বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট, ২০১২

লোকজ ধারার চিত্রী এস এম সুলতান


বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাস ৫০ বছরের কিছু বেশি হবে। আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে এই সময়ের মধ্যে। সাতচলি্লশের পূর্বে অবিভক্ত ভারতে চিত্রকলা চর্চায় ইউরোপীয় স্টাইল আমদানি হয় কোনো চিত্রশিল্পীর হাত ধরে নয়, একজন কবির মাধ্যমে। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গত শতকের শুরুতে প্রথম ২৫ বছরের মধ্যে পাশ্চাত্যে অন্তত পাঁচটি প্রবল গতিশীল শিল্প আন্দোলন গড়ে ওঠে, যথা_ ফবিজম (১৯০৫), কিউবিজম (১৯০৭), ফিউচারইজম (১৯০৯), দাদাইজম (১৯১৬) ও সারিয়ালিজম (১৯২৪)। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, সেই সময় এইসব শিল্প-আন্দোলনের কোনো প্রভাব বা ছোঁয়া তখনকার খ্যাতিমান ভারতীয় চিত্রকরদের ওপর পড়েনি এবং ভারতীয় শিল্পঐতিহ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি বরং ১৯০৭ সালে চিত্রশিল্পে ভারতীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে ওঠে 'প্রাচ্য শিল্প সভা'_ যা পরবর্তী সময়ে 'সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট' হয়। এর পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সময় তারা ব্যস্ত ছিলেন পশ্চিমা রিয়েলিস্টিক বা ন্যাচারালিস্টিক ধারার নিসর্গ-চিত্র, প্রতিকৃতি ও পৌরাণিক কাহিনী-নির্ভর ছবি অাঁকায়। রবীন্দ্রনাথই ভারতীয় চিত্রকলাকে এই পৌনঃপুনিকতার বলয় ভেঙে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করলেন। ১৯২৮ সালে তিনি যখন ছবি অাঁকা শুরু করলেন তখন তাতে অনুশীলনের দক্ষতা না থাকলেও সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক চিত্রকলা উপহার দিলেন যেখানে অলংকারের বাহুল্য নেই, নেই পৌরাণিক-কাহিনী-নির্ভরতা; বদলে আছে বর্জনীয় অসুন্দরকে সুন্দর করার প্রবণতা, আছে কিউবিক ঢং আর দ্বি-মাত্রিকতার বদলে ত্রি-মাত্রিকতা অর্জনের প্রচেষ্টা। যদিও তাঁর ছবিকে নির্দিষ্ট কোনো ইজমের আওতায় ফেলা যায় না। এরপর তার এই দেখানো পথে হাঁটলেন অনেকেই। এর দ্বারা প্রভাবিত হলেন কমবেশি অনেকেই। কেউ কেউ প্রাচ্য-প্রতীচ্য ধারার সংমিশ্রণে ছবি নির্মাণে উদ্যোগী হলেন। তবে বাংলার শিল্পকলাকে সমৃদ্ধ করতে হলে শুধু ইউরোপীয় রীতির অন্ধ অনুকরণ করলেই চলবে না, তার নিজস্ব, বিশেষ করে লোকজ-ঐতিহ্যের সমৃদ্ধি প্রয়োজন, এই সত্য যারা উপলব্ধি করেছিলেন তাদের মধ্যে যামিনী রায়, জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান অগ্রণী। অপর উজ্জ্বল নামটি অবশ্যই এস এম সুলতান।
১৯৪১ সালে সুলতান যখন কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন তখন রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকায়নের একযুগ পেরিয়ে গেছে। একাডেমিক কাজের মাঝেও নতুনত্ব এসেছে যদিও সব একাডেমিক কাজই একঘেয়ে। সুলতানের এই রুটিন-ওয়ার্ক ভালো লাগেনি। ফলে ডিগ্রী না নিয়েই তিনি ঐ প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একাডেমিক কাজে দক্ষতা বাড়লেই চিত্রশিল্পী হওয়া যায় না, তাকে নিজস্ব সুর, নিজস্ব স্টাইল খুঁজে পেতে হয়। চিত্রশিল্পের আধুনিকতা সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল স্বচ্ছ। শুধু পাশ্চাত্যের রূপরীতি অনুকরণই আধুনিকতা নয়। নিজের যা কিছু আছে তাকে বর্জন করে বাইরে থেকে গ্রহণ করলেই হলো না। সেই গ্রহণ যদি নিজের ঐতিহ্যের সমৃদ্ধির কাজে না লাগে তবে তা অপ্রয়োজনীয়। তাই তিনি তার নিজস্ব শৈলী খুঁজে পেয়েছিলেন যা দিয়ে তিনি তার নিজস্ব দর্শন, আদর্শিক চিন্তাকে সাফল্যের সাথে প্রকাশ করতে পেরেছেন।
মূলত ফিগারেটিভ শিল্পী, নিজস্ব দর্শন ও ব্যতিক্রমী অঙ্কন শৈলীর স্রষ্টা, কৌতূহল জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচারের সুলতান তার ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন গ্রাম বাংলার জীবন ও মানুষ_ বিশেষত যারা শ্রম ও উৎপাদনের সাথে জড়িত। এই একই বিষয়ের পৌনঃপুনিক চিত্রায়ণে তার ক্যানভাস ঠাসা। বাংলার কৃষক নিয়ে তার এক ধরনের 'রম্যবাদী আদর্শায়ন' (জড়সধহঃরপ-ওফবধষরুধঃরড়হ) আছে। বস্তুবাদী অন্তর্দৃষ্টি (ৎবধষরংঃরপ-ঠরংরড়হ) থেকে শুরু হলেও ইচ্ছাকৃতভাবে বাস্তবতাকে দূরে ঠেলে কোনো স্বাপি্নক-বাস্তবতার ইঙ্গিতই আদর্শায়ন। সুলতানের অতিকায় কৃষককুল বাস্তবের প্রতিনিধি নয়। তাই ব্যকরণগতভাবে তাকে শুদ্ধ বাস্তববাদী চিত্রী বলা যায় না। তবে ন্যাচারালিস্টিক বা রিয়েলিস্টিক ধারাকে তিনি একেবারে ফেলে দেননি, তার ছবিই তার প্রমাণ। কারণ যে কৃষক-জীবনকে তিনি তুলে ধরতে চান তাদের জীবনের বাস্তব দিকগুলো তুলে আনতে হলে অতি জটিল ও দুর্বোধ্য রূপরীতি সাধারণের উপভোগের ক্ষেত্রে অন্তরায় হতো। আর ভিজ্যুয়াল আর্টের ক্ষেত্রে তা না হয়ে উপায় নেই। সুলতানের লক্ষ্য ছিল শুধু কৃষক-জীবনের ছবি অাঁকা নয়, তা যেন কৃষকদের কাছে সহজবোধ্য হয়, স্বল্প ও অশিক্ষিত এই শ্রমজীবী শ্রেণী যেন বুঝতে পারে তাদের কথা কেউ বলছে, তাদের ছবি কেউ অাঁকছে। এইজন্য বিংশ শতাব্দীর চিত্রী হয়েও কতিপয় বিচ্ছিন্ন কিছু স্কেচ ব্যতীত তাকে বিমূর্ত বা অন্য কোনো রূপরীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখা যায়নি। আর শিল্পী যা চিন্তা করেন তার সাথে প্রকাশভঙ্গির একটা মিল বা সামঞ্জস্যতো থাকা প্রয়োজন। তাই সুলতান বাস্তববাদী রীতিকে অবহেলা করেন নি। কোনো জটিল কিছু তার ভাবনায় আসেনি, আর তাই তার প্রকাশভঙ্গিও জটিল হয়নি। তবে তার ছবি হুবহু বাস্তবের অনুকৃতি বা সাদা চোখে যা দেখা যায় তার সরল উপস্থাপনা নয়, কারণ বিশুদ্ধ বাস্তববাদী ছবির কোনো দার্শনিক ব্যাখ্যা থাকে না। এ প্রসঙ্গে খ্যাতিমান চিত্র সমালাচক হার্বাট রীড বলেছেন :
ঞযব ৎবধষরংঃরপ সড়ড়ফ হববফং হড় বীঢ়ষধহধঃরড়হ, রঃ রং রহ ঃযব ঢ়ষধংঃরপ ধৎঃ, ঃযব বভভড়ৎঃ ঃড় ৎবঢ়ৎবংবহঃ ঃযব ড়িৎষফ বীধপঃষু ধং রঃ রং ঢ়ৎবংবহঃ রহ ড়ঁৎ ংবহংবং, রিঃযড়ঁঃ ধঃঃবহঁধঃরড়হ, রিঃযড়ঁঃ ড়সরংংরড়হ, রিঃযড়ঁঃ ভধষংরঃু ড়ভ ধহু শরহফ. (ঞযব গবধহরহম ড়ভ অৎঃ, ঐবৎনবৎঃ জবধফ, চবহমঁরহ ইড়ড়শং খঃফ. চধমব-১৬০)
কিন্তু সুলতানের ছবি ব্যাখ্যা দাবি করে। দারিদ্র্য পীড়িত দেশের কৃষকের এমন অতিকায় হবার ব্যাখ্যা। সবাই তার ছবি দেখে একটি প্রশ্নই বার বার করে, আর তা হলো, 'গরিব দেশের কৃষকরা এমন দানবীয় অঙ্গসৌষ্ঠবের কেন?' ঠিক একই রকম একটি প্রশ্ন চিত্র সমালোচক নজরুল ইসলাম করেছিলেন কামরুল হাসানের ছবি সম্পর্কে। 'বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি, তার কাতরতা, যন্ত্রণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা কিছুই তার চিত্রে নেই কেন? এখনও কেন তার চিত্রে রমণীকুল ভরাট শরীর পদ্ম-পুকুরে ভিজিয়ে আসছে, আদর্শ স্বাস্থের সম্ভার নিয়ে?' এর উত্তরে আর এক খ্যাতিমান চিত্র-সমালোচক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলছেন, 'কামরুল হাসানের ছবিতে যে ধৎপযবঃুঢ়ধষ নারীমূর্তি অটুট স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য নিয়ে প্রতিভাত তা প্রকৃতপক্ষে এই দেশ ও জনগোষ্ঠীর চিরন্তন একটি পরিচয় এবং একই সাথে ভবিষ্যত নিয়ে শিল্পীর প্রচ- আশাবাদের প্রতিনিধিত্বকারী।' [ কামরুল হাসান, সম্পাদনা-আবুল হাসনাত, পৃষ্ঠা-৬১]। সুলতানের ছবির ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। এনাটমিতে তার যে অতিরঞ্জন তার উদ্দেশ্য, ্তুধফফরহম ংঃৎধহমবহবংং ঃড় নবধঁঃু্থ নয়, কারণ তার দর্শন সুস্পষ্টভাবে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চেতনাজাত। বাংলার একদার সবল কৃষক সামন্ত ও পূঁজিতান্ত্রিক শোষণে যে স্বাস্থ্য হারিয়েছে একজন 'ভিশনারী' হিসাবে সুলতান তার পুনরুদ্ধার চান। একজন শিল্পীর উদ্দেশ্য প্রতিচ্ছবি নয়, মনোচ্ছবি সৃষ্টি। এনাটমির ক্ষেত্রে এই বাঁধা অনুশাসন না মানার উদ্দেশ্যই এই মনোচ্ছবি সৃজন। একে স্বপ্ননির্মাণও বলা যেতে পারে। বাংলার লোকজ-জীবন নিয়ে তিনি যে আদর্শিক স্বপ্ন দেখেছিলেন তার নির্মাণে তিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁ মাস্টারদের শৈলীকে গ্রহণ করেছিলেন। তাদের অনুকরণে বাংলার কৃষক সমাজকে অতিকায় করে দেখার মধ্যে আছে স্বপ্ন নির্মাণ ও সংগ্রামের প্রচ্ছন্ন বাণী। বস্তুতঃ বাংলার কৃষকরা নিয়ত অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিয়োজিত। তাদের দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম শোষকের বিরুদ্ধে, যা একাধারে তাদের জীবন ও জীবিকার সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে জয়ী হয়ে একদিন তারা তাদের হৃত স্বচ্ছলতা ফিরে পাবে; কৃষকায় কৃষক স্বাস্থ্যবান হবে। তার ছবি এই স্বপ্ন ও আশাবাদ ধারণ করে।
এই বিষয়ে এই নিবন্ধকারের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে শিল্পী বলেছিলেন :
শুধুমাত্র ফটোগ্রাফিক উপস্থাপনা ছবি অাঁকার উদ্দেশ্য হতে পারেনা। আমার কৃষকের অতিকায়তা সব বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু, সমালোচকেরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একে ব্যখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন। কেউ একে বিকৃতি (উরংঃড়ৎঃরড়হ) বলেছেন, কেউ আবার একে আমার এনাটমীর জ্ঞানের অভাব হিসেবেও দেখেছেন, কিন্তু এখানেই আমার ছবির দর্শন। আমি রেনেসাঁ মাস্টারদের অনুকরণে তাদের দেহসৌষ্ঠব এঁকেছি মানুষকে দেখাতে যে, কৃষকদের এইরূপ হওয়া উচিত। তাদের কৃষকায় হওয়ার পিছনে নিয়তি বা ভাগ্য নয়, শোষণের দীর্ঘ ইতিহাস জড়িত। আমার ছবিতে একটি প্রতিবাদী মেসেজ আছে। আমার প্রত্যাশা, সব ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে একদিন ওরা জয়ী হবেই, ওরা ওদের হৃত স্বাস্থ্য ফিরে পাবে।
রূপরীতির ক্ষেত্রে সুলতানকে শুধুমাত্র ইমপ্রেশনিস্ট ধারার চিত্রী হিসাবে চিহ্নিত করা চলে না। তিনি প্রকাশবাদী ধারাও বটে। এই ধারার শিল্পীরা খুব আবেগপ্রবণ হন। যে কোনোভাবে সেই আবেগ প্রকাশ করেন। তার জন্য সর্বদাই পরিপাশ্র্বের চেনা জগতের অতিরঞ্জন ও বিকৃতিকে প্রশ্রয় দিতে ছাড়েন না। এমনকি মাঝে মাঝে তা উদ্ভট কিছুও হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রসঙ্গে হার্বাট রীড বলেন :
ওঃ বীঢ়ৎবংংবং ঃযব বসড়ঃরড়হং ড়ভ ঃযব ধৎঃরংঃ ধঃ ধহু পড়ংঃ ঃযব পড়ংঃ নবরহম ঁংঁধষষু ধহ বীধমমবৎধঃরড়হ ড়ৎ ফরংঃড়ৎঃরড়হ ড়ভ হধঃঁৎধষ ধঢ়ঢ়বধৎধহপবং যিরপয নড়ৎফবৎং ড়হ মৎড়ঃবংয়ঁব. (ঞযব গবধহরহম ড়ভ অৎঃ, ঐবৎনবৎঃ জবধফ, চধমব-১৬৩).
যদিও সুলতানের এনাটমিতেই যা কিছু অতিরঞ্জন। একে তিনি কখনোই উরংঃড়ৎঃরড়হ বলে মানতেন না। কারণ নৃতাত্তি্বক বৈশিষ্ট্যে প্রাচীনকালে আমাদের কৃষকরা এমনই স্বাস্থ্যবান ছিলেন বলে তার মত। তাছাড়া সদৃশরূপ (ঊীধপঃহবংং) বর্জন ক'রে রূপসৃষ্টির প্রয়াসে ইউরোপীয় রীতির সঙ্গে লোকজ ঐতিহ্য মিশ্রণের মাধ্যমে তার 'মেসেজ' তুলে ধরার উদ্দেশ্যে তিনি নির্মাণ করেন তার নিজস্ব 'স্টাইল'। যেমন যামিনী রায় টেম্পল টেরাকোটার ফর্মের সঙ্গে কিউবিক ফর্মের সম্মিলনে তৈরি করলেন তার নিজস্ব ফর্ম যা কামরুল হাসানেও দুর্লক্ষ্য নয়। সুলতানের মূল প্রেরণা বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, রেনেসাঁ মাস্টারদের অনুকরণে তিনি তার 'ফিগর' এঁকেছেন। তবে নারীর মুখশ্রীতে ভারতীয় রীতির কমণীয়তা সুষ্পষ্ট। তবে সুলতানের ছবি বিশেষ কোনো রূপরীতির নিগড়ে বাঁধা পড়েনি। একধরনের সারল্য, সজীব ও প্রাণবন্ত রূপ ফুটে উঠেছে, ইজম-পীড়িত হয়নি।
নিজস্ব শিল্প দৃষ্টি গড়ে তোলার প্রাথমিক পর্যায়ে সুলতান কাশ্মীর ও বাংলার প্রচুর নিসর্গচিত্র এঁকেছেন যার ধারাবাহিকতায় তিনি পরবর্তী সময়ে তার মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন বাংলার অবহেলিত কৃষক-সমাজের প্রতি, কারণ তার অভিজ্ঞতা জন্মসূত্রেই গ্রাম-কেন্দ্রিক আর রুচি লোক-শিল্প-জাত। পরবর্তী সময়ে তার সমস্ত কাজেরই কেন্দ্রে এসেছে মানুষ, পটভূমিতে নিসর্গ। একটি বিশেষ ভাবনা ও আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে একই বিষয় বার বার তার ছবিতে এসেছে। এই পৌনঃপুনিকতা অনিবার্য হওয়ায় একে অনেকে মুদ্রাদোষ বলে মনে করেন। এ বিষয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মন্তব্য প্রনিধাণযোগ্য :
"লোকজ-রীতির চিত্রে ইমেজগুলো অনেক সময় একটি আদর্শিক চিন্তাকে প্রকাশ করে। বস্তুতঃ লোকশৈলীর যে ম্যানারিজম সেটি পৌনঃপুনিকতা আক্রান্ত বলে আমাদের মনে হতে পারে, তা ওই আদর্শিক চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত।"
(ভোরের কাগজ সাময়িকী, ২৪ পৌষ, ১৪০০)।
এ প্রসঙ্গে যা মনে হয় তা হলো, যে কোনো মানুষেরই জীবন-জগৎ-বীক্ষা-দর্শন স্বপ্ন পুনঃ পুনঃ পাল্টাতে পারে না। সেই বিষয়গুলোর চিত্রায়নের পৌনঃপুনিকতা মুদ্রাদোষ মনে হতে পারে। সুলতানের যে দর্শন, যে আদর্শিক চিন্তা তার থেকে বেরিয়ে এলে সুলতান আর সুলতান থাকেন বলে মনে হয়না। আমাদের লোকজ ধারার অন্য দুই পথিকৃত জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের কাজও এই মুদ্রাদোষে আক্রান্ত। এমনকি যামিনী রায়ের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ। কিন্তু তাতে তাদের ছবির নান্দনিক ও আদর্শিক মূল্য কমে যায় না। তবে দর্শকের চোখে কখনো কখনো অবসাদ আসতে পারে।
লোকজ রীতির চিত্রকলায় মৌলিক রঙের প্রাধান্য বেশি কিন্তু সুলতানের বেশিরভাগ ছবিতে খয়েরি, বাদামি, কালো, সবুজ ইত্যাদি রঙের ব্যবহার চোখে পড়ে। মৌলিক রঙের কাজ খুবই কম। ধান মাড়ানো ও ধানক্ষেতে কৃষক ছবি দু'টিতে দেখতে পাই উজ্জ্বল হলুদের ব্যাপক ব্যবহার। কিছু কিছু ল্যান্ডস্কেপে দেখি মৌলিক রঙের প্রয়োগ। ফেরা, গুণটানা এবং জমি কর্ষণে যাত্রা সিরিজের ছবিগুলোতে দেখতে পাই গাঢ় সুবজ ও বাদামি রঙের ব্যবহার প্রকৃতির সংবেদনশীলতা ফুটিয়ে তুলেছে। তার তুলির স্ট্রোক ডাচ চিত্রী ভ্যানগঘের স্ট্রোকের সাথে সাদৃশ্য বহন করে। তুলির টানে তিনি ইউরোপীয় রীতির অনুসারী হলেও তিনি তার নিজস্ব 'স্টাইল' নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। ্তুঝঃুষব রং অৎঃরংঃ্থ একথা অল্প যে দুই-একজনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সুলতান তাদের একজন। আবহমান বাংলার লোকজ জীবন, লোকজ ঐতিহ্যকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সুলতান একটি প্রতীক নির্মাণ করেন যে প্রতীক মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির। এই শক্তির ওপর তার আস্থা ছিল। শুধু লোকজ-জীবনের নান্দনিক দিকটি নিয়ে তিনি ভাবেননি যদিও 'শক্তিই সৌন্দর্য' রেনেসাঁ মাস্টারদের এই কনসেপ্টটা তিনি পছন্দ করতেন। তাই অমিত শক্তির প্রতিনিধি তার কৃষককুল যেমন লোকজ জীবনের শিকড় অনুসন্ধানের প্রয়াস রূপে চিত্রিত তেমনি এর মাধ্যমে তার কাঙ্ক্ষিত কল্পরাজ্যের স্বপ্নও বিম্বিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন