বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৩

১৯৭৪ সালের দিল্লি চুক্তির অজানা অধ্যায়

উপমহাদেশের ইতিহাসে ১৯৭২ সাল অত্যন্ত আলোচিত একটি বছর। এ বছরের ২ জুলাই রাত ১২টা ৪০ মিনিটে ভারতের হিমাচল রাজ্যের স্বাস্থ্যনিবাস সিমলায় ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি স্বারিত হয়। ২৮ জুন চুক্তির খসড়া প্রণয়ন করা হয়। পাকিস্তান সংসদে ১৫ জুলাই এবং ভারতের সংসদে ২৮ জুলাই চুক্তি অনুমোদন করা হয়। চুক্তি কার্যকর হয় ১৯৭২ সালের ৪ আগস্ট থেকে। হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় চুক্তি লেখা হয়। ১৯৭১ সালে দু’টি দেশের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রেেিত এ চুক্তি স্বারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সিমলা চুক্তির পথ ধরে ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে স্বারিত হয় এক ত্রিপীয় চুক্তি। এ ত্রিপীয় চুক্তিতে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে মা করে দেয়ার স্পষ্ট ঘোষণা খুঁজে পাওয়া যায়। এতে আরো দেখা যায় যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো অতীতের কৃত ভুলত্রুটির জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে মা চেয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান মা করে দিয়েছিলেন। দিল্লিতে ত্রিপীয় চুক্তির ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘অতীত বিশেষ করে অতীতের ভুলভ্রান্তি ভুলে যেতে এবং মা করে দিতে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আবেদনের প্রেেিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশ সরকার মার নিদর্শনস্বরূপ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ব্যাপারে ঐকমত্য হয় যে, দিল্লি চুক্তির আওতায় বর্তমানে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াধীন অন্য যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন করবে। ’ দিল্লিতে ত্রিপীয় চুক্তিতে এই স্পষ্ট ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। অতীত একটি জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে যার খুশিমতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করছেন। যাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে তারা যুদ্ধাপরাধী এ কথা অতীতে কখনো বলা হয়নি। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন হয়তো সহযোগী নয়তো ছিলেন অখণ্ড পাকিস্তানের সংহতিতে বিশ্বাসী। ১৯৭২ সালে বন্দী ও আটকদের প্রত্যাবাসনে জটিলতা দেখা দিলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানকে বাগে আনতে ১৯৫ যুদ্ধবন্দীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারে পুনঃ পুনঃ বাংলাদেশকে তাগিদ দিচ্ছিলেন। ভারতের খ্যাতনামা সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত সিং তার ইন্ডিয়াস ওয়ার সিন্স ইন্ডিপেন্ডেন্স শিরোনামে গ্রন্থের ৫৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘কিন্তু তার আগে আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের বিমানে অসুস্থ ও আহতদের প্রত্যাবাসন করা হয় যেখানে ৭০ জন ভারতীয় সৈন্যের বিপরীতে প্রায় ৩২০ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও বেসামরিক লোককে বিনিময় করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মহিলা ও শিশুদের বিনিময় করা হয়। তারপর নেমে আসে অচলাবস্থা। এতে পাকিস্তানের চেয়ে ভারত ক্রুদ্ধ হয়েছিল বেশি। পুনরায় মিসেস গান্ধীর উদ্যোগে নয়াদিল্লি ও ঢাকা একটি প্যাকেজ ডিলের প্রস্তাব দেয় যার আওতায় ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দি ও বেসামরিক আটক ব্যক্তি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হয়। ’ ১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে স্বারিত দ্বিপীয় ও ত্রিপীয় চুক্তিগুলোর প্রতি ল করলে দেখা যাবে যে, এসব চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে সৃষ্ট সব সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। এ সমাধান করেছিল প্রত্যভাবে জড়িত পগুলো। বাংলাদেশের স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মাটিতে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকেও বাস্তবতা মেনে নিতে হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘের কাক্সিত সদস্যপদ লাভ, পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং সে দেশে আটক বাঙালিদের প্রতিশোধের হাত থেকে বাঁচাতে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়া স্থগিত করতে হয়েছিল। ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে মা করে দিয়ে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, বাঙালি মা করতে জানে। তার এ মহৎ উচ্চারণের জন্য তিনি অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। তিনি মার মহত্তম আদর্শের আশ্রয় না নিয়ে জিঘাংসু হলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠত। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। আত্মসমর্পণ করেছিল বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে। তারা অবস্থান করছিল ভারতের ৫০টি যুদ্ধবন্দী শিবিরে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ভারত তাদের নিরাপত্তার জন্য দায়ী ছিল। বিচারের জন্য ভারত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করলে তা হতো জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন। পাকিস্তানিদের প্রতি ন্যায়-অন্যায় যা-ই হোক, পাকিস্তানে অবস্থানকারী আড়াই থেকে চার লাখ বাঙালির ওপর প্রতিশোধ নেয়া হতো। পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ২০৩ জন বাঙালির বিচারের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। বিচারের জন্য এসব বাঙালিকে আটক করা হয়েছিল। আটককৃত বাঙালিদের বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন বন্ধ রাখা হয়েছিল। তিনটি দেশ শুভবুদ্ধির পরিচয় না দিলে এসব বাঙালির জীবনে নেমে আসত মহা দুর্যোগ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগে চীনের প্রতি আহ্বান জানান। চীন পাকিস্তানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭২ সালের ২৫ আগস্ট প্রথম জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করে। ভুট্টো জোর দিয়ে বলছিলেন, যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেয়া না হলে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৩ সালের ২৭ মে তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাথে এক সাাৎকারে পাকিস্তানে আটক ২০৩ জন বাঙালিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘জনমত তালিকা (বাঙালিদের) তৈরির দাবি করছে। আমরা জানি যে, যুদ্ধের সময় বাঙালিরা তথ্য পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হবে। তবে তাদের সংখ্যা কত হবে আমি তা বলতে পারি না।’ ১৯৭২ সালের ২৮ জুন সিমলায় পাক-ভারত শীর্ষ বৈঠক শুরু হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। ভুট্টোর সাথে ছিলেন তার কিশোরীকন্যা বেনজির। বেনজির ইন্দিরা গান্ধীর সাথে করমর্দন করেন। শীর্ষ বৈঠকের দ্বিতীয় দিন আলোচনা জটিলপর্যায়ে পৌঁছে। ইন্দিরা গান্ধী জোর দিচ্ছিলেন কাশ্মির সমস্যার ওপর। তিনি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ও আজাদ কাশ্মিরের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি রেখাকে দুই দেশের স্থায়ী সীমান্ত হিসেবে দেখতে চাইছিলেন। তিনি ভুট্টোর সামনে দু’টি বিকল্প উপস্থাপন করেন। তিনি জানতে চান ভুট্টো প্রথমে পাঁচ হাজার বর্গমাইল হৃত ভূখণ্ড ফেরত চান নাকি ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ফেরত চান। ভুট্টো আগে ভূখণ্ড দাবি করেন। ভূখণ্ডকে অগ্রাধিকার প্রদানে পিতার কৌশল বেনজির ভুট্টো সমর্থন করতে পারেননি। তিনি তার আত্মজীবনী ডটার অব দ্য ইস্টে উল্লেখ করেছেন যে, বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবন্দীকে মুক্ত করার জনপ্রিয় দাবির পরিবর্তে ভূখণ্ডকে অগ্রাধিকার প্রদানে তার পিতার সিদ্ধান্তে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। ভুট্টো মেয়েকে বুঝিয়ে বলেন যে, কোনো-না-কোনোভাবে যুদ্ধবন্দীরা একদিন মুক্তি পাবে। যুদ্ধবন্দীদের সমস্যা মানবিক। ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ভারতে অনির্দিষ্টকাল আটক করে রাখা হবে অমানবিক। এ ছাড়া ভারতের জন্য এত বিপুলসংখ্যক লোকের ভরণ-পোষণ ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে কঠিন। অন্য দিকে ভূখণ্ড মানবিক সমস্যা নয়। ভূখণ্ড হজম করা যায়। কিন্তু যুদ্ধবন্দীদের হজম করা যায় না। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে হারানো ভূখণ্ড আরবেরা ফেরত পায়নি। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ যত গভীর ভূখণ্ডের প্রতি ততটা নয়। এ যুক্তিতে তিনি ভূখণ্ডকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ভুট্টোর যুক্তিতে বেনজির আশ্বস্ত হন। ভুট্টো ঠিক কথাই বলেছিলেন। তিনি হারানো ভূখণ্ড ও যুদ্ধবন্দী উভয়ই ফেরত পান। ১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে উপমহাদেশের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। পাকিস্তান ভেঙে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য বন্দী হয় এবং লাখ লাখ অবাঙালি আটকা পড়ে। অন্য দিকে পাকিস্তানে ২৮ হাজার বাঙালি সৈন্যকে আটক করা হয় এবং ১৬ হাজার সরকারি কর্মচারীসহ সাড়ে তিন লাখ বাঙালি আটকা পড়ে। বাংলাদেশে ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলে এসব আটক বাঙালিকে বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে দরকষাকষিতে জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আগ্রহ ব্যক্ত করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অনুকূল সাড়া দেন। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইমের কাছে যেকোনো সময় যে কোনো স্থানে পূর্বশর্ত ছাড়া ভুট্টোর সাথে সরাসরি আলোচনা অনুষ্ঠানের আগ্রহ প্রকাশ করে একটি চিঠি পাঠান। ইন্দিরা গান্ধী প্রস্তাব করেন যে, শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্যের জন্য আলোচনার রূপরেখা প্রণয়নে উভয় দেশের বিশেষ দূতগণ বৈঠকে বসবেন। ভুট্টো ইন্দিরা গান্ধীর প্রস্তাবে সম্মত হন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধরের নেতৃত্বে একটি ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সাথে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও প্রতিরা প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদের নেতৃত্বে একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধিদল মারিতে ১৯৭২ সালের ২৬-২৯ এপ্রিল বৈঠকে মিলিত হয়। ২ জুলাই রাত সাড়ে ১২টায় ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্যসচিব পি এন হাকসার ঘোষণা করেন যে, উভয় প ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এ ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিমলা চুক্তি স্বারিত হয়। সিমলা চুক্তিতে সন্নিবেশিত নীতিগুলো দু’টি দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে পরবর্তী পদপে গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়। এ চুক্তি দ্বিপীয় আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তিতে দু’টি দেশকে বাধ্য করে। সিমলা চুক্তিতে পুনরায় কাশ্মির ইস্যু প্রাধান্য লাভ করে। চুক্তিতে ১৯৪৯ সালে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে কার্যকর যুদ্ধবিরতি রেখা নিয়ন্ত্রণ রেখায় রূপান্তরিত হয়। কাশ্মিরে দুই দেশের সীমান্তে ৭৪০ কিলোমিটার লাইনকে সীমান্ত রেখা (এলওসি) হিসেবে নামকরণ করা হয়। নিয়ন্ত্রণ রেখা কার্যকর হলে কাশ্মিরে ভূখণ্ডগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। চুক্তিতে বলা হয়, পরিবর্তন করা ছাড়া উভয় প ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতিকালে কার্যকর স্বীকৃত অবস্থাকে সম্মান করবে। অঙ্গীকার করা হয় যে, পারস্পরিক মতপার্থক্য এবং আইনগত ব্যাখ্যা নির্বিশেষে কোনো প একতরফাভাবে এ নিয়ন্ত্রণ রেখা পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না। চুক্তিতে স্বার করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রতিশ্র“তি দেন যে, তার দেশ জম্মু ও কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখাকে দু’টি দেশের কার্যত সীমান্ত হিসেবে মেনে নেবে এবং এ সীমান্তকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে না। চুক্তিতে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বলেন যে, চুক্তিতে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে অভ্যন্তরীণভাবে তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে। সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি মতাচ্যুত হবেন। ইন্দিরা গান্ধী সহৃদয়তার সাথে তার কথা মেনে নেন। সিমলা চুক্তির কোথাও ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর কোনো উল্লেখ ছিল না এবং বাংলাদেশ এ চুক্তির কোনো প ছিল না। বাংলাদেশকে বাদ দেয়ায় চুক্তির সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। সিমলা চুক্তির সাফল্য নিশ্চিত করতে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যাবাসনে আরেকটি সম্পূরক চুক্তি করা হয়। সম্পূরক চুক্তির আওতায় ভারত ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ ৯২ হাজার ৭৫৩ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেয়। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আরেকটি চুক্তি হয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে সৃষ্ট ত নিরসনে তাসখন্দ চুক্তি করা হয়। এ চুক্তি স্বারে সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যস্থতা করে। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু সিমলা চুক্তি স্বারে বাইরের কোনো দেশ চাপ সৃষ্টি অথবা মধ্যস্থতা করেনি। এ চুক্তি ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি দ্বিপীয় চুক্তি। সিমলা চুক্তি স্বারের সময় ভারতের বিপরীতে পাকিস্তানের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান পাকিস্তানে রূপান্তরিত হয়। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে দেশটির মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট দেখা দেয়। ভারতীয় সৈন্যদের হাতে শুধু বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের পতন ঘটে তা-ই নয়, পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড হারায়। এ ছাড়া পূর্ব রণাঙ্গনে বন্দী হয় ৯৩ হাজার সৈন্য। পান্তরে পাকিস্তানের হাতে বন্দী হয় মাত্র ৬১৬ জন ভারতীয় সৈন্য এবং দেশটি দখল করে ৩৫৯ বর্গকিলোমিটার ভারতীয় ভূখণ্ড। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান তার ৫৫ হাজার বর্গমাইল আয়তনের ভূখণ্ড এবং অর্ধেক জনশক্তি হারায়। দণি এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে দেশটির ভূমিকা গৌণ হয়ে যায়। দ্বিজাতিতত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তি কেঁপে ওঠে। অখণ্ড পাকিস্তানে বাঙালিদের ধরে রাখতে ইসলামি পরিচিতি অপর্যাপ্ত বলে প্রমাণিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মর্যাদা মারাত্মকভাবে ুণœ হয়। পাকিস্তানিরা পরাজয় মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। পাকিস্তানের প্রচারমাধ্যমে বিজয়ের কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করা হয়েছিল। চাপের মুখে জেনারেল ইয়াহিয়া খান পদত্যাগে বাধ্য হন এবং ১৯৭১ সালের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে মতা হস্তান্তর করেন। ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন। সিমলা চুক্তিতে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তান সরকার অঙ্গীকার করছে যে, দু’টি দেশ সঙ্ঘাত ও সংঘর্ষের পথ পরিহার করবে। সঙ্ঘাত তাদের সম্পর্ককে তিগ্রস্ত করেছে এবং সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করবে। দু’টি দেশ উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে যাতে তারা তাদের নিজ নিজ দেশের জনগণের কল্যাণে তাদের সম্পদ ও শক্তি নিয়োজিত করতে পারে। এ ল্য অর্জনে ভারত ও পাকিস্তান সরকার সম্মত হচ্ছে যে : ১. জাতিসঙ্ঘ সনদের নীতিমালা ও উদ্দেশ্যাবলি দু’টি দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করবে। ২. দু’টি দেশ দ্বিপীয় আলাপ-আলোচনা অথবা পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য অন্য যেকোনো ধরনের শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের মধ্যকার মতপার্থক্য নিরসন করবে। দু’টি দেশের মধ্যে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি নাগাদ কোনো প একতরফাভাবে বিদ্যমান অবস্থা পরির্বতন করবে না এবং দু’টি দেশ শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রতি তিকর যেকোনো ধরনের কর্মকাণ্ড সংঘটনে সহায়তা বা উৎসাহ জোগাবে না। ৩. উভয় দেশ অঙ্গীকার করেছে যে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সম্প্রীতি, সৎপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাব ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি পূর্বশর্ত এবং একে অন্যের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান করবে, একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তপে করা থেকে বিরত থাকবে। ৪. বিগত ২৫ বছর ধরে যেসব বিরোধ দু’টি দেশের সম্পর্ককে ব্যাহত করেছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সেসব বিরোধের মূল উৎস ও কারণ খুঁজে বের করা হবে এবং বিরোধগুলো মীমাংসা করা হবে। ৫. তারা সর্বদা একে অন্যের জাতীয় ঐক্য, ভৌগোলিক অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌম মর্যাদাকে সম্মান করবে। ৬. জাতিসঙ্ঘ সনদ অনুযায়ী তারা একে অন্যের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে হুমকি অথবা শক্তিপ্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। ৭. উভয় সরকার একে অন্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত বৈরী প্রচারণা বন্ধে তাদের মতার আওতায় যেকোনো পদপে গ্রহণ করবে। উভয় দেশ তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নে সহায়ক তথ্য পরিবেশনে উৎসাহ দান করবে। ৮. ধাপে ধাপে দু’টি দেশের দ্রুত সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ এবং সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠায় উভয় দেশ সম্মত হচ্ছে যে : ক. যোগাযোগ, ডাক, টেলিগ্রাফ, সমুদ্র, সীমান্তচৌকিসহ স্থল ও বিমানসহ আকাশ সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পদপে গ্রহণ করবে। খ. অন্য দেশের নাগরিকদের ভ্রমণ সুবিধার উন্নয়নে উপযুক্ত পদপে গ্রহণ করা হবে। গ. যত দ্রুত সম্ভব অর্থনৈতিক এবং সম্মত অন্যান্য েেত্র বাণিজ্য ও সহযোগিতা পুনরায় চালু করা হবে। ঘ. বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ে উৎসাহ দান করা হবে। এ উদ্দেশ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদল মাঝে মাঝে বৈঠকে মিলিত হয়ে প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ করবে। ঙ. স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু করতে উভয় দেশ সম্মত হচ্ছে যে : Ñক. ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্যদের আন্তর্জাতিক সীমান্তে তাদের নিজ নিজ ভূখণ্ডে প্রত্যাহার করা হবে। Ñখ. জম্মু ও কাশ্মিরে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতিকালে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রেখাকে উভয় প একে অন্যের স্বীকৃত অবস্থার পরিবর্তন করা ছাড়া সম্মান করবে। পারস্পরিক মতপার্থক্য এবং আইনগত ব্যাখ্যা নির্বিশেষে কোনো প একতরফাভাবে এ নিয়ন্ত্রণ রেখা পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না। উভয় প নিয়ন্ত্রণ রেখা লঙ্ঘনে হুমকি অথবা শক্তিপ্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকবে। Ñগ. এ চুক্তি কার্যকর হওয়া মাত্র সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হবে এবং ৩০ দিনের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হবে। Ñঘ. নিজ নিজ সাংবিধানিক পদ্ধতি অনুযায়ী উভয় দেশ এ চুক্তি অনুমোদন করবে এবং অনুমোদনের দলিল বিনিময়ের তারিখ থেকে চুক্তি কার্যকর হবে। Ñঙ. উভয় দেশ সম্মত হচ্ছে যে, তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রপ্রধান ভবিষ্যতে সুবিধাজনক সময়ে পুনরায় বৈঠকে মিলিত হবেন এবং ইতোমধ্যে যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক লোকদের প্রত্যাবাসন, জম্মু ও কাশ্মির সমস্যার চূড়ান্ত মীমাংসা এবং পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাসহ একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের রূপরেখা ও ব্যবস্থাদি নিয়ে উভয় পরে প্রতিনিধিগণ আলোচনায় মিলিত হবেন। চুক্তিতে ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের পক্ষে প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো স্বার করেন নয়াদিল্লিতে দ্বিপীয় চুক্তি ভারত যুদ্ধবন্দীদের ফেরত দানে অস্বীকৃতি জানালে ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপীয় একটি চুক্তি হয়। বাংলাদেশ এ চুক্তির অংশীদার না হলেও তাতে সম্মতি দেয়। এ চুক্তি ছিল মূলত একটি প্যাকেজ ডিল। এ ডিলের আওতায় বিষয় ছিল ৫টি। ১. পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের প্রত্যাবাসন; ২. বাংলাদেশ থেকে অবাঙালি উর্দুভাষীদের প্রত্যাবাসন; ৩. ভারতে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক লোকদের প্রত্যাবাসন; ৪. ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর ভবিষ্যৎ মর্যাদা নির্ধারণ; এবং ৫. বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি। দিল্লি এগ্রিমেন্ট সিমলা চুক্তি স্বার করার পর বাংলাদেশের শূন্যতা অনুভূত হয়। বাংলাদেশ সমস্যার একটি প হওয়ায় দিল্লিতে ত্রিপীয় চুক্তি করার প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে এ চুক্তি করা হয়। এ চুক্তি দিল্লি এগ্রিমেন্ট নামে পরিচিত। দিল্লি চুক্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও প্রতিরা প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ স্বার করেন। নয়াদিল্লি চুক্তিতে আশা প্রকাশ করা হয় যে, আটকে পড়াদের প্রত্যাবাসন উপমহাদেশে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে এবং তিন দেশের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। ১৯৫ পাকিস্তানি সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী এবং হাজার হাজার অবাঙালি উর্দুভাষীকে পাকিস্তানে এবং একইভাবে আটকে পড়া বাঙালিদের পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ফেরত পাঠানো ছিল এ চুক্তির ল্য। বাংলাদেশ এ মানবিক সঙ্কট নিরসনে ভারতের সাথে কাজ করে। দিল্লিতে স্বারিত ত্রিপীয় চুক্তিতে বলা হয় : ১. ১৯৭২ সালের ২ জুলাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী সিমলাতে একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বার দান করেন। এ চুক্তিতে তারা অঙ্গীকার করেন যে, দু’টি দেশ সঙ্ঘাত ও সংঘর্ষের পথ পরিহার করবে। সঙ্ঘাত তাদের সম্পর্ককে তিগ্রস্ত করেছে এবং দু’টি দেশ সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করবে এবং উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। এ চুক্তিতে পারস্পরিকভাবে সম্মত উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। ২. বাংলাদেশ সিমলা চুক্তিকে স্বাগত জানায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উপমহাদেশে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সৎপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাব এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তির উদ্দেশ্যাবলির প্রতি দৃঢ় সমর্থন দান করছেন। ৩. ১৯৭১ সালের মর্মান্তিক ঘটনায় সৃষ্ট মানবিক সমস্যা উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে একটি গুরুতর অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। পাকিস্তান স্বীকৃতি না দেয়ায় বাংলাদেশের পে মানবিক সমস্যা নিরসনে ত্রিপীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। সার্বভৌম সমতা ছাড়া বাংলাদেশ এ ধরনের বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে পারে না। ৪. ভারত ও বাংলাদেশ স্বীকৃতির রাজনৈতিক সমস্যা বাদ দিয়ে ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল মানবিক সমস্যার অচলাবস্থা নিরসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদপে গ্রহণ করে। একই দিন জারিকৃত এক ঘোষণায় তারা বলেছে যে, তারা উপমহাদেশে উত্তেজনা হ্রাস, বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় একযোগে কাজ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ ল্েয অনুপ্রাণিত হয়ে এবং উপমহাদেশে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, শান্তি ও স্থিতিশীলতার বৃহত্তর স্বার্থে তারা যৌথভাবে প্রস্তাব করছে যে, কয়েকটি অভিযোগে বাংলাদেশে বিচারের জন্য পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের ছাড়া মানবিক বিবেচনার ভিত্তিতে একযোগে প্রত্যাবাসনের মধ্য দিয়ে সব বন্দী ও আটকে পড়া লোকদের সমস্যার নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। ৫. এ ঘোষণার পর ভারত ও বাংলাদেশ এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উপর্যুপরি আলোচনা হয়। এসব আলোচনার পরিপ্রেেিত বাংলাদেশের সম্মতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট দিল্লিতে একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে অমীমাংসিত মানবিক সমস্যার একটি সমাধান দেয়া হয়। ৬. এ চুক্তি বাস্তবায়নে ১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ত্রিমুখী প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এ পর্যন্ত আনুমানিক ৩ লাখ লোককে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। এতে শান্তির একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। ৭. ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ায় সার্বভৌম মর্যাদার ভিত্তিতে বাংলাদেশ দিল্লিতে ত্রিপীয় বৈঠকে যোগদানে সম হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও প্রতিরা প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ ১৯৭৪ সালের ৫ থেকে ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে বৈঠকে মিলিত হন এবং দিল্লি চুক্তিতে উল্লিখিত বিভিন্ন বিষয় বিশেষ করে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর ভাগ্য এবং ত্রিমুখী প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। ৮. মন্ত্রীরা ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট স্বারিত দিল্লি চুক্তিতে উল্লিখিত ত্রিমুখী প্রত্যাবাসনের অগ্রগতি পর্যালোচনা করেছেন। মন্ত্রীরা সন্তোষ প্রকাশ করেন যে, তখন পর্যন্ত তিনটি দেশে আটকে পড়া বিপুলসংখ্যক লোক তাদের গন্তব্যে পৌঁছেছে। ৯. মন্ত্রীগণ ত্রিমুখী প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়াকে একটি সন্তোষজনক পরিণতিতে নিয়ে যেতে গৃহীত প্রয়োজনীয় পদপে বিবেচনা করেছেন। ১০. ভারতীয় প উল্লেখ করেছে যে, দিল্লি চুক্তির আওতায় ভারতে অবশিষ্ট পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক আটক ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসন করা হবে। আনুমানিক সাড়ে ৬ হাজার লোককে এক দিন অন্তর নিয়মিত ট্রেনে পাঠানো হবে এবং কুম্ভ মেলা উপলে ১৯৭৪ সালের ১০ থেকে ১৪ এপ্রিল ট্রেন চলাচল স্থগিত থাকায় ১৯ এপ্রিলের পর অতিরিক্ত ট্রেন চালু করা হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন