বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১২

বিএসএফের নতুন কৌশল ‘অপহরণ’


বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হত্যা-নির্যাতনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো যখন উদ্বেগ প্রকাশ করছে, ঠিক তখনি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হলো, সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন আগের তুলনায় আশ্চর্যজনকভাবে কমে এসেছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সীমান্তে বিএসএফের হত্যা, নির্যাতন কমে আসার বিষয়টি উল্লেখ করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
দু’দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত হত্যা-নির্যাতন কমে আসার দাবি করা হলেও বাস্তবে সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিকদের গুলি করে হত্যার পাশাপাশি নির্যাতনের ‘নতুন কৌশল’ হিসেবে যোগ হয়েছে অপহরণ। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সদস্যরা প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর চড়াও হচ্ছে এবং অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। অপহূত বাংলাদেশীদের সহজে আর ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পতাকা বৈঠক, চিঠি প্রদানেও কোনো কাজে আসছে না। কখনো কখনো দু’একজনের মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে ঘটনার দুই-একদিন পরে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশীদের ওপর একতরফাভাবে বিএসএফের হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতন প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে জারি থাকলেও, সম্প্রতি অপহরণের সংখা পৌঁছেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চলতি মাসের (ফেব্রুয়ারি-২০১১) প্রথম ২২ দিনে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত থেকে বিএসএফ ১৮ জন বাংলাদেশী নাগরিককে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এদের মধ্যে নির্যাতনের শিকার একজন কৌশলে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। ৫ জনকে দেওয়া হয়েছে ভারতের কারাগারে। নদীতে ভেসে লাশ এসেছে একজনের এবং অন্যদের কোনো খবর নেই।
এদিকে বাংলাদেশ-ভারত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন দিল্লি পৌঁছানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের প্রধান ইউকে বনশল দ্বিতীয়বারের মতো বলেছেন, সীমান্তে গুলি চলবে। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সীমান্তে গুলি চালানোর পক্ষে ফের তিনি যুক্তি তুলে ধরেন। এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও সীমান্তে গুলি চলবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। সীমান্তে বিনা উস্কানিতে বাংলাদেশীদের হত্যা, নির্যাতন এমনকি বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডকে পর্যন্ত অপহরণের ঘটনায় যখন খোদ ভারতীয় গণমাধ্যম সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিল, তখন বিএসএফ প্রধানের বক্তব্য সীমান্ত পরিস্থিতিকে আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। বিএসএফ সদস্যদের আগ্রাসী তৎপরতা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলায় বিএসএফ সাইফুল ইসলাম নামে এক বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। ভারতের শ্রীরামপুর সীমান্তের কাছে ভীমপুর ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাকে ধাওয়া করে ধরে নিয়ে যায়। এর পরদিন ৪ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার বৈকারি সীমান্তের বিপরীতে বিএসএফের খলিসা ক্যাম্পের সদস্যরা বাংলাদেশীদের লক্ষ্য করে ৭ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এরপর বিএসএফ ৫ বাংলাদেশীকে ধরে নিয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে সীমান্তে পতাকা বৈঠক হলেও পরবর্তীতে অপহূতদের বিষয়ে আর কিছুই জানা যায়নি। ৬ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলার গেন্দুকুড়ি সীমান্ত থেকে সাদেকুল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশী যুবককে অপহরণ করে নিয়ে যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। বাংলাদেশী যুবক ওই সীমান্তের ৮৯৮ নম্বর মেইন পিলারের কাছে ধানের জমিতে কাজ করছিল। অপহূতকে ফেরত চেয়ে বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার ভারতের কুচবিহার জেলার মিরাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প কমান্ডারকে পত্র দিলেও তারা কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
৮ ফেব্রুয়ারি চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বেনীপুর সীমান্ত থেকে ছয় বাংলাদেশীকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা। অপহরণের পর নির্যাতনের শিকার হাবিবুর রহমান ওরফে হারান নামে একজন কৌশলে পালিয়ে এলেও অন্য ৫ জন সেখানে রয়ে যায়। বিএসএফ সদস্যরা তাদের সীমান্ত থেকে জোরপূর্বক ধরে ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই পাঁচজনের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা নিয়ে পরিবারের সদস্যরা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। তবে সূত্র জানিয়েছে, বিএসএফ তাদের আদালতের মাধ্যমে সে দেশের জেলহাজতে পাঠিয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গা সীমান্ত থেকে বিএসএফ অপহরণ করে নিয়ে যায় এক বাংলাদেশী যুবককে। একই সপ্তাহে সেখান থেকে অপহূত হয় আরো এক বাংলাদেশী। এছাড়া গত ১৬ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ের ওই সীমান্ত থেকে বিএসএফ অপহরণ করে অপর এক বাংলাদেশীকে। এক মাসের মধ্যে এই সীমান্তে অপহরণ হওয়া তিন বাংলাদেশীর ভাগ্যে কি ঘটেছে তা এখনো জানা যায়নি।
২২ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সীমান্ত থেকে দুই বাংলাদেশী কিশোরকে অপহরণ করে ভারতের অভ্যন্তরে নিয়ে যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে অপহূত দুই বাংলাদেশী কিশোরকে ফেরত চাইলেও বিএসএফ তাদের ফেরত দেয়নি। অপহূত দুই কিশোর হলো- বেলাল (১৬) ও হাশেম (১৫)।
গত ১০ বছরে বিএসএফের হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়েছেন প্রায় এক হাজার বাংলাদেশী, অপহরণের শিকার হয়েছেন আরো এক হাজার, নিখোঁজ হয়েছেন দুই শতাধিক। সীমান্ত হত্যা বিষয়ে অধিকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিরস্ত্র নারী-পুরুষ, শিশুকে বিএসএফ হয় গুলি করে হত্যা করছে নতুবা নির্যাতন করে আহত করছে। এমনকি বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে কৃষিজমিতে কর্মরত কৃষকদেরও গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটাচ্ছে।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে বিএসএফের হাতে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। এরমধ্যে ২০০১ সালে ৯৪ জন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০৪ সালে ৭৬ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন ও ২০০৮ সালে ৬২ জন বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফের হাতে নিহত হয়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন ২০৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৯৮ জন, ২০১০ সালে ৭৪ জন এবং ১০১১ সালে ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীসহ ৩১ জন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিহত হয়েছে ৩ জন।
মঈনুল হক 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন