বৃহস্পতিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১২

সমদূরত্ব নীতিতে ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব নয় : আমি কৌণিক দ্বিখণ্ডক পদ্ধতির পক্ষে


ট্রাইবুনালের সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের খসড়া মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করে আমার পক্ষে এর সবগুলো বিষয় মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে আমি রায়ের মূল কার্যকরী অনুচ্ছেদের ব্যাপারে নেতিবাচক ভোট দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি। প্রক্রিয়াগত ইতিহাস এবং তথ্যভিত্তিক পটভূমি রায়ের সূচনাতে বর্ণিত হওয়ায় আমি আর তার পুনরাবৃত্তি করব না।
সঠিকভাবেই মামলাটিকে অধিকতর জটিল ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং আমাদের বিবেচনার জন্য অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে যেসব প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতেই তা স্পষ্ট হয়েছে। আমিও আইনের প্রযোজ্য ধারা এবং মূল নিয়ন্ত্রক ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ দৃঢ়ভাবে ব্যবহার করেছি। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রমাণসংক্রান্ত আমার মূল্যায়ন সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে ভিন্ন হয়েছে।
এ রকম একটি রায়ে এক বা একাধিক বিষয়ে ভিন্নমত থাকায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। এতে অস্বস্তিরও কিছু নেই। আমার মতে, আমি যে ভিন্নমত দিয়েছি, তা এই বিশেষায়িত আদালতের ব্যবহারশাস্ত্রের উন্নয়ন করে আন্তর্জাতিক সর্বোচ্চ মাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে কাজে লাগবে। রায়ের, বিশেষ করে ৯৮, ১১৫, ১৮, ১২৫, ৪৯০ এবং ৪৭৫ অনুচ্ছেদ বিষয়ে আমি নিম্নবর্ণিত কারণে দ্বিমত পোষণ করছি।
রায়ের ৮০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অনুমোদিত মাইনুটসের (পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা) আইনগত ভিত্তি নেই—আমি এর সঙ্গে একমত নই। ১১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এফিডেভিটে বাধ্যকারী কোনো প্রমাণ নেই—আমি এর সঙ্গেও ভিন্নমত পোষণ করছি। আমার কাছে মনে হয়নি, মৌখিক সম্মতির অস্তিত্ব সঠিকভাবে প্রমাণ করতে বাংলাদেশ কোনো ঘাটতি রেখেছিল (অনুচ্ছেদ ১১৮)। সমদূরত্ব দ্বারা বিচ্ছিন্ন করার (ইক্যুইডিসট্যান্স) নীতির ভিত্তিতে ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব নয়। এই মামলায় আমি কৌণিক দ্বিখণ্ডক (অ্যাঙ্গেল বাইস্টের) পদ্ধতির পক্ষে। আমি উপকূলরেখার পরিমাপের ব্যাপারে একমত নই (অনুচ্ছেদ ২০৬)। সীমানা নির্ধারণের জন্য মিয়ানমারের উপকূল হওয়া উচিত ভিফ অন্তরীপ পর্যন্ত। আমি বলেছিলাম, রায়ে ২১৫ ডিগ্রি দিগ্বলয় পর্যন্ত রেখা পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য সাময়িকভাবে সমদূরত্ব রেখা নির্ধারণের পদ্ধতির সঙ্গে আমি একমত নই।
উপস্থাপতি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রায়ে যা বলা হয়েছে, আমার অবস্থান তা থেকে অনেক ভিন্ন। কনভেনশনের ৭৬ নম্বর অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা এবং মহীসোপাানের সীমার ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারের যে কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে আমি একমত নই। রায়ে ‘প্রাকৃতিক প্রসারে’র (ন্যাচারাল প্রলংগেশন) যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে ৭৬ অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, আমি তার সঙ্গেও একমত নই। আমার মতে, ‘ধূসর এলাকা (গ্রে এরিয়া)’ নিয়ে যে উপসংহার টানা হয়েছে, তা পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। আমার উপসংহার অন্য রকমের।
পটভূমি : বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের সীমান্তবর্তী দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সাগরের সম্পদরাজি নিয়ে উভয় দেশেরই গভীর আগ্রহ রয়েছে। এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের মজুত। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত না থাকায় কোনো দেশই এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। এর কারণ বাংলাদেশ মিয়ানমারের তেলখনি সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে তেল অনুসন্ধানের জন্য চুক্তিতে পৌঁছতে চেষ্টা করে আসছিল। নাফ নদীও এর অন্তর্ভুক্ত।
বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমার ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছানের জন্য দুটি দেশই নিবিড় আলোচনা চালিয়েছে। ১৯৭৪ সালে দেশদুটি যেসব সিদ্ধান্ত নেয় তা-ও লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বরর বৈঠকের সিদ্ধান্ত মাইনুটসে (পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা) লেখা আছে। ওই মাইনুটসে উভয় দেশের প্রতিনিধি স্বাক্ষর করেন।
বাংলাদেশ অভিযোগ করছে, ৩৪ বছর ধরে অনুমোদিত মাইনুট উভয় দেশই মেনে চলেছে। এতে এটি কার্যত একটি চুক্তিতে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার জানিয়েছে, এ রকম কোনো চুক্তি নেই। কারণ অনুমোদিত মাইনুটগুলো তাদের সরকারের অনুমোদনের এবং উভয় দেশের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক চুক্তির প্রয়োজন ছিল।
এরপর উভয় পক্ষ এ নিয়ে আলোচনা করলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। এর ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর এক ঘোষণার মাধ্যমে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইবুনালের এখতিয়ার মেনে নেয়। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশও ২০০৯ সালের ১২ ডিসেম্বর এক ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের এ সংক্রান্ত এখতিয়ার মেনে নেয়।
বিরোধ : মামলার আরজি, প্রমাণ এবং বিজ্ঞ পরামর্শকদের বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এই জটিল বিষয় নিয়ে দেশদুটোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা, একান্ত অর্থনৈনিতক এলাকা (ইইজেড) এবং মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কনভেনশনের ১৫, ৭৪, ৭৬, ৮৩ এবং ১২১নং ধারার ব্যাখ্যা, নির্মাণ ও ব্যবহার নিয়েও বিরোধ রয়েছে। তবে দুটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক তথ্য নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। বাংলাদেশের উপকূল বদ্বীপের মতো। আমার মতে, বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য ভূতাত্ত্বিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যেমন দুটো দেশের মধ্যে নিজ নিজ সীমানা নির্ধারণে ডকট্রিন অব নেসেসিটি (প্রয়োজনীয়তার মতবাদ) কাজ করতে পারে।

সমদূরত্ব পদ্ধতিতে সীমা নির্ধারিত হলে আবদ্ধ হয়ে পড়বে বাংলাদেশ

মিয়ানমার দাবি করছে, এ সংক্রান্ত মামলার জন্য (জেনেভা) কনভেনশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইন উপযোগী নয়। কনভেশনের পূর্ববর্তী সময়ে যে নিয়মকানুন প্রচলিত ছিল, তার আলোকে কনভেনশনের বিধানগুলো ব্যাখ্যা করতে হবে। শুধু ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সীমানা নির্ধারণ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভুক্ত। ট্রাইব্যুনাল ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ করতে পারে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মিয়ানমার।
বাংলাদেশ যুক্তি দেখিয়েছে, মহীসোপান শব্দটিকে যেন ব্যাপক, উদার এবং ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ— সবদিক থেকে বিবেচনা করা হয়। মিয়ানমার চেয়েছে মহীসোপান শব্দটিকে শুধু ৭৬ অনুচ্ছেদের আলোকে বিবেচনা করতে। মিয়ানমার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে বাংলাদেশের কোনো মহীসোপান নেই। সীমানা নির্ধারণে বাংলাদেশ কৌণিক বিভাজক/দ্বিখণ্ডক (অ্যাঙ্গল বাইসেক্টর) পদ্ধতির পক্ষে এবং মনে করে যে, এর মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব। মিয়ানমারের দাবি হচ্ছে, সমদূরত্বের ভিত্তিতে এর সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ মনে করে, সমদূরত্ব ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ করা হলে তাতে বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে তার সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। বাংলাদেশ মনে করে, তার অসুবিধাজনক উপকূলীয় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সমদূরত্ব রেখার দ্বারা দেশটি আবদ্ধ হয়ে (সেলফ লকড) পড়বে। বাংলাদেশ বলছে, ন্যায়সঙ্গত সমাধান করার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ যুক্তি দেখিয়েছে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ শুক্তি (অয়স্টার) দ্বীপের মতো কোনো দ্বীপ নয়। শুক্তি দ্বীপে কোনো জনবসতি নেই। নেই কোনো বিশুদ্ধ পানি ও অর্থনৈতিক জীবন। অন্যকথায় বাংলাদেশের মতে, ১২১ ধারা অনুসারে শুক্তি দ্বীপ আদতে কোনো দ্বীপ নয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ একটি ‘বিশেষ পরিস্থিতি’।
আমার মনে হয়, দ্বীপগুলোর ভৌগোলিক অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সার্পেন্ট দ্বীপের মতো কোনো দ্বীপ নয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, দ্বীপগুলোরও উপকূলবর্তী অঞ্চল থাকতে পারে তবে এগুলো পরিপূর্ণ অঞ্চল নয়। (যেমন নর্থ সি কন্টিনেন্টাল সেলফ মামলা (তিউনিশিয়া বনাম লিবিয়া), গিনি ও গিনি বিসাউয়ের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং কৃষ্ণসাগরের উপকূলীয় সীমানা নির্ধারণ (রোমানিয়া বনাম ইউক্রেন)।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থান জটিল। এটা কি বিশেষ পরিস্থিতি? এটা কি মিয়ানমার উপকূলের কাছে কিংবা বিপরীতে অবস্থিত? এই দ্বীপটি কি ১২ নটিক্যাল মাইলের সমুদ্রের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে? সেন্ট মার্টিনের জন্য কৌণিক দ্বিখণ্ডক পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারণ উপযুক্ত। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কোনো বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতি নয়। এক্ষেত্রে এফিডেভিটে প্রদত্ত সাক্ষ্য বিবেচ্য। দু’দেশের মহীসোপানের সংজ্ঞা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনও প্রাসঙ্গিক এবং অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য আমি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব : ১. ১৯৭৪ এবং ২০০৮ সালে অনুমোদিত মাইনুট (পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা); ২. ভৌগোলিক পরিস্থিতি; ৩. সীমানারেখা নির্মাণ; ৪. সেন্ট মার্টিন দ্বীপের তাত্পর্য; ৫. কনভেনশনের ৭৬ ধারার ব্যাখ্যা এবং ৬. এ ট্রাইব্যুনাল এখতিয়ারের বাইরে যাচ্ছে কি-না।
আমার মতে, ট্রাইব্যুনালকে প্রতিবেদনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি বিবেচনায় নিতে হবে এবং মিয়ানমার যেসব বিষয় চ্যালেঞ্জ করেনি, তাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান নিয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য আমি তা-ই করেছি এবং প্রয়োজনে প্রমাণকে প্রয়োগ করেছি।
১৯৭৪ সালে অনুমোদিত মাইনুট : সমুদ্রসীমা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে কোনো চুক্তি রয়েছে কি-না, তা নিয়ে তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ বলছে, উভয় দেশের মধ্যে অনুমোদিত মাইনুট কার্যকর রয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে ১৯৭৪ সালে দেশ দুটির মধ্যে আলোচনা হয়। এতে ৭ দফার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে উভয় দেশের প্রতিনিধিদের প্রধানরা তাতে স্বাক্ষর করেন। ২০০৮ সালে আাাবার এর সংশোধন করা হয়। এতে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপান নিয়ে উভয় দেশ একটি ব্যাপকভিত্তিক চুক্তিতে পৌঁছানের জন্য আলোচনা অব্যাহত রাখবে।
জবাবে মিয়ানমার বলেছে, অনুমোদিত মাইনুট কোনো চূড়ান্ত চুক্তি নয় এবং ব্যাপকভিত্তিক সমুদ্র চুক্তির জন্য উপসংহারে পৌঁছানোর প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশ বলেছে, এসব কথা মাইনুটে ছিল না এবং অনুমোদিত মাইনুট গত ৩৪ বছর ধরে বহাল ছিল। এসব মাইনুট নিয়ে পরে আর আলোচনার কথা ছিল না।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে ১৯৭৪ সালের চুক্তির যে অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, তা চূড়ান্ত কি-না। আমার মতে, উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ সূচক। প্রথমত মাইনুটের শব্দগুলো স্পষ্ট এবং তা দ্ব্যর্থবোধক নয়। এর সাধারণ অর্থ হচ্ছে, একটি সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ও মিয়ানমারের উপকূলের মধ্যে একটি সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে।

চৌত্রিশ বছর ধরেই বহাল ছিল চুয়াত্তর সালের চুক্তি : ২০০৮ সাল থেকে বেঁকে বসে মিয়ানমার

আলোচনা শেষে বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) প্রতিনিধি দলের প্রধান কমডোর চিট হেলেং এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সার ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন। চুক্তিটি নিম্নরূপ :
বাংলাদেশ ও বার্মার প্রতিনিধিদের মধ্যে দু’দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে অনুমোদিত মাইনুটগুলো (পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা)।
১.বাংলাদেশ ও বার্মার প্রতিনিধি দল দু’দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ প্রশ্নে রেঙ্গুনে (৪-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪) এবং ঢাকায় (২০-২৫ নভেম্বর) আলোচনা করেছে। অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২.বাংলাদেশ ও বার্মার মধ্যে সমুদ্রসীমার প্রথম ছেদক (ফার্স্ট সেক্টর) অর্থাত্ স্থানিক জলরাশির সীমানা (টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস বাউন্ডারি) নির্ধারণের জন্য দু’দেশের প্রতিনিধি দল নিম্নোক্ত বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
১.একটি রেখা দ্বারা নাফ নদীর ১ নম্বর বাউন্ডারি পয়েন্ট থেকে সমুদ্র অভিমুখী সীমা গঠন করা হবে, যা সেন্টমার্টিন দ্বীপের সর্ব দক্ষিণের অগ্রভাগের ১২ নটিক্যাল মাইলের ছেদের বক্ররেখা এবং বার্মার মূল ভূখণ্ডের উপকূলের নিকটতম পয়েন্ট থেকে যা সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিকটতম পয়েন্ট
এবং বার্মার মূল ভূখণ্ডের মাঝামাঝি।
২.জলসীমা নির্ধারণের জন্য ওপরে বাঁক পয়েন্টের (টার্নিং পয়েন্ট) যে চূড়ান্ত স্থানাঙ্কের ব্যাপারে সম্মতি হয়েছে তা একটি যৌথ সমীক্ষায় সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে।
৩.ঢাকায় আলোচনায় বার্মা প্রতিনিধি দল বলেছে, স্থানিক জলরাশির সীমানা নির্ধারণের জন্য তাদের সরকারের চুক্তি ২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত নিশ্চয়তা প্রদান করবে যে, বার্মার জাহাজগুলো সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাংলাদেশের জলরাশিতে এবং নাফ নদীর বার্মিজ ছেদকের যে কোনো দিক থেকে অবাধ ও নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে।
৪.বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল ২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত স্থানিক জলরাশির সীমানার ব্যাপারে তাদের সরকারের অনুমোদনের কথা জানিয়েছে। ওপরে ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত বার্মার জলযানের অবাধ ও নির্বিঘ্ন চলাচলের নিশ্চয়তার কথা বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল উল্লেখ করেছে।
৫.বার্মা সরকারের মতামত দেয়ার জন্য ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল স্থানিক জলরাশির সীমানা নির্ধারণের খসড়া চুক্তি বার্মিজ প্রতিনিধি দলকে দিয়েছে।
৬.বাংলাদেশ ও বার্মার সমুদ্রসীমার দ্বিতীয় ছেদকের অর্থাত্ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণের জন্য দুটি দেশের প্রতিনিধি দল এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ও নীতি নিয়ে আলোচনা করেছে। তারা উভয়পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য সীমা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
আমি মনে করি, কোনো রাষ্ট্রের নিয়োগ করা প্রতিনিধিদের দিয়ে চুক্তি লেখা ও স্বাক্ষর হতে পারে। এখানে ঘটনাটি এরকমই। মাইনুটগুলোতে প্রতিনিধি দলের প্রধানরা স্বাক্ষর করেছেন। তারা অবশ্যই তাদের সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ভিয়েনা কনভেনশনের চুক্তি সংক্রান্ত আইনের ৭ ধারায় এখানে সম্মতি দেয়া হয়েছে। ব্যবহারশাস্ত্রে এটা স্বীকৃত।
মিয়ানমার যুক্তি দেখিয়েছে, মাইনুটের সূচনাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল আলোচনা করেছে। সরকারের কথা বলা হয়নি। কিন্তু তারা তো সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, যৌথ সমীক্ষার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হবে। তবে সেই সমীক্ষা আর কখনোই পরিচালিত হয়নি।
অনুমোদিত মাইনুট চুক্তিতে পরিণত নাও হতে পারে। তবে এগুলোকে উপেক্ষা করা যায় না। মাইনুটগুলোকে প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এ কারণে যে, গত ৩৪ বছর ধরে এই চুক্তি ছিল এবং তারা তা মেনে চলেছে। আমার মনে হয়, এসব প্রমাণাদি এটাই প্রমাণ করে, অনুমোদিত মাইনুটের আলোকে ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া যেত।
চুক্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন সুস্পষ্ট। আমার মত হচ্ছে, অনুমোদিত মাইনুট একটি মৌন চুক্তি যাতে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে সাত দফার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। দুটি দফায় সামান্য সংশোধন করে ২০০৮ সালে এটি আবারও নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মিয়ানমার আগে নির্ধারিত সীমা মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায়। বাংলাদেশ বলছে, গত ৩৪ বছর ধরে যে সীমানা সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলা হয়েছে সে ব্যাপারে একপক্ষীয়ভাবে মিয়ানমার মত পরিবর্তন করতে পারে না।
অন্য সব পক্ষের মৌন সম্মতি থাকা সত্ত্বেও এক পক্ষকে একটি এলাকার দাবি অবশ্যই করতে হবে এবং এটা করতে হবে স্পষ্টভাবেই। বাংলাদেশ গত ৩৪ বছর ধরে ঠিক তা-ই করে আসছে এবং মিয়ানমার তাতে আপত্তি জানায়নি। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের সীমা নির্ধারণ নিয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য মিয়ানমার আলোচনা অব্যাহত রেখেছিল। এটা লক্ষণীয় যে, এ আলোচনায় সমুদ্রসীমার সীমানা নির্ধারণ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। উপরন্তু ২০০৮ সালেও চূড়ান্ত দফার ৭ থেকে ৮/এ দফায় পরিবর্তন চেয়েছিল মিয়ানমার।

বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানের অধিকার হারাবে বাংলাদেশ

 ঙ্গোপসাগর পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগর। এটা একটা বিশাল আকৃতির পানির আধার। পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে প্রশস্ততম স্থানে এর প্রস্থ ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপকূল থেকে শুরু করে দক্ষিণে এর বিস্তৃতি ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এর আয়তন প্রায় ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার।
আন্তর্জাতিক হাইড্রোগ্রাফিক সংস্থার মতে, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণে বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূল, পশ্চিমে ভারতীয় এবং শ্রীলঙ্কার উপদ্বীপ, পূর্বে মিয়ানমারের নেগরায়েস অন্তরীপ হয়ে ভারতের আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ। এর পশ্চিমে ভারত ও শ্রীলঙ্কার পূর্ব উপকূল অবস্থিত। উত্তরে ভারত ও বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্বে এবং পূর্বদিকে মিয়ানমার।
বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর বৃহত্তম ডিপোজিটরি সিস্টেম। বাংলাদেশের উপকূল ব-দ্বীপ আকৃতির এবং এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। আমার মতে, বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে দেশগুলোর উপকূলের রূপরেখা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে নিজ নিজ উপকূলের দৈর্ঘ্য, বাংলাদেশের ব-দ্বীপ আকৃতির উপকূল, ডিপোজিটরি সিস্টেম এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রাসঙ্গিকতা।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ : সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি জনঅধ্যুষিত। এখানে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বহু বিদেশি পর্যটক দ্বীপটিতে বেড়াতে আসেন। দ্বীপটিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও উপকূল রক্ষীবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে। কাজেই কনভেনশনের ১২১ ধারা মোতাবেক সেন্ট মার্টিন একটি দ্বীপ এবং এ কারণেই সীমানা নির্ধারণে দ্বীপটি সমুদ্রের ১২ নটিক্যাল মাইল পাওয়ার পূর্ণ অধিকার
রাখে। কনভেনশনের ১২১ ধারা অনুসারে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী সেন্ট মার্টিন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে।
আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের (আইসিজে) সিদ্ধান্ত অনুসারে কৃষ্ণসাগরের সীমানা নির্ধারণ (রোমানিয়া বনাম ইউক্রেন) মামলার রায় এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। প্রশ্ন হলো, সমুদ্রসীমা নির্ধারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি কোনো বিশেষ অবস্থার কিনা।
একেক দ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থা একেক রকম। সেন্ট মার্টিন দ্বীপটিও সার্পেন্ট দ্বীপের মতো নয়। আইন অনুযায়ী, দ্বীপটি কোনো বিশেষ অবস্থার দ্বীপ নয়। কাজেই এই মামলার রায়ে দ্বিখণ্ডক রেখার সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেন্ট মার্টিন দিয়ে শুরু করতে হবে (স্টার্টিং পয়েন্ট)।
আইসিজে দ্বীপের কোনো সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা দেয়নি। আদালত বলেছে, সার্পেন্ট দ্বীপে জনবসতি নেই বলে সমুদ্রসীমা হবে ১২ নটিক্যাল মাইল। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে কোনো প্রভাব থাকা উচিত নয়।
একেক দ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থা একেক রকম। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ এবং সার্পেন্ট দ্বীপ একই অবস্থার নয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, দ্বীপগুলোর নিজস্ব উপকূলবর্তী অঞ্চল থাকতে পারে তবে এগুলো মহাদেশীয় ভূমির বিপরীতে বা সন্নিকটে থাকলে তারা পূর্ণ অঞ্চল হতে পারে না। অতএব, সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি বাংলাদেশের অংশ হিসেবে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের অন্তর্ভুক্ত এলাকা।
কৌণিক দ্বিখণ্ডক পদ্ধতি : এই মামলার ভৌগোলিক উপাদান অতুলনীয়। এদের মধ্যে রয়েছে দুটি অবতলতা (কনকাভিটি), উপকূলের সম্মুখভাগ, বাইরের মহীসোপান এবং সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। দুই পক্ষ একমত না জেনেও আমার কাছে মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে সীমানা নির্ধারণে সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি হলো কৌণিক দ্বিখণ্ডক (অ্যাংগল বাইসেক্টর) পদ্ধতি।
পক্ষগুলো একমত হয়েছে যে, সমুদ্রসীমা নির্ধারণে প্রথম কাজ হচ্ছে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সীমা নির্ধারণ। এ কাজ করতে হলে ট্রাইব্যুনালকে ন্যায়সঙ্গত সমাধানের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। আমি সমদূরত্ব নীতির ব্যাপারে একমত নই। কার্যত কৌণিক দ্বিখণ্ডক পদ্ধতি হলো সমদূরত্ব পদ্ধতির সংশোধিত রূপ। আমি একমত যে, বাংলাদেশ অনুপম উপকূল রেখা (কোস্টলাইন) একটি প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতি। এই উপকূল রেখা পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এবং সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এর অবতলতা (কনকাভিটি) অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। আমি উল্লেখ করেছি, সীমানা নির্ধারণে চূড়ান্ত ফল হলো ন্যায়সঙ্গত সমাধান অর্জন করা।
মিয়ানমারের পরামর্শকরা আইসিজের রায়ে সমদূরত্ব নীতিতে সীমানা নির্ধারণের উদাহরণ টেনে বলেছেন, তাতে ন্যায়সঙ্গত সমাধান হবে। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কেস বাই কেস ভিত্তিতে। কোনো কোনো মামলায় এটা সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি হতে পারে, তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে তা নয়। তিউনিশিয়া বনাম লিবিয়া মামলায় আইসিজে বলেছে, শুধু ন্যায়সঙ্গত হলেই সমদূরত্ব পদ্ধতির প্রয়োগ হতে পারে। তবে সমদূরত্ব পদ্ধতি ন্যায়সঙ্গত না হলে অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।
আমি মনে করি, শেষোক্ত বিবৃতিটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। স্থানিক ও সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে নিকারাগুয়া এবং হন্ডুরাসের মধ্যে মামলায় আইসিজে বলেছে, সীমানা নির্ধারণে সমদূরত্ব পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্যান্য পদ্ধতির ওপর প্রাধান্য পেতে পারে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে সমদূরত্ব পদ্ধতি অনুপযুক্ত হতে পারে। নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাস এবং গিনি ও গিনি বিসাউয়ের মধ্যে সীমানা নির্ধারণে কৌণিক দ্বিখণ্ডক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
এই মামলায় সমুদ্রসীমা নির্ধারণে ভৌগোলিক পরিস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উভয়পক্ষ যেসব মানচিত্র ও নকশা উপস্থাপন করেছে, তা থেকেই এর প্রতিফলন ঘটেছে। তদুপরি বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনেও বিশেষ পরিস্থতির কথা বলা হয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, এই মামলায় নিম্নোক্ত ভৌগোলিক কারণে সমদূরত্ব পদ্ধতি উপযুক্ত হবে না :
১. বাংলাদেশের পুরো উপকূল রেখার অবতলতা; ২. বেঙ্গল ডিপোজিটরি সিস্টেমের নিবিড়তা; ৩. বাংলাদেশের উপকূল রেখার ভূগঠনের বিবর্তনের প্রসার, বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনে যা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে; ৪. সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অবস্থান। দ্বীপটি বাংলাদেশের উপকূল রেখা থেকে ৪.৫ কিলোমিটার এবং মিয়ানমার উপকূল রেখা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সীমানা নির্ধারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে পরিপূর্ণভাবে বিবেচনায় নিতে হবে; এবং ৫. বাংলাদেশের উপকূল রেখার অবতলতা তাত্পর্যপূর্ণ। কারণ সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগ করা হলে বাংলাদেশের সমুদ্রাভিমুখী অভিক্ষেপ বা প্রজেকশন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। অন্যকথায় বঙ্গোসাগরের মহীসোপানে একটি পয়েন্টে এর অভিক্ষেপ অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে, যার ফলে বঙ্গোপসারের মহীসোপানে প্রবেশাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
আমি উল্লেখ করেছি, সমদূরত্ব পদ্ধতির প্রয়োগ হলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আমার কাছে মনে হয় না, সমদূরত্ব দ্বারা বিচ্ছিন্ন করার নীতি উপযুক্ত। কারণ এর ফলে বাংলাদেশ মহীসোপানের বহিস্থ সীমার অধিকার হারাবে। অতএব সীমানা নির্ধারণে বাংলাদেশ যদি মহীসোপানের অধিকার হারায়, তাহলে তা ন্যায়সঙ্গত সমাধান হতে পারে না। বরং এটি কনভেনশনের ৭৪ ধারার লঙ্ঘন।

গ্রে এরিয়া মিয়ানমার পেলে বাংলাদেশের বিরাট ক্ষতি হবে

গ্রে এরিয়া (ধূসর এলাকা) হলো কোনো দেশের উপকূলের ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে, তবে অন্য কোনো দেশের সমুদ্রসীমার বাইরে অবস্থিত এলাকা। তথাকথিত ধূসর এলাকার একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণে এই ইস্যুটির কথা তোলা হয়েছিল। এই মামলায় ধূসর এলাকা বাংলাদেশের মহীসোপানের আওতায় পড়েছে এবং তা আবার মিয়ানমারের ২০০ নটিক্যাল মাইলের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলেরও অন্তর্ভুক্ত।
আমার মতে, মিয়ানমারের পরামর্শক এই বিষয়টির পরিপূর্ণ সমাধানের পথ বাতলে দেননি। তার যুক্তি হলো, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি সীমানা নির্ধারণের এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের নেই। বাংলাদেশের যুক্তি হলো, মহীসোপানের ওপর একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলকে প্রাধান্য দিয়ে এর সমাধান সম্ভব নয়, বরং একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর মহীসোপানকে প্রাধান্য দিতে হবে। এটা কোনো বিরোধের বিষয় নয়, বাংলাদেশ এই অঞ্চলের মহীসোপানের অধিকারী। কিন্তু মিয়ানমার ২০০ নটিক্যাল মাইল পেলে বাংলাদেশের মহীসোপানের অধিকার লঙ্ঘিত হবে।
পরামর্শ দেয়া হয়েছে, ধূসর এলাকাকে অমীমাংসিত এলাকা হিসেবে রেখে দেয়া হউক। অথবা সমস্যার সমাধানের জন্য উভয়পক্ষ আলোচনা করবে এবং সহযোগিতা করবে। মাছ ধরা এবং সমুদ্রের তলদেশ অথবা অন্তমৃত্তিকার (ভূপৃষ্ঠের অব্যবহিত নিম্নবর্তী ভূস্থর) সম্পদরাজি আহরণ ও উত্তোলনের জন্য নির্ধারিত এলাকার জন্য উভয়পক্ষ লাইসেন্স প্রদান করবে। আমার মনে হয়, এটা করা হলে সমস্যা আরও বাড়বে এবং এটা করা হলে তা বিষয়টি নির্ধারণে ট্রাইব্যুনালের ব্যর্থতা হিসবে পরিগণিত হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, একটি রেখা দ্বারা সমুদ্র সীমা, একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার জন্য উভয়পক্ষই ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ করেছে। আপাতদৃষ্টিতে কনভেনশনে এমন কোনো বিধান নেই যে, একটি রাষ্ট্রের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপান অপর রাষ্ট্রকে দিয়ে দিতে পারে না। তবে আমি মনে করি, ৩ অনুচ্ছেদের ৫৬ ধারার বিস্তৃত ও উদার ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান সম্ভব।
বিপরীত অথবা সন্নিকটের উপকূলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে ৭৫ ধারায়। ৮৩ ধারায় সংলগ্ন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ পদ্ধতি বলা আছে। উভয় ধারাতে বলা হয়েছে, অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত সমাধান করতে হবে। আমার মনে হয়, এই মামলায় এই স্বাতন্ত্র্যসূচক উপাত্তসমূহকে বিবেচনায় নিতে হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিচারককে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে।
এলাকাটির অবস্থান, এলাকাটি কার্যত একই রকম, কোনো সুনির্দিষ্ট চুক্তি ছাড়াই পক্ষগুলো গত ৩৪ বছর ধরে আলোচনা চালিয়ে আসছে। বিবেচনায় নিতে হবে ডকট্রিন অব নেসেসিটি এবং বঙ্গোপসাগরের অনুপম ভৌগোলিক পরিস্থিতি। মহীসোপান ও একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর উপকূলীয় রাষ্ট্রের অধিকার জন্মগত এবং তা কেড়ে নেয়া যায় না।
মিয়ানমারকে যদি গ্রে এরিয়া দিয়ে দেয়া হয়, তবে বহিঃস্থ মহীসোপানে (আউটার কন্টিনেন্টাল শেল্ফ) প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ। এই এলাকাটি যদি বাংলাদেশকে দিয়ে দেয়া হয়, তাহলে বহিঃস্থ মহীসোপানে বাংলাদেশের অধিকার লঙ্ঘিত হবে না। এটা অবধারিত যে, যদি প্রথমটা গ্রহণ করা হয় (মিয়ানমারকে যদি গ্রে এরিয়া দিয়ে দেয়া হয়) তবে বাংলাদেশের বিরাট ক্ষতি হবে। তাহলে কনভেনশনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ন্যায়সঙ্গত সমাধানের যে কথা বলা হয়েছে, তা আর হবে না। পক্ষগুলো বিরোধের সমাধান চেয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, এই মামলার বিশেষ পরিস্থিতিতে একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর মহীসোপানের অধিকারকে প্রাধান্য দিতে হবে। এর ফলে আমি গ্রে এরিয়া বাংলাদেশকে দিয়ে দেব।
গ্রে এরিয়া পাবে বাংলাদেশ : আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সামনে যেসব বিষয় উপস্থাপন করা হয় তার সমাধানে শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত। বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার সময়ই আমি উল্লেখ করেছি যে, বঙ্গোপসাগর নিয়ে কোনো কিছু করার সময় মনে রাখতে হবে যে, এটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উপকূলরেখার সর্পিলতা, ব-দ্বীপ আকৃতির গঠন, দ্বৈত অবতলতা (ডাবল কনকাভিটিস) এ অঞ্চলকে অনুপম বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
গ্রে এরিয়ার ক্ষেত্রে আদালত ও ট্রাইব্যুনাল কোনো কোনো সুনির্দিষ্ট মত প্রদানে অনিচ্ছুক এবং বিষয়টিতে মনোযোগ দেয়নি। ট্রাইব্যুনাল অন্য জটিল বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছে এবং এ বিষয়টি পরবর্তীতে নিষ্পত্তির জন্য ফেলে রেখেছে। অন্য কথায় কোনো মন্তব্য না করে বিষয়টি স্থগিতাবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে এবং পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে, পক্ষগুলো যেন সমাধানে পৌঁছানের জন্য আরও আলোচনা করে এবং সহযোগিতা করে।
কনভেনশনে এ সংকান্ত যে আইন আছে তা সংক্ষিপ্ত নয়। কিভাবে বিরোধপূর্ণ এলাকার সীমানা নির্ধারণ করতে হবে তা কনভেনশনে বলা আছে। তবে যেখানে গ্রে এরিয়া নিয়ে পক্ষগুলো ওভারল্যাপ (উপরে চেপে পড়ে) করে সেরকম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বিধান নেই।
যেখানে আইন স্পষ্ট নয় এবং কোনো সুনির্দিষ্ট বিধান নেই, সেখানে বিচারককে উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হতে হবে। যেখানে ব্যাখ্যায় দ্ব্যর্থবোধকতা এবং গোলমাল দেখা যায় সেখানে বিচারককে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে নিতে হয়। যদি আইনে সমাধানের পথ না থাকে তবে বিচারককে আইন প্রয়োগ করেই সমাধান পেতে হবে।
কনভেনশন অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র মহীসোপানের অধিকার রাখে। একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের আগেও মহীসোপানের অস্তিত্ব ছিল এবং আমার মতে, এটা অবশ্যই অগ্রগণ্য। সাগরতল এবং অন্তমৃত্তিকা মহীসোপানের অন্তর্ভুক্ত এবং এটা একান্ত অর্থনৈনিতক অঞ্চলকে রহিত করে দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে যদি কোনো শূন্যস্থান থাকে তবে তা পূরণে একজন বিচারককে অবশ্যই উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল হতে হবে। এখানে এরকম একটি বিষয় রয়েছে। এখানে ডকট্রিন অব নেসেসিটির মতো একটি মতবাদ প্রাসঙ্গিক। কাজেই আমি গ্রে এরিয়া বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করছি।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, সব পক্ষের জন্য মহীসোপান নির্ধারণের জন্য ট্রাইব্যুনালের সামনে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। কাজেই ট্রাইব্যুনাল মহীসোপানের বহিঃস্থ সীমা (আউটার লিমিট) নির্ধারণ করার অধিকার রাখে।
বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানের ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি সীমানা নির্ধারণ করার এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের নেই বলে যে যুক্তি দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে আমি কোনো সারবত্তা খুঁজে পাইনি। পক্ষগুলো ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার এবং বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনের বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি প্রমাণ মেনে নিয়েছে।
কাজেই আমার মত হচ্ছে, বাংলাদেশ মহীসোপানের অধিকারী (মহীসোপানের বহিঃস্থ সীমা পর্যন্ত)। আমি আরও একবার পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, ডক্টর কুদরাস ও ডক্টর কুরের যে বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন, তা চূড়ান্ত। বস্তুত ট্রাইব্যুনালের সামনে যেসব প্রতিবেদন ও সংযুক্ত প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে এটা প্রমাণিত যে, ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের বহিঃস্থ মহীসোপান পর্যন্ত (২৫০০ মিটার আইসোবাথ) মহীসোপান নির্ধারণ করতে পারে।
উপসংহার : সমুদ্রসীমা নিয়ে ১৯৭৪ সালের অনুমোদিত মাইনুট, যা ২০০৮ সালে সংশোধন করা হয়, তাকে আমি মৌনচুক্তি বলে মনে করি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমুদ্র সীমার ১২ নটিক্যাল মাইল পাবার পূর্ণ অধিকারী। সমদূরত্ব দ্বারা বিচ্ছিন্ন করার বিশেষ অবস্থার নীতি অথবা বিধান একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই এলাকার সীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের অবতলতা (কনকাভিটি) গুরুত্বপূর্ণ এবং এই মামলায় এটি একটি বিশেষ অবস্থা। ১৯৭৪ সালের অনুমোদিত মাইনুট, যা ২০০৮ সালে সংশোধন করা হয় সেটিই হচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমার প্রথম অনুমোদিত রেখা।
বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদন এই মামলার প্রমাণ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুটি দেশের মহীসোপান বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। আমি দেখেছি যে, বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে মিয়ানমার ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরেও মহীসোপানের অধিকারী এবং সেটা সে বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। অতএব, কথিত এলাকাটি আমি কৌণিক দ্বিখণ্ডক পদ্ধতি অনুযায়ী দুটি দেশের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছি। কনভেনশনের ৭৬ ধারার প্রাকৃতিক প্রসার (ন্যাচারাল প্রলংগেশন) এর অর্থ উদ্ধারে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ গ্রহণযোগ্য এবং চূড়ান্ত।
বাংলাদেশের মহীসোপান হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত ল্যান্ডমাস (একটি ভৌগোলিক এলাকার সমগ্র উপরিভাগ)-এর প্রাকৃতিক প্রসার। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ করবে কৌণিক দ্বিখণ্ডক (অ্যাঙ্গল বাইসেক্টর)। কৌণিক দ্বিখণ্ডক প্রয়োগ করে সমতা নিশ্চিত করতে হবে। আমি যে মত দিয়েছি সেই অনুযায়ী গ্রে এরিয়া (ধূসর এলাকা) অবশ্যই ভাগ করে দিতে হবে। আমি গ্রে এরিয়া বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করছি। তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের অধিকার লঙ্ঘিত না হলে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে সীমানা নির্ধারণ হচ্ছে বিবদমান দেশগুলোর মধ্যে একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা (ইইজেড) এবং মহীসোপানের সীমারেখা ভাগের ধারাবাহিকতা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন