটালিয়নে গুলি বর্ষণ হয়। ঐ ব্যাটালিয়নের জোয়ানরা ফেনী-মাইজদী সড়কে অবরোধ তৈরী করে। জয়লস্করে (ফেনী-মাইজদী সড়কে) গুলি বিনিময় হয়। দিনাজপুরের ফুলবাড়ি ও কবিবাড়ি হাটে, সিলেটের সুনামগঞ্জে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়, দিনাজপুরের আমবাড়ীতে, জয়পুরহাটে শমসের নগরে, লালমনির হাটে, নওগাঁওতে, নেত্রকোণায়, সিলেট শহরে, যশোরে, কক্সবাজারে, হিলি ও ঠাকুরগাঁওয়ে, ফটিকছড়িতে, টেকনাফে সড়ক অবরোধ করা হয়। কুষ্টিয়া ও ভেড়ামারার মিরপুরে রেল চলাচল বিঘ্নিত হয়।*
লেখকের BDR Massacre: Target Bangladesh’ শীর্ষক গ্রন্থের একটি উপ-অধ্যায়

তথ্যসুত্র:
১. Sultan M Hali. BDR Mutiny : An India Conspiracy, Bangladesh Open Source Intelligence Monitors, 27 March, 2009. BDR Massacre: Target Bangladesh 
২. মোকাররম হোসেন, দৈনিক নয়া দিগন্ত্ম, ঢাকা, ৭ মার্চ, ২০০৯।
৩. দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, ৩ মার্চ ২০০৯।
৪. . MBI Munshi, The BDR Mutiny- revenge for Padua & Boraibari incident, march 02, 2009-httprecord=249915 
৫. Bangladesh Mutiny : India moves more troops to WB, March 4, 2009, http//timesofIndia.indiatimes.com/India/Bangladesh-mutiny-india-movesmore-troops-to-WB/articleshow/4220361.cms
৬. The Telegraph, Kolkata, India, 28 February, 2009.
৭. Sultan M. Hali. BDR Mutiny : An India Conspiracy, Bangladesh Open Source Intelligence Monitors, 27 March, 2009.
৮. ডঃ রেজোয়ান সিদ্দিকী, উপ-সম্পাদকীয়, দৈনিক সংগ্রাম, ঢাকা, ৪ মার্চ, ২০০৯।
৯. Sultan M. Hali. BDR Mutiny : An India Conspiracy, Bangladesh Open Source Intelligence Monitors, 27 March, 2009.
১০. Dr. K.M.A Malik, The Sugar-coated Poison: India’s offer of ‘help’ to restructure BDR, Bangladesh Open Source Intelligence Monitors, 6 April, 2009.
১১. Dr. K.M.A Malik, Ibid.
১২. দৈনিক সমকাল, ঢাকা, ২৬ ফেব্রম্নয়ারী, ২০০৯।
১৩. আমার দেশ, ঢাকা, ২ মার্চ, ২০০৯।
১৪. B. Rahaman, Bad Omens from Bangladesh, 27 February, 2009, http/www.southasiaanalysis.org/papers31/paper3072.html) The writer is an additional Secretary (Retd), Cabinet Secretariat. Govt of India, New Delhi, & presently= Director, Institutte For Tropical Studies, Chennai, India, E-maill : Seventyone 2@ gmaill.com
১৫. Sultan M. Hali. BDR Mutiny: An India Conspiracy, Bangladesh Open Source Intelligence Monitors, 27 March, 2009.
১৬. Dr K.M.A Malik, Bangla Mirror, 6 March, 2009.
১৭. হায়দার আকবর খান রণো, উপ-সম্পাদকীয় আমার দেশ, ঢাকা, ১০ মার্চ, ২০০৯।
১৮. অধ্যাপক আবদুল গফুর, দৈনিক ইনকিলাব, ঢাকা, ১৯ মার্চ, ২০০৯।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক, নিউইয়র্ক
Email: noa@agni.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন