সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত কী করতে চায়?


ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে দেশের মানুষ খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। দেশের মানুষ বুঝতে পারছে না বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত কী করতে চায়? আওয়ামী লীগও দেশকে কোন পথে নিয়ে যেতে চায়? সীমানে- বাংলাদেশী (আওয়ামী লীগের জন্য বাঙালি) হত্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শুনেছি, মুজিবনগর সরকারের সাথে ভারতের যে গোপন চুক্তি হয়েছিল, তাতে ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। বাংলাদেশের বিদেশনীতিও ভারত দেখাশোনা করবে। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে এই গোপন চুক্তি বাস-বায়নে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি ভারতের অনুরোধকে প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধু লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধুর সাথে ভারতের সম্পর্ক কখনোই উষ্ণ হয়নি। একটি ঘটনা আমি নিজেই জানি। তা হলো- ভারত সরকারের প্রভাবশালী সচিব ডিপি ধর তখন কোনো ধরনের নিয়মনীতি ও প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে যখন-তখন ঢাকায় চলে আসতেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে। এতে বঙ্গবন্ধু বিরক্ত হতেন এবং বলতেন, কী রে তাজউদ্দিন, তোরা হিন্দুস-ানের সাথে কী চুক্তি করেছিস? ডিপি ধর কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঢাকায় চলে আসে। এই জ্বালা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীকে অনুরোধ করেছিলেন কিছু একটা করার জন্য। ওই সময় মওলানার হককথা বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে ভারতীয় আগ্রাসন থেকে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের কাছে ভারত সরকার বা ইন্দিরা গান্ধী বেহায়ার মতো তেমন কিছু করতে সাহস করেননি।

যে ভৌগোলিক এলাকায় আমার পূর্বপুরুষ জন্মেছিলেন, সেই এলাকার নাম এখন বাংলাদেশ। এর আগে এই ভৌগোলিক এলাকার বিভিন্ন নাম ছিল। শাসক ছিলেন নানা রাজা-মহারাজা ও নবাব-বাদশাহ। মাটির বয়স বিবেচনা করলে এই অঞ্চলের বয়স দশ হাজার বছরের কম নয়। যেখানে লাল মাটি আছে, তার বয়স আরো বেশি। ওয়ারিশান সূত্রে আমি এ দেশের মানুষ। রাজা-বাদশাহর আমলে ছিলাম অধিকারহীন প্রজা। অধিকার নিয়ে আমরা তেমন সজাগও ছিলাম না। মানুষ হিসেবে আমাদের অবস'ান ও মর্যাদা সম্পর্কে আমরা শুরুতে জানতে পারি বিভিন্ন ধর্মগ্রন', ঋষি, পয়গম্বর ও রাসূলদের কাছ থেকে। পীর আউলিয়া ও ধর্ম প্রচার করা দেশে দেশে গিয়ে মানুষকে তার জন্মগত মৌলিক মানবাধিকার সম্পর্কে সজাগ ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। কোনো শাসক তার নিজের প্রজাদের কখনোই অধিকারসচেতন করেননি। আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সজাগ ও উদ্বুদ্ধ করেন একশ্রেণীর মানবদরদী ও প্রেমী দেশী মানুষ। স্বাধীন চিন-াধারার কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকেরাও জনসাধারণকে নিজেদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সজাগ করে থাকেন। এভাবেই সমাজে জাগরণ এসেছে। রাজা, মহারাজা, বাদশাহ ও সম্রাটদের যুগ পেরিয়ে মানুষ গণতন্ত্রের যুগে এসেছে। মানুষ নিজের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজ রাষ্ট্রের ধারণা মানুষের ভেতর এসেছে। আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক সমাজের ধারণা শুরু হয়েছে ইংরেজ আমলে। এ দেশবাসী ইংরেজদের বিদায় করে নিজেদের রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস'া প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের জাগ্রত শ্রেণী কথা বলতে শুরু করে। সারা পৃথিবীতে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস'া ও গণতন্ত্রের সূচনা শুরু হয়। চীনে রাজব্যবস'া থেকে সরাসরি বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজব্যবস'ার পরিবর্তন ঘটেছে। সমাজতান্ত্রিক নতুন গণচীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের কারণে আমরা পশ্চিমা ধ্যানধারণা, গণতন্ত্র ও সরকারব্যবস'ার উত্তরাধিকার পেয়েছি। আমরা এখনো মনে করি, পশ্চিমা গণতন্ত্রই উচ্চতর। তা এখনো জারি আছে। আমাদের বাংলাদেশে সেই গণতন্ত্রই কার্যকর রয়েছে।

আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা ও দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। কিন' রাষ্ট্রগুলো নিজ নিজ নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসঙ্ঘও ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলোর সীমাহীন প্রভাবের কারণে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। জাতিসঙ্ঘ এখন অপ্রয়োজনীয় কথামালার ক্লাবে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলোর কারণে জাতিসঙ্ঘ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের কারণে বিশ্ব এককেন্দ্রিক বা একমাত্রিক হয়ে পড়েছে। ফলে আমেরিকা এখন সারা পৃথিবীকে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্ব অশান- হয়ে উঠেছে। টুইন টাওয়ার পতনের পর আমেরিকার মাথা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। যখন যেখানে ইচ্ছা ঢুকে পড়ছে, হামলা চালাচ্ছে। পাকিস-ান তার জ্বলন- উদাহরণ। এই পাকিস-ান ৬০ বছর ধরে আমেরিকার তাঁবেদারি করে আসছে। আমেরিকার কারণে আজ পাকিস-ানের অসি-ত্ব বিপন্ন। রাজনৈতিকভাবে পাকিস-ানের অবস'া এখন টালমাটাল। পাকিস-ানের বন্ধুত্বকে ত্যাগ করে আমেরিকা এখন ভারতের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। ভারতও এই হাতকে বুকে টেনে নিয়েছে। উভয়ের লক্ষ্য চীনকে মোকাবেলা করা।

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি জন্ম নিয়েছে রাগবিরাগ, অভিমান ও শেষ পর্যন- যুদ্ধ ও বহু ধ্বংসের মাধ্যমে। পূর্ব পাকিস-ানের বাঙালিরা কখনোই যুদ্ধ চায়নি। তবুও তাকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছে পাকিস্তানিদের কারণে। ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণ করে পাকিস-ানিরা ভুল করেছে। ’৪৭ সালে পূর্ববঙ্গ পাকিস-ানের সাথে ছিল শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে। নিখিল বঙ্গদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দিতে চাননি কংগ্রেস নেতারা। ফলে বাংলা দুই ভাগ হয়ে গেল। পশ্চিম বাংলার হিন্দুরাও শুধু ধর্মীয় কারণে দিল্লির অধীনে চলে গেল। মুসলমান বাঙালিদের সাথে পাকিস-ানের অবাঙালি মুসলমানদের শুরু থেকেই নানা কারণে বনিবনা হয়নি। হিন্দি ভারতবাসীর ভাষা না হওয়া সত্ত্বেও তারা এই ভাষাকে লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে মেনে নেয়। কিন' পূর্ব পাকিস-ানের বাঙালিরা উর্দুকে সার্বজনীন ভাষা বা লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে মেনে নিয়েছে। সারা ভারতে বহু জাতি আছে। ভাষাভিত্তিক বাঙালিরা সেখানে ৫ শতাংশের বেশি নয়। পূর্ব পাকিস-ানে বাঙালি মুসলমানেরা ছিল ৫৬ ভাগ; কিন' দেশটা চালাত অবাঙালি মুসলমানেরা। ফলে সব দিক থেকে বৈষম্য বেড়ে চলে উভয় অঞ্চলের মাঝে। আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস-ানিরা শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয়। ভারতের মতো বৈরী প্রতিবেশী ভারতের কথা চিন-া না করেই পাকিস্তানের সামরিক জান-া নিজ দেশের এক অঞ্চলের নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। ভারত বাঙালি মুসলমানদের বন্ধু হিসেবে আবির্ভূত হলো। পাকিস-ান ভেঙে গেল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। শুরু হলো বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বের টানাটানি। ভারত চায় বাংলাদেশের সাথে গভীর বন্ধুত্ব। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে ভারতের বাজারে পরিণত হলো। কিন' ভারত শুধু বাজারে সন'ষ্ট নয়। চায় বন্ধুত্বে একাকার হয়ে যেতে। ভারতের কথা একেবারেই সোজাসাফটা- ‘তোমরা চেয়েছিলে বাঙালি হতে। আমরা তোমাদের স্বাধীন করে দিয়েছি ষোলো আনা বাঙালি হতে। বাঙালিপনা বা বাঙ্গালিয়ানায় কোনো ধরনের ভেজাল বা খাদ থাকতে পারবে না। তোমাদের স্বাধীন করে দিয়েছি মুসলমান বা বাঙালি মুসলমান হওয়ার জন্য নয়। শুরু হলো বন্ধুত্বের মাঝে টানাপড়েন। ভারতের শাসকগোষ্ঠী চায়- আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে পরিবর্তন করে দিতে। আজ থেকে ৫০ বা ১০০ বছর পরে যেন বাংলাদেশের মানুষ বলে, আমাদের সীমান- বা সীমানার কোনো প্রয়োজন নেই। সিকিমের প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জি নিজের দেশের পার্লামেন্টে আইন পাস করিয়েছিলেন ভারতের সাথে সংযুক্তির জন্য। তাই সিকিম আজ ভারতের একটি রাজ্য। তবে সেখানে একটি সুবিধা ছিল- সিকিমের নাগরিকেরা ছিলেন সবাই হিন্দু। সংস্কৃতি ও ধর্ম, ইতিহাস-ঐতিহ্যগতভাবে সিকিমবাসী ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতিরই ধারক-বাহক। তাদের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে ধর্মীয় চেতনা বেশি কাজ করেছে। স্বাধীনতার তেমন দাম তাদের কাছে ছিল না। তাই লেন্দুপ দর্জি গণতান্ত্রিকভাবে ভোটাভুটি করেই স্বাধীনতা ত্যাগ করেছিলেন।

কিছু দিন ধরে ভারত প্রায় প্রতিদিনই সীমানে- বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। ফালানীর ঘটনা বাংলাদেশের সব মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছে। এই তো ক’দিন আগে বাংলাদেশী এক নাগরিককে ভারতের বিএসএফ পেটাতে পেটাতে উলঙ্গ করে ফেলে। সারা পৃথিবীর মানুষ ওই অত্যাচারের দৃশ্য টিভিতে দেখেছে। ভারতের মানবাধিকার সংস'াগুলো বিএসএফের এই কর্মকাণ্ডের নিন্দা করেছে। বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো ভারতের আগ্রাসী নীতির নিন্দা জানিয়েছে। কিন' বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, সীমানে-র ঘটনা নিয়ে চিনি-ত হওয়ার কিছু নেই। এ রকম অতীতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে, আগামীতেও হবে। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বলেছেন, মিডিয়া ঘটনাটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। বিএসএফের মুখপাত্র বলেছেন, সবক দেয়ার জন্যই ওই বাংলাদেশীর ওপর একটু বল প্রয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশী হাবিলদারকে ধরে নিয়ে অত্যাচার করার ব্যাপারে এখনো ক্ষমা চাওয়া হয়নি। ভারতীয় দূতাবাস বলেছে, সীমানে- যাদের ওপর অ্যাকশন নেয়া হয়, তারা সবাই ক্রিমিনাল। দিল্লি বলেছে, ঘটনাটা বড় নয়, কিন' কারা ছবি তুলে প্রচার করেছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে পাকিস্তানের আইএসআই ও বাংলাদেশের ধর্মীয় দলগুলোর হাত রয়েছে।

ইতোমধ্যে রাজনীতির মাঠে নতুন এক মাত্রা যোগ হয়েছে। সেই মাত্রা হলো- কথিত সেনা অভ্যুত্থানের খবর। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে বা দেশবাসীকে বলা হয়েছে, অভ্যুত্থান করার ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করা হয়েছে। রাজধানীতে শক্তিশালী গুজব বিরাজ করছে যে, অনেক সেনা অফিসারকে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। পত্রপত্রিকায়ও গ্রেফতারের খবর ছাপা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ধর্মান্ধ কিছু অফিসার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। কলকাতার দক্ষিণপন'ী রক্ষণশীল সামপ্রদায়িক আনন্দবাজার পত্রিকার জয়ন- ঘোষাল বলেছেন, মৌলবাদীরা হাসিনা সরকারকে আঘাত করেছে। ঘোষাল বাবু পাকিস-ানের সেনাবাহিনীর কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস-ানপন'ী মৌলবাদীরা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা গণতান্ত্রিক সেকুলার উন্নয়নমুখী বাংলাদেশের অগ্রগতিকে রুখে দিতে চায়। ঘোষাল বাবুর লেখাটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসি'তি সম্পর্কে তার মনগড়া একটি ব্যাখ্যা। ভারত সরকার বলেছে, সব ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে তারা হাসিনার পাশে থাকবে। এসব হচ্ছে কূটনৈতিক ভব্যতা ও সংস্কৃতি। বন্ধুত্ব দেখানোর জন্য বলতে হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকারের পতনের পর খোন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বাণী পাঠিয়েছিলেন। শ্রীমতি গান্ধী বলেছিলেন, তারা বাংলাদেশে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার দেখতে চান। বঙ্গবন্ধুর সরকারের সাথে ভারত সরকারের সম্পর্ক খুব উষ্ণ ছিল বলা যাবে না। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, তিনি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান। তাই অনেকেই মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর সরকারের পতনের পেছনে ভারতের হাত ছিল। জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করলে ভারত তাকে অভিনন্দিত করেছিল। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি দিল্লির সাথে আলাপ করেই ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। কলকাতার আনন্দবাজার গ্রুপের ম্যাগাজিন দেশ-এর মন-ব্য ছিল- বন্দুকের নলে প্রজাপতি। ঢাকার বাংলার বাণী বলেছিল, একটি গুলিও ফোটেনি। জিয়া ও খালেদা জিয়ার সরকারগুলোর সাথেও ভারতের সম্পর্ক খারাপ ছিল বলা যাবে না। তবে কখনোই উষ্ণ ছিল না। হাসিনার সরকারকে ভারত সব সময় হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছে। বিপদের সময় দিল্লি হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বহু বছর দেখাশোনা করেছে। দিল্লির প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের মানুষ অবাক হয়নি। হাসিনার সাথে দিল্লির ব্যক্তিগত সম্পর্ক মধুর- এটা সবাই জানেন। দিল্লির একজন মন্ত্রী তো বলেই ফেলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের এত মধুর সম্পর্ক এর আগে কখনোই ছিল না। একজন তো আবেগের তাড়নায় বলেই ফেলেছেন, বিগত এক শ’ বছরেও ভারতের সাথে বাংলাদেশের এত ভালো সম্পর্ক ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি, ভারত বাংলাদেশে যুগের পর যুগ আওয়ামী লীগকে (বঙ্গবন্ধুর বংশধরদের) ক্ষমতায় দেখতে চায়। যেমন নেহরুর পরিবার থেকে ভারত মুক্তি পাচ্ছে না। লোকে বলে নেহরু পরিবার ও কংগ্রেসের সাথে শেখ হাসিনার প্রায় আত্মীয়তার সম্পর্ক। তাই ভারতের স্বার্থ আর হাসিনার স্বার্থ প্রায় একই।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, বিডিআর ও সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা আর কথিত ক্যু একই সূত্রে গ্রথিত। একই উদ্দেশ্যে ঘটানো হয়েছে। বিডিআরে ৫০-এর বেশি সেনা অফিসারকে হত্যা, আর এবারে ক্যুর অভিযোগ এনে বেশ কিছু অফিসারকে ধ্বংস করার নীলনকশা একই লক্ষ্যে পরিচালিত। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে মানসিকভাবে পরাভূত করে রাখা। একাত্তরে ভারত মুজিবনগর সরকারকে অনুরোধ করেছিল, সেনাবাহিনী গঠন না করার জন্য। সমপ্রতি আমরা লক্ষ করছি, ভারতের হেরিটেজ ফাউন্ডেশন গবেষণা করছে, কিভাবে ইতিহাসের ভুলগুলোকে শোধরানো বা মেরামত করা যায়। তাই সেখানকার গবেষকেরা বলছেন, ’৪৭ সালে ভারত বিভাগ ভুল ছিল। ভাগের জন্য এরা দায়ী করেছে গান্ধী, নেহরু ও প্যাটেলকে। তারা বলছে, জিন্নাহ ভারত ভাগ চাননি। এই ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য অখণ্ড বা নিখিল ভারত প্রতিষ্ঠা করা। হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পক্ষে বাংলাদেশ ও পাকিস-ানে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী কাজ করছেন বলে জানা গেছে। ফাউন্ডেশনকে অর্থ জোগান দিচ্ছে আমেরিকা ও ব্রিটেনের বেশ কিছু থিঙ্কট্যাঙ্ক।

শেখ হাসিনার এবারে ক্ষমতায় আসার পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তথাকথিত নির্বাচন দেয়ার আগে সেনাবাহিনী প্রধানকে দিয়ে এক-এগারোর সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে সরকার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। গ্রামগঞ্জের হাটবাজারকে তছনছ করে দিয়েছে। বহু রাজনীতিক ও শিল্পপতিকে দেশছাড়া করেছে। সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ নিজেকে ফোর স্টার জেনারেল পদে নিয়োগ দিলেন এবং নিজেকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় আসীন করে ভারত সফরে গিয়ে ছয়টি ঘোড়া এনেছিলেন। এক-এগারোর সরকারটি প্রতিষ্ঠা করেছিল ইইউ, ভারত ও বৃটেন। সেই সরকারের আদর্শ-উদ্দেশ্য নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ ভারত সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস-বায়ন করে চলেছে। ভারত বহুবার বলেছে, তারা বাংলাদেশে ধর্মমুক্ত সেক্যুলার সরকার চায়। দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে আমেরিকা ও ভারতের লক্ষ্য বাস-বায়নে সরকার কাজ করছে। ভারত ও আমেরিকা মনে করে সন্ত্রাস হচ্ছে ইসলাম। ২০০৮ সালেই ফরহাদ মজহার লিখেছিলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ইসলামমুক্ত করার জন্য বিদেশীরা কর্মসূচি নিয়েছে। বেশ কিছু দিন আগে বৃটেন এ দেশের মাদরাসাগুলোর ওপর এক জরিপ চালিয়ে তাদের নিজেদের মনমতো প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় কিছু দিন আগে নিবন্ধ লিখে বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মাদরাসার ছাত্র রিক্রুট করা হচ্ছে।

সেনাবাহিনী কয়েক দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, কিছু ধর্মান্ধ সেনা অফিসার ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে। তাদের সেই চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে। এই ব্যর্থ চেষ্টার সাথে ১৫-১৬ জন অফিসার জড়িত। সেনাবাহিনী যা বলেছে, তা হয়তো সত্য; কিন' দেশবাসীর কাছে বিষয়টি স্পষ্ট নয় চলমান সময় ও রাজনীতির কারণে। তবে দেশবাসী বুঝতে পারছে, বাংলাদেশকে ইসলামমুক্ত করার জন্য আওয়ামী লীগ, ভারত, আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস দিল্লির বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বলেছে, সেনাবাহিনী থেকে কিছু ধর্মপ্রাণ অফিসারকে বাদ দেয়ার জন্যই এই সেনা অভ্যুত্থানের খবর প্রচার করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য হচ্ছে আগামী নির্বাচন। ভারত শেখ হাসিনাকে আবারো ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চায়। তাই সরকারবিরোধী সব দলকে কথিত অভ্যুত্থানের সাথে জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এরশাদ মজুমদার
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন