রবিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১২

বাংলা নববর্ষ : চৈত্রসংক্রান্তি, শিব ও দয়ালচাঁদ


বাংলা নববর্ষ পালন করার পক্ষে যে যুক্তি সাধারণত দেওয়া হয় সেটা হয় সাহেবদের অথবা মুঘল আমলের জমিদার-মহাজনদের যুক্তি। সাহেবরা ‘নিউ ইয়ার’ পালন করেন। ইংরেজি নববর্ষে তারা সকালে পরস্পরকে বলেন, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। এর একটা স্মার্ট ধ্বনিগত ঝমক আছে। চৌকস। অতএব আমাদের চামড়া বাদামি হওয়া সত্ত্বেও আমাদেরও ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলবার একটা ব্যবস্থা থাকা চাই। ‘বাংলা নববর্ষ’ নামক আদৌ কি কিছু ছিল? সেটা কেমন ছিল? কারা করত? কোথায় ছিল? আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কিছু খোঁজখবর নিয়েছি। গত ২০ বছর ধরে আমি গ্রামে কৃষকদের নিয়ে কাজ করছি। দেখেছি বাংলা নববর্ষকে তারা জমিদার-মহাজনদের খাজনা আদায়ের দিন কিংবা সারা বছরের সুদের হিসাব মেলাবার জন্য যতোটা বোঝে তথাকথিত ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ হিসাবে বোঝে না বললেই চলে। সংক্রান্তির পরের দিন ঘর ধোয়ামোছা করা, গরুকে গোসল করানো ইত্যাদি অনেক কিছু করে তারা বটে, কিন্তু তাকে নববর্ষ নামক কোনো উৎসব বলা যায় না। বাংলা নববর্ষ বানানো জিনিস। আমাদের বানাতে হয়েছে। বিশেষত আমরা যারা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখি না, কিন্তু বাঙালির সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বয়ান রচনার জন্য নিজেদের যোগ্য মনে করি। আমাদের নিজ শ্রেণীর আধিপত্য বজায় রাখবার জন্যই সেটা দরকার। বাঙালির নববর্ষ নামক একটা বয়ান আমাদের নিজ শ্রেণীর স্বার্থেই বানাতে হয়েছে। তারপর সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের দাবি করতে হয়েছে, ‘এই দেখ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি।’ আবহমান বাংলার কেচ্ছা গাওয়া আমরা এভাবেই শিখেছি।
নতুন বছর। অতএব, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো… ইত্যাদি। যা কিছু ‘পুরাতন’, ‘জীর্ণ’, ‘আবর্জনা’ সব ‘যাক যাক’ – সব ‘নতুন’ করে শুরু হোক। ‘নতুন’-কে বরণ করা আর যা কিছু ‘পুরাতন’ তাকে আবর্জনা ও পরিত্যজ্য জ্ঞান করে ফেলেই যদি দিতে হয় তো বেচারা রবীন্দ্রনাথকেও ফেলে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর থাকে না। ফলে এখন ঠাকুরকে মহা আয়োজন করেই টিকিয়ে রাখবার দশা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যখন গান লিখছিলেন তখন ব্যান্ড সঙ্গীতের হুল্লোড় ছিল না। আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত বা ব্যান্ড সঙ্গীত দুটোর একটিরও বিপক্ষে নই। আমি গান পাগল মানুষ অতএব দুটোর প্রতি আমার সমান ভালোবাসা। এখানে আমি অবশ্য গানের বিচার করতে বসিনি। যে কথা শুরু করেছি তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাবার জন্য খানিক কোশেশ করছি মাত্র। যেমন ব্যান্ড সঙ্গীত ‘নতুন’ বলেই যদি ‘এসো এসো’ বলে তাকে বরণ করতে হয় আর ঠাকুর ‘পুরাতন’ বলে তাকে ‘যাক যাক’ বলে ফেলে দিতে হয় তাহলে আমার খুবই অসুবিধা। আমার বয়স যখন খুবই কম তখন মাঝে মধ্যে সকালে জামে মসজিদে ফজর নামাজের পরে যে গানটি গাইতে গাইতে নোয়াখালীর মতো একটি নিমশহরে অস্ফুট প্রভাতে ঘরে ফিরতাম সেটা ছিল, ‘দাঁড়াও আমার অাঁখির আগে, তোমার দৃষ্টি হূদয়ে লাগে।’ সুবেহসাদেক। আকাশ খানিক অন্ধকার, অতঃপর লালাভ হয়ে উঠছে চতুর্দিক। ভাবতাম আমার ‘অাঁখির আগে’ দাঁড়াবার জন্য আমি কাকে আবাহন করছি? কে দাঁড়াচ্ছে? সুবেহসাদেক থেকে শুরু করে যা ক্রমশ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে সেই অনির্বচনীয় মুহূর্তের সেই এক এবাদত, যার স্মৃতির সঙ্গে গোটা মাইজদীকোর্ট আমার বুকের মধ্যে আজও খচিত হয়ে আছে। অতএব ঠাকুরকে আর যাই হোক যাক যাক বলে ফেলে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। নতুন আর পুরাতনের ভেদরেখা টেনে একটিকে অন্যটির চেয়ে অধিক মূল্যায়নের যে ব্যাকরণ, রীতি, অভ্যাস বা দর্শন আমাদের চিন্তা অধিকার করে রাখে তাকে প্রত্যাখ্যান করবার শিক্ষা আমি সুবেহসাদেক থেকেই নিয়েছি। সেই ভাবের মধ্যে সন্ধিক্ষণ বা সংক্রান্তির আলোছায়া এমন এক আনন্দ নিয়ে হাজির হয় যে নিজের অজান্তে আমাদের ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে। ডাকি, ডাকতে থাকি ‘দাঁড়াও আমার অাঁখির আগে’। বহুদিন পর কমল মজুমদারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ পড়বার সময় প্রথম বাক্যেই পড়েছিলাম যে, ‘আলো ক্রমে আসিতেছে। এ নভোমন্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনর্বার আমরা প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। আলো ক্রমে আসিতেছে।…’। এটা শিহরণ হয়েছিল আমার।
বাঙালি সংস্কৃতির বয়ান তৈয়ার করবার তাগিদে বাংলা নববর্ষ পালন করবার পক্ষে মোঘলাই যুক্তির মূল কথা হচ্ছে সম্রাট আকবর বাংলা বছর চালু করেন সৌর বছর আশ্রয় করে। ঠিক। কিন্তু তিনি কাজটা করেছিলেন খাজনা আদায় করবার জন্য। জমির মালিকানা ও দখলদারির ওপর মোঘলাই শাসন কায়েম করবার দরকার। ওখানে মোঘলাই খাজনাদারি কিভাবে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি হয়ে উঠল সেটার ব্যাখ্যা খুব একটা পাওয়া যায় না। আমি সাহেবও নই, মোঘলও নই। কিন্তু সাহেবি বা মোঘলাই যুক্তি দেখিয়ে বাংলা নববর্ষ নামক একটি ব্যাপার চালু হয়ে যাবে আর তাকে আমাদের আবহমান বাঙালির সংস্কৃতি বলে মেনে নিতে হবে অতোটা উদার আমি হতে পারি না। নিজেকে নিয়ে আমার এই এক মুশকিল।
সবাই যখন বাংলা নববর্ষ বা বাঙালির (সাহেবি বা মুঘলিয়ানা) সংস্কৃতি নিয়ে মশুগুল তখন চৈত্রসংক্রান্তি পালন করবার পক্ষে ওকালতি করে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এইজ’ পত্রিকায়। সেই লেখা বাংলায় বিশদ করে এখানে হাজির করবার ধৈর্য আমার হবে না। উৎসাহী পাঠক একটু ঘাঁটলে খুশি হব :
http://www.newagebd.com/2006/apr/14/pb06/celebration.html/ সেখানে বাংলার ভাবান্দোলনের জায়গায় দাঁড়িয়ে যে দিকটার তাৎপর্য তুলে ধরে সকলকে সংক্রান্তি পালনের আহবান জানিয়েছিলাম সেটা হচ্ছে বাংলার ভাবে ‘সময়’ সংক্রান্ত ধারণা। এর কিছুটা ইশারা সন্ধিক্ষণ, সংক্রান্তি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মধ্যে পাঠক হয়তো ইতোমধ্যে খানিকটা টের পেয়েছেন। একই ভাব ধরবার জন্য আমি যখন আরবিতে ‘সুবেহসাদেক’ বলি তখন অনেকের উসখুশ লাগতে পারে। আমি ইংরেজ বা আরব নই, সংস্কৃত ভাষা আর বাংলা ভাষাও সমার্থক নয়। ধর্মসূত্রে ও মুঘল শাসনের কারণে আরব ও পারস্য সভ্যতার সঙ্গে আমাদের যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ঘটেছে তাকে আমরা রাবার দিয়ে মুছে ফেলতে পারি না। যেমন ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনকেও নয়। কিন্তু বাংলাকে অবশ্যই সংস্কৃত, আরবি, ফারসি বা ইংরেজি হলে চলবে না। ঠিক। কিন্তু সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ আহরণকে আমরা স্বাভাবিক গণ্য করি, এমনকি হরদম ইংরেজি ব্যবহারেও আমরা আপত্তি করি না। কিন্তু আরবি বা ফারসি থেকে শব্দ আহরণকে আমরা যখন কানা চোখে দেখি তখন তাকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? অন্য ভাষা ও ভাব আমার ভাষা ও ভাবের অন্তস্থ করবার শক্তি অর্জনের মধ্যেই আমি বাংলা ভাষা ও ভাবের বিকাশের সম্ভাবনা দেখি। বিশেষত যে সকল ভাষা ও ভাবের সঙ্গে ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় আমাদের যোগ ঘটেছে। জনগোষ্ঠী হিসাবে বিশ্বসভায় আমাদের দাঁড়াবার সম্ভাবনাও নির্ভর করবে এই হিম্মতটুকু দেখাবার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও ভাবের হজমি শক্তি প্রবল। পন্ডিত আর সাহেবে মিলে যে বাংলা গদ্য দাঁড় করিয়েছে তাকে ‘প্রমিত’ বা একমাত্র ‘বাংলা’জ্ঞান করবার কোনো যুক্তি নাই। রবীন্দ্রনাথও সেটা মানেনি। আমিও মানি না।
‘সময়’ সংক্রান্ত ধারণার যে দিকটা আমি বাংলার ভাবের জায়গায় দাঁড়াবার জন্য হারাতে চাই না সেটা হচ্ছে এই সময় যে একটা সরলরৈখিক ব্যাপার এই ধারণার আধিপত্য সম্পর্কে সাবধান হওয়া। বাংলার ভাবে বছর আর ঋতুর পার্থক্য প্রবল। এই ভাব মোতাবেক বছর ‘নতুন’ হয় না, বরং ফিরে ফিরে আসে। প্রত্যাবর্তন করে। একই ঋতুরই বারবার আবির্ভাব ঘটে। অতএব বছর শেষ আর শুরুর মুহূর্তকে একই কালের আবর্ত বলে বিচার করবার যে শিক্ষা আমরা পাই আমি তাকে ভুলে যেতে নারাজ। ‘নববর্ষ’ বা বছর নতুন ভাবে আসে এই ধারণার আধিপত্যের মধ্যে পড়েছি আমরা। এর মুশকিল হচ্ছে যা চলে গিয়েছে বা যা ‘পুরাতন’ হয়ে গিয়েছে তাকে আবর্জনা বা বর্জনীয় গণ্য করার মধ্যে। এর মধ্যে যে রাজনীতি নিহিত রয়েছে আমি সে সম্পর্কে সাবধান ও সতর্ক থাকতে চাই। নববর্ষ বা নতুন বছর পালন আমাকে সেই জন্য বিপদের মধ্যে ফেলে দেয়। অন্যে করলে করুক, সেখানে বাধা দেবার ফল কুফলই বয়ে আনবে, কিংবা যা ‘নতুন’ আর বিপরীতে ‘পুরাতন’-কে প্রতিষ্ঠাও আমার রাজনীতি নয়। নববর্ষ পালন আমি বছর বা ঋতুর এই ফিরে ফিরে আসার ভাবটা রক্ষা করতে আগ্রহী। আবর্তের বা প্রত্যাবর্তনের এই ধারণা আমাদের ভাবে, জ্ঞানে ও সংস্কৃতিতে এমন একটা স্থান দখল করে আছে যাকে হারাতে আমি নারাজ। এর একটা ভালো সুন্দর নামও আছে : সংক্রান্তি।
তাহলে একটিকে অন্যটির বিপরীতে বসিয়ে অন্যটির তুলনায় অধিক মূল্যায়নের যে নীতি, মানদন্ড, দর্শন বা ভাব আমরা তাকে পরিহার করতে চাইছি ঠিক, কিন্তু ভাব আর রাজনীতি তো এক কথা নয়। চৈত্রসংক্রান্তি পালন করার মধ্য দিয়ে মুঘল, ইংরেজ ও এই কালের সাম্রাজ্যবাদ আমাকে আমার ভাবগত অবস্থান থেকে টলিয়ে দেবার যে ধারা বজায় রাখছে তার বিরুদ্ধে তো দাঁড়ানো দরকার। চৈত্রসংক্রান্তি পালন করা না করা নিছকই ভাবের ব্যাপার মাত্র নয়, নিছকই সংস্কৃতি নয়। এটা রাজনীতি। আর যখনই আমরা রাজনীতির জায়গায় দাঁড়াই তখনই ভেদবিচার ছাড়া চলে না। যদি মোঘলাই, সাহেবি বা নব্য মধ্যবিত্তের সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাবগত বিকাশ ও রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে বিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে তাহলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাড়া পথ কই? তাছাড়া আরেকটি দিক আছে।
দুই.
বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন সংক্রান্তি, সূর্য এক রাশি থেকে আরেক রাশিতে যখন গমন করছে তখন প্রতি মাসেই তার একটা সংক্রান্তি ঘটে। সংক্রান্তি পালনের অর্থ তাহলে গ্রহ-নক্ষত্র ও বিশ্বনিখিলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটা ব্যাপারও বটে। যে গ্রহ বা নক্ষত্রের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগ নাই, যাদের অধিকাংশকেই আমি কখনোই দেখিনি বা দেখব না, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবার যে ভাব তার গুরুত্ব অপরিসীম। সেই দিক থেকে চৈত্র মাসের সংক্রান্তির ভাবই আবার আলাদা। সূর্যের শেষ দাবদাহ জ্বালিয়ে দিচ্ছে সব। কিন্তু বিদায় নিচ্ছে চৈত্র। আসছে বৈশাখ আর ওর সঙ্গে হাত ধরে মেঘ আর জল। জমিতে জো আসবে এখন, কৃষক নতুন আমন ধান লাগাবার জন্য তৈরি হবে। আর মেয়েদের কাজ? বিস্তর…।
সব কাজের সেরা কাজ হচ্ছে চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রকৃতির খোঁজখবর নেওয়া। কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যে দিকটা আমাকে দারুণ আকৃষ্ট করেছে সেটা হচ্ছে প্রকৃতির খোঁজখবর নেবার ধরন। যে কাজটা কৃষক মেয়েরা করে। কী করে সেটা করে তারা? বাংলার মেয়ে চৈত্রসংক্রান্তিতে শাক কুড়াতে বেরুবে। তাকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। ‘চৌদ্দ’ কথাটা আক্ষরিক অর্থে নিলে চলবে না। এর অর্থ যা পাওয়া সম্ভব, নানান ধরনের বিচিত্র সব শাক। আবাদি শাক নয় কিন্তু, অনাবাদী অর্থাৎ বনেজঙ্গলে আপনজালা শাক। ঘরের পাশে আলান পালান মাঠের আনচি কোণা কানচি থেকে তোলা শাক। বাংলার মেয়েকে সংক্রান্তি মুহূর্তে খবর নিতে হবে প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদী – যে অংশ কৃষি সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব – সেই অনাবাদী প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা। যে সব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদী জায়গায় কৃষক তাদের উঠতে দেয়নি, থাকতে দেয়নি, তারা সব কি ঠিকঠাক আছে? এখানে ‘কৃষি’ বললে কথাটি পরিষ্কার করা যায় না। বলতে হয় ‘চাষাবাদ’। ‘চাষ করা’ এবং ‘আবাদ করা’। কৃষক চাষ যখন করে তখন প্রকৃতির মধ্যে স্বাভাবিকভাবে বা প্রাকৃতিকভাবে যে শাক গাছপালা লতাগুল্ম বেড়ে ওঠে তাকে পরিষ্কার করে সেখানে যে জাত বা প্রজাতি কৃষক চাষ করতে চায় তারই বীজ বোনে। কিন্তু যে যা বা প্রজাতি সে মাঠে বাড়তে দিল না, তাদের কী হবে? ‘আবাদ’ করার অর্থ হচ্ছে কৃষকের এখন যা দরকার তা চাষ করবার জন্য যে প্রকৃতির যে অংশটা ব্যবহার করছে, অন্যদিকে প্রকৃতির অনাবাদী অংশে তাকে রক্ষা করতে হচ্ছে সেই সব জাত ও প্রজাতি যা আজ নয়, কিন্তু আগামী দিনে তার ও অন্যান্য প্রাণিকুলের প্রয়োজন হবে। প্রকৃতির ব্যবহার এই মুহূর্তের প্রয়োজন মেটাবে। কিন্তু প্রকৃতি আবাদি ও অনাবাদি দুটো দিককেই সমানভাবে প্রতিফলন করার মধ্য দিয়েই কৃষি সভ্যতা দাঁড়ায়। টিকে থাকে।
তাহলে চৈত্রসংক্রান্তিতে মেয়েদের চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। বাংলার মেয়ের ব্রত – পুরুষতান্ত্রিক ধর্মের সঙ্গে যার বিরোধ চিরকালের – সেই ব্রতের উপলক্ষ প্রকৃতি। স্রষ্টা নামক কোনো কর্তাসত্তা নয় – সৃষ্টির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা ও তার বিকাশ নিশ্চিত করাই তার কাজ। তার মানে পুরুষ কৃষক কৃষি কাজ করতে গিয়ে প্রকৃতির এমন কোনো ক্ষতি করল কিনা সেই খবর নেবার জন্য অনাবাদি শাকের খোঁজ পড়ে চৈত্রসংক্রান্তিতে। চৈত্রসংক্রান্তি সেই দিক থেকে অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রকৃতি, প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে বাংলার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি এখানে অঙ্গাঙ্গি হয়ে রয়েছে। যদি আমরা প্রাণে বেঁচে থাকতে চাই তাহলে এই সংস্কৃতির উপাসনাই আমাদের কাজ। এটাই এই কালে – পরিবেশ বিধ্বংসী সভ্যতার এই কলিকালে – আমাদের প্রধান কর্তব্য হয়ে উঠেছে। ‘বাঙালি’ বা ‘বাংলাদেশী’ হবার জন্য নয়, প্রকৃতির মধ্যে টিকে থাকার যে লড়াই – জীবের সে লড়াইয়ের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসবার জন্য আমাদের দরকার চৈত্রসংক্রান্তি। এই বিষয়ে আমি ‘ভাবান্দোলন’ বইতে ‘কৃষি, ভাব ও কাব্য’ নিবন্ধে আলোচনা করেছি। এখানে আর কথা বাড়াব না। নতুন একটি প্রসঙ্গে যাবো।
দেবের দেব মহাদেব কৃষির দেবতা কেন বাংলায় – এই প্রশ্ন আমার বহুদিনের। চৈত্রের শুরু থেকেই হরগৌরি সেজে গ্রামে গ্রামে গান, অভিনয়, ঢোল বাদ্যি ইত্যাদি এখনো রয়েছে। কেন শিবের এই ডাঁট আর তার পাশে পার্বতীর এই প্রতাপ এটা ভেবে ভেবে আমাদের অনেক দিন গেছে। কিন্তু শিক্ষাটা শেষাবধি গ্রামের কৃষক মেয়েদের কাছেই পেয়েছি। মহাদেবের পিন্দনে এখন যে বাঘছাল, আর হাতে ত্রিশূল – শিব বা মহাদেব আদিতে তা ছিলেন কিনা সন্দেহ। একবার দেখি গলায় নীল রঙ মেখে নীলকণ্ঠ সেজে মহাদেব পার্বতী পাশে নিয়ে গ্রামে ঘুরছেন প্রচন্ড চৈত্রে। আর হঠাৎ ধূপ ধূপ করে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মেয়েরা নীলকণ্ঠ মহাদেবকে প্রণাম আর সেলাম করছে। মেয়েদের শুধালাম শিব এতো প্রিয় কেন মেয়েদের? তাদের প্রথম উত্তর হচ্ছে শিব যেহেতু তার স্ত্রীর দাসত্ব করে অতএব আমরা মেয়েরা পার্বতীর হয়ে শিবের ভক্তি করি। এই উত্তরে খুশি না হওয়ায় প্রায় সব কৃষক মেয়ে উত্তর দিল, এই যে গলায় বিষ ধারণ করে আছেন মহাদেব তাকে দেখেন, নাগিনী বিষের জ্বালা শীতল করবার জন্য তার গলা পেঁচিয়ে আছে। শিব মহাদেব বটে, কিন্তু দেবতাও নন, অসুরও নন। তিনি আসলে মানুষ, তাই তিনি মহাদেব। তিনি মানুষ বলেই তাকে আমাদের ভক্তি। প্রশ্ন করলাম, এতো মানুষ থাকতে শিব কেন? উত্তর এলো অসুর আর দেবতা উভয়েই অমৃত চায়। তাদের সাধনা যে তারা ‘অমর’ হবে। কিন্তু শিব তো ‘অমর’ হবার সাধনা করে না, মানুষ হবার সাধনা করে। তাই সে পাগল, মাস্তান, উন্মাদ। সাগর মন্থন করে যখন বিষ উঠে এলো সেই বিষ দেবতা আর অসুররা কোথায় রাখবে ঠিক করতে পারছিল না। তখন তারা সেই বিষ খাইয়ে দিল শিবকে। এখন শিব দেখলেন তিনি যদি বিষ খেয়ে ফেলেন তো তিনি মরেন, আর যদি উগরে ফেলে দেন তাহলে সমস্ত জগৎ সংসার ধ্বংস হয়। সমস্ত প্রাণ ও পরিবেশের সর্বনাশ ঘটে। শিব তখন করলেন কি, তিনি বিষ রাখলেন তার কণ্ঠে। বিষে তার গলা নীল হয়ে গেল। বিষের জ্বালা নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন যেন প্রকৃতি বাঁচে, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, জীব অনুজীব প্রাণে রক্ষা পায়। এই যে নীলকণ্ঠ দেবের দেব মহাদেব তিনি ছাড়া ভক্তির পাত্র তো দেবতা হতে পারেন না।
যিনি জগৎ রক্ষা করেন ও জগৎ প্রতিপালন করেন। যিনি নিজে বিষ ধারণ করে জীবের প্রাণ রক্ষা করেন তিনি দর্শন দেন প্রতি বছর চৈত্রে। চৈত্রের সংক্রান্তিতে কৃষকের যে উৎসব, সেখানে তিনি পার্বতীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি বাড়ি যান। প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষার পাঠ মনে করিয়ে দেন, মানুষের কর্তব্য সম্পর্কে হুশিয়ার করে যান।
কে জানে হয়তো এই জন্যই ফকির লালন শাহ তার আগের প্রচলিত সমস্ত ‘গুরু’ সংক্রান্ত ধারণাকে নাকচ দিয়ে বললেন, ‘গুরু’ যিনি তাকে ধ্যানী শিবের মতোই প্রতিপালক জীবের প্রতিপালক হতে হবে :
কিঞ্চিত ধ্যান মহাদেব
সে তুলনা কী আর দেব
লালন বলে গুরু ভেব
যাবে রে মনের ধোঁকা
পাবে সামান্যে কি তার দেখা \
যদি চৈত্রসংক্রান্তি ভুলে যাই তো শিবকেও ভুলি। যদি শিবকে ভুলি, তাহলে ধ্যান ও প্রজ্ঞার অর্থও ভুলি। ভক্তি কথাটিরও কোনো অর্থ আর থাকে না। জগতে যদি ভক্তি না থাকে তাহলে বিষ রাখব কোথায়? জীবের বাঁচার উপায় কি হবে? জগৎ কি ছারে খারে যাবে?
ওই কালের রাজনীতি সেই পরওয়ারদিগারের রাজনীতি যিনি জগতের ‘প্রভু’ হবার বাসনা করেন না, কিন্তু হতে চান প্রতিপালক। রাববুল আলামীন। তাকেই আমরা দয়ার দয়া নামে ডাকি। বাংলায় রাহমানুর রাহিম কথাটির ভারি সুন্দর অনুবাদ হচ্ছে : ‘দয়াল’। সব কাজই সেই কারণে দয়ালের নামে শুরু করাই বাংলার সংস্কৃতি। হয়তো বাংলার বিধানও তাই।
‘দয়াল চাঁদ আসিয়ে আমায় পার করিবে
এমন সৌভাগ্য আমার কবে হবে’…

1 টি মন্তব্য: