বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট, ২০১২

অস্তিত্ব হারিয়েছে ৩১টি নৃ-গোষ্ঠী : রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই আদিবাসীদের


বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট ২০১২ : গত কয়েক দশকে নানা কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩১টি আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে টিকে থাকা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীগুলোর বেশিরভাগই সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। ফলে তারা এদেশের নাগরিক হয়েও রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত। সরকারি প্রজ্ঞাপনে ২৭টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করা হলেও এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে ৭৫টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসও বিষয়টি উল্লেখ করে এদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানিয়েছে।

আদমশুমারী প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে এক সময় ছিল কিন্তু এখন নেই এমন অনেক জাতিগোষ্ঠীর নাম পাওয়া গেছে। এই ভূখণ্ডে দীর্ঘদিন তারা বসবাস করেছে। কিন্তু এখন তাদের কোন সন্ধান নেই। অনেক জাতিগোষ্ঠী বিলীন হয়ে গেছে অথবা অন্য জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে কিংবা জীবনমান উন্নয়নে এদেশ ছেড়ে চলে গেছে। ১৯৩১ সালের আদমশুমারীতে ছিল, কিন্তু এরপরের আদমশুমারীগুলোতে তাদের অনেকের খোঁজ পাওয়া যায়নি। গেল আশি বছরে এরকম প্রায় ২০টি জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এগুলো হচ্ছে অসুর, আগরিয়া, করওয়া/করোয়া, কাছাড়ি, কাউর, কুকি, কুলিস, কোরা, খারওয়ার, গাড়ৎ, জমাতিয়া, ধিমাল, নাট, নাগেসিয়া, বিরজিয়া, বহেলিয়া, ভুটিয়া, মেচ, শেখালী ও রাভা/রাবা। এছাড়া ১৮৭৭ সালের আদমশুমারিতে নাম ছিল, কিন্তু এখন আর দেখা যায় না এমন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আবাশান, আকা, জমাতিয়া, ঘুরাও, বাকখো, বহেলিয়া, ভর, ভুঁইয়া, ভুইমালী, শেখালী ও রিয়াং।

টিকে থাকা জাতিগোষ্ঠী

বাংলাদেশে বর্তমানে ৭৫টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বসবাস করছে। বেশিরভাগই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশই আদিবাসী বংশোদ্ভূত। এছাড়া রাজশাহী, দিনাজপুর, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল, খুলনা ও যশোর জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আদিবাসীদের বসবাস আছে। সমতলে বসবাসরতদের বেশিরভাগই সাঁওতাল।

গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ (আরডিসি) এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে যে ৭৫টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী আছে তারা হলো অধিকার, অসম/অহম/অহমিয়া, ওরাও, কন্দ/খন্দ, কর্মকার/কামার, কড়া/করোয়া, কাউর, কুর্মি/কর্মালী, কোচ, কোল, খারওয়ার, খারিয়া, কাসি, খিয়াং, খুশি/খামি, গ্ল, গড়াইৎ/গড়াত, গারো, গোর্খা, গৌড়, চ্লাল, চাকমা, চাক, ছত্রী, ডালু, ডোম, ত্রিপুরা,/টিপরা, তঞ্চঙ্গ্যা, তুরি, তেলী, নুনিয়া, পল্ল, পাহাড়িয়া, পাত্র, পাহান, পাংখু, প্ল্রু/পোদ, বাউরি, বম, বর্মন, বাগদী, বানাই, বাড়াইক, বাদিয়া, বীন, বোনাজ/বুনা, ভর, ভুমিজ, ভুঁইয়া, ভুইমালী, মনিপুরী, মারমা, মালো/মাল, মাহালী, মাহাতো, মিরধা, ম্লা, মারারী, মুরমি, মুষহর, ম্রো/মুরং, রাই, রাউতিয়া, রাখাইন, রাজবংশী, রাজোয়াড়, রানা-কর্মকার, লুসাই, লোহার/লহরা, শবর, সাউ, সাঁওতাল/সানতাল ও হাজং। এছাড়া আরো তিনটি জাতি নিজেদের আদিবাসী মনে করে। এরা হলো কর্নিদাম, বসাক ও রবিদাস।

সরকারি প্রজ্ঞাপনে ভুল তথ্য

সরকারি প্রজ্ঞাপনে মাত্র ২৭টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০১০ সালের ১২ এপ্রিলে এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে এখানে তিনটি জাতির নাম দু’বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, মং আর মারমা একই জাতি। কিন্তু এ দুটো আলাদা করে লেখা হয়েছে। আবার পাহাড়ি ও মালপাহাড়ি একই জাতি। এদেরকে বলা হয় পাহাড়িয়া। কিন্তু এদেরকেও আলাদা দেখানো হয়েছে। ত্রিপুরা জাতির মধ্যেই আছে উসাই। অথচ ত্রিপুরাও লেখা হয়েছে আবার উসাইও লেখা হয়েছে।

সরকারি প্রজ্ঞাপনে যাদের নাম আছে তারা হলো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, বর্ম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ, সাঁওতাল, ডালু, উসাই (উসুই), রাখাইন, মনিপুরী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মং, ওরাও, বর্মন, পাহাড়ী, মালপাহাড়ী, ম্লা ও কোল।

সংসদীয় ককাসের বক্তব্য

২৭টির পরিবর্তে ৭৫টি জাতিগোষ্ঠীর নাম সরকারি প্রজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস। ককাসের সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু বলেন, প্রত্যেক আদিবাসী জাতিকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে আইন হওয়া জরুরি। সংবিধানে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী না বলে আদিবাসী বলতে হবে। আগামী বছর থেকে রাস্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করতে হবে এবং এই দিনে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে বাণী দিতে হবে। আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধান করতে হবে। পাবর্ত্যাঞ্চলে ভোটার তালিকা যথাযথভাবে করতে হবে। তিনি বন ও পাহাড়ে আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করাসহ শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানান।

‘পঞ্চম সংশোধনী সংশোধন দরকার’

গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ (আরডিসি) চেয়ারম্যান মেসবাহ কামাল বলেন, এ ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট জরিপ নেই। ফলে কত জাতি এই দেশে বাস করে তার ঠিক নেই। আদমশুমারীও নিয়ন্ত্রিত, ফলে যথাযথ তথ্য আসে না। তিনি বলেন, সরকারের সাথে গবেষকদের দূরত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে যে বৈচিত্র্য আছে তার স্বীকৃতি দরকার। পঞ্চম সংশোধনীর আবার সংশোধন দরকার।

সমপ্রতি এক সেমিনারে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) বলেন, সংবিধানে ‘আদিবাসী’ সম্পর্কে যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে আমাদের নাম পরিচয় কিছু নেই। এটা একটা গোঁজামিল দেয়ার চেষ্টা। যার আগাও নেই গোড়াও নেই। বলা হয়েছে, নৃ-গোষ্ঠী। নৃ-গোষ্ঠী তো সবাই। এটি ঔপনেবিশিক ধারণা। তিনি বলেন, আদিবাসীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তি চুক্তি) বাস্তবায়নে ক্ষমতাসীন সরকারই সমস্যার সৃষ্টি করছে। সে কারণেই গত ১৪ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। আদিবাসীদের সামনে সংগ্রাম ছাড়া বিকল্প পথ নেই। সন্তু লারমা বলেন, আদিবাসীদের প্রতিটি দাবি সরকার ও প্রশাসনের ইচ্ছার ওপরে আটকে আছে। তার মানে, সরকার আদিবাসীদের বিষয়ে আন্তরিক নয়। যারা শত শত বছর ধরে পাহাড়ে-সমতলে বাস করছে, তাদের বলা হচ্ছে বহিরাগত।

কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর অবস্থান

‘বাংলাদেশের আদিবাসী এথনোগ্রাফিয় গবেষণা’ গ্রন্থটিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় বসবাসরত কয়েকটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অবস্থানগত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এরমধ্যে কর্মকার জাতিগোষ্ঠীর মানুষ জয়পুরহাট শহরের শিশিরমোড় ও বেলআমলা এবং সদর উপজেলায় এবং রাজশাহী, নাটোর, বড়াইগ্রাম, দিনাজপুরের বিরামপুর বাস করে। এখনো ৮৫টি পরিবার টিকে আছে। খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠী সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ-এর চা বাগানে থাকে। সংখ্যায় প্রায় পাঁচ হাজার। কন্দ জাতিগোষ্ঠীও চা বাগানেই থাকে। বগুড়ার মহাস্থানগড় ও নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার মধ্যবর্তী স্থানে এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে পাহানদের দেখা যায়। রংপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ ও দিনাজপুরের বিভিন্ন জায়গাতে প্রায় ২০০ টি মালো পরিবার আছে। নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাজিপুর, ফরিদপুর ও সিলেট অঞ্চলে গ্ল জাতির বসবাস। এদের সংখ্যা প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার। জয়পুরহাটসহ উত্তরের কয়েক জেলায় আছে তুরি জাতিগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় প্রায় দুই হাজার তুরি জাতির মানুষ আছে। রাঙ্গামাটিতে প্রায় ৫০০ গুর্খা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। এছাড়া ঢাকা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও পটুয়াখালিতে এই জনগোষ্ঠীর কয়েকটি পরিবার এখনো টিকে আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন