মঙ্গলবার, ২০ মার্চ, ২০১২

'একটি বাড়ি একটি খামার-অর্ধেক তোমার অর্ধেক আমার'


দরিদ্রদের দিনবদলে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার 'একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি নেই। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের অধীন যে বরাদ্দ পাওয়া গেছে তা বিতরণ নিয়েও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। গ্রামের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীকে স্বনির্ভর করতে প্রকল্পটি নেওয়া হলেও সুফল পাচ্ছে না তারা। প্রকল্পের অর্থ চলে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের পকেটে। অনিয়মের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
'একটি বাড়ি একটি খামার_ অর্ধেক তোমার অর্ধেক আমার'_ প্রকল্পটি এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন বিশেষণও পেয়েছে। বরাদ্দ নিয়ে সরকারি দলের সংশ্লিষ্টদের ভাগাভাগি ও অনিয়মের কারণেই এখন প্রকল্পটি
নিয়ে এভাবে আলোচনা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের অধীন গ্রামে গ্রামে সমিতি গঠন করে দরিদ্রের মধ্যে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, খাসজমি, টিন ও ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কর্মসূচি ছিল। অভিযোগ উঠেছে, সরকারি দলের লোকজন দিয়ে এসব সমিতি গঠন করা হচ্ছে। প্রকল্পের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, খাসজমি, টিন সমিতির সদস্যরা বিক্রি করে দিচ্ছেন। এমনকি ক্ষুদ্রঋণ অন্য কাজে ব্যবহার হচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধে এ টাকা নির্বাচনী কাজে ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মিহির কান্তি মজুমদার জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনিয়মের কোনো অভিযোগ এখনও তাদের কাছে আসেনি। অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রকল্পে অর্থ সংকট রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংশোধিত এডিপিতে এ খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থ সংকটের ব্যাপারে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব ভূঁইয়া শফিকুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরের জন্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত এডিপির আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ ব্যাপক কাটছাঁটের পর বরাদ্দ বাড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন না তিনি। তবে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে অবশ্য প্রকল্পটি বিশেষ নজরে রয়েছে বলে জানান তিনি।
২০০৯ সালে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে প্রথমে ১ হাজার ১৯২ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। গত বছরের জুনে এতে ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত যোগ হয়। জানা গেছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) আর্থিক সংকটের কারণে চাহিদামতো বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদের ৬২ শতাংশ সময় চলে গেলেও প্রকল্পের অর্থ ব্যয় হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০৩ কোটি টাকা। প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটিতে চলতি অর্থবছরের জন্য ৩৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও এ পর্যন্ত অবমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১৭১ কোটি টাকা। মেয়াদ অনুযায়ী প্রকল্পটি আগামী বছর শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পটির আওতায় দেশের ১ হাজার ৯৩২ ইউনিয়নের ১৭ হাজার ৩৮৮টি গ্রামের মধ্যে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ পরিবারকে আনার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত এক-তৃতীয়াংশও এ সুবিধার আওতায় আসেনি। যারা এসেছে তাদের বেশিরভাগই বিত্তশালী বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিন প্রাপ্ত তথ্য
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমকাল প্রতিনিধিরা একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অবস্থা সরেজমিন ঘুরে যে তথ্য পেয়েছেন তা রীতিমতো ভয়াবহ। খুলনা জেলার ৯ উপজেলায় সচ্ছল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী লোক এ প্রকল্প থেকে সুবিধা পেয়েছেন। রূপসা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি সোহেল জুনায়েদ প্রকল্পের আওতায় ২০ হাজার টাকা মূল্যের একটি গাভী পেয়েছেন। রূপসা উপজেলার টিএস বাহিরদিয়া ইউপি সদস্য পলাশ হালদারও এ প্রকল্প থেকে একটি গাভী পেয়েছেন।
বটিয়াঘাটা উপজেলার ভাণ্ডারকোট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা ও ভাণ্ডারকোট ইউপি সদস্য মঞ্জু শেখও পেয়েছেন একটি করে গাভী। শুরুতে এলাকার গরিবদের নাম তালিকাভুক্ত হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়ে যায়।
সিলেটে সচ্ছল, বিত্তবান ও একই পরিবারের একাধিক সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করে নামমাত্র তালিকা তৈরি করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তালিকা প্রণয়নে অনেক উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলীয় নেতারা প্রভাব খাটিয়েছেন। এ ছাড়া নির্ধারিত মূল্যের কম দামে গরু, হাঁস-মুরগি কিনে সংশ্লিষ্টরা বাকি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন।
রাজশাহীতে প্রভাবশালী ও বিত্তশালীরা প্রকল্পের আওতায় পেয়েছেন গরু ও ঢেউটিন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ গরু বিক্রি করে ইউপি সদস্যপদে নির্বাচনও করেছেন। অন্যদিকে ভূমিহীনরা পেয়েছেন সবজি বীজ ও গাছের চারা। জমি না থাকায় এসব বীজ ও গাছের চারা তাদের কোনো কাজে আসেনি। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড ও কিসমতজামিরা গ্রামের বাসিন্দা রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে প্রভাবশালী আবদুস সালাম পেয়েছিলেন একটি গরু। গত ইউপি নির্বাচনে সে গরু বিক্রি করে ইউপি সদস্যপদে তিনি নির্বাচনে অংশ নেন। পুঠিয়া উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা আমাতুল হাকিম বলেন, বেলপুকুরের সালাম গরু বিক্রি করে নির্বাচন করেছেন বলে তিনিও শুনেছেন।
বাঘা উপজেলায়ও ধনীরা পেয়েছেন গরু আর দরিদ্ররা পেয়েছেন গাছের চারা। বাঘার কিশোরপুর গ্রাম সংগঠনের সভাপতি বুলবুল কিশোরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বেতনভুক্ত শিক্ষক হয়েও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প থেকে পেয়েছেন গরু। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের সদস্য মনিগ্রামের আনোয়ারা ও মিজানুর পেয়েছেন গাছের চারা।
পঞ্চগড় জেলায় এ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে মামলাও হয়েছে। জেলার ধাক্কামারা ইউপি চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমানুল্লাহ বাচ্চুর ছেলে, ভাই-ভাতিজাসহ একই পরিবারের ছয় সদস্যকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার গ্রামের আরও ছয় ধনাঢ্য ও দলীয় ব্যক্তিকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিত্তশালী ও প্রভাবশালীদের নাম অন্তর্ভুর্ক্তির অভিযোগ এনে পঞ্চগড় জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ আদালতে গত বছর মামলা করেন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রকল্পের জেলা কমিটির সদস্য আনসার আলী।
নওগাঁয় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এর সঙ্গে জড়িত জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই। সুবিধাভোগীদের তালিকা তৈরিতে সেখানেও অনিয়ম হয়েছে। এর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার রয়েছে। নীলফামারীতেও প্রকল্পটি ভেস্তে যেতে বসেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন