মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১২

মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিল ও বর্তমানের করণীয়


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে কয়েকটি ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ ও দিক-নির্ধারণী হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে, মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে অনুষ্ঠিত ফারাক্কা মিছিল সে সময়ে জাতীয় স্বার্থে খুবই ফলপ্রসূ অবদান রেখেছিল। এখনও ফারাক্কা মিছিলের তাত্পর্য বিশেষভাবে অনুধাবন করা দরকার। কারণ, ভারতের যে পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী মিছিলটির আয়োজন করেছিলেন, সে পানি আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। দেশটি একইসঙ্গে পানি আগ্রাসনকে আরও ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর করে চলেছে। ভারত আমাদের শুধু পানির ন্যায্য হিস্যা থেকেই বঞ্চিত করছে না, বাংলাদেশকে পানি-প্রতিবন্ধী রাষ্ট্রেও পরিণত করতে চাচ্ছে। সুতরাং ফারাক্কা মিছিলের ইতিহাস স্মরণ করার পাশাপাশি বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দরকার ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলা।
প্রথমে ফারাক্কা মিছিলের কথা সেরে নেয়া যাক। মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে, ৯৬ বছর বয়সে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এ ঐতিহাসিক মহামিছিলের আহ্বান জানিয়েছিলেন। নেতৃত্বও তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। লাখ লাখ নারী-পুরুষ সে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন (১৬ মে, ১৯৭৬)। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে মওলানা ভাসানীর দেয়া মাত্র ১০ মিনিটের এক ভাষণের মধ্য দিয়ে মিছিলের শুরু হয়েছিল। রাজশাহী, প্রেমতলী, নবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জ হয়ে কানসাটে গিয়ে ১৭ মে মিছিলের সমাপ্তি টেনেছিলেন মওলানা ভাসানী। পায়ে হেঁটে দু’দিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন মিছিলকারীরা। কানসাট হাই স্কুল ময়দানে ফারাক্কা মিছিলের সমাপ্তি ঘোষণার সময় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে ভারত সরকারকে বাধ্য করার জন্য আমাদের আন্দোলনের এখানেই শেষ নয়।’ ফারাক্কা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়ে মওলানা ভাসানী আরও বলেছিলেন, ‘ভারত সরকারের জানা উচিত, বাংলাদেশীরা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না, কারও হুমকিকে পরোয়া করে না।...’
ফারাক্কা মিছিল মওলানা ভাসানীর দিক থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন কর্মসূচি ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দেয়াকে পুঁজি বানিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রাথমিক দিনগুলোতেই ভারতের আধিপত্যবাদী সরকার ও তার সহযোগীরা বাংলাদেশকে অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা ও সহযোগিতার সুযোগে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ও অন্যান্য সম্পদ পাচার হয়েছে ভারতে। সমগ্র দেশ ছেয়ে গেছে ভারতীয় পণ্যে, চোরাচালান হয়েছে সর্বব্যাপী। গোপন ও প্রকাশ্য বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমেও বাংলাদেশকে রাতারাতি ভারতের ইচ্ছার অধীনস্থ করা হয়েছিল। এই কার্যক্রমকে আরও এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’ নামে পরিচিত এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বেরুবাড়ী ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে তিনবিঘা করিডোরসহ বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো আদায় করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার।
একইসঙ্গে ভারত পেয়েছিল ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সম্মতি। এই সম্মতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের জন্য মরণ বাঁধ হিসেবে চিহ্নিত ফারাক্কা বাঁধ চালু করার ব্যাপারে ভারত নিয়েছিল চাতুরিপূর্ণ কৌশল। মুজিব-ইন্দিরা যুক্ত ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ফারাক্কা বাঁধ সম্পূর্ণরূপে চালু করার আগে শুষ্ক মৌসুমে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ নিয়ে উভয় পক্ষ যাতে সমঝোতায় আসতে পারে সেজন্য ভারত প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে ফিডার ক্যানেল চালু করবে। যুক্ত ইশতেহারের এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারত ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছিল। কিন্তু ৪১ দিনের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ভারত ফিডার ক্যানেল দিয়ে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না করেই ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে গঙ্গার পানি নিয়ে যায়। এর ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। ভারতের এই একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে সর্বনাশ সূচিত হয়েছিল। দেশ ও জাতির সেই দুঃসময়ে অভয় ও আশ্বাসের বাণী মুখে এগিয়ে এসেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ভারতের শাসকগোষ্ঠীবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি প্রথম থেকেই ফারাক্কা বাঁধের বিরোধিতা করে এসেছেন। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বিরুদ্ধেও তিনি কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এবং ভারতকে বেরুবাড়ী না দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরদিন, ১৯৭৪ সালের ১৭ মে এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক শীর্ষ সম্মেলনে ফারাক্কা বাঁধের পানি বণ্টনের মীমাংসা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য হায়াত ও মউতের প্রশ্ন ছিল। কিন্তু ইহার কোনো মীমাংসা করা হয়নি।’
ভারত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের দেয়া সম্মতির আড়াল নেয়ায় ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল। একদিকে ভারতের পক্ষ থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে সৃষ্ট সঙ্কট এবং অন্যদিকে সীমান্তে সশস্ত্র আক্রমণ ও সামরিক তত্পরতার ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত অভ্যুত্থানে বাকশাল সরকারের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর থেকে সীমান্তে সশস্ত্র হামলা শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের মুজিব অনুসারীদের নাম প্রচার করা হলেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হামলা আসলে ভারতের সেনাবাহিনী এবং বিএসএফ চালাচ্ছিল। ভারতের এই যুদ্ধবাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ব্যাপকভাবে সীমান্ত এলাকা সফর করেন। সন্তোষে ফিরে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আক্রমণের কলাকৌশল ও ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা দেখিলে যে কোনো পর্যবেক্ষকই স্বীকার করিবেন যে, সাধারণ দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা এই কাজ সম্ভব নহে; বরং ইহা অভিজ্ঞ ও দক্ষ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারাই সংঘটিত হইয়াছে।’ (৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬)
মওলানা ভাসানী এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে নিজের চোখে সীমান্ত পরিস্থিতি দেখে যাওয়ার জন্য তার প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি ১৯৭৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এক ‘খোলা চিঠি’তে ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের কন্যা হিসেবে সম্বোধন করে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘বিশ্বের অন্যতম মহাপুরুষ মহাত্মা গান্ধীকে আপনার দেশের বিশ্বাসঘাতক নথুরাম গডসে হত্যা করিয়া যে মহাপাপ করিয়াছে তাহার চেয়েও জঘন্য পাপ আপনার দেশের দস্যুরা করিতেছে।’ সীমান্তের গোলযোগ ও জনগণের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিয়ে মওলানা ভাসানী তার ‘খোলা চিঠি’তে লেখেন, ‘আমার আন্তরিক আশা, আপনি স্বচক্ষে দেখিলেই ইহার আশু প্রতিকার হইবে এবং বাংলাদেশ ও হিন্দুস্থানের মধ্যে ঝগড়া-কলহের নিষ্পত্তি হইয়া পুনরায় বন্ধুত্ব কায়েম হইবে। ফারাক্কা বাঁধের দরুন উত্তরবঙ্গের উর্বর ভূমি কিভাবে শ্মশানে পরিণত হইতেছে তাহাও স্বচক্ষে দেখিতে পাইবেন।’
উদাত্ত আহ্বান জানানো সত্ত্বেও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ার পরই মওলানা ভাসানী ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। আরও একবার ফারাক্কা কবলিত উত্তরবঙ্গ সফর শেষে ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে আয়োজিত এক সমাবেশে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘গঙ্গা আন্তর্জাতিক নদী। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী ভারত এককভাবে এই নদীর পানি ব্যবহার করতে পারে না।’ প্রতিবাদী কর্মসূচি হিসেবে ফারাক্কা মিছিলের জন্য ১৬ মে-কে বেছে নেয়ার পেছনেও মওলানা ভাসানীর স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। কারণ ১৯৭৪ সালের ওই দিনটিতেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি। ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করতে গিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘ভারত সরকার পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ন্যায্য অধিকারের উপর হামলা চালালে বাংলাদেশের আট কোটি মানুষ তা জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করবে।’
ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি মওলানা ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একটি চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। এই চিঠিতেও তিনি ফারাক্কা সমস্যার সমাধান এবং বাংলাদেশকে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারত সরকার যদি কিছু না করে তাহলে আমরা ভারতের ষাট কোটি জনতার কাছে বিচার চাইব।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালের ৪ মে। মওলানা ভাসানীর চিঠিতে তিনি ‘ব্যথিত ও বিস্মিত’ হয়েছেন জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধী লিখেছিলেন, ‘এ কথা কল্পনাও করা যায় না যে, যিনি আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নিজের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে দুঃখ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে শরিক হয়েছেন, সেই তিনি এখন কীভাবে এতটা মারাত্মকরূপে আমাদের ভুল বুঝেছেন, এমনকি প্রশ্ন তুলেছেন আমাদের উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে।’ ১৫৬ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পক্ষে ‘পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়’ জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধী সবশেষে লিখেছেন, ‘আমি আশ্বাস দিয়ে আপনাকে বলতে চাই, যে কোনো যুক্তিসঙ্গত আলোচনার জন্য আমাদের দরজা খোলা থাকবে। কিন্তু কারও এ কথা মনে করা উচিত নয় যে, ভারত কোনো হুমকি বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অযৌক্তিক দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করবে।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চিঠিতে মওলানা ভাসানীর অনুরোধ উপেক্ষিত হয়েছিল। তাছাড়া বিশেষ করে শেষের বাক্যে ছিল প্রচ্ছন্ন হুমকি। জবাবে ফারাক্কার কারণে ক্ষয়ক্ষতি নিজের চোখে দেখে যাওয়ার জন্য আরও একবার আহ্বান জানিয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে মওলানা ভাসানী লিখেছিলেন, ‘পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে আমি আপনার মনোভাবের প্রশংসা করি। কিন্তু সে সমাধান হতে হবে স্থায়ী এবং ব্যাপকভিত্তিক। এই সমাধান শুধু শুষ্ক মৌসুমের জন্য হলে চলবে না, সারা বছর ধরে পানির প্রবাহ একই পরিমাণ হতে হবে।’ সংঘাত ও শত্রুতা এড়িয়ে এবং আমলাদের পরিবর্তে রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্জন করার আহ্বানের পুনরুল্লেখ করে চিঠির শেষ দিকে মওলানা ভাসানী লিখেছিলেন, ‘আপনি যদি আমার এই অনুরোধ রক্ষা না করেন, তাহলে সমস্যার সমাধান অর্জনের জন্য আমি নির্যাতিত জনগণের নেতৃবৃন্দ তথা আপনার পূর্বপুরুষ ও মহাত্মা গান্ধীর কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার ভিত্তিতে আমার ভবিষ্যত্ সংগ্রামের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে বাধ্য হবো।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আর কোনো সাড়া না পাওয়ায় মওলানা ভাসানী ফারাক্কা মিছিলের কর্মসূচি পরিবর্তন করেননি। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে অনুষ্ঠিত ফারাক্কা মিছিল ছিল মওলানা ভাসানীর সমগ্র কর্মসূচির অংশ। সে বছরের ১৮ এপ্রিল কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার পর স্বল্প সংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এবং ভারতপন্থী কয়েকটি দল ছাড়া সব দল সমবেত হয়েছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে। ‘চলো চলো—ফারাক্কা চলো’ স্লোগান মুখে সারাদেশ থেকে লাখ লাখ নারী-পুরুষ গিয়েছিল রাজশাহী—ফারাক্কা মিছিলের সূচনাস্থলে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ বিশাল মিছিল গিয়েছিল ফারাক্কা অভিমুখে। পরদিন ১৭ মে মিছিল শেষ হয়েছিল কানসাটে গিয়ে, বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে। এই মিছিলের আতঙ্কে ভারত সরকার রীতিমত যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের দরিদ্র নিরস্ত্র মানুষের ভয়ে ভারতকে যখন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করতে হয়েছে, তখন তার অবিলম্বে ফারাক্কা সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা উচিত।’
একথা সত্য যে, ভারতের সম্প্রসারণবাদী ও অবন্ধুসুলভ মনোভাবের কারণে মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিল সমস্যার স্থায়ী সমাধান অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু একথাও স্বীকার করতে হবে যে, মূলত এই মিছিলের জনপ্রিয়তা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর ব্যাপক প্রচারণার ফলেই ভারতকে বহুদিন পর বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে হয়েছিল। জনগণের ঐক্য সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানকেও সাহস জুগিয়েছিল। ১৯৭৬ সালেই তিনি জাতিসংঘে ফারাক্কা বাঁধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের রাজনৈতিক কমিটির ২৪ নভেম্বরের সর্বসম্মত বিবৃতির ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়ায় ১৯৭৭ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়েছিল ‘ফারাক্কা চুক্তি’। বাংলাদেশের অনুকূলে ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল চুক্তিটির উল্লেখযোগ্য বিষয়। ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ থাকায় ভারত কখনও যথেচ্ছভাবে পানি প্রত্যাহার করতে কিংবা বাংলাদেশকে কম হিস্যা দিতে পারেনি। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৯৬ সালে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আগত আরেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সরকার ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। স্বাক্ষরিত হওয়ার পরপর, ১৯৯৭ সালের মার্চেই ভারত চুক্তি লঙ্ঘন করেছিল। সর্বনিম্ন পরিমাণ পানি পাওয়ার রেকর্ডও স্থাপিত হয়েছিল সে বছরই। যুক্তি দেখাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির ওপর তো কারও হাত নেই!’ অন্যদিকে অনুসন্ধানে জানা গিয়েছিল, ভারত ৬৫ শতাংশেরও বেশি পানি আগেই উজানে উঠিয়ে নিয়েছে। অথচ ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের সময় ১৯৯৫ সালের ২৭ মার্চও বাংলাদেশ পেয়েছিল ১৬ হাজার ৮৮১ কিউসেক পানি। ১৯৭৭ সালের চুক্তির ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ ছিল এর কারণ। এটাই ছিল মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা মিছিলের গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। ফারাক্কা মিছিলের মাধ্যমে আংশিকভাবে হলেও গঙ্গার পানির ওপর বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত দাবি ও অধিকার স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ফারাক্কা মিছিলের কারণে শুধু নয়, মওলানা ভাসানী স্মরণীয় হয়ে আছেন জাতির সঙ্কটকালে দুর্দান্ত সাহসে এগিয়ে আসার এবং বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দেয়ার কারণেও। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি দেশপ্রেমিক প্রধান জাতীয় নেতার অবস্থানে থেকেছেন এবং ভারতের শোষণমূলক সম্প্রসারণবাদী নীতি ও বাংলাদেশকে ইচ্ছাধীন করার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৯৬ বছর বয়সেও তিনি ফারাক্কা মিছিলের ডাক দিয়েছিলেন, সে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতীয়রা হুমকি দিয়ে এবং সীমান্তে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়েও মওলানা ভাসানীকে এক চুল পরিমাণ টলাতে পারেনি। সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে না পারলেও ফারাক্কা মিছিলের মাধ্যমে মওলানা ভাসানী গঙ্গার পানির ওপর বাংলাদেশের দাবি ও অধিকার আদায় করার পথ দেখিয়ে গেছেন। বর্তমান পর্যায়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিকদের উচিত মওলানা ভাসানীর দেখিয়ে যাওয়া পথে পা বাড়ানো এবং ফারাক্কা মিছিলের মতো কর্মসূচির মাধ্যমে একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার ও ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
shahahmadreza@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন