মঙ্গলবার, ২৮ আগস্ট, ২০১২

ইসলামের মর্ম সন্ধানে



অন্য ধর্মের তুলনায় ইসলামে উৎসবের পরিমাণ কম। এই ধর্মে স্বীকৃত মূল ধর্মীয় উৎসব হলো দু’টি। ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতর হলো উপবাস ভঙ্গের উৎসব। আর ঈদুল আজহা হলো আত্মত্যাগের উৎসব। এক সময় বাংলাদেশে ঈদুল আজহাকে তুর্কি কথায় বলা হতো বকরা ঈদ। বাংলাদেশে সাধারণত ঈদুল ফিতর উৎসবের পরিমাণ হয়েছে বেশি। আরবিতে ঈদ বলতে ধর্মীয় উৎসব বোঝায়। সেই সাথে ভোজপর্বও। ভোজ ও উৎসব অনেক ভাষাতেই হতে পেরেছে সমার্থক। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে সুরুচিকর রসনারঞ্জন খাদ্য খেতে (সূরা ২; ১৭২)। ভালো খাদ্য হয়েছে ধর্ম উৎসবের অংশ। মানুষের সংস্কৃতির পরিচয় ফুটে উঠেছে রন্ধনকর্মে। রন্ধনকর্ম দিয়ে তাই বিচার করতে হয় একটি সংস্কৃতিকে। যাকে বলা হয় মুসলিম সংস্কৃতি, রন্ধন হতে পেরেছে তার বিশেষ অংশ। মানুষ কাঁচা গোশত খায় না। খায় রন্ধন করে। রন্ধন তার সংস্কৃতির পরিচয়। আমরা পত্রপত্রিকায় তাই প্রতি ঈদের আগে ঈদের রান্না নিয়ে আলোচনা হতে দেখি। এবারো তা দেখা গেছে। ঈদের খাদ্য তালিকায় রয়েছেÑ রোস্ট চিকেন, মিক্সড সালাদ, চিকেন মালাইকারি, শাহী পোলাও, মটর পোলাও ইত্যাদি। এই খাদ্যতালিকার সাথে যুক্ত হতে দেখা যাচ্ছে আমাদের রান্নায় কিছুটা বিদেশী প্রভাব। অর্থাৎ মুসলিম সংস্কৃতিতে যুক্ত হচ্ছে অন্য সংস্কৃতির প্রভাব। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। যাকে ইসলামি সংস্কৃতি বলে, তা গঠিত হয়েছে একাধিক সংস্কৃতির অবদানে। এই সংস্কৃতিকে তাই চিহ্নিত করা হয় ইকলেকটিক (Eclectic) হিসেবে। পরলোকগত অধ্যাপক পি কে হিট্টি (P K Hitti) তার বহুল পঠিত Islam And The West বইতে বলেছেন, ইসলাম শব্দটিকে বিবিধ অর্থে প্রয়োগ করা যায় : ধর্মীয় অর্থে, রাষ্ট্রিক অর্থে ও সাংস্কৃতিক অর্থে। ধর্মীয় অর্থে ইসলাম বলতে বোঝায়Ñ বিশিষ্ট ধর্মবিশ্বাস ও প্রার্থনা পদ্ধতিকে। রাষ্ট্রিক অর্থে ইসলাম বলতে বোঝায়Ñ ইসলামি খিলাফতকে, যা পরে বিভক্ত হয়ে পড়ে বিভিন্ন ইসলামি রাজ্যে। কিন্তু তাদের আইনকানুন নির্ধারিত হতে থাকে কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতে। সংস্কৃতির েেত্র ইসলাম বলতে বোঝায়Ñ খেলাফতের মধ্যে এবং বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যে গড়ে ওঠা সংস্কৃতিকে। এই সংস্কৃতিতে বজায় থেকেছে একটা ঐক্য, যে ঐক্যের কারণ হলো আরবি ভাষা। মুসলিম রাজ্যে, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে সহজেই যেতে পেরেছেন শিল্পী, স্থপতি, কারিগর ও সওদাগরেরা। গড়ে উঠতে পেরেছে একটা মূল বৈশিষ্ট্যময় স্থাপত্য ও অপ্রধান শিল্পকলা, যাকে সাধারণভাবে চিহ্নিত করা চলে ইসলামি হিসেবে। কিন্তু এই সংস্কৃতিতে এসে মিশেছে নানা সংস্কৃতির অবদান, ইসলামি সংস্কৃতিতে হতে পেরেছে যার সংশ্লেষণ। ইসলামকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আলোচনা করতে হয় এই ঐতিহ্যের বিশেষ পটভূমিকায়। কেবল তা হলেই আমাদের দৃষ্টিতে পরিদৃশ্যমান হয়ে ওঠে ইসলামের প্রকৃত পরিচয়। ইসলামি ধর্মচেতনার একটি বৈশিষ্ট্য হলো রোজা। ঠিক এভাবে উপবাস ব্রত আর কোনো ধর্মে পালন করা হয় না। কুরআন শরিফে বলা হয়েছেÑ রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, আত্মসংযমের অনুশীলন। রোজা পালন করা হয় হিজরি বছরের নবম মাসে। হিজরি চন্দ্রাব্দ, সৌরাব্দ নয়। ঋতু পরিবর্তন ঘটে পৃথিবী বিশেষভাবে বাঁকা হয়ে সূর্যকে প্রদণি করছে বলে। দিন-রাত্রি হয় পৃথিবী গোলাকার এবং তা আপন অরে ওপর আবর্তিত হচ্ছে বলে। হিজরি অব্দের বছর হয় ৩৫৪ দিনে আর সৌরবছর ৩৬৫ দিনে। খ্রিষ্টাব্দ হলো সৌরবছর। খ্রিষ্টাব্দ আর হিজরির মধ্যে প্রতি বছর ১১ দিন করে তফাত হতে থাকে। ৩৩ বছরে পুরো এক বছরের তফাত ঘটে। আমাদের এখন সরকারি কাজ চলেছে খ্রিষ্টাব্দ ধরে। আমরা ইতিহাস লিখছি খ্রিষ্টাব্দ অনুসরণ করে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের আগে আমরা অনুসরণ করেছি হিজরি সন। হিজরি সন আরবের হেজাজে প্রবর্তন করেন খলিফা ওমর রা:। হিজরি সনকে বলা যায় না ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হেজাজে ভৌগোলিক কারণে ঋতু পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য নয়। হিজরি সন সেখানে মেনে চলা সহজ। কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্র চন্দ্রাব্দ মেনে চলা সহজ নয়। আমাদের বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক, দিনের দৈর্ঘ্য এখানে বছরের সব সময় এক থাকে না। নভেম্বর-মার্চ মাসে দিন হয় ১০-১২ ঘণ্টা; মার্চ-জুন মাসে দিন থাকে ১২-১৪ ঘণ্টা; জুন-সেপ্টেম্বর মাসে দিন থাকে ১৪-১২ ঘণ্টা। আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে দিন থাকে ১২ থেকে ১০ ঘণ্টা। অর্থাৎ রোজা যখন হয় শীতকালে তখন মানুষ রোজা রাখে কম করে দিনে ১০ ঘণ্টা। কিন্তু রোজা যখন হয় গ্রীষ্মকালে, তখন এ দেশের মানুষকে রোজা রাখতে হয় ১৪ ঘণ্টা। রোজার পরিমাণ ঘণ্টা ধরে তাই হতে দেখা যায় কম-বেশি। পৃথিবীতে এমন দেশও আছে যেখানে সূর্য অস্ত যায় না ছয় মাস ধরে। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এ রকম আংশে মানুষ রোজা রাখবে কিভাবে? উত্তরটি ব্যক্তিগতভাবে আমার জানা নেই। তবে কুরআন শরিফে বলা হয়েছেÑ আল্লাহ মানুষকে কষ্ট দেয়ার জন্য রোজার বিধান করেননি। রোজার বিধান করা হয়েছে আত্মসংযম চর্চার জন্য (সূরা ২; ১৮৩-১৮৫)। অসুস্থকে তাই রোজা রাখতে হয় না। দূরপথযাত্রীকে রোজা রাখতে হয় না, যদিও বলা হয়েছে, এদের পরে রোজা রাখতে হবে; যতগুলো দিন তারা রোজা রাখেনি সেই দিনগুলো পূরণের জন্য। রোজার ল্য কখনোই মানুষকে কষ্ট দেয়া নয়। যে পরিস্থিতিতে রোজা রাখা সম্ভব নয়, সে পরিস্থিতিতে মানুষকে রোজা রাখতে বলা হয়নি। আমি একবার রোজার মধ্যে ঢাকা থেকে ফরাসি দেশে যাচ্ছিলাম বিমানে চড়ে। যখন বিমান দুবাই পৌঁছল, তখন সেখানে ঝিকমিক করছে রৌদ্র। বিমানবালা বললেন, যারা ঢাকায় সেহরি খেয়ে রোজা রেখেছেন, তাদের এখন ইফতার করতে হবে। কারণ ঢাকায় এখন ইফতারের সময় হয়েছে। বিমানের কয়েকজন যাত্রী অবাক হলেন। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা হলো এক স্বাভাবিক ভৌগোলিক ঘটনা। তিউনিসিয়ার এক কালের বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা হাবিব বরগুইবা ১৯৫৬ সালে বলেছিলেনÑ রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়। জিহাদের সময় রোজা রাখতে মানা করা হয়েছে। সারা মুসলিম জাহানে বিরাজ করছে জিহাদি অবস্থা। রোজা রেখে এই জিহাদ করা সম্ভব নয়। কিন্তু হাবিব বরগুইবার বক্তব্য মুসলিম বিশ্ব মেনে নেয়নি। ইসলামের একটা বড় শিা হলো মধ্যপন্থার অনুসরণ। বলা হয়েছে কোনো বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করতে (সূরা ২; ১৪৩)। কোনো কিছুর কতটাকে বাড়াবাড়ি বলে ধরতে হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। মধ্যপন্থা ঠিক করতে হবে বিরাজমান পরিস্থিতিকে বিবেচনা করে। ঠিক করতে হবে মানুষকে তা নিজের বিদ্যাবুদ্ধি প্রয়োগ করে। ইসলামি এই চিন্তার সাথে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের (৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) চিন্তার আছে যথেষ্ট মিল। অ্যারিস্টটল মনে করতেন ভালো-মন্দের মধ্যে তফাতটা অনেক েেত্রই হলো পরিমাণগত। যেমনÑ যে কাপুরুষ, সে বিপদের কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। যে হঠকারী, সে বিপদের ঝুঁকি নিতে চায় অতি মাত্রায়। কিন্তু যে ব্যক্তি যথার্থ সাহসী, সে বিপদের ঝুঁকি গ্রহণ করতে চায় সঠিক মাত্রায়। আর এই সঠিক পরিমাণটা নির্ধারিত হতে পারে কেবল বিদ্যমান পরিস্থিতিকে বিশেষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে; মানববুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে। অ্যারিস্টটলের চিন্তা একসময় মুসলিম দার্শনিকদের বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। আরবিতে তাই অ্যারিস্টটলকে বলা হয় ‘আল-মুয়াল্লিম আল-আউয়াল’। সব সময় জীবনের সব েেত্র বাড়াবাড়িকে এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে ইসলামে। এটা ইসলামের একটি মূল শিা। আমরা আলোচনা করছিলাম রোজার উদ্দেশ্য নিয়ে। আমার মনে হয় আগে আমরা যেভাবে রোজা পালন করতাম, সেটা ছিল এখনকার তুলনায় অনেক বেশি ইসলামি। এখন আমরা রোজার মাসে অন্য মাসের চেয়ে খরচ করি বেশি। খুব ঘটা করে করি ইফতারÑ যার প্রচলন আগে ছিল না। মানুষ আগে ঈদে উৎসব করেছে, কিন্তু এই উৎসব ছিল না এখনকার মতো এতটা জাঁকজমকপূর্ণ। মানুষ নতুন জামাকাপড় কেনার জন্য ব্যয় করেনি এখনকার মতো। ইসলাম একটা অনাড়ম্বর, সহজ-সরল ধর্মবিশ্বাস। কিন্তু এখন এটা হয়ে উঠেছে ক্রমেই আড়ম্বরপূর্ণ এবং বিলাসী মানুষের ধর্মবিশ্বাসে।
আমার ছেলেবেলায় অর্থাৎ ১৯৩০-এর দশকে রোজাকে কেন্দ্র করে কাজী নজরুল ইসলামের একটি গান খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলÑ ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ’। এতে ফুটে উঠেছে রোজা ও ঈদের বিশেষ তাৎপর্য। গানটি প্রথম গেয়েছিলেন আব্বাস উদ্দীন আহমদ। রেকর্ড করেছিল হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানি। বাংলাদেশে ইসলামি সংস্কৃতি নিয়ে প্রথম আধুনিক ধারায় গান রচনা করেন নজরুল। আর ইসলামি সংস্কৃতি বাংলায় আত্মপ্রকাশ করে বিশেষ সুষমা নিয়ে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন