বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১২

এবার গঙ্গার পানি নিয়েও প্রশ্ন উঠালো ভারত

ম. ইনামুল হক • তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই যখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতা বাড়ছে তখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবার গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কথা তুললেন। কেন্দ্রকে লেখা এক পত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ফারাক্কা ব্যারেজের দুটি গেট ভেঙে গেছে যার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের দিকে চুক্তির অতিরিক্ত পানি চলে যাচ্ছে। মমতা একে মনুষ্যসৃষ্ট ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ শুধু ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে, কিন্তু পাচ্ছে ৮২ হাজার ৮০১ কিউসেক। এর ফলে ভাগিরথীতে পানি কমে গেছে। মমতা ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তদন্ত দাবি করলেন। মমতার দাবি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করে আসছিল। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের পাঠিয়ে বাংলাদেশ ভারতীয় কূটকৌশলের অংশ হয়ে যৌক্তিক কাজটি করেনি। তিস্তা চুক্তি না করেই ফারাক্কা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে মমতাকে ব্যবহার করে ভারত কর্তৃক আসলে তিস্তা চুক্তিকেই বহু দূরে ঠেলে ফেলা হলো। একে ভারতের কূটকৌশল হিসেবেই চিহ্নিত করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
শীতকালে ভাগিরথীর মুখ শুকিয়ে গেলে গঙ্গার পানি তো ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশেই আসতো, তাই গঙ্গার পানি তো বাংলাদেশেরই পানি। ভারত ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করে ওই পানি থেকে ৪০ হাজার কিউসেক পানি লিংক ক্যানাল দিয়ে ভাগিরথীতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এখন ভাগিরথীর মুখ ব্যারেজ দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে, নইলে ওই পানি প্রাকৃতিকভাবে আবার গঙ্গাতে বাংলাদেশের দিকেই ফিরে আসে। আবার ফারাক্কা থেকে বাংলাদেশের দিকে ছাড়া পানির একটা অংশ এখনো গঙ্গা নদীর শাখানদী আখেরীগঞ্জের ভৈরব এবং জলঙ্গীর মাথাভাঙ্গার মাধ্যমে আবার কলকাতা বন্দরের দিকে ফিরে যায়। শীতে এই দুটি নদীর মাধ্যমে ফিরে যাওয়া পানির পরিমাণ কম হলেও বর্ষার আগমনে এর পরিমাণ হয় অনেক বেশি।
মমতা বলছেন, ফারাক্কার ভাঙ্গা দুটি গেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ বেশি পানি পাচ্ছে। ফারাক্কা ব্যারেজে অন্য গেটগুলোও তো আছে, যাদের মোট সংখ্যা ১২৩। সেগুলো বন্ধ রাখলেই বা নিয়ন্ত্রণ করলেই তো পানি কমে যাবে। আসলে যত পানিই ছাড়া হোক না কেন, ফারাক্কা ব্যারেজের ভাটিতে, কলকাতামুখী লিংক ক্যানালের ভাটিতে ও বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে উভয় দেশের প্রতিনিধিরা যৌথভাবে পানিপ্রবাহ পরিমাপ করেন। তবে উজান থেকে যত পানিই আসুক ৪০ হাজার কিউসেকের বেশি পানি টানার ক্ষমতা লিংক ক্যানালের নেই বলে ভারত কোনো অবস্থাতেই তার বেশি পানি কলকাতা বন্দরের দিকে সরিয়ে নিতে পারে না। তাই গঙ্গার পানিপ্রবাহ কমে গেলে ভারতের চাহিদার পুরোটাই সরিয়ে নিয়ে চুক্তি অনুযায়ী বরং বাংলাদেশকেই কম পানি দেওয়া হয় বলেই বাংলাদেশের কাছে রেকর্ড আছে।
সুসম্পর্কসম্পন্ন প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে বিবেচ্য হবে উভয় দেশের জনগণের স্বার্থ। তিস্তার পানি চুক্তি, ফেনী নদীর চুক্তি, ছিটমহল বিনিময় কিংবা ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারে শুধু ভারত বা পশ্চিমবঙ্গের জনগণের স্বার্থই নয় বাংলাদেশের স্বার্থকেও প্রাধান্য দিতে হবে।
এ বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘মমতার শর্ত মেনে তিস্তা-জট খুলতে উদ্যোগী মনমোহন’ শীর্ষক একটি খবর প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র আপত্তিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল তিস্তা চুক্তি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইতোমধ্যে সে দেশের একজন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে তিস্তার পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন।
বাংলাদেশকে ২৫ শতাংশ তিস্তার পানি দেওয়ার সপক্ষে ভারতের সংবাদ মাধ্যমেই বলা হচ্ছে, গজলডোবায় যে ব্যারেজ আছে, সেখান থেকে ২৫ শতাংশ পানি দেওয়া হলেও নদীর ভাটিতে দোমোহনির কাছে এসে তা অন্যান্য উপনদী ও বৃষ্টির প্রবাহে ‘রিচার্জ’ হয়ে আরো ২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে।
ঐতিহাসিকভাবে, তিস্তার পানি আসে হিমালয়ের হিমবাহগুলো থেকে যার সঙ্গে যোগ দেয় এর গতিপথের ঝর্ণা ও উপনদীগুলোর প্রবাহ। এই প্রবাহ বসন্ত আসার সঙ্গে বাড়তে থাকে যখন তাপবৃদ্ধির কারণে তুষার ও হিমবাহগুলো গলতে শুরু করে। বর্ষার অতিবৃষ্টি (সারা সিকিমে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত ২৭৪০ মিলিমিটার) অনেক সময় ভাটির ডুয়ার্স সমতলে বন্যা সৃষ্টি করে। ভারতের পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র তিস্তার পানি প্রসঙ্গে লিখেছেন, দার্জিলিং কালিমপং সড়কের এন্ডারসন সেতুর তলায় এই প্রবাহ অনেক সময় ৯০ কিউমেকে (৩১৭৭ কিউসেক) নেমে আসে। এর ৪০ কিলোমিটার ভাটিতে শিলিগুড়ি মহকুমার সমতলে নির্মিত হয়েছে গজলডোবা ব্যারেজ। কল্যাণ রুদ্র বিগত ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতাতে বলেন, গজলডোবা ব্যারেজের কাছে তিস্তার ন্যূনতম প্রবাহ হলো ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার কিউসেক। গজলডোবার ২৫ কিলোমিটার ভাটিতে দোমোহনি রেল ও সড়ক সেতু, যার উজানে ডুয়ার্স অঞ্চলের ধরলা নদী এবং ভাটিতে তরাই অঞ্চলের কারলা নদী এসে মিশেছে। শীতে তিস্তা নদীতে এ দুটির যোগান ১০ কিউসেকের বেশি নয়। গজলডোবার ৬৫ কিলোমিটার ভাটিতে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের কাউনিয়া রেল সেতুর কাছে আমরা গড়ে ২০০ কিউসেক ন্যূনতম প্রবাহ পেয়েছি।
ভারত ১৯৮২ সালে গজলডোবার কাছে তিস্তা নদীর ওপর ব্যারেজ নির্মাণ করে ও ডাইভারশন খাল কেটে মহানন্দা নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। তাছাড়া উত্তরবঙ্গের কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ জেলার ৯.২২ লাখ হেক্টর জমিতে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ দেওয়ার জন্য ভারতের বিশাল পরিকল্পনা আছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে দোয়ানীর কাছে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করেছে যার আওতায় বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার ৬.৩২ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। বাংলাদেশে নির্মিত তিস্তা ব্যারেজের কাছে ঐতিহাসিকভাবে তিস্তা নদীর সর্বাধিক গড় প্রবাহ ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার কিউসেক এবং সর্বনিম্ন গড় প্রবাহ ছিল ১০ হাজার কিউসেক। এর উজানে ক্রমবৃদ্ধি হারে পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে বাংলাদেশে এর প্রবাহ এখন ১ হাজার কিউসেকে এসে দাঁড়িয়েছে, এমনকি খরার সময় তা ৫০০ কিউসেক হয়ে যায়।
কল্যাণ রুদ্র বিগত ৬ সেপ্টেম্বর বলেন, সিকিমে প্রস্তাবিত ২৩টি ‘Low Flow’ dams নির্মিত হলে পানি আরো কম পাওয়া যাবে। বাস্তবে ১৯৮২ সালে গজলডোবা ব্যারেজ চালু করার আগে থেকেই সেচের জন্য তিস্তা নদী থেকে পানি উত্তোলন করায় এবং সিকিমে নির্মিত পর্যটন ও জলবিদ্যুৎ জলাধারগুলোতে পানি আটকে রাখায় প্রবাহ কমতে থাকে। তিস্তা অববাহিকায় ৫টি নির্মিত, ৪টি নির্মীয়মান ও ৩১টি প্রস্তাবিত ড্যাম প্রকল্প আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গজলডোবা ব্যারেজের কাছে আসা ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার কিউসেক পানি কোথায় যাচ্ছে? কারণ ভাটিতে দোয়ানীর কাছে বাংলাদেশ মাত্র ১ হাজার থেকে ৪০০ কিউসেক পানি পাচ্ছে। এর উত্তর পেতে আমাদের মহানন্দা নদীপ্রবাহ দেখতে হবে। আমরা দেখব তিস্তার পানি এই নদী দিয়ে সরিয়ে ভারত নিয়ে যাচ্ছে বিহারের মেচী নদীতে, সেখান থেকে ফুলহার নদের মাধ্যমে ফারাক্কার উজানে। ভারত মেচী নদীতে একটি ব্যারেজ নির্মাণ করছে, যার ফলে উত্তরবঙ্গ ও বিহারে তার আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক
চেয়ারম্যান, দেশপ্রেমিক জনগণের মঞ্চ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন