রবিবার, ২০ মে, ২০১২

হিলারী ও মেরুদন্ড সমস্যা



বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার ‘গরীব’ দেশগুলো রফতানি করে খাদ্য বস্ত্রসহ এমন ভোগ্যপণ্য, যা দিয়ে মানুষ বাঁচে। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ ‘ধনী’ দেশগুলো রফতানি করে অস্ত্র, যা দিয়ে মানুষ মরে।
সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছিলেন নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন ও বিনিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে কথা বলতে। সংবাদপত্র, টিভি টকশো, বিবরণী, ‘আড্ডা’ সর্বত্র এটাকে বাংলাদেশের জন্য ‘বিরাট সুযোগ’ ‘বিরাট সম্ভাবনা’ হিসাবেই দেখানো হয়েছে। হিলারী ক্লিনটনের সফরের আসল বৃত্তান্ত নিয়ে কমই জানা যাবে। বোঝার জন্য কোন সুযোগও রাখা হয়নি। সরকার, প্রধান বিরোধী দল, মিডিয়া, সুশীল সমাজ সর্বত্র এত মুগ্ধতা, গদগদভাব আর সম্মতি ছিল যে কোথাও কোন ভিন্নমত, যথাযথ তথ্য উপস্থাপন কিংবা প্রশ্নেরও সুযোগ ছিল না। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের ভদ্রলোকদের চরিত্রে কি মেরুদন্ডের কোন স্থায়ী সমস্যা আছে? নইলে দেশি বিদেশি ক্ষমতাবানদের সামনে সবসময় এরকম প্রভুতোষণ চেহারা দেখা যায় কেন? তোষণ, তোষামোদ, হাত কচলানো, নতজানু , নতমস্তক, হাত পা ধরা, নুইয়ে পড়া, নিজেদের ছোট করে ধন্য হওয়া এগুলোর এত উপদ্রব কেনো? এই স্বভাব যাদের তাদের সম্পদ আছে, ক্ষমতা আছে। বোঝা যায়, আরও দরকার। এরাই যেহেতু সমাজের নানাক্ষেত্রে ক্ষমতাবান, সেহেতু এদের সমষ্টিগত উচ্ছাসে আচ্ছন্নতা তৈরি হয় চারিদিকে। আগ্রাসনকে ভালবাসা, যুদ্ধকে শান্তি, ধ্বংসকে তখন উন্নয়ন মনে হতে থাকে তখন।
সেজন্য শুধু হিলারী কেন, একের পর এক সফররত কোনো মার্কিনী কর্মকর্তার সামনেই বাংলাদেশের জন্য বহু প্রয়োজনীয় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়না। মিডিয়ার আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকার কারণে সমাজের মধ্যেও এই জরুরী প্রশ্নগুলো যায় না। অনেক চুক্তি, গোপন সমঝোতা দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে, যেগুলো জনগণের আড়ালেই থাকে। হিলারীও তাই বাংলাদেশে মার্কিন সেনাবাহিনীর অবস্থান, বাংলাদেশ-মার্কিন গোপন সামরিক চুক্তি, মার্কিন-ভারত চুক্তি, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি করা ও সমুদ্রের গ্যাস ব্লক মার্কিন কোম্পানিকে দেবার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের চাপ, শেভ্রনের পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতা সত্ত্বেও তার জন্য মার্কিন অব্যাহত তদ্বির, সারা বিশ্বে মার্কিনী সন্ত্রাস, বাংলাদেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক, মার্কিন কোম্পানির কাছে আমাদের পাওনা ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি কোনো প্রশ্নেরই মুখোমুখি হননি।
এটা কেন হয়? কীভাবে হয়? এই বিষয় নিয়ে নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় বিশ্লেষণ করেছেন। এই লেখায় ক্রিস হেজেস-এর এম্পায়ার অব ইল্যুশন (২০০৯) থেকে যে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তার সারকথা হল, এই অবনত সংস্কৃতি এমন একটি মায়াময় বিশ্ব তৈরি করে যে, তা মানুষের সামনে বিশ্বের প্রাকৃতিক অবক্ষয়, বিশ্ব পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা, ক্রমবর্ধমান তেল সংকট, বিশ্ব অর্থখাতের ধ্বস, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সবকিছুকে তুচ্ছ কিংবা অদৃশ্য করে দেয়। …. এই মায়ার সংস্কৃতি আমাদের মায়া থেকে সত্যকে আলাদা করবার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। আমরা শিশুর মতো পুতুল চালক, যারা নিজেরাই পুতুল, তাদের দ্বারা পরিচালিত হই। টেলিভিশন, প্রচার, বাজারজাত করণের কৌশল, ফটোগ্রাফ, খবর, সাজানো প্রশ্নোত্তর সবকিছু একের পর এক আমাদের বোধবুদ্ধি ভোঁতা করে দিয়ে এক মায়ার জগতে সম্মতি নিয়ে হাজির হতে প্ররোচিত করে। ( ‘ইয়েস’,‘ওয়াও’, ইয়ুথ আড্ডা উইথ হিলারী, নিউ এইজ, ১৪ মে ২০১২)
আমাদের ‘কর্তা’দের কথায় মনে হয়, বাংলাদেশের পণ্য যে যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে সেটা তাদের প্রয়োজন নয়, তাদের দয়া। তারা আমদানি করলেও দয়া, রফতানি করলেও দয়া। তারা বিনিয়োগ করলেও সেটা অনুগ্রহের বিষয়। অথচ তারা ঋণ অনুদান নামে যে তহবিল বরাদ্দ করে তার ৪ গুণ বেশি অর্থ বাংলাদেশ শুল্ক হিসেবে প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্রকে। মার্কিন তেল কোম্পানি শেভ্রন যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তার কয়েকগুণ ইতিমধ্যে দেশে প্রেরণ করেছে। গত ৬ বছরে তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনতে আমাদের খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা, যে পরিমাণ গ্যাস আমাদের জাতীয় সংস্থা ২ হাজার কোটি টাকায় সম্পাদন করতে পারতো। তাদেরই আরেকটি কোম্পানি অক্সিডেন্টাল মাগুড়ছড়ায় যে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে তা পুরো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ১ বছরে যে গ্যাস ব্যবহার হয় তার সমান। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এই গ্যাস কিনতে বাংলাদেশের যে অর্থ প্রয়োজন তা তাদের ১০ বছরের বার্ষিক ঋণ অনুদানের সমান।
২০১০-১১ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করেছে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার পণ্য, এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই গার্মেন্টস। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে মাত্র ৬৭ কোটি মার্কিন ডলার। দুনিয়াজুড়ে অস্ত্র রফতানিতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অবস্থান। বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার ‘গরীব’ দেশগুলো রফতানি করে খাদ্য বস্ত্রসহ এমন ভোগ্যপণ্য, যা দিয়ে মানুষ বাঁচে। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ ‘ধনী’ দেশগুলো রফতানি করে অস্ত্র, যা দিয়ে মানুষ মরে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ যা রফতানি করে তার ওপর শুল্ক দিতে হয় শতকরা ১৫.৩ ভাগ। অথচ তাদের গড় শুল্কহার শতকরা ২ ভাগেরও কম। ফ্রান্স, বৃটেন ও সৌদী আরব থেকে পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক শতকরা ১ ভাগেরও কম। অতএব বাংলাদেশ একটি বড় আকারের বৈষম্যের শিকার। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পণ্য আমদানি বিষয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধি ও সাধারণ চর্চার সাথে এটা অসঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, কিংবা বিদ্যমান বৈষম্যের অবসান কোনো দয়াদাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়, বাংলাদেশ এটা নিশ্চয়ই দাবি করতে পারে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস দিয়ে তাদের রাষ্ট্র, ব্যবসায়ীরা এই দেশের মালিকদের থেকে বেশি মুনাফা করে। শুল্কমুক্ত না হলেও শুধু যদি শুল্ক শতকরা ৫০ ভাগ কমে তাহলেও তথাকথিত বিদেশি সাহায্য নামের তহবিলের তুলনায় তার পরিমাণ বেশি হবে।
হিলারীর এই সফর বাংলাদেশের নিরাপত্তা, শান্তি আর সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রক্রিয়া শক্তিশালী করবে বলে আমরা বারবার শুনছি। এত ভক্তি এত সালাম এত নিবেদনের মধ্যে খুব সরল কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করাই কঠিন। মার্কিন প্রশাসন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার যে বর্ণনা দেয়, তাতে কোন রাষ্ট্রশক্তি ছাড়াই কতিপয় সন্ত্র্রাসী যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি ভবন টুইন টাওয়ার গুড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল, এমনকি পেন্টাগনেও হামলা পরিচালনা করেছিল। বিশ্বের সবচাইতে দক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের ঠেকাতে পারেনি, সেজন্য সিআইএ, এফবিআই বা সম্পর্কিত কোন সংস্থার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। এনিয়ে কোনো তদন্তকাজও ঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। তাদের বর্ণনা যদি সত্যিও ধরি তাহলে প্রশ্ন হল, যে রাষ্ট্র কতিপয় ব্যক্তি সন্ত্রাসীর হাত থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষম, তার কোন কুলকিনারাও করতে পারে না সে কী করে অন্যের নিরাপত্তা দেবে? নিরাপত্তার নাম দিয়ে বঙ্গোপসাগর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বহুদিনের। ঐ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক বেসামরিক লোকজনের ঘন ঘন সফর থেকে যে কেউ এটা উপলব্ধি করবেন। কিন্তু কাকে কার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র? যারা আমাদের জন্য হুমকি হতে পারে তাদের সাথেই তো যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ মহড়া। ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের কথা আমাদের কখনোই ভুলে যাওয়া উচিৎ হবে না। যে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করে ইরাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করলো, তাদের ওপর আমরা বাংলাদেশের নিরাপত্তার ভার ছাড়বো?
প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ সারাবিশ্বের মানুষ, সহযোগী সারাবিশ্বের তাবৎ সন্ত্রাসীরা। এই তথ্য তাই সবার সবসময় মনে রাখা উচিৎ যে, বর্তমান বিশ্বে সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। মার্কিন গবেষক উইলিয়াম ব্লুম যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সন্ত্রাসী তৎপরতার প্রামাণ্য বিবরণ দিয়ে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাদের রেকর্ডে এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নির্বাচিত সরকার উচ্ছেদ, নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, সামরিক অভ্যুত্থান, গণহত্যা, অন্তর্ঘাতসহ সব বর্বরতা অন্তভর্’ক্ত। বিশ্বে বর্তমানে সামরিক খাতে বার্ষিক ব্যয় বা হত্যা ধ্বংসের প্রধান অংশই যুক্তরাষ্ট্রের ভাগে, একাই শতকরা প্রায় ৬০ ভাগের বেশি। যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজেই একটি সামরিক দুর্গ, একটি ক্যান্টনমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের বহু মানুষ এখন অনাহারে, কর্মহীন, চিকিৎসার সুযোগ বঞ্চিত। অথচ মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ ইরাক যুদ্ধব্যয়ের হিসাব করে দেখিয়েছেন, প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে ইরাকে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে, যার সুবিধাভোগী অস্ত্র ও তেল ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও আমলা। কৃত্রিম বানানো শত্রুর ভয়ংকর চেহারা তৈরি করে আতংকিত আবহাওয়া তৈরি করা হয় মার্কিন জনগণের মধ্যে। এবং তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার অর্থ বিনা বাধায় যুদ্ধখাতে স্থানান্তরিত হয়। সেখানেই মার্কিন ক্ষমতাবানদের মুনাফার পাহাড়।
যে কাজ সরাসরি হত্যা, দখল, ধ্বংস আর কিছু নয়- তাই মানুষের সামনে উপস্থিত করা হয় ‘সার্বভৌমত্ব’ ‘মুক্তি’ ‘নিরাপত্তা’ ‘গণতন্ত্র’ ‘স্বাধীনতা’ রক্ষা, কিংবা ‘সন্ত্রাস’ দমনের উপায় হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক কার্যক্রমের জন্য বরাবর ‘নিরাপত্তার হুমকি’ হিসেবে কোন না কোন দেশ বা শক্তিকে দেখিয়েছে। ক্ষুদ্র কিউবা বা নিকারাগুয়াকেও আগ্রাসী শক্তি হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে। প্রচারণার কল্যাণে এসব দেশও, কিংবা বহু দূরের ভিয়েতনাম বা কোরিয়া বা ইরান মার্কিন জনগণকে আতংকিত করতে পেরেছে। এখন আতংক আরও বিস্তৃত হয় কোন গুহায় বসবাসরত কল্পিত কিংবা নিজেদের নির্মিত ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’ দিয়ে। অনেক সরল তথ্যকেও এসব প্রচারণা আড়াল করে ফেলে।
২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান সরাসরি মার্কিনী নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর হাতে। এই সময়কালে জাতিসংঘের ড্রাগ অফিসের তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানে হিরোইন উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। এর আগে তালিবান, তারও আগে মুজাহিদীনরাও মার্কিনী মদদেই ক্ষমতায় বসেছিল। মার্কিনী বাহিনী মুজাহেদীনদের মদদ দিয়েছিল এমন সরকারের বিরুদ্ধে – যারা ভূমি সংস্কার করতে উদ্যোগ নিয়েছিল, নারীর শিক্ষা ও চিকিৎসার পথে সব বাধা দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছিল। এখন মার্কিন কর্তৃত্বাধীন আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমে হিরোইনের শতকরা ৭০ ভাগ যোগান যায়, যেখানে আফগানিস্তানের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার অনেক নীচে বাস করেন। আর এই মাদক সরববরাহের রাস্তাও পরিষ্কার রাখা হয়েছে মার্কিনী নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় এশীয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ দিয়ে, এর মধ্যে অন্যতম তাজিকিস্তান। এই দেশের মানুষদের এখন প্রধান কর্মসংস্থান এই মাদকদ্রব্য চালান কাজ। করপোরেট বিশ্বের মুখপাত্র ইকনমিস্ট পত্রিকা জানাচ্ছে, ‘তাজিকিস্তানের জিডিপির শতকরা ৩০-৫০ ভাগ এই মাদকদ্রব্য চালান ‘শিল্প’ থেকেই আসে।’ পত্রিকাটি আরও জানাচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ জোট ন্যাটো তাজিকিস্তানের এই তৎপরতায় বাধা দিতে আগ্রহী নয়। বরং সেখানকার মার্কিন সাহায্যে পরিচালিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্মকর্তারাই এই কাজে নেতৃত্ব দেয়, তা তাদের অনুমোদনেই ঘটে। ন্যাটো যুক্তরাষ্ট্র এই অবস্থার পরিবর্তন চায় না। কেন? তাদের যুক্তি, কারণ তা করতে গেলে আফগানিস্তানে তাদের যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাজিকিস্তানে তাদের ভারসাম্য নষ্ট হবে। সেই দেশে দারিদ্র এখন ভয়াবহ, অনেক স্থানে এখন ২৪ ঘন্টায় ২ ঘন্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। (ইকনমিষ্ট, এপ্রিল ২১-২৭, ২০১২) এই হল যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমন, শান্তি ও নিরাপত্তায় সহযোগিতার ধরন।
হিলারীর সফরের পর ‘একুইজিশন এ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক চুক্তি সম্পাদনের জন্য চাপও বাড়ছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায় (নিউ এজ, ১৩ মে, ২০১২)। সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের নামে বিপুল অস্ত্রক্রয়েরও চাপ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারী এফেয়ার্স’ এর সহকারী সেক্রেটারী এন্ড্রু জে শেপিরো ঢাকা সফর করেন গত ১৯ এপ্রিল। ২৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে তিনি এক বক্তৃতায় বলেন, ‘এই আধুনিকীকরণ কর্মসূচি আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা সম্প্রসারণের সুযোগ দেবে…আমাদের বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র সহযোগীদের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে।’
বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব এবং খনিজ সম্পদের বিপুল আধার বাংলাদেশের ভূমি ও সমুদ্রে কর্তৃত্ব বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে বিশেষভাবে সক্রিয় করে তুলেছে। আর এই সক্রিয়তা দেখে আমাদের দেশের অনেক নির্বোধ কিংবা অনুগত কর্তাব্যক্তি বা সুশীল ‘বিশেষজ্ঞরা’ মুগ্ধ। এতেই নাকি বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে! যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশের ওপর ভর করে, আর সেই দেশ যদি তাদের ভৃত্য হিসেবে সার্ভিস দিতে থাকে তার কী পরিণতি হয় তা দেখার জন্য আছে পাকিস্তান নামক তাবেদার রাষ্ট্রটি।

মেরুদন্ডের সমস্যাওয়ালা লোকেরা এই দেশের নানা ক্ষেত্রে মাথা হয়ে থাকায় জাতির মাথা বারবার হেঁট হচ্ছে, বিপদ ও বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে নানা মাত্রায়। এদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত না করতে পারলে আমাদের কোন উদ্ধার নাই। এটাই ভরসার কথা যে, এরাই বাংলাদেশ নয়। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করেই মানুষ যুদ্ধ করে বাংলাদেশ এনেছেন। ১৯৯৮ সাল থেকে মার্কিন প্রশাসনের প্রবল চাপ ছিল বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রফতানি করা আর চট্টগ্রাম বন্দর তাদের এক জালিয়াত কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া। জনগণ মেরুদন্ড নিয়েই এর সবই প্রতিরোধ করেছেন। দেশের পানি, আবাদী জমি ও মানুষের সর্বনাশ করে ফুলবাড়ী উন্মুক্ত খনি করতে চেয়েছিল এরা। মানুষ জীবন দিয়ে তা ঠেকিয়েছেন। এটা হয়নি, হবে না। মেরুদন্ডহীনদের তোষামোদী সত্ত্বেও কনোকো ফিলিপসের সাথেও জনগণের মোকাবিলা চলছে। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ লুট ও পাচার এদেশের মানুষ কোনভাবেই হতে দেবে না। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের দানবীয় আগ্রাসনের মুখেও, তাকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করবার সাহস দেখানোর তাই যথেষ্ট কারণ আছে।
১৮ মে ২০১২
আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন