বৃহস্পতিবার, ৭ জুন, ২০১২

সংসদ-আদালত মুখোমুখি

বিচারপতি মানিকের অপসারণ চাইলেন সাংসদরা
উত্তপ্ত সংসদ :তিন দিনের আলটিমেটাম

উত্তপ্ত সংসদে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের অপসারণ দাবি করেছেন সাংসদরা। এ জন্য তিনদিনের আলটিমেটাম দেওয়ার কথাও বলেছেন তারা। তা না হলে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা পুনরায় সংসদেই ফিরিয়ে আনা হবে বলে উত্তপ্ত সংসদে জানিয়েছেন দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এ সময় সংসদের অধিবেশন কক্ষে থাকা সব সাংসদকে উল্লসিত হতে দেখা গেছে। সংসদ থেকে বলা হয়, বিচার বিভাগ স্বাধীন হতে পারে; কিন্তু তারা সংবিধান ও সংসদের ঊধর্ে্ব নয়। সংসদ থেকে বেশ
ক'জন সিনিয়র সাংসদ পয়েন্ট অব অর্ডারে এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা বা সংসদ থেকে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের কথা বলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনদিনের মধ্যে অপসারণের প্রস্তাব করা হয়। তবে অধিবেশনে সভাপতিত্বকারী ডেপুটি স্পিকার বলেন, এই সিদ্ধান্ত হলো যে, স্পিকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তিনি তার সিদ্ধান্ত জানাবেন।
আদালতের আদেশ প্রসঙ্গে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ সময় তিনি বলেন, ঘটনার বিষয়ে এখনও তিনি কিছু জানেন না। সাংবাদিকদের মাধ্যমেই শুনলাম। ফলে প্রতিক্রিয়া জানানোর কিছু নেই। তবে সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, পরে কখনও সংসদ অধিবেশনে স্পিকার এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন।
এর আগে বিকেলে অধিবেশন বসার পর থেকে গোটা সংসদ যেন ফুঁসছিল। এ বিষয়ে সংসদে কথা বলা হবে বলেও মাগরিবের বিরতিতে বেশ ক'জন সিনিয়র সাংসদ জানান। এর আগেই এ বিষয়ে জাসদের মইনউদ্দিন খান বাদল পয়েন্ট অব অর্ডার চাইলেও ডেপুটি স্পিকার তাকে সুযোগ দেননি। পরে মাগরিবের বিরতির পর তিনি আবার সুযোগ চাইলেও স্পিকার তাকে বুধবার পয়েন্ট অব অর্ডার দেবেন বলে জানান। এরপরই বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন পয়েন্ট অব অর্ডারে বিষয়টি তোলার জন্য দাঁড়ান। কিন্তু ডেপুটি স্পিকার তাকেও বুধবার সুযোগ দেবেন বলে জানান। এ সময় সব সাংসদ একযোগে শোরগোল শুরু করেন। সংসদে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে ডেপুটি স্পিকার রাশেদ খান মেননকে ফ্লোর দেন।
এরপরই একে একে সরকারি দলের সিনিয়র নেতারাও বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের নাম উল্লেখ করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। একে একে বক্তব্য রাখেন তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মইনউদ্দিন খান বাদল এবং মুজিবুল হক চুন্নু। তবে আইনজীবী পেশায় নিয়োজিত আছেন এমন কোনো সাংসদ কোনো কথা বলেননি। এ সময় সংসদ নেতা শেখ হাসিনা অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন না।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, যে ঘটনা আজ ঘটেছে তার নিন্দা জানানোর ভাষা তার নেই। '৭২ সালের সংবিধানে যেভাবে বিচারপতিদের অভিশংসনের সুযোগ রাখা ছিল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশোধন করে সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, একজন স্যাডিস্ট বিচারককে মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ বিচারক মানুষকে কষ্ট দিয়ে মজা পান। সালাম না দেওয়ায় পুলিশকে রাস্তায় কান ধরে ওঠবস করানো ছাড়াও তিনি বিমানে তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কিনে কীভাবে সামনের সারিতে আসন চান সেটি আমরা দেখেছি। তিনি হয়তো কোনো একদিন সাংসদদেরও একইভাবে দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইবেন।
এ পর্যায়ে তিনি বলেন, সাংসদদের এক হওয়া ছাড়া আর কোনো সুযোগ নেই। বিচার বিভাগ সর্বোচ্চ জেলে পাঠাতে পারবে। এটি নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই। তিনি বলেন, অনেক আন্দোলনের মাধ্যমে এগিয়েছি। বিচারপতিদেরও বুঝতে হবে, বিচারপতিদের বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা। এটি আমাদের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, অবাক হয়ে গেলাম কীভাবে একজন বিচারক সংবিধান লঙ্ঘন করেন। তিনি প্রশ্ন করেন, তাহলে কি বিচার বিভাগ সংসদের ঊধর্ে্ব উঠে গেল? তিনি বলেন, এই বিচারপতিকে আগেরবার আওয়ামী লীগ চাকরি দিয়েছিল; কিন্তু জোট সরকার তার চাকরি স্থায়ী করেনি। এবার আবার আওয়ামী লীগ এসে তার চাকরি কনফার্ম করেছে। আর তিনিই কি-না একজন মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে এমন কথা বলেন!
আদালতের রায়কে সংবিধানের ওপর বিচার বিভাগের নগ্ন হস্তক্ষেপ মন্তব্য করে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিচার বিভাগ সংসদের ওপর সার্বভৌম হতে পারে না। বিচারপতিরা সংসদের ঊধর্ে্ব নন। এ ধরনের আদেশকে আমরা সংসদের ওপর বিচার বিভাগের নগ্ন হস্তক্ষেপ মনে করি।
তিনি বলেন, বিচারপতি স্পিকারকে অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী বলে অভিহিত করেছেন। সংসদের কোনো বিষয় নিয়ে আদালতে যাওয়ার কোনো অধিকার নেই। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের হাত লম্বা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাদের হাত সংসদের চেয়েও লম্বা। বিচার বিভাগ কীভাবে স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলেন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, স্পিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা মানে সংসদ, সাড়ে তিনশ' সাংসদ, সরকার_ সবাইকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল করা। সংসদের ওপর বিচার বিভগের হাত নেই। স্পিকারকে অপমান করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের নেই। এই বিচার বিভাগের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আদালতে বসে যা কিছু করবেন, সংবিধান লঙ্ঘন করবেন, এটা হতে পারে না। সবকিছুর এটা সীমা আছে।
তিনি স্পিকারের উদ্দেশে বলেন, সংসদের ওপর বিচার বিভাগের এ নগ্ন হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য সংসদে প্রস্তাব চাই। সংসদের ওপর হস্তক্ষেপকারী ওই বিচারপতিকে বিচার বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে সংসদের সার্বভৌম রক্ষা করতে চাই।
রাশেদ খান মেনন একটি অনলাইন বার্তা সংস্থার সংবাদের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, সংসদে আলোচনার বিষয় নিয়ে আদালত কোনো কার্যধারা গ্রহণ করতে পারেন না। বিচারপতি বিষয়টি কার্যধারায় নিয়েছেন শুধু তাই নয়, বলেছেন, স্পিকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল অপরাধ করছেন। স্পিকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিচারপতি সংসদের আলোচনার কোনো বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন না। সংসদের বিষয় নিয়ে কথা বলা সঙ্গত মনে করি না। বিচারপতি এটা করে এই হাউসের সার্বভৌমত্ব ও অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করেছেন। সংবিধান, সংসদকে অবহেলা করেছেন। এটা সংবিধানের ৭৩ ধারার লঙ্ঘন। এ ব্যাপারে সংসদকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, বিচারপতি স্পিকারের অ্যাডভোকেটশিপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, যা তিনি করতে পারেন না।
মেনন এবং সেলিমের পর ডেপুটি স্পিকার আর কোনো সাংসদকে সুযোগ দিতে না চাইলে আবার সাংসদরা হৈ-হৈ করে ওঠেন। তা ছাড়া বিভিন্নজনের বক্তব্যের মাঝে সাংসদরা 'শেম শেম' বলে মন্তব্য করতে থাকেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, '৭২ সালের সংবিধানে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দেওয়া হয়েছিল। ওই ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না। এ সময় তিনি প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনারাই সংবিধানে দেওয়া আপনাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করেন। অবিলম্বে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন করুন। তিনি বলেন, সংবিধান লঙ্ঘন করে ইতিমধ্যেই তিনি (এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী) বিচারপতির পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তিনদিনের মধ্যে অভিশংসন করুন। না হলে সংসদ থেকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই আহ্বান সুরঞ্জিত রাষ্ট্রপতির কাছেও রাখেন।
তিনি বলেন, সংবিধানের হেফাজত করার ক্ষমতা সংসদ ও সাংসদদের হাতে। কেউ যাতে সংবিধানের লঙ্ঘন করতে না পারে সেটি সাংসদরাই দেখবেন। যিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেন তাকে আর ওই পদে রাখা কোনো অবস্থাতেই সমীচীন হবে না।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সামান্য কারণে ওই বিচারপতি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের দাঁড় করিয়ে রাখেন। সবকিছু দেখে মনে হয়েছে, তিনি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রবর্তন করে তার অভিশংসন হওয়া প্রয়োজন।
মইনউদ্দিন খান বাদল বলেন, এ দেশেও পাকিস্তানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে যিনি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন তাকে অজ্ঞ বলা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। সংবিধানের কথা নিয়ে আদালতের কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের একটি অঙ্গকে অপর একটি অঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হচ্ছে। এটিও মেনে নেওয়া যায় না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন