সোমবার, ১ জুলাই, ২০১৩

যে ইতিহাস প্রায় বিস্মৃত

পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বছর ১ জুলাই এ বিশ্ববিদ্যালয় পা রাখতে যাচ্ছে ৯২ বছরে। বঙ্গভঙ্গ রদ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে, পূর্ব বাংলার আশাহত, বিক্ষুব্ধ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সান্ত¡না দিতে ও বিক্ষোভ প্রশমিত করতে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজ এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। বাহ্যিকভাবে আমরা এমনটি জানলেও সুচতুর ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। ‘মুসলমানদের অগ্রগতি’Ñ এমন মহৎ উদ্দেশ্য তাদের মধ্যে ছিল না। ব্রিটিশেরা তাদের রাজত্ব দীর্ঘস্থায়ী করতে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। প্রথমত, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে মুসলমানেরা ছিল বিক্ষুব্ধ। এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ রেখে শাসন দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে নাÑ এমন উপলব্ধি থেকে শাসনক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার কূটকৌশলের অংশ হিসেবে ব্রিটিশ সরকার এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়।
ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ‘বঙ্গভঙ্গ’ প্রদেশ কার্যকর হয়। শিক্ষাদীক্ষাসহ সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য বঙ্গভঙ্গ ছিল এগিয়ে যাওয়ার একটি সোপান। হিন্দু নেতাদের বড় অংশটি ছিল এর প্রচণ্ড বিরোধী। তারা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ বাতিলে বাধ্য করে। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’ ঘোষিত হয়। এ খবর পুর্ব বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত মুসলমানদের কাছে ছিল যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানে মুসলিম সমাজে সার্বিক যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল, এ ঘোষণায় তা কর্পূরের মতো উবে যায়। মুসলিম সমাজ বিুব্ধ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালের ২৯ জানুয়ারি তিন দিনের এক সফরে ঢাকা আসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ ১৯ মুসলিম নেতার একটি প্রতিনিধিদল ৩১ জানুয়ারি গভর্নর জেনারেলের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে পূর্ববাংলার মুসলমানেরা সব দিক থেকে যে তিগ্রস্ত হবে এ বিষয়টি জানিয়ে তা পুনর্বহালের দাবি জানান। না হয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে কমপে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জোরালো দাবি তোলেন। জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেনÑ ‘ÔThe Government of India realised that education was the true salvation of the Muslims and that the Government of India, as an earnest of their intentions, would recommend to the Secretary of State for the constitution of University of Dacca. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এ ঘোষণা এবং পদক্ষেপ বিশাল বিতর্কের সৃষ্টি করে। আবারো বাধার সৃষ্টি করেন হিন্দু নেতারা। তারা প্রবল বিরোধিতা করতে থাকেন। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন সভা-সমিতি ও পত্রপত্রিকায় জনমত গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রকাশ করতে থাকেন।
বিরোধিতার ক্ষেত্রে অন্যান্য হিন্দু নেতার মতো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৯১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে কলকাতার গড়ের মাঠে একটি সভা হয়। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্বকবি নিজে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্য হিন্দু নেতাদের বিরোধিতার বিষয়টি জাতীয় অধ্যাপক ইন্নাছ আলী তার ‘সমাজ ও রাজনীতি’ বইয়ে স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হিন্দু নেতারা মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়, ফুক্কাহ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি আখ্যায়িত করে বিদ্রƒপ করেছেন সে সময়। অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ তার ‘বঙ্গভঙ্গ : তৎপরর্তী সমাজ ও রাজনীতি’ বইয়ে এ নিয়ে যেমনটি লিখেছেন, ‘বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে আশাহত পূর্ববঙ্গবাসীদের জন্য সান্ত¡না হিসেবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি ব্রিটিশ শাসকরা দেয় সেটি হিন্দু ভদ্রলোকদের বিরোধিতার মুখে ১০ বছর বিলম্বিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশে প্রগতি, আধুনিকতা ও উন্নত সংস্কৃতি ও সভ্যতা নির্মাণে যত রকম প্রয়াস আমরা লক্ষ করি, এর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯২১ সালে এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না হলে আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম না। বঙ্গভঙ্গ না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ও হতো না।’ বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ল্েয তদানীন্তন ভারত সরকার একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্বিত হতে থাকায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের মনে সরকারের সদিচ্ছার ব্যাপারে সন্দেহ বাড়তে থাকে। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিষয়টি ১৯১৭ সালের ৭ মার্চ রাজকীয় আইন পরিষদে উত্থাপন করেন এবং ২০ মার্চ সরকারের কাছে অচিরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রেক্ষাপটে রাজকীয় আইন পরিষদের সমাপনী অধিবেশনে ১৯১৭ সালের ২৩ এপ্রিল এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আশ্বাস দেয়া হয়। নাথান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশাল জমির প্রয়োজন দেখা দেয়। জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে নাÑ এমন অজুহাতেও প্রতিষ্ঠার কাজ বিলম্বিত হতে থাকে। এগিয়ে আসেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করেন জমিদারির বড় অংশটি। এ দিকে আর্থিক সঙ্কট নিরসনে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যে ভূমিকা রাখেন তাও অবিস্মরণীয়। টাঙ্গাইলে তার জমিদারির বিরাট একটা অংশ বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে বাংলার মুলমানেরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে সম হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত শিাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। সাত বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী উদযাপন করবে।
এহসানুল হক জসীম
লেখক : সাংবাদিক
ehsan.jasim@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন