মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১২

ভারতে প্রতিদিন অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যায় ৩ হাজার শিশু : দৈনিক ৩২ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়

ভারতের মধ্যপ্রদেশের শিবপুরি জেলার একটি জীর্ণশীর্ণ ক্লিনিকে ওজন মাপানোর জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল দু’বছর বয়সী শিশু রজনীকে। বিরামহীন কান্নারত রজনীর গায়ে কোনো পোশাক ছিল না। দেখা গেল, তার ওজন মাত্র ৫ কেজি। অথচ এ বয়সে তার ওজন হওয়ার কথা ছিল ১০ কেজি। বলা বাহুল্য, রজনী অস্থিসারসর্বস্ব এবং তার চাহনিও উদাসীন। তার ঠাকুরমা (দাদি) সুশিলা দেবী বলেন, ‘রজনী গাছের পাতার মতোই হালকা।’
এই করুণ অবস্থা শুধু রজনীর একার নয়। ভারত সরকার পরিচালিত সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে শুক্রবার রয়টার্স ও নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪২ শতাংশেরই ওজন কম। এ সংখ্যা সাব-সাহারান আফ্রিকার প্রায় দ্বিগুণ। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অপুষ্টিকর খাবার গ্রহণের কারণে সৃষ্ট রোগব্যাধিতে ভারতে দৈনিক ৩ হাজার শিশু মারা যায়। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একে ‘জাতীয় লজ্জা’ (ন্যাশনাল শেম) বলে মন্তব্য করেছেন।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, পুরো জনসংখ্যাকে বিবেচনায় নিলে ভারতের প্রায় ৫০ শতাংশ বা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই অপুষ্টির শিকার। ২০১১ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুযায়ী পৃথিবীর ৮৭টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬৭তম। ভারতের অবস্থা দুর্ভিক্ষপীড়িত রুয়ান্ডার চেয়েও খারাপ।
এসব ভয়ঙ্কর তথ্য ভারতকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। কারণ, এ দেশটি এখন সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। চলতি মাসেই দেড় হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত। ভারতীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠান নন্দী ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভারত স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির মাত্র ১.২ শতাংশ ব্যয় করে থাকে। এটা পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে কম। ভারতের মধ্যপ্রদেশের চিত্র সবচেয়ে ভয়াবহ। এখানে প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে ৫ বছর হওয়ার আগেই ১০৩টি শিশু মারা যায়। ইউনিসেফের হিসাবে, ভারতে ৫ বছর হওয়ার আগেই ১ হাজার শিশুর মধ্যে ৬৬ জন মারা যায়।
ভারতে পুষ্টি আর অনাহারের এ মর্মন্তুদ উপাত্তের বিপরীত চিত্রও লক্ষ্যণীয়। গত ১ জুন ভারতের খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ সাড়ে ৭ কোটি টনে পৌঁছেছে। তবে গুদাম সঙ্কটের কারণে আড়াই কোটি টন খাদ্যশস্যকে উন্মুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এ অবস্থায় রফতানির অনুমোদনের জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখন হিসাব-নিকাশ করে দেখছে ঠিক কী পরিমাণ খাদ্যশস্য রফতানির অনুমতি দেয়া যেতে পারে। বর্তমানে খাদ্যশস্য রফতানি স্থগিত আছে।
ভিন্ন ধারার ওয়েবসাইট কাউন্টারকারেন্টসে এক নিবন্ধে খাদ্য ও কৃষি নীতি বিষয়ক ভারতীয় বিশ্লেষক দেবিন্দর শর্মা লিখেছেন, ভারতের এ মজুদের হিসাবটি একটি অদ্ভুত প্যারাডক্স (আপাত স্ববিরোধী মনে হলেও বাস্তবে সত্য)। একদিকে ভারতের খাদ্যশস্য মজুদের পরিমাণ বাড়ছে অন্যদিকে প্রতিদিন ৩২ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। ভারতে অনাহারী এবং অপুষ্টির শিকার লোকদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার সমান।
খাদ্যশস্য ও ডালসহ ভারতে দৈনিক মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের হার ৪৪১ গ্রাম। ১৯৯১ সালে যখন ভারতে অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয় তখনও এর পরিমাণ ছিল ৪৮০ গ্রাম। এতে প্রমাণিত, ভারতে অনাহারী লোকের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে হাস্যকর যুক্তি উপস্থাপন করে বলা হয়, যেহেতু জনগণের আয় বাড়ছে, তাই অনেকেই খাদ্যশস্যের পরিবর্তে আরও পুষ্টিকর খাবার যেমন ডিম, মাংস, ফলমূল খাচ্ছে। বলাবাহুল্য, এ বক্তব্য সত্য নয়।
২০১০ সালের ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অর্গানাইজেশন পরিচালিত সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যশস্যের পাশাপাশি ডিম, মাংস, ফলমূলের ভোগও কমে যাচ্ছে। শহর ও গ্রাম উভয় এলাকার জন্যই এ তথ্য প্রযোজ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে খাদ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভারতে বিত্তহীন ও বিত্তশালীদের মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়েছে। জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশের পক্ষেই দু’বেলার খাবার কেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এর মানে হচ্ছে ভারতে অনাহারী লোকের সারি প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে।
দেবিন্দর শর্মা লিখেছেন, ‘খাদ্যশস্যের মজুদ বাড়ার কারণ হলো দরিদ্র ও অভাবী লোক খাদ্য কিনতে পারছে না। দুর্ভাগ্যজনক হলো, দরিদ্ররা অনাহারে থাকলেও ভারত খাদ্যশস্য রফতানির পাঁয়তারা করছে। এমনকি গত অর্থবছরেও ভারত ৭০ লাখ টন চাল রফতানি করেছে। এরফলে পৃথিবীর বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশে উন্নীত হয়েছে ভারত। রফতানির মাধ্যমে ভারত হয়তো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে কিন্তু প্রশ্ন হলো ভারতের এ বিশাল ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠীকে খাওয়ানোর দায়িত্ব কে নেবে?’
দেবিন্দর শর্মা লিখেছেন, ‘নিজ জনগোষ্ঠীকে ক্ষুধার্ত রেখে খাদ্যশস্য রফতানি করা সবচেয়ে বড় অপরাধ। সব নাগরিক যেন পেটভরে খেতে পারে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো ৭০ বছর আগে ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় ভারতে মাথাপিছু যে পরিমাণ খাদ্যশস্যের জোগান ছিল এখনও তাই রয়ে গেছে। আজও আমরা অনাহার ও উপবাসের ছায়াতলে বাস করছি।’
প্রথম পাতা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন