বুধবার, ১০ জুলাই, ২০১৩

গভীর ভাবসঙ্কটে আওয়ামী লীগ

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার মূল রূপকার ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর খ্যাতনামা নেতা গোলাম আযম। তিনি আজ কারা প্রাচীরের অন্তরালে। তার ভাবনা চিন্তা সম্পর্কে আমরা অবগত হতে পারছি না। তবে যত দূর অনুমান করতে পারি, তিনি চাচ্ছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন। কারণ তার দলের কর্মীরা আন্দোলন করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের। মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাচ্ছে কি না, সেটা স্থির করার জন্য করা যেতে পারে গণভোট। গণভোটের ধারণা আমাদের কাছে এখন আর অপরিচিত নয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া গণভোটের নজির স্থাপন করে গিয়েছেন। সব দেশেই গণভোট এখন হয়ে উঠেছে জনমত নিরূপণের প্রকৃষ্ট পন্থা। গণভোটব্যবস্থা উদ্ভব হয়েছিল সুইজারল্যান্ডে। কিন্তু এখন এটা স্বীকৃতি পেয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশেই।
শেখ হাসিনা বলছেন, পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আমাদের দেশেও সেভাবেই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সব দেশেই কি অবিকল একইভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়? বিলাতে নির্বাচন হয় এক দিনে। কিন্তু বিলাতের কাছের দেশ ফ্রান্সে জাতীয় নির্বাচন হয় দুই দফায়। প্রথম দফায় যেসব সংসদীয় আসনে প্রার্থীরা মোট ভোটের শতকরা ৫১ ভাগ কি তা অপেক্ষা বেশি ভোট লাভ করেন, তারা হন চূড়ান্ত সংখ্যক ভোটে নির্বাচিত (Absolute majority)। দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোট সেসব আসনেই অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কোনো প্রার্থীই প্রথম দফার ভোটে ৫১ শতাংশ ভোট পেতে পারেন না। দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যালটে বিভিন্ন আসনে যারা অন্য প্রার্থীদের চেয়ে বেশি ভোট লাভ করেন (Relative majority) তারা ঘোষিত হন নির্বাচিত হিসেবে। ফরাসিরা মনে করেন, দ্বিতীয় ব্যালট ব্যবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলী অনেক ভেবেচিন্তে ভোট দিতে পারেন। তাই নির্বাচন হতে পারে অনেক সুষ্ঠুভাবে। বিখ্যাত দার্শনিক জঁ জাক্ রুশো (১৭১২-১৭৭৮) তার সাড়া জাগানো Le Contrat Social বইতে বলেন, ব্রিটিশ গণতন্ত্র মোটেও আদর্শ গণতন্ত্র নয়। কেন না, ব্রিটিশ গণতন্ত্রে ভোট দেয়ার পর ভোটারেরা হয়ে পড়েন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির আজ্ঞাবহ। তারা কোনো ভুল করলে অথবা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে নির্বাচকমণ্ডলী তাদের পদচ্যুত করতে পারেন না। তাদের সেই স্বাধীনতা নেই। জঁ জাক্ রুশো জন্মেছিলেন সুইজারল্যান্ডে। সুইজারল্যান্ডে আছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পদচ্যুতির (Recall) বিধান। নির্বাচকমণ্ডলী বিধানসভায় দরখাস্ত করে তাদের প্রতিনিধিকে আর প্রতিনিধি নন বলে ঘোষণা করতে পারেন। যদি সংখ্যাগুরু ভোটার এই দরখাস্তে স্বাক্ষর দান করেন তবে নির্বাচিত প্রতিনিধির পদচ্যুতি ঘটে। তিনি আর জনপ্রতিনিধি থাকেন না। আমাদের দেশে কেবল পার্লামেন্টের সদস্যরাই আইন প্রণয়ন করতে পারেন। কিন্তু সুইজারল্যান্ডে নির্বাচকমণ্ডলী কোনো আইন পাস করার জন্য সংসদে প্রস্তাব পাঠাতে পারেন। সংসদ তা গণভোটের মাধ্যমে আইনে পরিণত করতে পারে। এই ব্যবস্থাকে বলে গণ-উদ্যোগ (Initiative)। সুইচ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পরিষদে (Federal Council) সাতজন সদস্য থাকেন। এই সাতজন সদস্যের মধ্যে থেকে এক একজনকে নির্বাচন করা হয় প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতার দিক থেকে বিচার করলে প্রেসিডেন্ট আর ছয়জন সদস্যের চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন নন। আমি এসব কথা বলছি এই কারণে যে, সব দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো অবিকল একই রকম নয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো যে অবিকল অন্য কোনো দেশের মতো হবে তা মনে করার কোনো ভিত্তি নেই। বাংলাদেশ তার আপন প্রয়োজনে আপন গণতান্ত্রিক কাঠামোকে গড়ে নিতেই পারে।
কমিউনিস্টদের পরম গুরু কার্র্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) বহু দিন ইংল্যান্ডে বাস করেছিলেন। তিনি মারা যান লন্ডনে। মার্কস বিলাতে চার্টিস্ট (Chartist) আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। চার্টিস্ট আন্দোলন বিলাতে হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে। চার্টিস্টদের দাবি ছিল সব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে ভোটাধিকার দিতে হবে। সে সময় বিলাতে কেবল সেসব প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষই ভোট দিতে পারতেন, যাদের থাকত একটা বিশেষ মাত্রার সম্পত্তি। চার্টিস্টরা এর বিরোধিতা করেন। তারা দাবি করেন, ভোট হতে হবে গোপনে এবং ব্যালট পেপারের মাধ্যমে। নির্বাচনের এলাকা হতে হবে যত দূর সম্ভব সমমাপের। যারা পার্লামেন্টে নির্বাচিত হবেন, তাদের দিতে হবে বেতন। এবং প্রতি বছর কমপক্ষে একবার করে হতে হবে পার্লামেন্টের অধিবেশন। মার্কস সেই দাবিগুলোকে সমর্থন করে বলেন, বিলাতের মানুষ হয়ে উঠেছেন যথেষ্ট রাজনীতি-সচেতন। ভোটের মাধ্যমে এক দিন বিলাতে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারবে। লেনিন কিন্তু বিলাতের গণতন্ত্রকে স্বীকার করতে চাননি। তিনি বলেন, বিলাতের গণতন্ত্র মূলত হলো বড়লোকদের ব্যাপার। কারণ বড়লোকেরা টাকার জোরে বিলাতের জনমতকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন। লেনিন বিলাতে ছিলেন বেশ কিছু দিন। তিনি ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে এক সামরিক ক্যু-দেতার মাধ্যমে রাশিয়ায় ক্ষমতায় আসেন। এবং প্রতিষ্ঠা করতে পারেন কমিউনিস্টদের শাসন। রাশিয়ায় যে সামান্য পরিমাণ বহুদলীয় গণতন্ত্র ছিল লেনিনের ক্ষমতা দখলের পর তা পায় বিলুপ্তি। লেনিনবাদ উদার গণতন্ত্রে আস্থাবান নয়। লেনিন সর্বপ্রকার পার্লামেন্টারিলিজমের বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন না, সরকারের ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্য বিধানে। তিনি মনে করতেন সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকতে হবে একটি মাত্র বিদ্রোহী দলের হাতে। না হলে, শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়া সম্ভব হবে না। শেখ মুজিব এক পর্যায়ে ছিলেন উদার গণতন্ত্রী। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তিনি গ্রহণ করেন কার্যত লেনিনবাদ। প্রতিষ্ঠা করেন একদলের রাজত্ব। গঠন করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল। এই বাকশালে সামিল হয় মনিসিংহের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। মনিসিংহের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুগত। ন্যাপও ছিল তাই। সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশে তারা শামিল হয়েছিল বাকশালে। সেই থেকে আওয়ামী লীগের ওপর প্রতিষ্ঠা পেতে পেরেছে লেনিনবাদীদের প্রভাব। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়েছে। মানুষ রাশিয়ায় এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আর ১৪টি রিপাবলিকে এখন আর লেনিনবাদী নয়। তারা চাচ্ছে, বহুদলীয় গণতন্ত্র। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্চর্যজনকভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে পেরেছেন লেনিনপন্থী কমিউনিস্টরা। তারাই নির্ধারিত করছেন আওয়ামী লীগের নীতি। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে এখনো আছেন, যারা লেনিনবাদী নন। আওয়ামী লীগে গভীর ভাবসঙ্কট সৃষ্টি হতে পারছে লেনিনবাদী বনাম উদার গণতন্ত্রবাদীদের মধ্যে মতবাদিক পার্থক্যের কারণে। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বর্তমান মন্ত্রিসভার মধ্যে রয়েছে লেনিনবাদীদের প্রাধান্য। এই পত্রিকার মতেÑ ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, আ ফ ম রুহুল হক, নুরুল ইসলাম নাহিদ, শাহজাহান খান, অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান, ইয়াফেস ওসমান প্রমুখ আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা এক সময় ছিলেন সোভিয়েতপন্থী। হাসানুল হক ইনু সোভিয়েতপন্থী ছিলেন না। কিন্তু তিনিও ছিলেন মার্কসবাদী। তিনি চান বাংলাদেশে বৈাজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। দিলিপ বড়–য়া মার্কসবাদী। কিন্তু তিনি ছিলেন কিছুটা চৈনিক কমিউনিস্ট ভাবধারা সম্পন্ন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ উল আলম লেনিন তার জীবনে এক পর্যায়ে ছিলেন লেনিনপন্থী। (তথ্য উৎস : আলোকিত বাংলাদেশ; ২৭ জুন, ২০১৩)।
বাংলাদেশের সুশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মার্কসবাদের একটা প্রভাব থাকতে দেখা যায়। তাই মার্কসবাদ সম্পর্কে সামান্য কিছু আলোচনা মনে করছি বর্তমান অবস্থায় হবে প্রাসঙ্গিক। কার্ল মার্কস তার ডক্টরেট ডিগ্রি করেছিলেন প্রাচীন গ্রিক বস্তুবাদী দার্শনিক দিমোক্রিতাস-এর গবেষণা করে। মার্কস ছাত্রজীবন থেকেই হয়ে ওঠেন জড়বাদী বা মেটিরিয়ালিস্ট। কিন্তু মার্কস দার্শনিক হিসেবে যত না খ্যাত, তার চেয়ে বহু গুণে প্রসিদ্ধি পেতে পেরেছেন তার অর্থনৈতিক মতবাদগুলোর কারণে। অর্থনীতির ওপর তার লেখা বই Das Kapital  হলো সবচেয়ে বিখ্যাত। কিন্তু মার্কস তার Das Kapital বইটি লেখার আগে অর্থনীতির ওপর আর একটি বই লেখেন। বইটির নাম Zur kritik der politischen okonomie। অনেক মার্কস বিশেষজ্ঞের মতে এই বইটির মধ্যে মার্কসের অর্থনৈতিক চিন্তার একটি সহজ পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। মার্কস উৎপাদিকা শক্তি বলতে বুঝিয়েছেন- কাজ জানা দক্ষ শ্রমিক, প্রাকৃতিক সম্পদ, উৎপাদনের (জিনিস তৈরির) জন্য যন্ত্রপাতি, কলকারখানা, উৎপাদনের পরিবেশ এবং উৎপাদনের সহায়ক সব কিছুকে। মার্কসের মতে উৎপাদিকা শক্তি নিয়ে আলোচনা করে বুঝতে হবে একটি অর্থনীতির উৎপাদিকা শক্তিকে। অর্থনীতির বিশ্লেষণে উৎপাদিকা শক্তির বিশ্লেষণ খুবই গুরুত্ববহ। মার্কস উৎপাদনী সম্পর্ক বলতে বুঝিয়েছেনÑ  উৎপাদনে অংশগ্রহণ করার সময় অংশগ্রহণকারী মানুষগুলোর মধ্যে যে সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তাকে। যেমন- মালিক ও শ্রমিকের মধ্যকার সম্পর্ক। যেহেতু মালিক ও শ্রমিক সমানভাবে উৎপাদনের ফল ভোগ করতে পারে না। তাই মালিক শ্রমিক সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই সঙ্ঘাত এড়াতে হলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে। যেখানে মালিক শ্রেণী বলে কিছু থাকবে না। উৎপাদন পরিচালনার ভার গ্রহণ করবেন শ্রমিকেরাই। অথবা শ্রজীবীদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র। এ সম্পর্কে মার্কস অবশ্য বিস্তারিতভাবে কিছু বলেননি। রাষ্ট্রিক পরিকল্পনা অনুসারে অর্থনীতিকে গড়ে তোলা ও পরিচালনার ধারণাটি এসেছে জার্মান দার্শনিক ফিক্ট (Johann Gottlieb Fichte; 1762-1814)-এর কাছ থেকে। জোসেফ স্টালিন (১৮৭৯-১৯৫৩) রাষ্ট্রিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে চান। সমাজতন্ত্র বলতে কার্যত বোঝাতে থাকে রাষ্ট্রিক পরিকল্পনা অনুসারে অর্থনৈতিক জীবনের পরিচালনা ও উন্নতি বিধানকে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করতে পারেনি। পারেনি মেহনতি মানুষের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে। বাংলাদেশে তৈরী পোশাক শিল্পে নিয়জিত শ্রমজীবী মানুষ ধর্মঘট করছেন তাদের কর্মের পরিবেশ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য। যেহেতু জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য উচ্চহারে মজুরি লাভ প্রয়োজন, তাই তারা দাবি করছেন উচ্চহারে মজুরি, যা দিতে সম্মত হচ্ছেন না গার্মেন্টের মালিকপক্ষ। এই শ্রেণী সঙ্ঘাতের সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না আওয়ামী লীগের বাম বুদ্ধিজীবীরা। এ কারণেও সৃষ্টি হতে পারছে আওয়ামী লীগের ভাবসঙ্কট। আশ্চর্যজনকভাবে ধনতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসতে চাচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টের শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে। আওয়ামী লীগ সরকার ঠিক করতে পারছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এ ক্ষেত্রে তার কী ধরনের সমঝোতা হওয়া উচিত। এটাও ডেকে আনছে আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবসঙ্কট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন