বুধবার, ১৯ জুন, ২০১৩

ভারতের রক্ত নোংরা করা গণতন্ত্র

গত সেপ্টেম্বরে, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের এক আইন প্রণেতা রাজ্যের আইনসভায় দাঁড়িয়েছিলেন এবং তার বাড়ির কাছে মানুষের লাশে ভরে থাকা এক উপত্যকার কথা বলেছেন। ‘আমাদের এলাকায় বড় গিরিখাদ আছে, যেখানে শত শত মানুষের কাকে খাওয়া হাড় রয়েছে’।
আমি এটি সুদূর লন্ডন থেকে পড়েছি এবং আমার শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল- আমি আমার একটি ফিকশন The Lost Boys of Held Kashmir বইতে এ ধরনের একটি উপত্যকা নিয়ে লিখেছি। আইনসভায় তর্ক চলছিল ভারতের আয়ত্তের সীমানায় মাঝে থাকা দু-হাজার অচিহ্নিত গণকবর নিয়ে।
ভারত সরকার রাজ্য মানবাধিকার সংস্থাকে রিপোর্টের জন্য নিযুক্ত করেছে এবং গণকবরের সামনে থেকে প্রথম দাফতরিক স্বীকারোক্তি পাওয়া গেছে। এই রিপোর্টে আরও লক্ষণীয়ভাবে দেখা গেছে, ওই মানুষদের যারা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার, ধারণা করা হয় তাদের মাটির গভীরের কিছু স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
লাশগুলো ট্রাকে করে আনা হয়েছিল এবং এগুলো চাপা দিতে বড় ধরনের খনন কাজ করা হয়েছিল। রিপোর্টে ২১৫৬ বুলেট বিদ্ধ দেহ পাওয়া গেছে এবং এগুলো অনুসন্ধান ও চিহ্নিত করার জন্য বলা হয়েছে। অনেককেই অচিহ্নিত যোদ্ধা বলে বর্ণনা করা হয়েছে- এরা ভারতের সঙ্গে ১৯৯০ সাল থেকে শুরু হওয়া সশস্ত্র যুদ্ধে মারা গেছে। কিন্তু রিপোর্ট অনুসারে মাত্র ৫০০ ব্যক্তি ছিল ওই এলাকার। রিপোর্টের উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘এটা যে কোনো কিছুই হতে পারে’, এই কবরগুলোতে আছে গুম হওয়াদের দেহ, সুন্দর করে যাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে- আটকে রাখা হয়েছে, অপহরণ করা হয়েছে, প্রায়ই ভারতীয় সেনা ও পুলিশ কোনো অভিযোগ বা অপরাধী সাব্যস্ত করা ছাড়া যাদের ধরে নিয়ে যায় এবং আর পাওয়া যায় না।
লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফির কম্পাউন্ডে ও সিরিয়ার পাথুরে হোমসে পাওয়া কবরগুলো নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু উচ্চবাচ্য হয়েছে। কিন্তু যখন অন্দরে সমস্যায় জর্জরিত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে দু’হাজারেরও বেশি কঙ্কাল পাওয়া গেল তখন কেউ ভ্রূক্ষেপও করেনি। যতক্ষণ পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান থাকে- কখনও কখনও তারা অতি উচ্ছ্বাসে সামরিক মিশন নিয়ে দূরদেশে যায় অত্যাচারী উত্খাতে, তবে তারা কীভাবে মানবিকতার সঙ্গে ফের সম্পর্ক স্থাপন করে— যেখানে তারা ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জীবনগুলোর অধিকারকে নির্লজ্জ অবজ্ঞা করছে? আমরা কি ধরে নেব যে এখানে ন্যায়বিচারের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র কাজ করছে? তবে কি গণকবরগুলো বুঝিয়েছে গণতান্ত্রিক ভারত কম আগ্রাসী?
কাশ্মীরিদের স্বাধীন হওয়ার বৈধ আবেগ বা কাশ্মীরিদের আশার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমস্যা সমাধান ও সেনাবাহিনীর অপরাধের অনুসন্ধান না করেই, ভারত সরকার দীর্ঘ সময় ধরে পাকিস্তানের ওপর অস্থিরতা উসকে দেয়ার দোষ চাপানোর নীতি অবলম্বন করে কাশ্মীর ইস্যু ঝুলিয়ে রেখেছে এবং প্রায় এক বছর পর মানবাধিকার সংস্থা গণকবরগুলো নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করল, ভারত নামক দেশটির নিয়মিত একই ধরনের অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার প্রমাণ রয়েছে। নৈতিক বিশ্বে বিশ্বাসী হিসেবে- আমি আরও ভালো কিছু আসা করেছিলাম। কিন্তু সবই খুব পরিচিত ছকে আঁকা।
মার্চ ২০০০, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভারত সফরের আগের দিনের কথা- ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ৫০ মাইল দূরে ছত্তিসিংপুরা গ্রামে বন্দুকধারী আততায়ীদের হাতে ৩৫ জন শিখ নিহত হয়। পরক্ষণেই দ্রুত, এল কে আদভানী ও পরে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর জন্য সন্ত্রাসীদের দায়ী করেন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর এনকাউন্টারে সন্ত্রাসীরা মারা গেছে বলে জানান। কিন্তু সত্য ঘুরে দাঁড়ালো আরও করুণ হিসেবে। মানবাধিকার সংগঠন এবং আত্মীয়দের চাপে তথাকথিত সন্ত্রাসীদের লাশ খুঁড়ে তোলা হলো এবং দুটো নোংরা তদন্ত ও ডিএনএ নিয়ে বাজে তর্কের পর এটা পরিষ্কার হলো যে, মৃত মানুষগুলো নিরপরাধ কাশ্মীরিই ছিল।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কিছু করার ব্যাপারে ভারত সরকারের অনীহার কারণে, এটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে ১২ বছর লেগেছে। পহেলা মে অনেক বিশ্লেষণের পর সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যাপারে করণীয় কি হবে তা সেনাবাহিনীর ওপর অর্পণ করে এবং সেনাবাহিনী স্বচ্ছ অসামরিক বিচারের চেয়ে কোর্ট মার্শালের প্রতি দৃষ্টিপাত করে। কাশ্মীরি আইনবিদ ও অধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী পারভেজ ইমরোজের দৃষ্টিতে- কোর্টের রায় আবারও নিরাপত্তা বাহিনীর কাজের ওই চলমান ধারাকে সাহসী ও শক্তিশালী করল; যে (আইন) কখনোই ক্ষতিগ্রস্তর পক্ষে যায় না।
কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা কাশ্মীরের ৮০০০ হারিয়ে যাওয়াকে ভুলে যায়নি। অনেক পরিচিত একটি ঘটনা মনে পড়ছে। কাশ্মীরি নারীরা শ্রীনগর পার্কে প্রতীকী বিক্ষোভ করে- প্লাজা ডি মায়ো’র মায়ের মত, যিনি আর্জেন্টাইন স্বৈরশাসনের সময় (১৯৭৬-৮৩) সন্তানেরা গুম হওয়ার পরে প্রতি সপ্তাহে বুয়েনেস আয়ারসে প্রতিবাদ জানাতেন। সব নারী মাথায় একটি করে পট্টি বাঁধে এবং একটি করে ফাঁকা ছবি বহন করে—ভারত সরকারের অনৈতিক আচরণ উপেক্ষা করে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দীর্ঘ রক্তাক্ত অবিচার চলমান থাকায় এটি মানুষের চিন্তা চেতনায় গভীর ও নৈতিক দাগ কেটেছে। তাই ২০১০ এর গ্রীষ্মে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক গণবিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেন আরব বসন্তের আগেই একটি আরব বসন্ত।
এটির শুরু পুলিশ কর্তৃক এক কিশোরকে হত্যার মধ্য দিয়ে, তাই কাশ্মীরজুড়ে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ভারতীয় প্যারামিলিটারি বাহিনী এখানে আবার পাশবিক শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে— কার্যত তারা এখানে দু’ মাসের বেশি সময় ধরে অবরোধ করে রেখেছে এবং ১২০ জন মানুষকে হত্যা করেছে যাদের অনেকেই কিশোর। প্যারামিলিটারিরা সবচেয়ে ছোট সামির রাহকেও নির্যাতন করেছে— যার বয়স ১০ বছরেরও কম। প্রাদেশিক সরকার দ্রুত ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু এখনও এখানে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করেনি বরং উল্টো তাদেরই (কাশ্মীরিদের) দায়ী করছে তারা।
ভারত সরকার নিজ কৌশলের অংশ হিসেবে বৃহত্ সামরিক অবস্থান নিয়েছে, কিন্তু এটা অনেক পুরনো কৌশল। এমন কিছু করার আগে তারা কাশ্মীরিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজা উচিত ছিল। এটাই ন্যায়বিচারের জন্য ভালো আচরণ হতো- যাদের সন্তান গুম হয়েছে তাদের জন্য, ২০১০ সালের ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীদের জন্য, পর্বতগুলোর মাঝে অচিহ্নিত কবরের বিস্মৃতদের জন্য, ভারতীয় কারাগারে থাকা আইনি সুবিধাবঞ্চিত কাশ্মীরিদের জন্য, ১৯৯০ সালে পালিয়ে যাওয়া হিন্দু পণ্ডিতদের জন্য— যারা টার্গেটে পরিণত হয়েছিল ও অনেকেই যোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছিল এবং সামির রাহের মায়ের জন্য— যে এখনও জানে না তার ছোট্ট বাচ্চাকে কেন হত্যার উদ্দেশ্যে নির্যাতন করা হয়েছিল এবং তার বামপাশের স্থায়ী ক্ষতি করা হয়েছিল।
মি র্জা ও য়া হে দ, অনুবাদ : হাসান বিন নজরুল

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন