বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১২


শুরুতেই বলে নিই- দেশপ্রেম নিয়ে সচরাচর আমরা যে কথাবার্তা বলি, তা প্রথমে বলি জনগণের দেশপ্রেম নিয়ে এবং তারপর বলি বিরোধী দলের দেশপ্রেম নিয়ে। সাধারণত সরকার বা সরকারি দলের দেশপ্রেম নিয়ে আমরা কথা বলি না, বরং তাদের দেশপ্রেম নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলি। কারণ আমরা নিশ্চিতভাবেই ধরে নিই বাংলাদেশের মতো একটি সাম্রাজ্যবাদ-সমপ্রসারণবাদ নিয়ন্ত্রিত নয়া ঔপনিবেশিক দেশের কোনো সরকারই এবং কোনো সরকারি দলই দেশপ্রেমিক হয় না। অন্তত স্বাধীন বাংলাদেশের চল্লিশ বছরের ক্ষমতার রাজনীতির বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এমনটি বলতে বাধ্য করে। অথচ বাস্তবে যেটি হওয়া উচিত সেটি হলো, বাংলাদেশের মতো শতকরা এক শ’ ভাগ পরনির্ভরশীল ও ভয়ানকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশে সাধারণ জনগণ ও বিরোধী দলের যতটা দেশপ্রেম থাকা জরুরি তার চেয়ে বেশি দেশপ্রেম থাকা জরুরি দেশ পরিচালনাকারী সরকার ও সরকারি দলের।

আর সরকার ও সরকারি দল বলতে তো ক্ষুদ্র কোনো অংশ বোঝায় না। সরকারের উপরিকাঠামোর (মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের) বাইরেও থাকে সরকারি দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী-সমর্থক, যারা জনগণেরই অংশ। তা ছাড়া তারা জনগণের শুধু অংশই নয়, বরং সাধারণ হিসাবে বলা যায় ‘সংখ্যাগুরু’ অংশ। কারণ সংখ্যাগুরুর ভোটেই তো সরকার নির্বাচিত হয়। আর এটি সব নির্বাচিত সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ কারণেই বলছিলাম, সাধারণ জনগণ ও বিরোধী দলের চেয়ে সরকার ও সরকারি দলের দেশপ্রেম থাকা সবচেয়ে বেশি জরুরি। বলা বাহুল্য, বাস্তব কাজকর্মে তার কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলেও যখনই যে দল বা জোট ক্ষমতায় যায় তারাই নিজেদের দাবি করে সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক বলে। সেই দেশপ্রেম নিয়েই আমাদের আজকের প্রথম পাঠ।

শুরু করব একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক ছোট্ট প্রতিবেদন দিয়ে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন পত্রিকার ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি মাহবুবুল হক। প্রতিবেদনের শিরোনাম হ"েছ- ‘হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচ থেকে বালু তুলছেন আ’লীগ নেতা’। খুবই গতানুগতিক খবর। সরকারি দলের লোকদের দিয়ে এ রকম ঘটনা সারা দেশে প্রতিদিনই ঘটছে এবং তা পত্রপত্রিকায় ছাপা হ"েছ। কিন' এই প্রতিবেদনের একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাবনার পাকশীর হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও মাটি কাটা হ"েছ। সেতুর পাকশী প্রান্তে পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা (সভাপতি) এনামুল হক ও তার লোকজন কয়েক মাস ধরে সেতুর সীমানার ভেতর থেকে বালু উত্তোলন ও মাটি কাটছেন। এতে সেতু ও সেতু রক্ষা বাঁধ হুমকির মধ্যে পড়েছে।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২)।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ‘পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা এনামুল হক ও তার লোকজন হার্ডিঞ্জ সেতু এলাকা ইজারা নিয়ে বালু ও মাটির ব্যবসায় করছেন। বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার কাজ তদারকি করেন পাকশী ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা তুহিন। তুহিন জানান, বালুর প্রকারভেদে প্রতি ট্রাক এক হাজার থেকে আট হাজার টাকায় বিক্রি হ"েছ। তিনি বলেন, সেতুর নিচ থেকে বালু উত্তোলন ও মাটি কাটা নিষিদ্ধ জেনেও তিনি নেতার নির্দেশে এই কাজ করছেন।’ (সূত্র : প্রাগুক্ত)।

খবর যতই গতানুগতিক হোক, এখানে কয়েকটি বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে :
এক নম্বর প্রশ্ন হলো : সেতুর নিচ থেকে শত শত অথবা হাজার হাজার ট্রাক বালু ও মাটি উত্তোলন করে নেয়ার ফলে যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আজ হুমকির মধ্যে পড়েছে এবং ঐতিহ্যবাহী যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আজ থেকে প্রায় দেড় শ’ বছর আগে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল, সেই হার্ডিঞ্জ সেতু আজ ২০১২ সালে নির্মাণ করতে হলে প্রয়োজন পড়বে কমপক্ষে পনেরো হাজার কোটি টাকা।

দুই নম্বর প্রশ্ন হলো : ঐতিহ্যবাহী হার্ডিঞ্জ সেতু তো বাংলাদেশের প্রধান নদী এককালের বিপুল জলরাশির প্রমত্তা পদ্মার ওপর অবসি'ত। সেই পদ্মার ওপর হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচে খনন করে হাজার হাজার ট্রাক বালু ও মাটি উত্তোলন করা কিভাবে সম্ভব হ"েছ? এটা কিন' খুবই বড় প্রশ্ন। স্বাধীনতার আগের বছরের কথাও যদি ধরা যায় তাহলে সে সময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মার তলা থেকে এক বেলচা বালু ও মাটি উত্তোলন করতে হলেও তার জন্য প্রয়োজন হতো ঝানু ডুবুরির। আর আজ? প্রমত্তা পদ্মার তলদেশ আজ শুকনো বালুচর। নদীর বুকের শুষ্ক বালুচর থেকে শত শত শ্রমিকের কোদাল-বেলচা দিয়ে উত্তোলিত বালু ও মাটি পরিবহনের জন্য অবাধে চলাচল করছে শত শত ট্রাক। প্রমত্তা পদ্মার গভীর তলদেশ আজ খাঁ খাঁ বালুচর। আর সেখানে এখন সরকারদলীয় ‘দেশপ্রেমিক’ লোকদের চলছে বাণিজ্যের রমরমা বাজার।

প্রমত্তা পদ্মার আজ এই দশা হলো কেমন করে সেটি যেমন আমরা সবাই জানি; তেমনি আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী মহাজোট সরকার ও সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও জানেন। কবি রবিঠাকুরের কাব্যচর্চা ও গানের প্রেরণা এককালের গ্রীষ্ম-বর্ষা উভয় ঋতুর বিপুল জলরাশির পদ্মা আজ ধু-ধু বালুচর। অতীতের খরস্রোতা পদ্মা আজ নিস্তেজ অজগরের মতো বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পড়ে আছে খাঁ খাঁ তৃষ্ণা বুকে নিয়ে। সীমান্তের ওপারে ফারাক্কা, তার উজানে শত শত মিনি ফারাক্কা আমাদের গলায় ফাঁস পরিয়ে দিয়েছে। ষোলো কোটি মানুষের ‘মারণফাঁদ’ ফারাক্কা-মিনি ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ সবুজ-শ্যামল অঞ্চল আধা-মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বিশাল জলরাশি পদ্মার বুকে বিশ্বকবির ‘সোনার তরী’র বদলে আজ শুষ্ক মওসুমে গরুর গাড়ি চলে। সেচের অভাবে লাখ লাখ একর জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। বন, মৎস্য, পশুসম্পদ ও পরিবেশ আজ ধ্বংসের মুখোমুখি।

উজানে ভারত সরকারের তৈরী ফারাক্কা বাঁধের কারণে আটত্রিশ বছর ধরে পদ্মার পানিপ্রবাহ ভয়াবহভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলো সমুদ্রের লোনাপানিতে সয়লাব হয়। লোনাপানির কারণে লাখ লাখ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়, মিঠাপানির মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হয়। ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সুন্দরবনের বনাঞ্চলের অনেক অংশ ইতোমধ্যে উজাড় হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে নিয়মিত খরা এবং দক্ষিণের বনাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হয়েছে। সীমান্তের ওপারে পদ্মার (গঙ্গার) ওপর ফারাক্কা এবং তার উজানে আরো শত শত ছোট-বড় বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের অস্তিত্ব আজ বিপন্নপ্রায়।

এবারে তিন নম্বর প্রশ্ন হলো : পদ্মা নদীর ওপর হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচে অথৈ পানির বদলে আজ যে খাঁ খাঁ শুষ্ক বালুর স্তূপ এবং সেই সাথে চার পাশে মরুকরণ ও ধ্বংসলীলার কারণ যে উজানে ভারত সরকারের তৈরী ফারাক্কা বাঁধ- এ খবর কি পাকশী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা জানেন না? কেউ বলবে হয়তো জেনেও জানেন না, বুঝেও বোঝেন না। কারণ ফারাক্কা তো তার জীবনে কোনো অভিশাপ নয়। ফারাক্কা তো তার জন্য কোনো মারণফাঁদ নয়। ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় পদ্মা শুকিয়ে যাওয়ার বদৌলতেই তো হার্ডিঞ্জ সেতুর নিচের বালুর খনি এখন তার দখলে। তার তো এখন স্বপ্ন শুধু টাকার। লাখ নয়, কোটি টাকার। হার্ডিঞ্জ সেতু ধ্বংস হোক তাতে তার কী? ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় দেশ মরুভূমি হয়ে যাক তাতে তার কী এসে যায়? তার দরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, আর দরকার ভারতের সাথে ‘বন্ধুত্ব’। আর এই হ"েছ আজকের সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দেশপ্রেম।
লেখক : প্রাবন্ধিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন