বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

সংসদ-আদালত মুখোমুখি

স্পিকারের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল :হাইকোর্ট
সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে

রাজধানীতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের দখলে থাকা সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তি উচ্চ আদালতের রায়ে পুনরুদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে স্পিকার আবদুুল হামিদ অ্যাডভোকেটের বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ও আদালত অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংবিধান ও বিচার বিভাগ সম্পর্কে স্পিকারের নূ্যনতম জ্ঞান নেই মন্তব্য করে আদালত বলেছেন, 'সংসদের অভিভাবক হলেন স্পিকার। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুসারে তিনি রাষ্ট্রের তিন নম্বর ব্যক্তি। অথচ তার (স্পিকার) সংবিধান, সংসদ ও আদালত
সম্পর্কে নূ্যনতম জ্ঞান নেই। তাই ওই পদে থাকার যোগ্যতাও তার নেই।'
আদালত বলেছেন, সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বিচার বিভাগের কাজে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো চাপ নেই। অথচ স্পিকার সংসদে বলেছেন, আইনমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে সড়ক ভবনের সম্পত্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তাকে বলা যেত। আদালত বলেন, তাহলে কি স্পিকার মনে করেন আইনমন্ত্রীর নির্দেশে বিচার বিভাগ চলে। বিচারাধীন বিষয়ে স্পিকারের এ বক্তব্য আদালত অবমাননাকর। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিয়ে স্পিকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধও করেছেন।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার জনস্বার্থে করা একটি আবেদনে এসব মন্তব্য করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ গতকাল দুপুরে ২৯ মে সংসদে উচ্চ আদালতের সমালোচনা করে স্পিকারের দেওয়া বক্তব্যের বিষয়টি নিয়ে পরদিন তিনটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ আদালতের নজরে আনেন।
২৯ মে জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে সাংসদ শাহরিয়ার আলমের করা প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেছিলেন, 'আমি যদি মনে করি সংসদই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, সরকার যদি মনে করে তারাই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, আবার আদালত যদি মনে করেন যা ইচ্ছা তা করবেন_ এটা ঠিক নয়। কোর্টের বিচারে (রায়ে) জনগণ যদি ক্ষুব্ধ হয় তাহলে বিচারকের বিরুদ্ধে এক সময় রুখে দাঁড়াতে পারে। এমনিভাবে সরকারও যদি জনগণের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করে, জনগণ একদিন সরকারের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াবে। এ ধরনের ইতিহাস আছে।' স্পিকার আরও বলেন, 'আমি কী হনুরে' ভাবসাব ঠিক নয়। কোনো ভাব না দেখিয়ে সবারই উচিত দায়িত্ব পালনের মনোভাব রাখা।
দিনভর শুনানির পর বিকেলে আদালতের আদেশে বলা হয়, দুই সাংসদ আবদুল মতিন খসরু ও নুরুল ইসলাম সুজন আশ্বস্ত করেছেন বিচার বিভাগের ওপর সরকারের কোনো ব্যক্তি বা বিভাগের চাপ নেই। স্পিকার ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সংসদে উচ্চ আদালতের সমালোচনা করেছেন, যা অপ্রত্যাশিত। সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের জন্য অবশ্যই স্পিকার এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা করবেন। আদেশে আরও বলা হয়, সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদের কার্যপ্রণালি নিয়ে কোনো সাংসদকে আদালতে তলব করা যায় না। এ ধরনের দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে বিচারাধীন কোনো বিষয়ে সংসদে সমালোচনা করা এবং জনগণকে উসকে দেওয়াটা দুঃখজনক। এর আগে সড়ক ও জনপথ বিভাগের আইনজীবী আনিসুল হক হাইকোর্টের নির্দেশে তাদের (সড়ক ও জনপথ) দখলে থাকা কয়েকটি ভবন ও কক্ষ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে হস্তান্তর করেন। এর ভিত্তিতে আদালত এ বিষয়ে আগামী ১০ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
শুনানি : গতকাল দুপুর ১২টায় সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তি বিষয়টি নিয়ে শুনানি শুরু হয়। এ পর্যায়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের আইনজীবী আনিসুল হক আদালতে বলেন, গতকাল (সোমবার) রাতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে হাইকোর্টের আদেশ অনুসারে সড়ক ভবনের কিছু অংশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি অংশও শিগগিরই আদালতের নির্দেশ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এর পর সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তি রক্ষার বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আদালতে তিনটি জাতীয় দৈনিক সমকাল, কালের কণ্ঠ ও আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাশিত সংবাদ উপস্থাপন করেন। পত্রিকাগুলোতে উচ্চ আদালতের সমালোচনা করে স্পিকারের বক্তব্য ছাপা হয়েছে জানিয়ে মনজিল মোরসেদ আদালতে তা পড়ে শোনান।
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, 'আমি কী হনুরে'_ এটা কোনো সংসদীয় ভাষা হতে পারে না। স্পিকার একজন আইনজীবী। তিনি কি জানেন না বিচারাধীন বিষয়ে উচ্চ আদালতের সমালোচনা করা যায় না। তখন 'কোর্টের বিচারে (রায়ে) জনগণ যদি ক্ষুব্ধ হয়, তাহলে বিচারকের বিরুদ্ধে এক সময় রুখে দাঁড়াতে পারে।' _স্পিকারের এ মন্তব্যের সমালোচনা করে আদালত বলেন, 'এটা পুরোপুরি আদালত অবমাননাকর। জনগণকে তিনি উসকে দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল অপরাধ করেছেন। সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে আদালত বলেন, সাংসদরা বিচার বিভাগের রায়সহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন। আইন প্রণয়নের জন্য সাংসদরা এটা করতে পারেন। স্পিকার বিচারাধীন বিষয়ে কোনোভাবেই সাংসদদের উসকে দিতে পারেন না। আইনজীবী হিসেবে স্পিকারের বার কাউন্সিলের সনদ থাকা উচিত কি-না তা নিয়েও এখন ভাবতে হবে। এ সময় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের একটি অংশ উল্লেখ করে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আদালতকে বলেন, 'স্পিকার বলেছেন, আইনমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে তাকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা যেত।' তখন আদালত বলেন, আইনমন্ত্রী কি বিচার বিভাগ চালায়। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা সরকারের কোনো সংস্থা বিচার বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে বলার কে? এ সময় বিচারকক্ষে উপস্থিত সাংসদ নুরুল ইসলাম সুজনের কাছে বিষয়টি জানতে চান। জবাবে সুজন বলেন, সেদিন আমি সংসদে ছিলাম। পত্রিকায় যেভাবে ছাপা হয়েছে এতটা আক্রমণাত্মক স্পিকার ছিলেন না। এ পর্র্যায়ে আদালত বলেন, টিভিতে সরাসরি সংসদের কার্যপ্রণালি দেখানো হয়। তা ছাড়া আদালতে উত্থাপিত তিনটি পত্রিকার বক্তব্য প্রায় একই ধরনের। এর পর ৪৫ মিনিট মধ্যাহ্ন বিরতির পর দুপুর পৌনে ৩টায় শুনানি শুরু হলে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সাংসদ সুজন আদালতে নিয়মিত প্র্যাকটিস করছেন। ওইদিন সংসদে তার উপস্থিতিতে স্পিকার কীভাবে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন বিষয়ের সমালোচনা করলেন। জবাবে কনিষ্ঠ বিচারপতি বলেন, এটা কোনো কথা হতে পারে না। তাহলে তো সাংসদ হতে হলে সবাইকে আইনজীবী হতে হবে। এ সময় সাংসদের কার্যপ্রণালি ও স্পিকারের ভূমিকা বিষয়ক যুক্তরাজ্যের আর্থার কিন মে এবং ভারতের একজন প্রখ্যাত লেখকের দুটি বইয়ের কিছু অংশ উদৃব্দত করে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, বিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে বিচার বিভাগ স্বাধীন। ব্রিটেনের একটি আদালত বিংশ শতাব্দীতে একটি ঘটনায় স্পিকার, পরে প্রধানমন্ত্রীকে তলব করেন। এ নিয়ে পরে রাজা মধ্যস্থতা করে বিচার বিভাগের পক্ষে মত দেন। আদালত বলেন, স্পিকার কোনোদিন এ বই পড়েছেন কি-না সন্দেহ রয়েছে। এ বই দূরে থাক এখন মনে হচ্ছে, সংবিধান ও আদালত সম্পর্কে নূ্যনতম জ্ঞান স্পিকারের আছে কি-না। জবাবে সাংসদ সুজন বলেন, স্পিকারের কাছে সঠিক তথ্য ছিল না। তখন আদালত বলেন, সড়ক বিভাগ ও শিশু একাডেমী ১৯৮৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তির কিছু অংশ লিজ নিয়েছিল। এ নিয়ে দেড় বছর মামলা চলার পর হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট সড়ক বিভাগ ও শিশু একাডেমীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। অর্থাৎ উচ্চ আদালত তাদের দখলে থাকা সম্পত্তি ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইতিমধ্যে সড়ক বিভাগও তাদের দখলে থাকা সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ ফেরত দিয়েছেন। অহেতুক এ নিয়ে জনগণকে কেন বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যায়ে আদালতে উপস্থিত হন সাবেক আইনমন্ত্রী আইনজীবী আবদুল মতিন খসরু। তাকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট বলেন, মি. খসরু আপনিও তো আইনমন্ত্রী ছিলেন? আপনি কি সুপ্রিম কোর্টকে পরিচালনা করতেন? আপনি কি বিচারপতিদের ডাণ্ডাবেড়ি পরাতেন? এ সময় অ্যাডভোকেট খসরু বলেন, কখনও নয়। সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন। আদালত বলেন, স্পিকারের বক্তব্য শুধু অজ্ঞতাই নয়, তার বক্তব্য অমার্জনীয়। খসরু বলেন, এ বিষয়ে এখানে থেমে যাওয়াই আমাদের সবার জন্য মঙ্গলজনক। এ সময় আদালত বলেন, স্পিকারই বিষয়টি শুরু করেছেন। আমাদের তো জবাব দিতেই হবে। উনি জনগণকে বিদ্রোহ করার জন্য উসকানি দিচ্ছেন। এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। খসরু বলেন, স্পিকার আবদুল হামিদ একজন আইনজীবী এবং অত্যন্ত সিনিয়র সংসদ সদস্য। তখন আদালত বলেন, উনি তো বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। আইন অনুযায়ী তিনি কোনো বিতর্কে অংশ নিতে পারেন না। আলোচনার সূত্রপাত তিনি করেছেন। আমরা তার বক্তব্যে হতবাক হয়েছি। দায়মুক্তির অপব্যবহার তিনি করতে পারেন না। তিনি জানেন, আমরা তাকে ডকে দাঁড় করাতে পারব না। তিনি ভীষণভাবে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছেন। তার বক্তব্যে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি। এ সময় খসরু বলেন, স্পিকার সংসদের প্রতীক। আদালত বলেন, ওই প্রতীক হতে হলে যোগ্যতা থাকতে হয়। পড়ালেখা জানতে হয়। তিনি বিচারাধীন বিষয়ে আলোচনায় শরিক হয়েছেন। এ পর্যায়ে খসরু বলেন, কারও বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। স্পিকারকে সঠিক তথ্য তুলে ধরা হবে। নিশ্চয় তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, আদালত স্বাধীন। এটা বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বীকৃত। ভারতে প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত আদালতে তলব করা হয়েছিল। তখন আদালত বলেন, পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রীকে কিছুদিন আগে সাজা দেওয়া হয়েছে। এর পর আদালতের আদেশে স্পিকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গটি এলে আইনজীবী আনিসুল হক হাতজোড় করে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের জন্য সংযত হতে অনুরোধ করেন। আনিসুল হক বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আর আপনি মুক্তিযোদ্ধা। দেশ ও জনগণের মঙ্গলের জন্য একবার ভাবুন। তখন দুই সাংসদ মতিন খসরু ও নুরুল ইসলাম সুজনসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীও আদালতকে দেশ এবং জনগণের মঙ্গলের জন্য বিচার বিভাগ ও সংসদকে মুখোমুখি না করতে অনুরোধ জানান। আবদুল মতিন খসরু বলেন, কোনো পক্ষ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে। তাদের ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। এ পর্যায়ে কনিষ্ঠ বিচারপতি সাউন্ড বক্সের সুইচ বন্ধ করে দেন। আদেশের বিষয়টি নিয়ে তারা সেখানে বসে প্রায় ১০ মিনিট আলোচনা করেন। এর পর খাসকামরায় গিয়ে প্রায় ৩০ মিনিট আলোচনা করেন দুই বিচারপতি। এরপর আদেশ দেওয়া হয়। আদেশে আরও বলা হয়, আদালত কখনও সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে নয়। কারণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ জনগণের কল্যাণে কাজ করছে। তাদের কাজ ও জবাবদিহিতা সংবিধান অনুসারেই নির্ধারিত রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন