শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৩

ভারতের কালো দিনগুলো ও বর্তমান অবস্থার মধ্যে পার্থক্য নেই

ভারতকে তার ইতিহাসের কিছু দিনের কথা কখনোই ভুলে গেলে চলবে না। এর একটি হলো ২৬ জুন। ৩৮ বছর আগের ওই দিনের গভীর রাতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং দেশ স্বৈরশাসনের অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ এবং স্বাধীনতাকে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছিল। সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্য সরকার অপমানজনক কর্মকাণ্ড, ক্ষতি, আটক ইত্যাদির মাধ্যমে একটি অবৈধ কর্তৃপক্ষে পরিণত হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি নির্বাচনী অপরাধের দায়ে পার্লামেন্ট থেকে অপসারিত ও পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতিতে অযোগ্য ঘোষণা করার পর এসব ঘটনা ঘটে। তিনি ব্যাপকভাবে পরিচিত ‘এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়’-এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিদ্যমান ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে বিশেষ ক্ষমতার মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত আইন চালু করাকে শ্রেয় মনে করলেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে একনায়কতন্ত্র চালু করার কারণে উদার বিশ্বে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তিন দশক ধরে সাংবিধানিক রাজনীতি উপভোগ করার পর ভারতের জনগণের কাছে এই অবস্থা ছিল অবিশ্বাস্য। ইন্দিরা গান্ধীর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর এ-সংক্রান্ত একটি মন্তব্য ছিল তীè ও মর্মভেদী : ‘আমি শত্রুদের সেবা করতে পারি, কিন্তু আমি আমার বন্ধুদের কী বলব?’ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তার ছেলে সঞ্জয় গান্ধীর মাধ্যমে অধিকতর নিষ্ঠুর শাসন চালানো ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতো না। সঞ্জয় গান্ধী তখন সংবিধানের এখতিয়ারের বাইরের যেকোনো ক্ষমতাচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। তার হাতে ছিল অবাধ কর্তৃত্ব। এই জরুরি অবস্থা প্রায় দু’বছর স্থায়ী হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে নির্বাচন মাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল এবং ছেলেকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল।
তারা দু’জন যে স্বৈরাচারী আচরণ করেছিলেন তা ছিল লজ্জাকর। একটি রুচিহীন ও আপত্তিকর কাজ ছিল হাজার হাজার লোককে জোর করে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে বহু দূরের জনহীন প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়া। শিবসেনার মতো কয়েকটি চরমপন্থী সংগঠনের জন্য এগুলো একটি নজিরে পরিণত হয়েছিল। শিবসেনা কয়েক বছর পর বাংলাদেশীদের ধরে এনে জোরপূর্বক বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ঠেলে দেয়। প্রকৃতপক্ষে, ইন্দিরা গান্ধী বহু ক্ষতিকর নজির স্থাপন করেছিলেন। যেমন তিনি সিভিল সার্ভিস তথা আমলাদের বশংবদ বা দাসসুলভ মনোবৃত্তির এবং পুলিশকে শাসকদের খেয়ালখুশির প্রতি আনুগত্যশীল করে গড়ে তুলেছিলেন। বর্তমানে বহু মুখ্যমন্ত্রী (তারা কংগ্রেস পার্টির হওয়ার প্রয়োজন নেই) ইন্দিরা গান্ধীর মতোই সমালোচকদের শায়েস্তা করার জন্য আমলা এবং পুলিশদের ব্যবহার করছেন।
জরুরি অবস্থায় আরো দেখা গেছে, কিভাবে শক্তিশালী বিচার বিভাগ সহজে বেঁকে যায় অর্থাৎ সহজে প্রভাবিত হয়ে যায়। কথিত উদারপন্থী পিএন ভানুওয়াতিসহ সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন বিচারপতির মধ্যে চারজনই জরুরি অবস্থা আরোপ করাকে ন্যায্য তথা যুক্তিযুক্ত বলেছিলেন। একমাত্র বিচারপতি যিনি ওই রায়ের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেননি তিনি হলেন বিচারপতি এইচ আর খান্না। ইন্দিরা গান্ধী যখন ভারতের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন তখন বিচারপতি খান্নাকে সুপারসিড করা হয়েছিল। বিচার বিভাগকে তখনো দেখতে চূর্ণবিচূর্ণ অর্থাৎ দুর্বল দেখালে সেটার কারণ হচ্ছে ওই কালো দিনগুলোতে বিচার বিভাগের ওপর যে আঘাত এসেছিল সেই আঘাতের ধকল থেকে এখনো বিচার বিভাগ মুক্ত হতে পারেনি।
ইন্দিরার বাবা জওয়াহের লাল নেহরু ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি স্বাধীনতার পর একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলার জন্য মনস্থির করেছিলেন এবং তার প্রবৃদ্ধি অবলোকন করছিলেন। তিনি বিচার বিভাগের একটি উদাহরণ গ্রহণ করেছিলেন। একবার নেহরু তার নিজের ইচ্ছা অনুসারে বিচারপতি মেহর চাঁদ মহানজনকে সুপারসিড করার কথা চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু নেহরু দেখলেন, সুপারসিডের ঘটনা ঘটলে গোটা সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চই পদত্যাগের প্রস্তাব দেবে, তখন তিনি তার চিন্তাভাবনা অর্থাৎ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। অবশ্য পরে মহাজনকে ভারতের প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সবচেয়ে তিরস্কারযোগ্য বিষয় হচ্ছে, জোরপূর্বক পরিবার পরিকল্পনাব্যবস্থা গ্রহণ করানো। সঞ্জয় গান্ধীর দৃষ্টান্তে ইন্দিরা গান্ধী জোরপূর্বক বন্ধকরণ কর্মসূচি চালু করেন। কম ছেলেমেয়ে নেয়ার এই প্রয়াস কেবল নিন্দনীয়ই নয়, বরং যখন ওই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা হয় তখন দেখা যায় স্টালিন অথবা মাওজেদং যে ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন তার সাথে এর কোনো পার্থক্য নেই। জরুরি অবস্থার সময় ৬৫ বছরের বেশি বয়সের অনেক বৃদ্ধাকেও বন্ধ্যা করা হয় এবং এমনকি যেসব বালক মাত্র সাবালক হওয়ার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে তারাও এই বর্বরতার শিকার হয়েছে। এমনকি পুলিশকে যেকোনো ব্যক্তির বেডরুমে প্রবেশ করে তারা পরিবার পরিকল্পনার নির্দেশনা মেনে চলছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। বিচার ছাড়াই ডিটেনশন বা আটকাদেশ দেয়া হচ্ছে ঔপনিবেশিক আমল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। ইন্দিরা গান্ধী এক লাখেরও বেশি লোককে বিচার ছাড়াই কারাগারে আটক রেখেছিলেন। আজকের ট্র্যাজেডি হচ্ছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওইসব পদ্ধতির অনুসরণ করছেন। মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসবাদ  দমনের নামে গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের ওপর বিধি-নিষেধ বা কড়াকড়ি আরোপ করছে। বেআইনি কর্মকাণ্ড আইন অনুযায়ী একটি ওপেন কোর্ট অব ল’তে বিনা বিচারে জনগণকে আটক করা যায়। সরকার নিযুক্ত এডভাইজরি কমিটি এ ধরনের বিষয় বা মামলাগুলোকে অনুমোদন করত এবং জেলের ভেতরেই এ ধরনের বিচার সম্পন্ন করা হতো। বিখ্যাত চিকিৎসক ও রাজনৈতিক কর্মী ড. ভিনায়েক সেনকে এই আইনের আওতায় প্রথম আটক করা হয়। পরে বিজেপি শাসিত ঝাড়খণ্ড সরকার মাওবাদীদের সাথে ‘যোগাযোগ’ রাখার অভিযোগে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য অভিযুক্ত করে। ভারত কেন জরুরি অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়নি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাসকেরা গণতন্ত্রকে লাইনচ্যুত করার জন্য ইন্দিরা গান্ধী যে পথ অবলম্বন করেছিলেন সেই পথেই চলছেন তা ভেবে আমি প্রায় বিস্মিত হই। আমি মনে করি, এর কারণ হচ্ছে যে, যারা সীমালঙ্ঘন করে অপরাধ করে তাদের কোনো শাস্তি হয় না। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, যাদের দোষী হিসেবে পাওয়া যায় বর্তমানে তারা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের শাসনামলে রাষ্ট্রের বা সরকারের কাণ্ডারির ভূমিকায় রয়েছেন। জনতা পার্টির ব্যর্থতার কারণে দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রয়োজনে শাস্তি দেয়ার মতো বিষয়গুলো কেবল স্থগিতই করেননি বরং জরুরি অবস্থা বলবৎ না থাকা অবস্থায়ও জরুরি অবস্থার চেতনা যাতে অুণœ থাকে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য একই ধরনের কলঙ্কিত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। গণতন্ত্রের ক্ষতির বিষয়টি কমবেশি ভুলে যাওয়া হয়েছিল। দেশ কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে তরুণেরা জানত না। প্রবীণেরা যারা সে সময়ের কথা স্মরণ করেনÑ তারা অত্যন্ত নির্জীব ও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েন। সেটা ছিল একটা খারাপ স্বপ্নÑ যার অর্থ হচ্ছে সেটা ভুলে যেতে হবে। যাই হোক না কেন, বর্তমানে যখন নিরাপত্তা ও শান্তির নামে জরুরি অবস্থার সময়কার পদক্ষেপগুলো আবার গ্রহণ করা হচ্ছে, তখন মনে হচ্ছেÑ তখন ও এখনকার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
অবশ্যই জবাবদিহিতা থাকতে হবেÑ যেটা ছাড়া যে কেউ ক্ষমতায় গিয়ে তার ইচ্ছামতো কর্তৃত্ব দেখাতে কোনো ভয় পাবে না। লোকপাল বিল যেটা এখনো আলাপ-আলোচনার মধ্যে রয়েছে- কে দোষী এবং দোষীকে কিভাবে শাস্তি দেয়া যায় সেটা খুঁজে বের করার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অনমনীয়। লোকপাল প্রধানমন্ত্রী, বিচার বিভাগ অথবা পার্লামেন্ট সদস্যদের দুর্নীতিতে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগের বিষয় দেখতে না পারলে তাহলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন কী? সরকার কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোকে নিয়ন্ত্রণ করলে ব্যুরোর যেকোনো কার্যক্রম অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। প্রভুকে ধন্যবাদ, আর কোনো জরুরি অবস্থা বলবৎ করা যাবে না, কারণ পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই এবং রাজ্যসভাগুলোতেও একই অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।
লেখক : যুক্তরাজ্যে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত, সাবেক রাজ্যসভা সদস্য ও প্রখ্যাত সাংবাদিক
গালফ নিউজ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন