বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

ওবামা লিবিয়ায় কেন ১২ হাজার মার্কিন সৈন্য পাঠাচ্ছেন?

 
বিদেশী প্রচার মাধ্যম এবং লিবীয় মিত্রদের থেকে জানা গেছে যে,  প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মাল্টায় ১২ হাজার মার্কিন সৈন্য পাঠিয়েছেন এবং তারা সেখান থেকে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। বিষয়টি অত্যন্ত পরিতাপের ও দুশ্চিন্তার।

যারা লিবিয়ার ঘটনাবলী সম্পর্কে যথাযথভাবে ওয়াকিবহাল নন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলা যায়, ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের শাসনের বিরুদ্ধে সেখানকার বর্তমান প্রতিরোধ আন্দোলন কিন্তু খুবই শক্তিশালী। ফিলিস্তিনে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের দেওয়া প্রস্তাবের আগে মাহমুদ আববাসের কিংবা আফগানিস্তানের জন্য রাজকীয় দর্শনের নিমিত্তে রাজনৈতিকভাবে স্ত্রৈন হামিদ কারজাই, বা বলা চলে আট বছর পরে এসে জর্জ ডব্লিউ বুশের যতটা জনপ্রিয়তা ছিল লিবিয়ায় ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এনটিসি) নেতৃবৃন্দের বর্তমান জনপ্রিয়তাও অনেকটা সেরকমই। এনটিসি যে কেবল দুর্ধর্ষ, আর্থিকভাবে শক্তিশালী, তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থকদেরই বিরোধিতা মোকাবিলা করছে তাই নয় খোদ এনটিসির ভেতরেই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখা দিয়েছে। লিবীয় সমাজের এখন যে বিরোধপূর্ণ অবস্থা সে ধরনের অবস্থা এর আগে ইরাক এবং আফগানিস্তানেও প্রত্যক্ষ করা গেছে। খুব পরিকল্পিতভাবেই এসব বিরোধের জন্ম দেওয়া হয়, যাতে এরকম একটি দেশের সমাজ ভেঙেচুরে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সেটি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ সংরক্ষণে কাজে লাগে। এমনি একটি পরিস্থিতি থেকে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের দালালরাও লাভবান হয়। এরা সম্মিলিতভাবে আরবি ভাষাভাষী মানুষের ওপর ইসরাইলের আধিপত্যবাদী কর্তৃত্ব চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে। পাকিস্তানকে মুসলিম এবং বিশ্বের অন্যান্য বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এর অজনপ্রিয় বেসামরিক নেতৃত্ব দেশটির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এরা যুক্তরাষ্ট্রের পকেটে গিয়ে আশ্রয় নেয় এবং অর্থ দেওয়োর বিনিময়ে মাঝে মাঝে তাদের অর্থ প্রদানকারী যুক্তরাষ্ট্র ধমকাধমকি করতেও ছাড়ে না।

আরব বসন্ত শুরু হয়ে গেছে। তবে এসব আন্দোলনে বিদেশীদের অর্থ ঢালার যেসব ক্ষতিকর চিহ্ন রয়ে গেছে সেগুলো একেবারেই মুছে ফেলতে হবে। তা না হলে আন্দোলনকারী আরবরা নিজেরা নিজেদের শাসন করার সুযোগ হারাবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো বিদেশীদের মদদপুষ্ট এ জাতীয় সংগঠন বিশ্বের সব দেশেই সক্রিয় রয়েছে। সব দেশে সব কালেই এরা হুমকি হিসেবে বিরাজমান। এরা যেন অনেকটা নিষ্ক্রিয় বোমার মতো পড়ে আছে, কেবল কেউ একজন হাতে নিয়ে সক্রিয় করে দিলেই বিস্ফোরণের আকারে ছাড়িয়ে পড়বে। দানিয়েল ওর্তেগা এবং হুগো শেভেজ  চাইলে তাদের দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের নামে ঘাপটি মেরে থাকা এসব সংগঠনকে নিয়ে বিরাট আকারের পুস্তিকা রচনা করতে পারেন।

অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায়, যারা এ জাতীয় সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে থাকে তাদের মাথায় একটি পরিকল্পনা থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে তারা তাদের নিজেদের লাভটি উঠিয়ে নেয়। এসব বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির চিত্রনাট্য যারা রচনা করেন তারা নিউ আমেরিকান সেনচুরি প্রকল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক জানিয়েছেন, পাঁচ বছরের মধ্যে বিশ্বের সাতটি দেশ দখল করে নিয়ে সেসব দেশের সরকারগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়ার চিত্রনাট্যগুলো কীভাবে রচিত হয়েছিল সেসব কাহিনী। দেশগুলো হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান এবং ইরান। ক্লার্ক বলেন, এই পরিকল্পনাকারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিলেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াটিকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিজেদের হাতে নিয়ে নেন। এরা হচ্ছেন উলফুভিজ, চেনি, রামসফেল্ড। তাদের সহযোগী ছিল নিউ আমেরিকান সেনচুরি প্রকল্পের কর্তা ব্যক্তিরা। তারা মধ্যপ্রাচ্যকে আশান্ত করে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিল। ক্লার্ক বলেন, রিচার্ড পার্লে, বিলি ক্রিস্টলের মতো ব্যক্তিরা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে ইরাককে ধ্বংস করে দেয়। তবে সিরয়ায় হাত দেওয়ার সময়টি তারা পায়নি। মধ্যপ্রাচ্যের অশান্তির মূলে রয়েছে ওই অঞ্চলের জন্য নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত পরিকল্পনাসমূহ। যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন এই অঞ্চলে মারা পড়ছে কেন? ক্লার্ক বলেন, এটিই হচ্ছে আসল প্রশ্ন।

লিবিয়া থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, মিসরাতা বিদ্রোহীরা (ন্যাটোর সহযোগী বাহিনী এরাই মোতাসীম গাদ্দাফিসহ বহু লিবীয়কে হত্যা করেছে) এখন নিজেরাই পেট্রোলিয়াম শিল্পের দখল নিতে গিয়ে তাদেরই মিত্র ন্যাটো বাহিনীর এপেক হেলিকপ্টারের গুলিতে নিহত হচ্ছে। সাংবাদিকে রূপান্তরিত হওয়া এক লিবীয় চিকিৎসক জানিয়েছেন, লিবিয়ায়  অধিকাংশ পেট্রোলিয়াম স্থাপনাই এখন ন্যাটো বাহিনীর দখলে। যুদ্ধজাহাজগুলো লিবিয়ার বন্দরগুলোও দখল করে নিয়েছে। ছবি দেখে বোঝা যায়, মরুভূমির মধ্যে স্থাপিত ইতালিয়াদের একটি তাঁবুর গায়ে লেখা আছে, ‘ফরাসিদেরও একই কাজ করা উচিত’। আরেকটি খবর থেকে জানা গেছে, লিবিয়ার তেল উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে এখন কাতার ও আরব আমিরাতের প্রকৌশলীরা কাজ করছে এবং তারা প্রতিবাদী লিবীয় শ্রমিকদের সেসব স্থান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। লিবিয়ায় গাড়ি চালকগন জ্বালানির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও বিদেশীরা দেশটি থেকে অবলীলায় তেল রফতানি করছে। লিবীয়রা প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রীর অভাবে ভুগছে। দেশটির পা এখন মাথার দিকে এবং মাথা পায়ের দিকে চলে এসেছে। ইউরেনিয়ামের বিষাক্ততা চারদিকে ছাড়িয়ে পড়ছে। কত লোক যে মারা যাচ্ছে তার সঠিক কোনো হিসাবও নেই। জামহুরিয়ার সমর্থক হাজার হাজার তরুণ লিবীয় মিসরাতা কারাগারে নির্যাতন কিংবা হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। যে কোনো সময় ওই স্থানে সংঘটিত মানবিক মহাবিপর্যয়ের ঘটনা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। কারণ মিসরাতা বিদ্রোহীরা সেখানকার সব মানুষকেই মেরে ফেলতে চাচ্ছে। এই উদ্দেশ্যে তারা কয়েকবার প্রচেষ্টাও চালিয়েছিল। সেখানকার বন্দিদের জীবন রক্ষার জন্য ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক রেডক্রস সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, কৃষ্ণকায় লিবীয়রাই ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনীর সহযোগীদের হামলায় লক্ষ্যবস্ত্ততে পরিণত হচ্ছে। মৃত আফগানদের শরীরের ওপর মূত্রত্যাগ করে মার্কিন সৈন্যরা ঘৃণার জন্ম দিয়েছে এবং এ ধরনের কাজ যে খুব অবলীলায়ই করা যায় সে শিক্ষাটাও প্রচার করেছে তারা। প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, লিবিয়াতেও কৃষ্ণকায় লিবীয়দের শারীরিকভাবে নির্যাতন ও নাজেহাল করা হচ্ছে। ভয় দেখানো হচ্ছে, চাবুক দিয়ে চাবকানো হচ্ছে এবং বিভিন্ন ধরনের অপমানজনক আচরণ করা হচ্ছে তদের সঙ্গে। এসব দৃশ্য গৃহযুদ্ধের পূর্বকালীন সময়ের দাস প্রথা এবং একই সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সুতরাং যখন প্রশ্ন করা হয় যে মার্কিন সৈন্যরা অবতরণ করেছে তখন তারা কী উদ্দেশ্যে সেখানে যাচ্ছে সেটিও চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে। এটা নিশ্চিত যে, তাদের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এই পৃথিবীর বুকেই নির্মিত নরকের দিকে তারা এগুচ্ছে। শুধু প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একা নন, এই নরক নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দও জড়িত, যারা লিবীয় সমাজকে ধ্বংস করে দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেছে, এই কাজে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে এবং নিজেরাও তাতে অংশগ্রহণ করেছে। লিবিয়া থেকে প্রাপ্ত অন্য আরেকটি খবরে জানা গেছে, সেখানকার একজন মিলিশিয়া অন্য আরেকজন মিলিশিয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য বিদেশী সৈন্যদের ডেকে আনছে। এটা বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, ১২ জানুয়ারি ২০১২ থেকে যেসব সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো সঠিক নয়। বিশ্বাস করতে হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিবিয়ার উদ্দেশ্যে ১২ হাজার দখলদার মার্কিন সেনাকে মাল্টায় পাঠাননি। লুসি গ্রিডার ব্রাডলি লিবীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ একজন প্রতিনিধির করা মন্তব্যের কথা জানিয়েছেন। তিউনিস-লিবিয়া সীমান্তে ওই প্রতিনিধি বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই নাকি তার কাছে বলছেন, ‘আমেরিকানদের আগে আসতে দিন। আমরা চাই তারা এসে আমাদের স্যান্ডউইচের স্বাদ নিক। ভিয়েতনামে যে ধরনের আতিথেয়তা তারা পেয়েছিল আমরাও তাদের এখানে সেভাবেই আতিথ্য প্রদান করব।
সিনথিয়া ম্যাককিনি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন